ফর্মুলা ওয়ান, শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিশাল বিশাল লম্বা রেসিং ট্র্যাক, দেখতে ছোট কিন্তু দুর্দান্ত গতিতে ছুটে চলা বিশ্ববিখ্যাত একেকটি ব্র্যান্ডের গাড়ি, ফিনিশিং লাইন এবং সবশেষে একজন বিজয়ী। মাইকেল শুমাখার, ম্যানুয়েল ফাঞ্জিও, জিম ক্লার্কের মতো একেকজন ফর্মুলা ওয়ান রেসার, যারা শুধু গাড়িই চালান না, নিজেরাই একেকজন কিংবদন্তির পর্যায়ে চলে গেছেন।
সম্প্রতি খেলার দুনিয়ায় অন্যতম একটি খবর হলো বহু বছর পর ফর্মুলা ওয়ানের আয়োজকরা নারীদের রেসিং প্রতিযোগিতা চালু করতে যাচ্ছে। শুনে উচ্ছ্বসিত হতে গিয়েই মনে পড়ে গেল, সেই কিংবদন্তী নারী গ্রাঁ প্রি জয়ীর কথা, যিনি নিজের যুগ থেকে অনেক এগিয়ে ছিলেন। একপেশে পুরুষদের খেলায় অংশগ্রহণ করে রেসিং ট্র্যাক মাতিয়েছেন। তখনকার সময় পুরো দুনিয়া যাকে একনামে চিনতো। যেমন বিস্ময়কর ছিল তার উত্থান, ঠিক ততটাই হতাশার ছিল মদ্যপান, উচ্ছৃঙ্খল আর বিলাসী জীবনযাপনের কারণে তার পতন। এই জীবনের চেয়েও বড় অ্যাথলেটকে নিয়ে এই ফিচারটি।
হ্যালে নাইসের আসল নাম হেলেনা ডেলাংগেল। জন্ম ১৯০০ সালে প্যারিস থেকে ৪৭ কিলোমিটার দূরের ছোট্ট একটি গ্রামে। পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তার বাবা ছিলেন একজন সাধারণ দোকানদার। কিন্তু নাইসের মাথায় ছিল অন্য চিন্তা। তিনি একজন সাধারণ দোকানদারের মেয়ে হয়ে থাকতে চাননি। এজন্য তিনি যাত্রা শুরু করেন স্বপ্নের নগরী প্যারিসে, যেখানে তিনি বিখ্যাত আর্টিস্ট রেনে কারেরির জন্য নগ্ন চিত্রের মডেলিং শুরু করেন।
এর কিছুদিন পরই ব্যালে ড্যান্সের প্রতি আকর্ষণের কারণে একটি কোর্স করে পেশাদার নৃত্যশিল্পী হয়ে যান। নিয়মিত শো করার মাধ্যমে প্যারিসে তার বেশ নামডাক হয়েছিল। তখন নাইসের কাছের বন্ধু হেনরি, যিনি কি না নিজেও একজন রেসিং ড্রাইভার ছিলেন, তার মাধ্যমে মোটর সার্কিটের সাথে পরিচয় হয়। সাথেই সাথেই এই ক্যারিয়ারের অ্যাডভেঞ্চার নাইসকে ব্যাপকভাবে রেসিং ট্র্যাকের প্রতি আকৃষ্ট করে তোলে। ১৯২১ সালে তিনি ইংল্যান্ডের সারেতে একটি রেসিংয়ে অংশ নিতে যান, কিন্তু তার আবেদন বাতিল হয়ে যায় তিনি নারী বলে। এরপর পুরো একটি দশক তিনি রেসিং করার জন্য সংগ্রাম করে গেছেন, কিন্তু তেমন কোনো সুযোগ পাননি।
