ইতালির জাতীয় পর্যায় কিংবা ইউরোপীয় ফুটবলের মর্যাদাপূর্ণ লড়াই– দুটি ভিন্ন জায়গাতেই একসময় দোর্দণ্ড প্রতাপে রাজত্ব করা রসোনেরিদের সূর্য যেন অসময়েই অস্তমিত হয়ে গিয়েছিল। অপরিণামদর্শী ম্যানেজমেন্ট, মালিকানার ঝামেলা কিংবা সঠিক ফুটবল প্রজেক্ট না থাকার কারণে 'এসি মিলান' হয়ে উঠেছিল আক্ষেপের সমার্থক শব্দ। গত দশকে ইতালিয়ান ফুটবলে তুরিনের ক্লাব জুভেন্টাসের সাথে শিরোপা জয়ের চ্যালেঞ্জে পেরে ওঠা তো দূরের কথা, পয়েন্ট টেবিলে শীর্ষ চারে থেকে যেন উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগে অংশগ্রহণ করতে পারা যায়, সেটিই দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছিল রসোনেরিদের জন্য।
এলিয়ট কর্পোরেশনের হাতে ইতালির ঐতিহ্যবাহী ক্লাব এসি মিলানের মালিকানা যাওয়ার পর সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আসে ক্লাবের ব্যবস্থাপনা পরিষদে। টেকনিক্যাল ডিরেক্টর পদে যোগ দেয়ার জন্য ক্লাবের সাবেক তারকা ফুটবলার পাওলো মালদিনিকে ডেকে আনা হয়। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে আর্সেনাল থেকে নিয়ে আসা হয় অভিজ্ঞ ইভান গাজিনিসকে। ক্লাবের স্কাউটিং ডিপার্টমেন্টকে আরও গতিশীল, যুগোপযোগী করার জন্য গঠনগত পরিবর্তন আনা হয়। এর ফলাফল পাওয়া গিয়েছিল অল্প সময়ের মধ্যেই। অল্প ট্রান্সফার ফি–তে দুর্দান্ত প্রতিভাবান তরুণ খেলোয়াড়দের আনতে পেরেছিলেন মালদিনিরা। তবে মিলানের পুনরুত্থানের কথা যদি বলতে হয়, তাহলে সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ছিল কোচ মার্কো গিয়ামপাওলোকে বরখাস্ত করে আরেক অভিজ্ঞ কোচ স্টেফানো পিওলির হাতে কোচিংয়ের দায়িত্ব তুলে দেয়া।
মালদিনি-গাজিনিসরা দায়িত্ব নেওয়ার পর স্কোয়াডে প্রতিভাবান খেলোয়াড়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও মাঠে কেন জানি নিজেদের দামের প্রতি সুবিচার করতে পারছিলেন না তারা। জেন্নারো গাত্তুসো নিজে থেকে সরে দাঁড়ানোর পর অভিজ্ঞ মার্কো গিয়ামপাওলোকে রসোনেরিদের দায়িত্ব নেওয়ার সুযোগ দেয়া হয়। কিন্তু সেটি তিনি কাজে লাগাতে পারেননি মোটেও। তার অধীনে এসি মিলান সাত ম্যাচ খেলে মাত্র তিনটিতে জয়লাভ করে। সাত ম্যাচের ছয়টিই ছিল মধ্যম ও নিচু সারির দলগুলোর সাথে। শেষপর্যন্ত মালদিনিরা তাকেও বরখাস্ত করেন, স্টেফানো পিওলিকে রসোনেরিদের নতুন কোচ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
