জুভেন্টাসকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে আয়াক্স। সেটা বেশ পুরানো খবর। যেই ডি লিটের নেতৃত্বে সেমিফাইনালে আয়াক্স, তার জন্মই হয়নি যখন সর্বশেষ এই ডাচ ক্লাব চ্যাম্পিয়ন লিগের সেমিফাইনালে উত্তীর্ণ হয়েছিল। এইবার চ্যাম্পিয়নস লিগ আয়াক্সের ঘরে যাবে কি না, তা সময়ই বলে দিবে। তবে এই দলটিই আরো কয়েক বছর একসাথে খেললে হয়তো জিততো পারতো সবকিছুই। কিন্তু তা যে সম্ভব না, তা এখনই বলে দেওয়া যায়। ইতঃমধ্যেই মাঝমাঠের কান্ডারি ডি ইয়ং নাম লিখিয়েছেন বার্সেলোনার হয়ে। তারই পথে পা বাড়িয়ে রেখেছেন অধিনায়ক ডি লিট। তাগ্লিয়াফিকোর দিকে চোখ রয়েছে আর্সেনাল ও টটেনহ্যামের। নেরেস কিংবা জিয়েশদের পেছনেও লেগেছে ইউরোপিয়ান বড় ক্লাবগুলো। তাই হয়তো অচিরেই বর্তমান আয়াক্স দলের সদস্যরা ছড়িয়ে পড়বে অন্য কোনো ক্লাবে।
ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবলে এই ঘটনা নতুন নয়। আর্থিকভাবে একটু পিছিয়ে থাকা ক্লাবগুলো সহজেই তাদের ভালো খেলোয়াড়কে হারিয়ে ফেলে অন্য ধনী ক্লাবের কাছে। বর্তমানের আয়াক্সের সম্ভাব্য পরিণতির মতো হয়েছে আরো অনেক ক্লাবেরই। আজ আমরা দেখবো সেই সব ক্লাবের গল্প।
মোনাকো (২০০৩-০৪)
বার্নার্ডো, বাকোয়োকো, মেন্ডি, এমবাপ্পেদের এক যুগ আগে ছিল এভরা, মরিয়েন্তেস, রথেন, গুলি। এই চারজন খেলোয়াড়ের মধ্যে একমাত্র এভরাই পোর্তোর কাছে চ্যম্পিয়নস লিগ ফাইনাল হারের পরপরই দল ছেড়ে চলে যাননি, গিয়েছেন দুই মৌসুম পর।
এদের হাত ধরেই ২০০৩-০৪ মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে ওঠে মোনাকো। কিন্তু ফাইনালে মরিনহোর পোর্তোর কাছে হেরে শিরোপা খুঁইয়েছিলো সেবার। ফাইনালের ঠিক কয়েক মাসের ব্যবধানেই রথেন যোগ দেন পিএসজিতে। মরিয়েন্তেস ধারে লিভারপুল হয়ে তাবু গাঁড়েন রিয়াল মাদ্রিদে। আর অন্যদিকে গুলি যোগ দেন বার্সেলোনায়। আর তাতেই মোনাকোর সাজানো দলটি ভেঙে যায়। এরও ২ বছর পর ২০০৬ সালে এভরা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে যোগদান করে দল ভাঙার ষোলকলা পূর্ণ করেন।
বেয়ার লেভারকুসেন (২০০১-০২)
পুরো মৌসুম দুর্দান্ত কাটানোর পর শেষ তিনদিনে তিনটি শিরোপা খুইয়ে ফেলা লেভারকুসেন ভাগ্যকে দোষারোপ করতেই পারে। লিগের শেষ দিনে এসে পয়েন্ট টেবিলে দ্বিতীয় স্থানে চলে গিয়ে বুন্দেসলিগা হারায় লেভারকুসেন। তেমনিভাবে ফাইনালে এসে আটকে যায় চ্যাম্পিয়নস লিগ ও ডিএফবি পোকালেও। তবে তার চেয়ে দুঃখের বিষয় হচ্ছে যে, এই দুর্দান্ত দলটিকেও ধরে রাখতে পারেনি লেভারকুসেন। সেই মৌসুমের গ্রীষ্মেই