একবার গোরান ইভানিসেভিচ বলেছিলেন, প্রতিটি টেনিস খেলায় নিজের মধ্যে তিনটি চরিত্র ধারণ করেন তিনি। সেগুলো হলো ভালো গোরান, খারাপ গোরান এবং পাগল গোরান। কিন্তু তারা তিনজনই ছিলো দুর্দান্ত সার্ভার। টেনিস জগতের অন্যতম এক প্রতিভাবান খেলোয়াড় এই গোরান ইভানিসেভিচ। তবে ক্যারিয়ারের শুরুতে টেনিস কোর্টে তার কথামতো তিনি পরিচিতি লাভ করেন দুটি কারণে। একটি কোর্টে সহজেই মেজাজ হারানো, অন্যটি অসাধারণ সব সার্ভের জন্যে। তবে টেনিস ইতিহাসে তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে ওয়াইল্ড কার্ড নিয়ে খেলতে এসে উম্বলডন গ্র্যান্ড স্লাম জেতার জন্য।
গোরান ইভানিসেভিচের জন্ম ১৯৭১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর। ক্রোয়েশিয়ার স্পলিট শহরে তার বেড়ে ওঠা এবং সেখানেই টেনিসের হাতেখড়ি। মাত্র ৭ বছর বয়স থেকেই টেনিস খেলা শুরু করেন গোরান। ১০ বছর পর ১৯৮৮ সালে ১৭ বছর বয়সে তিনি পেশাদার টেনিস খেলোয়াড় বনে যান। সেই বছর ইভানিসেভিচের র্যাঙ্কিং দাঁড়ায় ৩৫১-তে। কিন্তু নিজের চেষ্টা এবং প্রতিভা দ্বারা মাত্র দুই বছরের মধ্যে সেই র্যাঙ্কিং উন্নীত করেন নয়ে। তবে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন ১৯৯০ সালের ফ্রেঞ্চ ওপেনে প্রথম রাউন্ডেই কিংবদন্তী বরিস বেকারকে হারিয়ে।
১৯৯০ সালের সেই সুখস্মৃতির পরবর্তী ৮টি বছর ইভানিসেভিচের কাটে আক্ষেপের মধ্য দিয়ে। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৮ এর মাঝে গোরান খেলেন তিনটি উম্বলডন ফাইনাল। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, জিততে পারেননি একটিতেও।
১৯৯২ সালে ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো উম্বলডন ফাইনালে ওঠেন এই ক্রোয়েশিয়ান। প্রথমবারেই তাকে মোকাবেলা করতে হয় আরেক টেনিস কিংবদন্তী আন্দ্রে আগাসিকে। সেবার কাছাকাছি গিয়েও আগাসির অসামান্য দক্ষতার কারণে ৩-২ সেটে ম্যাচটি হেরে যান ২১ বছর বয়সী গোরান।
দুই বছর পর ১৯৯৪ সালে দ্বিতীয়বারের মতো সুযোগ আসে উম্বলডন জেতার। কিন্তু সেবার ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন পিট সাম্প্রাসের কাছে সরাসরি সেটে হেরে ট্রফি উঁচিয়ে ধরার আশা জলাঞ্জলি দেন গোরান। তবে টানা অসাধারণ পারফর্মেন্সের জন্য পরের বছরই নিজের ক্যারিয়ার সেরা র্যাঙ্কিং দুইয়ে উন্নীত হন তিনি। পিট সাম্প্রাসের কাছে হারার চার বছর পর ১৯৯৮ সালে তৃতীয়বারের মতো সুযোগ আসে গোরানের কাছে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, তৃতীয়বারের মাথায়ও হেরে যান এই ক্রোয়েশিয়ান। তবে সবচেয়ে কাছাকাছি এসেছিলেন এবারই। কিন্তু শেষপর্যন্ত দ্বিতীয়বারের মতো পিট সাম্প্রাসের কাছে ধরাশায়ী হন তিনি।
