সান্তোস থেকে নেইমারকে দলে ভেড়ানোর পর বার্সেলোনায় ভয়ঙ্কর একটি আক্রমণভাগ তৈরি হয়েছিল, যা তাদের ক্লাবের ইতিহাসেই আগে দেখা যায়নি। নেইমার তখন উঠতি তারকা। কিন্তু তার প্রতিভার কোনো ঘাটতি ছিল না। ক্রমেই সময়ের সেরা একজন হয়ে উঠছিলেন তিনি। বার্সেলোনা সমর্থকদের পাশাপাশি ক্লাবের হর্তাকতারাও চেয়েছিল, মেসির বিদায়ের পর ক্লাবের রাজত্ব তুলে দেওয়া হবে নেইমারের হাতে। কিন্তু সে ভাগ্য বার্সেলোনার হয়নি। অন্যের তৈরি করা রাজত্বে ভাগ না বসিয়ে নেইমার চেয়েছিলেন নিজের রাজত্ব নিজেই গড়তে, যা হয়তো ছিল তার ক্যারিয়ারের অন্যতম ভুল সিদ্ধান্ত।
নেইমারের প্রস্থানের পর তার শূন্যস্থান পূরণের জন্য বার্সেলোনা অঢেল টাকা ঢেলে বহু চেষ্টা করেছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি। প্রথমে ডর্টমুন্ড থেকে কেনা হয় উসমান দেমবেলেকে, যিনি মূলত একজন রাইট উইঙ্গার। তারপর ফিলিপে কৌতিনহো, যার খেলার জন্য কোনো পজিশনই ছিল না বার্সার কাছে। তাকে একবার মিডফিল্ডে, তো অন্যবার উইংয়ের বাম প্রান্তে ব্যবহার করা হতো। কিন্তু, ফলাফল শূন্য। ফলে, ক্লাবের রেকর্ড পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে কেনা খেলোয়াড় এখন লোনে বায়ার্ন মিউনিখে। এরপর, বার্সেলোনা ম্যালকমকে এনেছিল। সেও এক মৌসুমের বেশি সময় টেকেনি। এখন বার্সেলোনার এই আক্রমণভাগের নতুন সংযোজন আঁতোয়ান গ্রিজমান, যিনি কোনো অংশেই একজন লেফট উইং পজিশনে ব্যবহার করার মতো খেলোয়াড় নন।
নেইমার প্রসঙ্গ আপাতত বাদ থাকুক, কৌতিনহো প্রসঙ্গও। গ্রিজমানের কথা বরং বলা যাক।
নেইমারের পিএসজি পাড়ি দেবার পর বার্সেলোনা সবসময় চেষ্টা করেছে আক্রমণের বামপ্রান্তে কোনো তারকা খেলোয়াড়কে রাখতে। কিন্তু যাকে আনা হচ্ছে, তিনি ঐ পজিশনের জন্য যথাযথ কি না, এসব বিষয় বার্সেলোনা বোর্ড ভেবে দেখেনি। গত চ্যাম্পিয়নস লিগে লিভারপুলের বিপক্ষে আরও একবার বিধ্বস্তের পর অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ থেকে সব মিলিয়ে ১৩৫ মিলিয়নের বদলে গ্রিজমান বার্সায় আসেন। গ্রিজমান যখন বার্সেলোনা অধ্যায় শুরু করেন, মেসি তখন ইনজুরিতে। মৌসুমের প্রথম ম্যাচে গ্রিজমান মাঠে নামেন লেফট-উইং পজিশনে, যে ম্যাচে অ্যাটলেটিক ক্লাবের বিপক্ষে হেরে এসেছিল তার দল।
মৌসুমের প্রথম ম্যাচেই ইনজুরিতে আক্রান্ত হন স্ট্রাইকার লুইস সুয়ারেজ। তাই রিয়াল বেটিসের বিপক্ষে গ্রিজমান নামেন স্ট্রাইকারের ভূমিকায়। সে ম্যাচেই ২ গোল ও ১ অ্যাসিস্ট করে বার্সেলোনার অধ্যায়ের শুভ সূচনা করেন। কিন্তু আস্তে আস্তে মেসি ও সুয়ারেজ নিয়মিত হয়েছেন। গ্রিজমান সরে গেছেন লেফট-উইং পজিশনে। মাঠে যেমন তার গোল দেওয়ার হার কমে গেছে, তেমনই মাঠে অদৃশ্য থাকার প্রবণতা বেড়ে গেছে।