মাইকেল বালাক ও জি রবার্তো পাড়ি জমান বায়ার্ন মিউনিখে। এই দুই বিখ্যাত জোড়াকে হারিয়েই বিপাকে পড়ে জার্মান ক্লাবটি। পরবর্তীতে দুই বছর পর ডিফেন্ডার লুসিও সাবেক সতীর্থদের দেখানো পথে হেঁটে যোগ দেন বাভারিয়ানদের দলে। অবশেষে ২০০৬ সালে লেভারকুসেন ছেড়ে ২০০১-০২ মৌসুমের আরেক নায়ক দিমিতর বারবেতভ পাড়ি জমান ইংলিশ ক্লাব টটেনহ্যামে।
আয়াক্স (২০০৩-০৪)
নব্বই দশকে সর্বশেষ চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতা আয়াক্স এরপরের এক দশক ধরে একটি ভালো স্কোয়াডের জন্যই হাপিত্যেশ করে মরছিলো। অবশেষে ২০০৪ মৌসুমে এসে প্রতিভাবান সব তরুণে ভরে যায় আয়াক্স দল। ইব্রাহিমোভিচ থেকে শুরু করে স্নাইডার, রাফায়েল ভ্যান ডার ভার্ট, জারি লিটমানেন, নাইজেল ডি ইয়ং, থমাস ভারমেলেন, ম্যাক্সওয়েল সব তখন ছিলই একই ক্লাবে।
কিন্তু সেই ভাঙা শুরু হয় ইব্রাহিমোভিচকে দিয়ে। ২০০৪ সালে আয়াক্স ছেড়ে জুভেন্টাসে পাড়ি জমান তিনি। ধীরে ধীরে বছরখানেকের মধ্যেই সব প্রতিভাবান খেলোয়াড় পাড়ি জমান অন্য ক্লাবে। ২০০৭ সালে স্নাইডার রিয়াল মাদ্রিদে যোগ দেওয়ার সময়কালে ক্লাবে একমাত্র টিকেছিল থমাস ভারমেলেন।
ডায়নামো কিয়েভ (১৯৯৮-৯৯)
১৯৯৮-৯৯ মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগে সবাইকে চমকে দেয় ইউক্রেনের ক্লাব ডায়নামো কিয়েভ। একে একে রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা ও আর্সেনালকে হারিয়ে সেমিফাইনালে পৌঁছে দলটি। সেখানে বায়ার্ন মিউনিখের কাছে ৪-৩ গোলে হেরে গেলেও সবার নজর কাড়ে দলটি।
সার্জি রেবরভ আর আন্দ্রেই শেভচেঙ্কোর দুর্দান্ত রসায়নেই এতদূর আসা ডায়নামো কিয়েভের। বলা বাহুল্য, সেইবার লিগ শিরোপাও ঘরে তুলেছিল কিয়েভ। কিন্তু সেই মৌসুমশেষেই শেভচেঙ্কো পাড়ি জমান এসি মিলানে, যেখানে নিজেকে প্রমাণ করেন সময়ের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় হিসেবে। অধিনায়ক ওলেগ লুঝনি চলে যান আর্সেনালে। তারই দেখানো পথে হেঁটে ১২ মাস পর লন্ডনের ক্লাব টটেনহ্যামে যোগ দেন সার্জি রেবরভ। পরবর্তীতে কাখা কালাদজে'ও যোগ দেন এসি মিলানে। আর সেই ভাঙার পর এখনো ইউরোপে নিজেদের আর প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি ডায়নামো কিয়েভ।
পার্মা (১৯৯৮-৯৯)
সেবার উয়েফা কাপ জিতে চমকে দেয় ইতালিয়ান ক্লাব পার্মা। তবে তৎকালীন সময়ে পার্মায় থাকা খেলোয়াড়ের নাম শুনলে হয়তো তাদের অর্জন আপনাকে অবাক না'ও করতে পারে। জিয়ানলুইজি বুফন, ফ্যাবিও ক্যানাভারো, লিলিয়ান থুরাম, ভেরন, হার্নান ক্রেসপো প্রমুখ!
