হুমগুটি: আড়াইশো বছরের ঐতিহ্যবাহী এক দেশি খেলা

আড়াইশো বছর ধরে টিকে আছে একটি খেলা! সারা দুনিয়ায় এর একমাত্র ভেন্যু ময়মনসিংহের একটি প্রত্যন্ত গ্রামের মাঠ। বছরে মাত্র একবার মাঠে গড়ায় খেলাটি! আর এই খেলাকে কেন্দ্র করেই তৈরি হয় হুলস্থুল কান্ড! খেলোয়ার সংখ্যার দিক থেকে একে বলা যায় পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি মানুষের খেলা! কারণ এই খেলায় খেলোয়াড় সংখ্যা নির্দিষ্ট তো নয়ই, বরং অংশ নেয় হাজারো মানুষ! আয়োজকদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী,  ২০২২ সালের জানুয়ারিতে এই খেলা আয়োজিত হয়েছে ২৬৩ তম বারের মতো! 

ফসলের বিস্তৃত মাঠকে ময়মনসিংহের স্থানীয় ভাষায় বলা হয় ‘বন্দ’। ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় এমন একটি বন্দের নাম ‘বড়ই আটা বন্দ’। পৌষ মাসের শেষ দিন; স্থানীয়রা বলেন ‘পুহুরা’। সদ্য কাটা ধানের ক্ষেতের মাঠে পিতলের মোড়কের ভেতর মাটি ভরাট করে তৈরি প্রায় এক মণ ওজনের একটি বল। খেলা শুরুর ঘোষণা দেওয়ার সাথে সাথেই গুটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল হাজারো মানুষ। টানাহেচড়া, ধাক্কাধাক্কি চলছে রীতিমতো। কাড়াকাড়িতে সকলের মুখে চিৎকার, “গুটি ধর রে হেইও…!”  এই হচ্ছে হুমগুটি খেলার শুরু। কোথায় যায় এই গুটি? কী ঘটে তারপর?

এই হচ্ছে হুমগুটি: যাকে নিজ অধিকারে নিতে চলে হাড্ডাহাড্ডি; Image Sourcc: daily-bangladesh.com

খেলাতো নয় যেন উৎসবের হেতু

তারপর কী ঘটে তা বলার আগে আপনাকে জানিয়ে রাখি, হুমগুটি খেলা চলাকালীন আটা বন্দ মাঠের পাশে অন্তত ১৪-১৫টি ছোট গ্রামে একপ্রকার উৎসবমুখর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। যেহেতু কয়েকটি গ্রামের হাজারও পরিবারের মানুষ অংশ নেয়, কাজেই এই খেলা দেখতে এবং এর আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে মেহমানে গম গম করে অধিকাংশ বাড়ি। তৈরি হয় শীতের পিঠা আর বাহারি খাবার। বসে অস্থায়ী দোকানপাট, মানসিক প্রস্তুতি চলে এক বিশাল আঞ্চলিক মিলনমেলার।

এই উৎসবে শামিল হওয়া গ্রামগুলোর নাম বলা যাক; মনে ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করা গ্রামগুলোর নাম! বড়ই আটা, ইচাইল, ভাটিপাড়া, লক্ষ্ণীপুর, বালাশ্বর,শুভরিয়া, চর কালীবাজাইল, তেলিগ্রাম, সারুটিয়া, গড়বাজাইল, বাসনা, দেওখোলা, কুকরাইল, বরুকা, ফুলবাড়ীয়া, আন্ধারিয়াপাড়া, জোরবাড়ীয়া, চৌধার, দাসবাড়ী, কাতলাসেনসহ আরো নাম সংগ্রহ করতে না পারা বেশ কয়েকটি গ্রাম। এই গ্রামগুলোর বাইরে কিন্তু এই খেলা নিয়ে দেশের অন্য অঞ্চলের মানুষের তেমন ধারণাই নেই! বিষয়টি বেশ অদ্ভুতই বটে।

খেলার মাঠে নেওয়া হচ্ছে হুমগুটি; Image Source: jagonews24.com

তারপর কী ঘটল?