গাড়ির রেসার না হতে পারার কষ্ট এবার তাকে সার্ফিংয়ের দিকে নিয়ে গেল। তিনি সার্ফিং করা শুরু করলেন এবং অনেক ভালও করতে লাগলেন। পাশাপাশি তার ব্যালে ক্যারিয়ার তো ছিলই। সব মিলিয়ে ফ্রান্সে ভালোই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন হ্যালে। কিন্তু ভাগ্য বেশিদিন সহায় হয়নি। এই সার্ফিং করতে গিয়েই ভয়াবহ এক দুর্ঘটনার শিকার হন এবং হাঁটুতে স্থায়ী ইনজুরির কারণে তার সার্ফিং এবং ব্যালে ডান্সিং দুটি ক্যারিয়ার আজীবনের জন্য শেষ হয়ে যায়। এরপরই নাইস আরেকবার হাতে স্টিয়ারিং তুলে নেয়ার কথা ভাবেন এবং শেষপর্যন্ত সেই সুযোগটি এসে যায়।
হ্যালের জয়যাত্রা
১৯২৯ সালে প্রথমবারের মতো ফ্রান্সে নারীদের গ্রাঁ প্রি অনুষ্ঠিত হয়। নাইস এতে জেতার জন্য মরিয়া ছিলেন। শুরু করেন কঠোর অনুশীলন। কিন্তু অভ্যাস যার সঙ্গ ছাড়ে না, সে বারবার উল্টোপথেই চলে যায়। ফলাফলস্বরূপ, নাইস তার রেসের ঠিক আগের রাতটি কাটান মাদক, নেশা ও ছেলে মানুষের সঙ্গে। যদিও পরদিন সকালে ঠিকই নাইস তার নির্ধারিত জুলস ডুবস্ক কোম্পানির ওমেগা সিক্স গাড়িটি চালিয়ে সবাইকে পেছনে ফেলে চ্যাম্পিয়ন হন। জয়ের পর গাড়িটির সাথে নাইসের ছবি জুলস ডুবস্ক কোম্পানির মার্কেটের শেয়ারের মূল্য বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়।
এ জয়ের পর থেকেই নাইস অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন। এরপর তিনি যুক্তরাষ্ট্রে যান ইন্ডি-৫০০ খ্যাত মিলার কোম্পানির হয়ে গাড়ি চালাতে। কিছুদিন পর ফিলিপ রসচাইল্ড নামের একজন গ্রাঁ প্রি রেসারের প্রেমে পড়েন এবং তার টানে ইউরোপে ফেরত আসেন। ফিলিপ তাকে বিশ্ববিখ্যাত বুগাটি ব্র্যান্ডের মালিক ইতোর বুগাটির সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। ঠিক পরদিন বুগাটি নাইসকে তাদের রেসার এবং ফেস অব দ্য কোম্পানি হিসেবে চুক্তি করিয়ে নেন।
বুগাটি ব্র্যান্ডের হয়ে চারদিকে নাইসের জয়জয়কার পড়ে যায়। নারী হয়েও পুরুষদের সাথে সমানতালে গ্রাঁ প্রি, রেসিং ট্র্যাক, পর্বত রেসিং ট্র্যাক এবং দেশ-বিদেশের নানা মোটর রেসিং প্রদর্শনীতে অংশ নিতে থাকেন। ১৯২৯ সালের ডিসেম্বরে নাইস নারীদের রেসিংয়ে ঘণ্টায় ১৯৭ কিলোমিটার গতিতে গাড়ি চালানোর নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেন। এরপরেই বুগাটি তাদের বিখ্যাত ইসো গাড়ির ড্রাইভার হিসেবে নাইসের সাথে চুক্তি করে। আর নাইস রাতারাতি 'বুগাটি কুইন' খেতাব পেয়ে যান।
বিলাসিতার জীবনকে একটু পাশ কাটিয়ে নাইস এবার রেসিং ট্র্যাকে মনোনিবেশ করতে চেয়েছিলেন। সেই অনুযায়ী ১৯৩১ সালের গ্রাঁ প্রি-তে চতুর্থ হয়ে রেস শেষ করেন। যেখানে সেই সময়কার বিখ্যাত রেসার ফিলিপ ইটানসেলিন, রেনে ড্রেফুস, লুইস চিরনের মতো ড্রাইভাররাই শুধুমাত্র তার আগে শেষ করেছিলেন। দ্বৈত রেসিং ট্র্যাকগুলোতে নাইস কখনোই সবার আগে ফিনিশিং লাইন অতিক্রম করতে পারেননি। কিন্তু প্রতিটি রেসিং ট্র্যাকে তিনি ছিলেন আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে। মাঝে মাঝে তার জনপ্রিয়তা বিজয়ীর জয়কেও ম্লান করে দিত।