থুরাম, ক্যানাভারো, বুফন তো বিশ্বকাপজয়ী খেলোয়াড়ই ছিলেন। হার্নান ক্রেসপো ছিলেন সেই সময়ের সবচেয়ে দামী খেলোয়াড়। তবে সেইবার পার্মা সিরি আ'তে চতুর্থ স্থান অর্জন করে। ওই মৌসুম শেষেই ল্যাজিওতে পাড়ি জমান ভেরন, ক্রেসপো যান তার পরের বছর। বুফন যোগ দেন জুভেন্টাসে। ক্লাব ছাড়েন থুরাম আর ক্যানাভারোও। এরপর অনেক প্রতিভাবান খেলোয়াড় পার্মাতে আসলেও একই সাথে এত প্রতিভাবান খেলোয়াড় আর কখনোই পায়নি এই ইতালিয়ান ক্লাবটি।
ওয়েস্টহ্যাম (২০০০-০১)
রিও ফার্দিনান্ড, মাইকেল ক্যারিক, ফ্রাঙ্ক ল্যাম্পার্ড, জো কোল, জার্মেইন ডিফো। এই সব খেলোয়াড় একসময় খেলেছেন একইসাথে, ওয়েস্টহ্যামের হয়ে ২০০০-০১ মৌসুমে। কিন্তু ২২ বছর বয়সী রিও ফার্দিনান্ডকে বিক্রয় করাটাই কাল হয়ে দাঁড়ায় ওয়েস্টহ্যামের জন্য। ফার্দিনান্ড লিডসে চলে যাওয়ার পরই রেলিগেশনে পড়ে ওয়েস্টহ্যাম। একে একে সব রত্নও ক্লাব ছাড়তে শুরু করে তখন। ফার্দিনান্ড ও ক্যারিক তো ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে জেতেন চ্যাম্পিয়নস লিগ। জো কোল আর ল্যাম্পার্ড তাবু গাঁড়েন স্ট্যামফোর্ড ব্রিজে। ল্যাম্পার্ড ২০১২ সালে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতলেও জো কোল ২০০৮ সালে ফাইনাল খেলেন চেলসির হয়ে। অন্যদিকে ডিফোও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন সময়ের অন্যতম সেরা ফরওয়ার্ড হিসেবে।
বরুশিয়া ডর্টমুন্ড (২০১২-১৩)
১৯৯৭ সালে চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার পর ইয়ুর্গেন ক্লপের অধীনে ২০১৩ সালে আবারও ফাইনালে ওঠে বরুশিয়া ডর্টমুন্ড। কিন্তু ফাইনালে বুন্দেসলিগা প্রতিদ্বন্দ্বী বায়ার্ন মিউনিখের কাছে হেরে রানার্সআপ হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাদের। তবে ধ্রুপদী ফুটবল খেলে সবার মন জয় করেছিল ডর্টমুন্ড বাহিনী।
তবে এই অর্জনের পিছনে রয়েছেন মারিও গোৎজে, রবার্ট লেভানডস্কি ও মার্কো রিউস - এই 'ত্রিমূর্তি'র অসামান্য অবদান। এছাড়াও মাঝমাঠে ছিলেন শিনজি কাগাওয়া, নুরি শাহিন, কিংবা রক্ষণে ছিলেন ম্যাট হ্যামেলস। কিন্তু সেই মৌসুমশেষেই ফ্রি ট্রান্সফারে বায়ার্নে যোগ দেন লেভানডস্কি। তারই দেখানো পথে হাটেন মারিও গোৎজে। এর ১২ মাস পর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে যোগ দেন শিনজি কাগাওয়া। নুরি শাহিন বেছে নেন রিয়াল মাদ্রিদকে। সবশেষে ক্লাব ছাড়েন ম্যাট হামেলস। অন্যান্য বরুশিয়ার খেলোয়াড়ের মতো তিনিও যোগ দেন বাভারিয়ানদের দলে। বর্তমানে একাই পড়ে আছেন মার্কো রিউস। যদিও সেই দলবদলের ধাক্কা সামলে ডর্টমুন্ড আবারও তরুণ খেলোয়াড়দের নিয়ে নিজেদের দলকে গুছিয়ে তুলছে। তবে কে জানে, আবার কখন বড় বড় ক্লাবগুলো হানা দেয় ডর্টমুন্ড শিবিরে।
This article is about the departure of the footballers from the club. References are hyperlinked in below.
Feature Image: Four Three Three