হ্যাঁ, খেলা শুরুর পর কী ঘটে? তা জানার আগে আরে একটু বলে নেই, এই খেলার পক্ষ-বিপক্ষ কিন্তু অন্যরকম। অংশ নেওয়া গ্রামগুলো থেকে ভাগ করা হয় কয়েকটি পক্ষ। খেলার মূল উদ্দেশ্য এক মণ ওজনের পিতল মোড়ানো বলটি নিজেদের দিকে নিয়ে যাওয়া কিংবা লুকিয়ে ফেলা। যে গ্রামের বা পক্ষের লোকজন এই বলটি নিজেদের অধিকারে নিতে সমর্থ হবেন, সেই গ্রাম বা পক্ষই বিবেচিত হবেন বিজয়ী বলে। 

এই খেলা শুরুর সাথেই শুরু হয় অংশ নেওয়া খেলোয়ারদের মধ্যে তুমুল উন্মাদনা। হুমগুটি নামের সোনালী রঙের ভারি বল ঘিরে শুরু হয় টানাটানি, ধস্তাধস্তি, হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। কখনো দলবেধে একটি গ্রামের খেলোয়াররা একদিকে কিছু দূর নিয়ে গেলেন, তো অন্য পক্ষের লোকজন সেখান থেকে লড়াই করে নিয়ে যান আবার নিজেদের দিকে। কখনো সেই বল হয়তো বিলের কোনো পুকুর বা গর্তে চলে গেল, কোনো পক্ষ লুকিয়ে ফেলল কাদায়, কিন্তু অপরপক্ষ ঠিকই খুঁজে বের করে শীতের কনকনে ঠান্ডা উপেক্ষা করে! নির্মল আনন্দে, উচ্ছাসে চলতে থাকি ভারি বলটি নিজেদের দিকে টেনে নেওয়ার লড়াই।

টানাটানি চলতে থাকে। কখনো বিকাল গড়িয়ে রাত হয়ে যায়। রাতে টর্চের আলোয় চলে গুটি খোঁজা। সে এক বিরল দৃশ্য। তারপর সেই হুমগুটি একসময় যখন কোনো পক্ষ নিজেদের দিকে নিতে কিংবা কোনো বাড়িতে লুকিয়ে ফেলতে সমর্থ হন, তাতেই সমাপ্তি ঘটে এই খেলার। স্থানীয়রা একে বলেন গুটিতোলা। এই গুটি তুলতে যতদিন সময় লাগে, লাগতে পারে। সে নিয়ে নিয়ম বাধেনি কেউ! তবে খেলা শুরু থেকে কয়েক ঘন্টার বেশি সময় লাগে না শেষ হতে। তবে তিন-চার দিন কিংবা দশ দিন লেগেছে এমন উদাহরণও আছে বলেছেন স্থানীয়রা।  গুটিতোলা হয়ে গেলে কখনো কখনো গরু জবাই করেও করা হয় ভুরিভোজ, আবার কখনো মুুড়ি-চিড়া দিয়ে চলে খাওয়াদাওয়া। 

এই খেলায় রীতিমতো হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হলেও তা সংঘর্ষ বা ব্যক্তিগত রেষারেষিতে গড়ায় না কখনো। খেলাটি টিকে থাকার বড় কারণগুলোর মধ্যে এটা একটা বড় কারণ। যে দল এই বল নিজেদের গ্রামে নিতে পারবেন, বিজয়ের গৌরবের অধিকারী হওয়ার পাশাপাশি পরবর্তী খেলা শুরু হওয়ার আগপর্যন্ত সারাবছর তাদের অধিকারেই থাকে এই বল। গ্রামের পালোয়ান জোয়ানরা বিজয়ের এই গৌরব নিয়ে নিজেদের জয়গানে মুখর থাকেন পুরো বছর!

হুমগুটি খেলার গুটি। পিতলের মোড়কের ভেতর ভরাট করা হয় মাটি; Image Source: Wikimedia Commons

অদ্ভুত এই খেলার শুরু কীভাবে?

লোকমুখে নানা কথা প্রচলিত আছে এই খেলার শুরু নিয়ে। কিন্তু কোনটা সঠিক আর কোনটা শুধুই মুখরোচক গল্প তার খোঁজই বা কে রেখেছে? দেশের অধিকাংশ সংবাদমাধ্যমে সবচেয়ে প্রচলিত যে মত তা হচ্ছে- মুক্তাগাছার জমিদার রাজা শশীকান্ত আচার্য্যের সঙ্গে বৈলরের জমিদার হেমচন্দ্র রায়ের জমির পরিমাপ নিয়ে এই খেলার সৃষ্টি। বলা হয়, এই অঞ্চলে দুই ধরনের জমির পরিমাপ চালু ছিল- তালুক আর পরগণা। তালুকের পরিমাপ ছিল প্রতি কাঠায় দশ শতাংশ জমি। আর পরগণার পরিমাপ ছিল প্রতি কাঠায় সাড়ে ছয় শতাংশ জমি। এই দুই ধরনের পরিমাপে সমস্যার সৃষ্টি হলে প্রজারা এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। এই বিরোধ মীমাংসার নিমিত্তে ময়মনসিংহের বড়ই আটা গ্রামে আয়োজন করা হয় এরকম একটি গুটি খেলার, যেখানে বলে দেওয়া হয়- যে পক্ষ এই গুটি নিজেদের অধিকারে নিতে পারবে, তাদের এলাকার পরিমাপ পদ্ধতি হবে তালুক আর পরাজিত অংশের পরিমাপ পদ্ধতি হবে পরগণা। সেই খেলায় মুক্তাগাছার জমিদারের প্রজারা জয়ী হয় বলেও প্রচলিত আছে। যা-ই হোক, এই প্রচলিত কাহিনি দেশের প্রায় সংবাধ্যমেই স্থান পেয়েছে। কিন্তু বিপত্তি হলো, ইতিহাসের সময়ের দিকে চোখ বুলালে এই মতটি একেবারেই ধোপে টিকে না।  

