Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

যে অচেনা আগন্তুক বদলে দিলেন গোটা আর্জেন্টিনাকে

আর্জেন্টিনার এই দলের দায়িত্ব নিয়ে সাম্পাওলি যেন তার জীবনের সবথেকে বড় ভুল করেছিলেন। বাউজা-র ব্যর্থতাকে নতুন জীবন দিতে এই দলের দায়িত্ব হাতে নিতে হয়েছিল তাকে। কিন্ত দলকে সাজাতে গিয়ে তার হাঁসফাঁস অবস্থা। সামনে বিশ্বকাপ, অতএব এক পাহাড়-সমান চাপ। কিন্তু যে দলটা নিয়ে তিনি রাশিয়া পাড়ি জমালেন, সেটার কোমর প্রথম ম্যাচেই আইসল্যান্ড ভেঙে দিল। এরপর হাঁচড়ে-পাঁচড়ে পরের রাউন্ডে গিয়ে রাশিয়ার কাছে হেরে বিশ্বকাপ-স্বপ্ন এবং সাম্পাওলির চাকরি সবকিছুই শেষ। 

ব্যর্থতার তলানীতে থাকা এক দল তখন তুলে দেওয়া হলো লিওনেল স্কালোনি নামক এক অখ্যাত কোচের কাছে। এতদিন তিনি ছিলেন সাম্পাওলির সহকারী কোচের দায়িত্বে। তাই প্রধান কোচ হিসেবে এই আর্জেন্টিনাই তার প্রথম মিশন।

Image Credit: AFA

স্কালোনিকে আর্জেন্টিনার দায়িত্ব দেবার খবরে পুরো আর্জেন্টাইন গণমাধ্যম ফেটে পড়েছিল ক্ষোভে। স্বয়ং ম্যারাডোনা তো স্কালোনিকে এক হাত নিয়ে নিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন,

‘ওকে আমি আমার দলে চাই না। সে তো ট্র্যাফিকই ঠিকমতো পরিচালনা করতে পারবে না।’

– ডিয়েগো ম্যারাডোনা, প্রয়াত আর্জেন্টাইন কিংবদন্তী

অনেকে ভেবেছিল, স্কালোনি আর্জেন্টিনার সাথে টিকতেই পারবেন না। হয়তো তার সময়কাল হবে মাত্র কয়েক মাস। কিন্তু সেই অখ্যাত স্কালোনি আর্জেন্টিনার সাথে রইলেন টানা চার বছরের মতো। অন্তর্বর্তীকালীন কোচ থেকে তাকে বানানো হয়েছে প্রধান কোচ। তার অধীনে এক প্রজন্মের আক্ষেপের সমাপ্তি টেনে আর্জেন্টিনা জিতেছে কোপা আমেরিকা, এরপর ইতালির সাথে ফিনালিসিমা। 

ফিনালিসিমা জেতার পথে; Image Credit: AP

কিন্তু গল্পটা এখানেই শেষ নয়। ২০১৪ সালের পর আরও একবার বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলবে স্কালোনির শিষ্যরা। সে বিশ্বকাপ খেলার গল্পে আবার কী নেই! আবেগ-রোমাঞ্চের সাথে ইতিহাস; গল্পটা তো কোনো থ্রিলার উপন্যাসকেও হার মানায়।

আর্জেন্টিনাকে নিয়ে স্কালোনির যাত্রা শুরু হয়েছিল মেক্সিকোর বিপক্ষে এক প্রীতি ম্যাচ দিয়ে। এরপর চোখের পলকে ২০১৯ সালের কোপা আমেরিকা হাজির। কলম্বিয়ার বিপক্ষে ২ গোলে হেরে সেবারের কোপা যাত্রা শুরু তাদের। পারফরম্যান্সের দিক দিয়েও আর্জেন্টিনার শুরটা হয়েছিল বেশ ছন্নছাড়া। তাও দেশকে নিয়ে কোপার সেমিফাইনাল পর্যন্ত যেতে পারলেন স্কালোনি। প্রতিপক্ষ ব্রাজিল; জেসুস আর ফিরমিনো দুটো গোলে আর্জেন্টিনার কোপার ফাইনালে ওঠার স্বপ্ন সেখানেই শেষ। কিন্তু ঐ ব্রাজিলই শেষ; দিন যায়, বছর যায়, আর্জেন্টিনা আর ম্যাচ হারে না।