রেসিং ট্র্যাকে পুরুষদের সাথে প্রতিযোগিতা করে, পুরুষদের চেয়ে ভাল করার পরও নাইস কখনোই জানান দিতে ভোলেননি যে, তিনি আসলে একজন নারী। তার পোশাক, আবেদনময়ীতা, পুরুষদের সাথে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক সবসময়ই তাকে লাইমলাইটে রেখেছে।
সাও পাওলোর দুর্ঘটনা
বুগাটির পর নাইস এরপর ইতালিয়ান আলফা রোমেও ব্র্যান্ডের সাথে চুক্তি করেন। ১৯৩৩ সালে ইতালিতে মনযা গ্রাঁ প্রিতে অংশ নিয়ে তৃতীয় অবস্থান অধিকার করেন। তিন বছর পর ১৯৩৬ সালে ব্রাজিলের সাও পাওলো গ্রাঁ প্রিতে অংশ নেন। আর সেখানেই ঘটে যায় নাইসের জীবনের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা।
রীতিমতো মৃত্যুর হাত থেকে একটুর জন্য বেঁচে গিয়েছিলেন। নাইস বেঁচে গেলেও, তার চালানো গাড়ি বাউন্ডারি পার হয়ে ভিড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ে এবং ৬ জন মানুষের মৃত্যু হয়। তাদের মধ্যে একজন সৈন্য ছিলেন, যিনি নাইসের ভক্ত ছিলেন এবং মারা যাবার মুহূর্তেও নাইসকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিলেন। এ ঘটনার পর নাইস তিনদিন কোমায় ছিলেন এবং মাথায় ভয়ানক আঘাত পেয়েছিলেন।
এ ঘটনার পরপর নাইসের দুর্নাম ছড়িয়ে পড়ে। দুই মাস হাসপাতালে থাকার পর নাইস আবার স্টিয়ারিং ধরেন। মিলে মিগলিয়া ও ত্রিপলি গ্রাঁ প্রিতে নিজেকে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু স্পনসররা তাকে সাহায্য করা থেকে বিরতই থেকেছেন। রেসিংয়ে অংশগ্রহণের অর্থ যোগাড় করার জন্য যখন হিমশিম খাচ্ছিলেন, তখন নাইস শেষ একটি চেষ্টা করেন। ফ্রান্সের মন্থেরিতে টানা দশ দিন দশ রাত রেসিং করে দশটি রেকর্ড গড়েন, যার কয়েকটি আজ অবধি টিকে আছে। কিন্তু এত উন্মত্ত প্রয়াসের পরও নাইস আর কখনো রেসিং ট্র্যাকে ফিরে আসতে পারেননি।
হিটলারের সাথে সখ্যতা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যখন সারা দুনিয়ায় তাণ্ডব চলছিল, খেলার জগতও ব্যতিক্রম ছিল না। যুদ্ধকালীন সব ধরনের বড়সড় টুর্নামেন্ট বন্ধ ছিল। ফ্রান্স বড় পরিসরে মিত্রবাহিনীর হয়ে যুদ্ধ করছিল। কিন্তু এই সময় নাইসের বিলাসবহুল জীবনযাপন মানুষের চোখ এড়ায়নি। হিটলার যখন প্যারিস আক্রমণ করেন, তখনও নাইসকে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। ১৯৪৯ সালে যুদ্ধ পরবর্তী মন্টে কার্লো র্যালিতে সাফল্য উদযাপনের পার্টিতে লুইস চিরন নাইসকে গেস্টাপোর গুপ্তচর হওয়ার অভিযুক্ত করেন। যদিও তার এই অভিযোগের কোনো শক্ত প্রমাণ ছিল না।