টানা ৫ ম্যাচে নিজের কোনো দক্ষতা দেখাতে না পারা গ্রিজমানের গত অক্টোবরে সেভিয়ার বিপক্ষের ম্যাচে আর নামার সুযোগ হয়নি। কারণ, গত ৫ ম্যাচে আসলেই গ্রিজমান দলের জন্য তেমন কাজে আসেননি। দেমবেলের ফিরে আসার পর গ্রিজমানের বেঞ্চ হবার কারণ, তিনি মাঠে তার স্বভাবসুলভ কিছু করতে পারছেন না। কারণ, বার্সেলোনার ফুটবল দর্শনের ছিঁটেফোঁটাও তিনি এখনও ধরতে পারেনি। উয়েফাকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে গ্রিজমান নিজেই স্বীকার করছেন যে, বার্সেলোনায় মেসি, দেমবেলে বা সুয়ারেজের খেলার ধরন তিনি বুঝতে পারছেন না। কখন দৌঁড়াতে হবে, বা কখন পাস দিতে হবে, এ বিষয়গুলোর সাথে তিনি নিজেকে সেভাবে মেলাতে পারছেন না। তার উপরে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি তো আছেই।
কিন্তু ২৮ বছর বয়সী বিশ্বকাপ জেতা ও অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের হয়ে নিজেকে সেরাদের একজন হিসেবে মেলে ধরা খেলোয়াড়ের এমন সমস্যা কেন দেখা দেবে? এর উত্তর সেই কৌতিনহোর সময়ই দেয়া হয়ে গেছে। কৌতিনহো বার্সেলোনায় এসে একজন নাম্বার টেন হিসেবে খেলতে পারেননি। গ্রিজমানও পারবেন না, কারণ বার্সেলোনায় একজন লিওনেল মেসি বহাল তবিয়তে ক্লাবের সে স্থান আঁকড়ে আছেন। অথচ কৌতিনহো থেকে গ্রিজমান, এরা 'ফ্রি রোল'-এ সব থেকে বেশি সফল।
গ্রিজমান অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ অথবা ফ্রান্সের হয়ে সবসময় ডিয়েগো কস্তা বা অলিভিয়ের জিরুর মতো স্ট্রাইকারকে সামনে রেখে সম্পূর্ণ স্বাধীন রোলে খেলে এসেছেন। লেফট-উইং পজিশনে মাঠে নামলেও গ্রিজমান চলে আসতেন মাঠের মধ্যভাগের আক্রমণাত্মক পজিশনে। উয়েফা ইউরো '২০ বাছাইপর্বে আলবেনিয়ার বিপক্ষে সর্বশেষ যখন গ্রিজমান খেলেছিলেন, তখন তাকেও এই পজিশনেই দেখা গিয়েছিল।
বার্সেলোনার সিস্টেমের সাথে খাপ খাওয়াতে না পারার প্রসঙ্গে কথা বলেছেন 'এল প্যারিস' পত্রিকার সাংবাদিক রেমন বেসা। এই সমস্যার বিশ্লেষণ তার কাছ থেকে শোনা যাক,
"গ্রিজমানের এরূপ ফর্মের পেছনে বিভিন্ন কারণ আছে। প্রথমত, গ্রিজমানের আসল পজিশন মেসির দখলে। সে স্ট্রাইকার পজিশনেও খেলতে পারত, কিন্তু সে স্থান লুইস সুয়ারেজের। তাই তাকে আক্রমণের বাম প্রান্তে যেতে বাধ্য করা হয়েছে।