খালি চোখে আর্জেন্টিনা দলটা দেখতে তেমন আকর্ষণীয় নয়। ব্রাজিল, ইংল্যান্ড, বা ফ্রান্স দলে যেমন তারকার মেলা, স্কালোনির দলে সেই তারকা আদতে আসলে একজনই – লিওনেল মেসি। কিন্তু গোলবারে দিবু, ডিফেন্সে লিসান্দ্রো, ও ক্রিশ্চিয়ান রোমেরো, মিডফিল্ডে পারেদেস বা ডি পল যেন মেসির যোগ্য সহচর। প্রথাগত তারকা খেলোয়াড় না থাকলেও এই দল যখন মাঠে নামে, দলগত পারফরম্যান্স দিক থেকে আর্জেন্টিনার চেহারা ভোজবাজির মতো বদলে যায়। এজন্যই টানা ৩৬ ম্যাচ অপরাজিত থাকার পর আর্জেন্টিনা যখন কাতার বিশ্বকাপে গেল, তখন তারা বিশ্বকাপ জেতায় অন্যতম বড় দাবিদার। সাধারণ ফুটবল সমর্থক থেকে ইউরোপের ফুটবলবোদ্ধারা আর্জেন্টিনাকেই এবারের বিশ্বকাপের সবথেকে বড় ফেভারিট হিসেবে মেনে নিয়েছিল।

বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচ সৌদি আরবের বিপক্ষে। শক্তিমত্তায় আর্জেন্টিনা যোজন যোজন এগিয়ে। শুরুটাও মন্দ হলো না স্কালোনির দলের। প্রথমার্ধেই লিওনেল মেসির পেনাল্টিতে আর্জেন্টিনা এগিয়ে। ম্যাচটা তাদের খুব সহজেই বের করে নিতে পারার কথা। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধ শুরুতেই পাশার দান উলটে গেল। সৌদি আরব যেন পেয়েছে পরশ পাথরের ছোঁয়া। আর সেই ছোঁয়াতেই মরুর এই দেশ যেন শিখে গেছে আর্জেন্টিনাকে আটকানোর গোপন কৌশল।

পরপর ২ গোল; এমনকি দুটো গোল দেবার পরও সৌদি আরব যেন আরও মরিয়া। অপরপাশে আকস্মিক গোল খেয়ে আর্জেন্টিনা একেবারেই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এজন্য এই ম্যাচে ফিরতে ফিরতে তাদের কেটে গেল প্রায় ২৫ মিনিট। কিন্তু সৌদি আরবের ঐতিহাসিক গল্পে তখন আরও কিছু অধ্যায় লেখা বাকি। শেষের দিকে আর্জেন্টিনার বেশ কয়েকটি আক্রমণ ঠেকিয়ে দিলেন সৌদি আরবের গোলরক্ষক। এবং দুই যুগের বেশি সময় পর আর্জেন্টিনা তাদের বিশ্বকাপ যাত্রা শুরু করলো হার দিয়ে।

আর্জেন্টিনা তাদের বিশ্বকাপ যাত্রা শুরু করলো সৌদি আরবের কাছে হার দিয়ে; Image Credit: Getty Images

ফেভারিটের তকমা থেকে আর্জেন্টিনাকে ‘ওভাররেটেড’ তকমা দিতে এক মুহূর্ত লাগল না। প্রশ্ন উঠতে লাগল আর্জেন্টিনার গোলরক্ষক ও ডিফেন্ডার নিয়ে। খেলোয়াড়দের সমালোচনা ছাড়াও স্কালোনির ফুটবল কৌশল নিয়ে আঙুল উঠতে লাগলো বারবার। সামনের দুই ম্যাচে প্রতিপক্ষ মেক্সিকো এবং পোল্যান্ড। পরের রাউন্ডে যেতে হলে আর্জেন্টিনাকে জিততে হবে দুটো ম্যাচেই। এমন সমীকরণ যখন সামনে, ফেভারিট তকমা পেয়ে আসা আর্জেন্টিনাকে তখনই পারলে বিমানের ফিরতি টিকেট কেটে দেয়া হয়। তবে ফেভারিট তকমা পেয়ে আসা একটা দলের প্রথমেই হেরে আসার মতো ঘটনা দলের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে বাধ্য। হয়তো অনেকে নিজেদের উপর ভরসা হারিয়ে গোটা দলকে নিয়ে ফেলতেন খাদের কোণায়। কিন্তু আর্জেন্টিনা তাদের স্বপ্ন থেকে এক মুহূর্তের জন্যও পিছু হটেনি। স্বপ্ন স্পর্শ করার মিশনে, গোটা দলকে এক সুতোয় গেঁথে রেখেছিলেন তাদের কোচ – লিওনেল স্কালোনি।