ম্যাচের একটা সময়ে জেতার অবস্থাতেই ছিলেন গোরান। কিন্তু ভাগ্যের মুখ ফেরানোর পাশাপাশি সহজেই মেজাজ হারানোই কাল হয়ে দাঁড়ায় তার জন্য। পয়েন্ট হারানোর পর র্যাকেট ছুড়ে ফেলে দিতে দিতে নিজের উপর আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ৩-২ সেটে হেরে যান। ম্যাচ শেষে গোরান ইভানিসেভিচ বলেন, ম্যাচের মধ্যে সাম্প্রাস ছাড়াও তার প্রতিপক্ষ ছিলো পাঁচজন। আম্পায়ার, বল বয়, কোর্ট, দর্শক এবং তিনি নিজে। রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারার খেসারত দিতে হয় তাকে। প্রথম উইম্বলডন জেতার নিঃশ্বাস দূরত্বে থেকেও আবারো হতাশায় পুড়তে হয় গোরানকে।
টানা তিনটি ফাইনালে হার আর ইনজুরি সমস্যায় হঠাৎ করেই নিজেকে গুটিয়ে নেন এই টেনিস তারকা। ইনজুরি পরবর্তীতে এতটাই প্রকট হয় যে, অবসরের ঘোষণা দিতে বাধ্য হন তিনি। তবে কে জানতো, বিধাতা তার টেনিস ভাগ্য লিখে রেখেছেন অন্যভাবে!
৩ বছর পর ২০০১ সালে আবার হঠাৎ করেই টেনিসে ফিরে আসেন গোরান। তবে সেই সময় তার র্যাঙ্কিং ছিলো ১২৫। তাই সরাসরি উম্বলডন খেলার কোনো সুযোগই ছিলো না তার। অবশেষে উম্বলডন কর্তৃপক্ষ থেকে ওয়াইল্ড কার্ড পেয়ে টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করেন তিনি। একে একে অ্যান্ডি রডিক আর মারাত সাফিনকে হারিয়ে সেমিফাইনালে পৌঁছে যান গোরান। সেখানে তার প্রতিপক্ষ ছিলেন টিম হ্যানম্যান। গোরানের সর্বশেষ উম্বলডনে ভাগ্য সহায় না হলেও এবার ভাগ্যের আশীর্বাদেই হ্যানম্যানের বাঁধা পেরিয়ে যান গোরান।
গ্যালারিভর্তি দর্শকেরা ঘরের ছেলে হ্যানম্যানকে উৎসাহ দিতে জড়ো হয়েছিলো। সেই উৎসাহে তিন সেট শেষে হ্যানম্যান এগিয়ে ছিলেন ২-১ ব্যবধানে। যার মধ্যে তৃতীয় সেটে সরাসরি ৬-০ তে হারান গোরানকে। তা-ও মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যেই। মনোবল হারানো গোরানের বিপক্ষে চতুর্থ সেটেও ২-১ পয়েন্টে এগিয়ে ছিলেন হ্যানম্যান। ঠিক তখনই বৃষ্টি বাগড়া দেয় ম্যাচে। বৃষ্টির জন্য সেই দিনের জন্য ম্যাচটি স্থগিত করা হয়। প্রকৃতির এই আশীর্বাদ কাজে লাগিয়ে পরের দিন নতুন উদ্যমে ফিরে আসেন গোরান। সেই অবস্থা থেকে ইংলিশ দর্শকদের সামনে ৩-২ সেটে হারান টিম হ্যানম্যানকে। চতুর্থ সেটটি টাইব্রেকে জিতলেও শেষ সেটে দাঁড়াতেই দেননি প্রতিপক্ষকে। পঞ্চম সেটে জয় তুলে নেন ৬-৩ পয়েন্টে। তাতেই চতুর্থবারের মতো ফাইনালে পৌঁছান গোরান।