ডিফেন্ডারদের 'ম্যান মার্কিং' সিস্টেম থেকে দূরে থাকা খেলোয়াড় হলেন গ্রিজমান। আর এখানে তিনি নিজের পজিশন থেকে ভিন্ন একটি পজিশনে খেলে ঠিক অভ্যস্ত হতে পারছেন না। যে কারণে মেসির পাশ থেকে আসা বা মধ্যমাঠ থেকে আসা বলগুলো বুঝতে তার সমস্যা হচ্ছে। বার্সেলোনা হচ্ছে এমন একটি দল, যারা নিজেদের ভেতর পাস দেবে বেশি, কিন্তু খাটবে কম। কিন্তু গ্রিজমান এ ধরনের ফুটবলে অভ্যস্ত নন। তিনি ড্রিবল করবেন গতিময় ফুটবলের সাথে। সেটাই তিনি বার্সেলোনার সাথে করতে গিয়ে ছন্দ হারিয়ে ফেলছেন।"
রেমস বেসার এই বিশ্লেষণে একটি প্রশ্ন থেকে যায়। বার্সেলোনার বাম প্রান্ত যখন নেইমারের দখলে ছিল, তিনি ছিলেন সফল। অথচ নেইমার মাত্রাতিরিক্ত ড্রিবল ও গতিময় ফুটবলে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। কিন্তু মেসি বা সুয়ারেজের সাথে বোঝাপড়ায় তার কোনো সমস্যা হয়নি। তবে গ্রিজমানের কেন হচ্ছে?
এর প্রথম উত্তর, গ্রিজমান নেইমারের মতো কোনো প্রথাগত লেফট উইঙ্গার নন। আর বর্তমানে বার্সেলোনার খেলার ধরনও সেই আগের মতো নেই। পাসের পসরা বসানো বার্সা ভালভার্দের অধীনে একদম অন্যরকম ফুটবল খেলে, যা তাদের স্বভাবসুলভ নয়। তাই একজন লেফট-উইঙ্গার না হয়েও সে পজিশনে খেলে স্থায়ী হবার পরামর্শ গ্রিজমান সেভাবে পাচ্ছেন না।
নেইমারের বিদায়ের পর এবং কৌতিনহো কাণ্ডের পর বার্সেলোনার উচিত ছিল একজন পূর্ণাঙ্গ লেফট-উইংগার দলে ভেড়ানো। কিন্তু গ্রিজমানকে কেনা বার্সেলোনার সম্প্রতি সময়ে করা আরও একটি বড় ভুলের উদাহরণ। গ্রিজমান দারুণ খেলোয়াড়, এতে সন্দেহ নেই। কিন্ত একজন খেলোয়াড়ের সেরাটা বের করে আনতে হলে তাকে তার নিজস্ব পজিশনে খেলানো উচিত। মেসি যেমন এবং যে পজিশনে খেলেন, কোনো খেলোয়াড় যদি ঠিক তেমনই হন, তবে তার উচিত মেসি যেখানে নেই, সেই ক্লাবে যাওয়া। কারণ, আপনার রুমে যদি মাত্র একজন মানুষ থাকে, এবং সেটি আপনি, সেক্ষেত্রে আপনার ঘরে দুটো বিছানা এনে রাখার কোনো প্রয়োজন নেই। গ্রিজমানের ক্ষেত্রেও হয়েছে তাই। সুতরাং, তার বেহাল অবস্থা দেখে অবাক বনে যাবার কিছু নেই।
তাই সমাধান কী? সব থেকে সহজ সমাধান হলো, মেসিকে বেঞ্চে রেখে তার পজিশনে গ্রিজমানকে খেলানো। তবে তা কতটা অসম্ভব ব্যাপার, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে সব থেকে সহজ সমাধান ছিল, বুড়িয়ে যাওয়া সুয়ারেজকে বেঞ্চ করে গ্রিজমানকে স্ট্রাইকার হিসেবে ব্যবহার করা। কিন্তু সে সুযোগেও এখন গুড়েবালি। সুয়ারেজ হুট করে তার চিরচেনা অফ ফর্ম থেকে বের হয়ে এসে নিয়মিত গোল করে যাচ্ছেন। তাই, অগত্যা গ্রিজমানের স্থান হয়েছে আক্রমণের বাম প্রান্তে, যেখানে তাকে অধিকাংশ সময়ে দেখা যাচ্ছে রক্ষণাত্মক ভূমিকায়। কারণ, সুয়ারেজ ও মেসির সাথে পাল্লা দিয়ে খেলে খাবি খাওয়ার থেকে রক্ষণে কিঞ্চিৎ সাহায্য করা ভালো। কিন্তু ১২০ মিলিয়ন ইউরো খরচ করে তো তাকে আর রক্ষণে ব্যবহার করার জন্য কাতালানরা কেনেনি!