কোচ হিসেবে স্টেফানো পিওলির শুরুটা মোটেও ভালো ছিল না। ইতালিয়ান মাস্টারমাইন্ড গ্যাস্পেরিনির আটালান্টার কাছে শুরুর দিকে ৫–০ গোলে বিধ্বস্ত হয়ে সমর্থক থেকে শুরু করে ক্লাবের সাবেক খেলোয়াড়– সবাই তুলোধুনো করেছিল পিওলিকে। কিন্তু সেই ম্যাচটিই পিওলির শিষ্যদের আমূল বদলে দেয়। গতানুগতিক রক্ষণাত্মক ঘরানার ফুটবল থেকে সরে এসে হাই-প্রেসিং ফুটবলের দিকে নজর দিয়ে দ্রুতই সফলতা পেতে শুরু করেন চালহানোগলু, ইব্রাহিমোভিচ, সান্দ্রো তোনালিরা। স্টেফানো পিওলির এসি মিলান অধ্যায়ের একটু কাটাছেড়া করা যাক।
মার্কো গিয়ামপাওলোর সময়ে এসি মিলানের নির্দিষ্ট ফর্মেশন ছিল না। তিনি কখনও ৪-৪-২ খেলিয়েছেন, কখনও ৪-৩-২-১, আবার কখনও ৪-৩-৩। তিনি কখনোই তার সেরা একাদশ নির্বাচিত করতে পারেননি। খেলোয়াড়দের নিয়মিত রোটেশন করিয়েছেন। তার একাদশের খেলোয়াড়দের ভিন্ন পজিশনে খেলিয়ে তাদের সেরাটা বের করে আনার পথ রুদ্ধ করে ফেলেছিলেন। উদাহরণ হিসেবে সাবেক খেলোয়াড় সুসোর কথা বলা যায়। তিনি অধীনে খেলেছেন রাইট উইঙ্গার হিসেবে, কখনও খেলেছেন অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবে। খুব কম সময়ই তার কাছ থেকে সেরাটা বের করে আনতে পেরেছিলেন কোচ জিয়ামপাওলো।
বর্তমান কোচ স্টেফানো পিওলি এদিক থেকে একেবারে শুরু থেকেই তার নিজের কোচিং দর্শনের উপর অবিচল থেকেছেন। ৪-২-৩-১ ফর্মেশনে শুরু থেকে খেলিয়েছেন রসোনেরিদের, এখনও খেলাচ্ছেন। চারজন ডিফেন্ডারের সামনে দুজন 'ডাবল পিভট' মিডফিল্ডার রাখেন তিনি। ডাবল পিভটের সামনে থাকেন তিনজন অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার, যাদের মধ্যে একজন আবার একজন ঐতিহ্যবাহী 'নাম্বার ১০' এর ভূমিকায় থাকেন। তিনজন অ্যাটাকিং মিডফিল্ডারের কাজ একেবারে সামনে থাকা একজন সেন্টার ফরোয়ার্ডকে বল সরবরাহ করা ও ক্রমাগত সুযোগ তৈরি করা। তার দর্শনের মূল বক্তব্য একেবারে পরিষ্কার– হাইপ্রেসিং ৪-২-৩-১ ফর্মেশনের মাধ্যমে ম্যাচ বের আনা।
এই মৌসুমে পিওলির অধীনে মোট পঁচিশজন খেলোয়াড় মাঠে নেমেছেন, যাদের মধ্যে পাঁচ বা ততোধিক ম্যাচ খেলেছেন বিশজন। সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলেছেন তুর্কি প্লেমেকার হাকান চালহানোগলু ও ডেভিড ক্যালাব্রিয়া। মিলানের সেন্টারব্যাকে বেশ কয়েকবার পরিবর্তন আসলেও মোটামুটি ধারাবাহিক হিসেবে অ্যালেসিও রোমাগ্নোলি ও সিমন জায়ের দারুণ পার্টনারশিপ তৈরি করেছেন এই মৌসুমে। ফরাসি লেফটব্যাক থিও হার্নান্দেজ ও ইতালিয়ান রাইটব্যাক ডেভিড ক্যালাব্রিয়া– দুজনই নিজ নিজ পজিশনে ইতালিয়ান ফুটবলে নিজেদের অপ্রতিদ্বন্দ্বী করে তুলেছেন। আক্রমণের সময় থিও হার্নান্দেজ বা ডেভিড ক্যালাব্রিয়া দুই উইংয়ে চলে যান, মিডফিল্ডারদের জন্য পাসিং ট্রায়াঙ্গেল তৈরি করেন। উইং থেকে বল ডি-বক্সের মধ্যে পাঠানো তথা নিখুঁত ক্রসের জন্য বর্তমানে গোলের সুযোগ তৈরির ক্ষেত্রে দুজন ফুলব্যাক দারুণ ভূমিকা পালন করছেন।