ফাইনালে এবার গোরানের প্রতিপক্ষ ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার প্যাট্রিক র্যাফটার। সোমবার হাজারখানেক অস্ট্রেলিয়ান ও ক্রোয়েশিয়ান দর্শকের সামনে মুখোমুখি হয় দুই দর্শকপ্রিয় টেনিস খেলোয়াড়। অবশেষে ২৯ বছর বয়সী গোরান চৌদ্দবারের চেষ্টায় র্যাফটারকে হারিয়ে জেতেন ক্যারিয়ারের প্রথম উম্বলডন। পাঁচ সেটের ফলাফল ছিলো ৬-৩, ৩-৬, ৬-৩, ২-৬ ও ৯-৭। প্রথম চার সেটে ২-২ সমতার পর শেষ সেটে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বীতা গড়ে তোলেন দুজন। টাইব্রেকারে যাওয়া সেই সেটে তিনবার চ্যাম্পিয়ন পয়েন্ট মিস করেন নার্ভাস থাকা গোরান। তা-ও আবার দুবার ডাবল ফল্ট করে। অবশেষে চতুর্থবার নিজের দুর্দান্ত সার্ভের বিনিময়ে আদায় করে নেন উম্বলডন জেতা পয়েন্ট। প্রথম উইম্বলডন জেতার পর স্পলিট শহরের লোকজন আনন্দ উৎসব শুরু করে। রাজকীয়ভাবে বরণ করা হয় গোরানকে। প্রায় দেড় লাখ মানুষের সমাগম ঘটে তাকে অভিবাদন জানানোর জন্য।
ম্যাচ শেষে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন গোরান। সিএনএন-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানান, উইম্বলডন জেতা তার জীবনের সেরা মূহুর্ত। তবে এই জয়টা নিজের কাছেই রহস্যময় বলে জানিয়েছেন তিনি। কঠিন ড্রয়ের ফলে তাকে মুখোমুখি হতে হয় অ্যান্ডি রডিক, গ্রেগ রুসেকি, মারাত সাফিন, টিম হ্যানম্যান ও প্যাট্রিক র্যাফটারের। এদের সবাই-ই ক্যারিয়ারের কোনো না কোনো সময় শীর্ষ চার বাছাইয়ে ছিলেন। ম্যাচ শেষে গোরান বলেন, "এই উইম্বলডন জেতাটা অনেকটা অমীমাংসিত রহস্যের মতো। তবে দ্বিতীয় রাউন্ডে জেতার পরেই আমি আঁচ করতে পেরেছিলাম যে এবার আমিই এটা জিততে চলেছি। কিন্তু কাউকে বলিনি, কারণ সবাই আমাকে পাগল ভাবা শুরু করতো তখন।"
টেনিস ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ওয়াইল্ড কার্ড নিয়ে উইম্বলডন জেতা গোরানের এই অর্জন অনেকের কাছে রহস্য মনে হলেও টেনিস কিংবদন্তীই হয়ে থাকবেন এই ক্রোয়েশিয়ান। উইম্বলডন জেতার তিন বছর পর ২০০৪ সালে পুরোপুরিভাবে টেনিস ক্যারিয়ারের ইতি টানেন তিনি। পুরো ক্যারিয়ারে ২২টি এটিপি একক টাইটেল জেতেন গোরান। তবে তার ক্যারিয়ারে একমাত্র আক্ষেপ ছিলো কখনো র্যাঙ্কিংয়ে ১ এ উঠতে না পারাটা। সর্বোচ্চ অর্জন ২য় অবস্থান। অবশ্য সেই সময়ে আরেক টেনিস কিংবদন্তী পিট সাম্প্রাসকে সরিয়ে এক নাম্বার জায়গা দখল করাটা অনেকটা মিশন ইম্পসিবলই ছিলো। তবে তার চেয়ে বড় মিশন পসিবল করেই উম্বলডন জিতেছেন এই টেনিস তারকা।
This Bangla article is about a tennis player named Goran Ivanisevic who won wimbledon after many tries. Necessary sources are hyperlinked in the article.
Feature Image: Getty Image