গ্রিজমানের উত্থান রিয়াল সোসিয়াদাদের হয়ে। এরপর দিদিয়ে দেশঁর অধীনে ফ্রান্স দলের পাশপাশি ডিয়েগো সিমিওনের অ্যাটলেটিকোর সাথে মানিয়ে নেয়া তার জন্য সহজ ছিল না। তাকে সেখানে শিখতেই হয়েছে, কীভাবে স্ট্রাইকার হয়েও রক্ষণে সাহায্য করা যায়, কীভাবে প্রেস করতে হয়, বা আক্রমণে থেকেও মধ্যমাঠ সামাল দেওয়া যায়। বার্সেলোনায় আসার পর তাই কাতালানদের খেলার ধরন বুঝে নিয়ে আবার নিজেকে নতুন করে মানিয়ে নেয়া তার জন্য সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ।
একজন বিশ্বসেরা খেলোয়াড় হিসেবে গ্রিজমান হয়তো পারতেন বার্সেলোনার একজন যোগ্য খেলোয়াড় হতে, আয়ত্বে আনতে পারতেন তাদের দর্শন; যদি সিমিওনের মতো একজন কোচ থাকত তার পাশে। কিন্তু তিনি পেয়েছেন আর্নেস্তো ভালভার্দেকে, যে কোচের অধীনে বার্সেলোনাই ছন্দে নেই ঠিক। তাদের চিরচেনা 'তিকিতাকা' ফুটবল তাদের সমর্থকেরা প্রায় ভুলতেই বসেছে। সেখানে গ্রিজমানকে কতটা সাহায্য করতে পারবেন ভালভার্দে, তা বোঝা দুষ্কর। উপরন্ত, ভালভার্দেও হয়তো ভেবে নিয়েছেন, বর্তমান সময়ের সেরা খেলোয়াড়দের একজন হয়তো ঠিকই নিজের মতো করে মানিয়ে নেবেন।
তবে গ্রিজমান চেষ্টা যে করছেন, তা বোঝা যায়। বরুশিয়া ডর্টমুন্ড, ইন্টার মিলান, মায়োর্কা বা রিয়াল সোসিয়াদাদ ম্যাচগুলোতে তার উন্নতি লক্ষণীয়। মেসি বা সুয়ারেজকে পাসগুলো দিচ্ছেন বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে। ডি ইয়ং বা রাকিটিচের থেকে আসা পাসগুলোতে আস্তে আস্তে আয়ত্ব আসছে তার। দেমবেলে ইনজুরি থেকে ফেরার আগেই এই পজিশনে তাকে স্থায়ী হতে হবে; কারণ তিনি জানেন, বার্সেলোনার দর্শনের সাথে মানিয়ে নেয়া ছাড়া তার হাতে আর কোনো রাস্তা খোলা নেই। কারণ, বার্সেলোনায় এসে চরম মাত্রার ব্যর্থতা মানেই গোটা ক্যারিয়ারের নিশ্চিত ভরাডুবি।
খেলাধুলার চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/
This article is in bangla language which is about french forward Antoine Griezmann and explain why he struggling to adapt with Barca's playing style at the Left-Wing position.
Feature Image Source: Quality Sport Images/Getty Images
Feature Source :