image source: sempremilan.com
তবে পিওলির গেমপ্ল্যানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে ফ্রাঙ্ক কেসি-ইসমাইল বেন্নাসের জুটির। ফ্রাঙ্ক কেসি মৌসুমের শুরু থেকেই একাদশে ছিলেন, আরেকটি জায়গার জন্য লড়াই হয়েছে তরুণ সান্দ্রো তোনালি ও ইসমাইল বেন্নাসেরের মধ্যে। এসি মিলানের ডিফেন্সের সামনে দেয়াল হয়ে দাঁড়ানো এই জুটি প্রতিপক্ষের আক্রমণ রুখে দিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে। দুই ফুলব্যাক ডেভিড ক্যালাব্রিয়া ও থিও হার্নান্দেজ আক্রমণের সময় উপরে চলে গেলে কেসি কিংবা বেন্নাসেরের মধ্যে একজন ব্যাকলাইনে চলে আসেন, আরেকজন হোল্ডিং মিডফিল্ডারের দায়িত্ব পালন করেন, প্রতিপক্ষের ১০ নাম্বারকে কড়া মার্কিংয়ে রাখেন।
এছাড়া প্রতিপক্ষ যখন প্রেস করতে থাকে, তখন এই জুটির মধ্যে একজন ডিপ-লায়িং প্লেমেকার বা রেজিস্তার দায়িত্ব পালন করেন, চালহানোগলু, রেবিচ কিংবা সায়েলমায়েকার্সদের বল জোগান দেন। প্রতিপক্ষ যখন এসি মিলানের অর্ধে আক্রমণে আসে, তখন দুজন মিলে ডিফেন্সিভ থার্ডের একটু উপরে অবস্থান নিয়ে প্রতিপক্ষের আক্রমণের জায়গা সংকুচিত করে ফেলেন। এ কারণে বর্তমান এসি মিলানের বিপক্ষে সেটপিসে গোল দেয়া অত্যন্ত দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ফ্রাঙ্ক কেসি-ইসমায়েল বেন্নাসের জুটি ডিফেন্সিভ থার্ডের একটু উপরে থাকায় এসি মিলানের মিডফিল্ডে প্রচুর জায়গা ফাঁকা থাকে, যেগুলোতে মিলানের তিনজন অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার আক্রমণের সময় প্রতিপক্ষের মার্কিংকে ফাঁকি দিয়ে সঠিক অবস্থান নিতে পারেন। জার্মান ক্লাব বায়ার লেভারকুসেন থেকে যোগ দেয়া তুর্কি প্লেমেকার হাকান চালহানোগলু সেন্টার অ্যাটাকিং মিড হিসেবে পিওলির ফর্মেশনে থাকলেও বাস্তবে তিনি ফ্রি-রোলে খেলে থাকেন। গোলের সুযোগ তৈরিতে দারুণ সৃজনশীলতার পরিচয় দেয়ার জন্য পিওলির অধীনে তিনি তার প্রতিভার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে পারছেন। ইউরোপের সবচেয়ে বেশি সুযোগ তৈরি করা মিডফিল্ডারদের মধ্যে বর্তমানে হাকান চালহানোগলু অন্যতম।
চালহানোগলুর দুই পাশে পর্তুগিজ ইয়াংস্টার রাফায়েল লিয়াও কিংবা আন্তে রেবিচ, ব্রাহিম দিয়াজ কিংবা সায়েলমায়েকার্স থাকেন। রিয়াল মাদ্রিদ থেকে লোনে যাওয়া ব্রাহিম দিয়াজ ইতালিতে এই মৌসুমে ভালো পারফর্ম করছেন। রাফায়েল লিয়াও মূলত অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হলেও ইব্রাহিমোভিচ ইঞ্জুরি ও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে তার জায়গায় সেন্টার ফরোয়ার্ড হিসেবে খেলেছেন, গোলও করেছেন। সিরি আ-র ইতিহাসে সবচেয়ে দ্রুত গোল করে জানান দিয়েছেন, তিনি ফরোয়ার্ড হিসেবেও কম যান না।