তবুও এটা ধারণা করা হয় যে, নাইস তার বিলাসী জীবনযাপন অব্যাহত রাখার জন্য হিটলারের সাথে হাত মিলিয়েছিলেন। নাইসের স্পন্সর ও তার পরিবারও এ ব্যাপারে সহমত পোষণ করেছিলেন। অনেকে বলে থাকেন, নাইসের সাথে একজন জার্মান রেসারের বেশ সখ্যতা ছিল। এ কারণেই মূলত তাকে গুপ্তচর বলে সন্দেহ করা হয়ে থাকে। এরপরও নাইসকে সরাসরি জার্মানির গুপ্তচর হিসেবে অভিযুক্ত করার মতো প্রমাণ কখনোই পাওয়া যায়নি। কিন্তু হিটলারের সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগ তো ছোটখাট কোনো অভিযোগ নয়। তাই নাইস একরকম বিচ্ছিন্নই হয়ে যান সমাজ থেকে। তিনি চেষ্টা করেছিলেন, তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ ভুল প্রমাণ করার, কিন্তু তিনি তার সহকর্মী বা অন্য কারো কাছ থেকে তেমন কোনো সহযোগিতা পাননি।
পরবর্তী জীবন
এরপর হ্যালে নাইস কীভাবে জীবনযাপন করেছিলেন আর জানা যায়নি। নাইসের পরিবার অনেক আগে থেকেই তার সাথে সকল ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল। সর্বশেষ পেরেকটি তখনই এসে লাগে যখন তার প্রেমিক তার চেয়ে কম বয়সী একটি মেয়ের জন্য নাইসকে ছেড়ে চলে যান। জীবনের শেষ ৩৫ বছর তিনি অনেক অর্থকষ্টে সর্বহারা হয়ে বেঁচে ছিলেন। তার অবস্থা এতই খারাপ ছিল যে, প্রতিবেশীর বাড়ির বাইরে বিড়ালের জন্য রাখা দুধ নাইস নিয়ে এসে খেয়ে ফেলতেন। ১৯৮৪ সালে নাইস মারা যান এবং স্থানীয় একটি দাতা সংস্থার অর্থায়নে তার সৎকার কাজ সম্পন্ন হয়। মৃত্যুর পরও তার পরিবারের কেউ এগিয়ে আসেননি।
এভাবেই একজন দক্ষ, বিখ্যাত এবং জাঁকজমক জীবন কাটানো দুর্দান্ত রেসার ইতিহাসের গহ্বরে হারিয়ে যান। কিন্তু ২০১০ সালে নাইসের নামে একটি ফাউন্ডেশন চালু হয়, যার লক্ষ্য হলো নাইসের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস পুনরুদ্ধার করা। তার সমাধির ওপর তার পরিচয় এবং স্মৃতিফলক বসানো হয়েছে। কারণ, হ্যালে নাইস মানুষ হিসেবে যতই বিতর্কিত হন না কেন, রেসিং ট্র্যাকে তার রাজত্বের কথা কেউ ভুলতে পারবে না। তাই তাকে তার অর্জনের জন্য স্বীকৃতি দান এবং ভবিষ্যৎ নারীদেরকে উৎসাহিত করতে এমন উদ্যোগের অনেক বেশি প্রয়োজন ছিল।
It's an article about once world famous grand prix F1 driver Halle Nice. Making out her way in the patriarchial world of car racing, achieveing and yet losing everything just on her own fault.
Image source : Getty Images