২০২০ সালে অনুষ্ঠিত হুমগুটি খেলা মাঠে খেলোয়াড় ও দর্শক; Image Source: Wikimedia Commons

ইতিহাসের যোগসূত্র কি শুধুই মুখরোচক গল্প?

হুমগুটির সাথে প্রচলিত এই গল্পে ইতিহাসের একটি চমৎকার মেলবন্ধন পাওয়া গেলেও ইতিহাসের সময়ের দিকে তাকালে এর ঐতিহাসিক সত্যতা পাওয়া যায় না। কারণ রাজা শশীকান্ত আচার্য্য জমিদার হন ১৯০৮ সালের দিকে। যদি ১৯০৮ সালে তার জমিদারির প্রথম বছরেও এই খেলার প্রচলন ঘটে, সেই হিসেবে ১৯০৮ থেকে ২০২২ পর্যন্ত মাত্র ১১৪ বছরের ব্যবধান! তার মানে আড়াইশ বছরের তথ্যের সাথে বড়ই বেমানান। আবার অন্যদিকে, এই গল্পের অন্য চরিত্র জমিদার হেমচন্দ্র রায় জন্মগ্রহণ করেন ১৮৩৩ সালে। তার জমিদারির সময়ে তো নয়ই, বরং তার জন্ম থেকেও ২০২২ সাল পর্যন্ত আড়াইশ বছরের ব্যবধান নয়। আরো বড় কথা- শশীকান্ত আচার্য্যের জমিদারের কাল আর জমিদার হেমচন্দ্র রায়ের জমিদারির কালেও রয়েছে বিস্তর ফারাক। কাজেই এই তথ্য যে শুধুই মুখরোচক একটি গল্প তা বলাই যায়। কারণ, আড়াইশ বছরের এই ইতিহাসের সাথে যোগসূত্র মেলাতে হলে ফিরে যেতে হবে অন্তত ১৭৬০ সালের আগে। তবে কীভাবে একটি মুখরোচক গল্প ইতিহাস হয়ে গেল? দায় এড়ানোর জন্য একটা শব্দ এই উত্তরের জন্য যথেষ্ট। সেটা হচ্ছে “কথিত আছে”! 

কিন্তু আসলেই কীভাবে শুরু হয়েছিল এই খেলা? হয়তো নিছক বিনোদন হিসেবেই কোনোভাবে চালু হয়েছিল, কিংবা জমিদারগণ তাদের শোষণ ভুলিয়ে রাখতে কৌশলের অংশ হিসেবে প্রজাদের বিনোদন দিতে চালু করেও থাকতে পারেন। যা-ই হোক, ইতিহাসের অনেক নিখোঁজ পাতার মতো এই খেলার সঠিক ইতিহাসও আড়ালেই রয়ে গেছে। হতে পারে চমকপ্রদ কোনো ইতিহাস লুকিয়ে আছে এই খেলার জন্মকালে! 

হুমগুটি খেলায় জনসমাগম; Image Source: channel24bd.tv

সাম্প্রতিককালে হুমগুটি

অতি সাম্প্রতিককালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে প্রচারে এসেছে  হুমগুটি খেলা। বেড়েছে লোকসমাগম। নিজ গ্রামের গৌরব ধরে রাখার উদ্দীপনা আর এই খেলা ঘিরে যে আবেগ তা কিন্তু কয়েক প্রজন্মের ঐতিহ্য। 

খেলায় কোনো বিচারক নেই, ধরাবাধা নিয়ম নেই, খেলোয়ারদের কোনো আর্থিক সুবিধার বিষয়ও নেই। প্রজন্মের আবেগ ছাড়া এই খেলায় আধুনিক কোনো পদ্ধতিও যোগ হয়নি কখনো! প্রাচীন এই খেলায় আধুনিকতার ছোঁয়া না লাগাই কি টিকে থাকার কারণ? খুব সম্ভবত তা-ই। আড়াইশো বছর যে খেলাটি এই অঞ্চলের সাথে মিশে আছে, তা টিকে যাক আরো হাজার বছর কিংবা আরো বেশি সময়!

This Bangla is article based on Hoomguti sports which is only played on Mymensing, bangladesh for nearly 263 years. References have been hyperlinked inside.

Related Articles