ইউরোপের বিভিন্ন লিগে নিজেকে প্রমাণ করা ইব্রাহিমোভিচ গত মৌসুমে আমেরিকার মেজর সকার লিগের ক্লাব এলএ গ্যালাক্সি থেকে ফ্রি ট্রান্সফারে যোগ দেন তার পুরনো ক্লাবে। এর আগে যখন এসেছিলেন, তখন এসি মিলান ইউরোপের পরাশক্তিগুলোর একটি ছিল। কিন্তু এবার যখন আসলেন তখন রসোনেরিরা নিজেদের পুরনো গৌরব ফিরিয়ে আনার মিশনে নেমেছিল। ৩৯ বছর বয়সী এই তারকা এই মৌসুমে ইঞ্জুরিতে পড়ার আগে সিরি আ-তে সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন।
বয়স ৩৯ বছর হলেও এরিয়াল বল রিসিভ ও কন্ট্রোলের ক্ষেত্রে এখনও পৃথিবীর সেরা ফরোয়ার্ডদের একজন ইব্রাহিমোভিচ। আটালান্টা কিংবা লাৎসিওর মতো যেসব প্রতিপক্ষ খুব বেশি প্রেসিংয়ের কৌশল অবলম্বন করে, সেসব দলের বিপক্ষে এসি মিলানের ডিফেন্ডাররা কিংবা গোলকিপার জিয়ানলুইজি ডোনারুম্মা বল সোজাসুজি লংকিকের মাধ্যমে ইব্রাহিমোভিচের কাছে পাঠিয়ে দেয়। যেহেতু এরিয়াল বলের ক্ষেত্রে ইব্রাহিমোভিচের দক্ষতা সর্বজনবিদিত, তাই ইব্রাহিমোভিচ তার পজিশন থেকে সরে এসে বল রিসিভ করে ফাঁকা জায়গায় দাঁড়ানো মিডফিল্ডারদের কাছে বল পাঠিয়ে দেন। মাঠের খেলা দিয়ে আসলে ইব্রাহিমোভিচকে বিচার করলে একটু ভুল হবে। একেবারে তরুণ খেলোয়াড়দের নিয়ে গড়া এসি মিলানের দলটিতে দরকার ছিল একজন যোগ্য নেতার। ইব্রাহিমোভিচের বিশেষত্বটা ঠিক এখানেই, তিনি সামনে থেকে দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
অর্ধেক সিজন শেষ হয়ে গিয়েছে, সিরি আ-র পয়েন্ট টেবিল অনেক উত্থান-পতনের স্বাক্ষী হয়েছে এই মৌসুমে। প্রায় এক দশক ধরে চলা তুরিনের জুভেন্টাসের একাধিপত্য ভেঙে এখন পর্যন্ত পয়েন্ট টেবিলে তাদের চেয়ে উপরের অবস্থানে আছে রসোনেরিরা। স্টেফানো পিওলির অধীনে এসি মিলানের বর্তমান দলটি একটি অপ্রতিরোধ্য দলে পরিণত হয়েছে। এই মৌসুমে ইতালিয়ান ফুটবলের সর্বোচ্চ পর্যায়ের শিরোপা ইব্রাহিমোভিচদের হাতে উঠবে কি না, তা সময়ই বলে দিবে। কিন্তু আধা যুগের অচলায়তন ভেঙে যে তারা আবারও নিজেদের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছেন, একজন এসি মিলান সমর্থকের চোখের শান্তি আনতে এই বিষয়টিই যথেষ্ট। স্টেফানো পিওলির শিষ্যরা আরেকবার ইউরোপে রাজত্ব করলে অবাক হওয়ার কিছুই নেই।
This is a Bengali article discussing how Pioli has taken AC Milan towards a positive outcome.
Reference:
১) Stefano Pioli – AC Milan – Tactical Analysis
২) Tactical Analysis: Stefano Pioli’s Milan
৩) AC Milan Tactical Analysis: How Pioli has led the ambitious AC Milan on their way to resurgence?