সৌদি আরবের সাথে লজ্জাজনক হারের পর লিওনেল মেসি বলেছিলেন, 

“আমি সমর্থকদের বলবো, আমাদের উপর আস্থা রাখতে। আমরা আপনাদের হতাশ করবো না।’’

– লিওনেল মেসি, আর্জেন্টাইন ফুটবলার

মেক্সিকোর সাথে দ্বিতীয় ম্যাচ। স্কালোনি তার দলে বেশ কয়েকটি পরিবর্তন আনলেন, পালটে গেল তাদের ছকও। তবুও হুট করে মেসিরা আশাব্যঞ্জক ফুটবল খেলতে পারেনি। মধ্যমাঠের বোঝাপড়া ঠিক করতে সময় লেগেছে। সময় লেগেছে মেক্সিকোর রক্ষণ দেয়াল ভাঙতে। এরপর ভিনগ্রহের ঐ আর্জেন্টাইনের পায়ের জাদু। মেসি এক গোল করলেন, এনজোকে দিয়ে আরেক গোল করালেন। মেসি এবং গোটা আর্জেন্টিনা যে মিথ্যা আশ্বাস দেয়নি, সেটার প্রমাণ মেসি নিজের হাতেই দিয়ে দিলেন।

স্কালোনির ফুটবল কৌশল জটিল গোছের কিছু নয়। কিন্তু মাঠে অবস্থা বুঝে তার পরিবর্তনগুলো বেশ কার্যকরী। অস্ট্রেলিয়া এবং পোল্যান্ডের সাথে লিসান্দ্রোকে তিনি নামাননি। এমন না যে লিসান্দো যে একাদশে জায়গা পাবার মতো ডিফেন্ডার নন। তবে পোল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার খেলোয়াড়দের উচ্চতা ও হেডে গোল করার নমুনা দেখে স্কালোনি রোমেরোকে জায়গা দিয়েছেন একমাত্র উচ্চতার জন্য। কিন্তু যখন ছকে বদল আনার প্রয়োজন হয়েছে তখন লিসান্দ্রোকে ঠিকই নামিয়েছেন তিনি।

তেমন জটিল কিছু নয় স্কালোনির ফুটবল কৌশল; Image Credit: AFA

ফুলব্যাকের ডানপাশে একবার মন্তিয়েল তো অন্যদিন মোলিনা। বামপাশেও আকুনা এবং তাহলিয়াফিকোকে তিনি নামিয়েছেন ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে। বেনফিকার তরুণ মিডফিল্ডার এনজোকে এবার দেন বক্স-টু-বক্স রোল। সেদিন এনজো বারবার প্রতিপক্ষের হাফ-স্পেস সীমানা দিয়ে ছুটে চলেন। বারবার ডি-বক্সের বাইরে থেকে জোরালো শট নেন। আবার সেই এনজোই খেলেন হোল্ডিং মিডফিল্ডার পজিশনে। তাকে দেখা যায় ৪-৪-২ ছকে নামানো দুই ডিফেন্ডারের সাথে জোট বেঁধে তিনজনের রক্ষণ দেয়াল গড়ে তুলতে। স্কালোনির কৌশল এবং একাদশ বাছাই যেন এক ধুম্রজাল। আগে থেকে নিশ্চিত কিছু ভেবেছেন তো মরেছেন।

তবে বিশ্বকাপে কৌশলগত মারপ্যাঁচের দারুণ এক উদাহরণ তিনি দিয়েছেন ডাচদের ম্যাচের বিপক্ষে। ম্যাচের আগে সংবাদ সম্মেলনে ফন হাল থেকে ডাচ গোলরক্ষক মেসি এবং আর্জেন্টিনার এক হাতে সমালোচনা করেছিলেন। কিন্তু স্কালোনি তেমন কোনো উত্তরই দেয়নি। তার কথা ছিল, আর্জেন্টিনা সবকিছুর জবাব মাঠেই দেবে। 

ফন হাল সাধারণত ৩-৫-২ ছকে খেলান। এই কৌশলে উপরে থাকা দু’জন স্ট্রাইকার মেমফিস এবং গাকপো কখনও নিচে নামেন না। প্রতিপক্ষের আক্রমণের সময়ও এই দু’জন মাঝমাঠের অনেক উপরেই থাকেন। এজন্য নিজেদের পায়ে বল এলে একটা লং বলে গাকপো এবং মেমফিসের গোল পাবার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। প্রথাগত ৪-৩-৩ ছকে খেললে এই দু’জন স্ট্রাইকারের বিপরীতে ডিফেন্ডার মাত্র থাকে দু’জন। দু’জনের বিপরীতে দু’জনের রক্ষণভাগ বেশ বিপদজনক। এজন্য স্কালোনি আর্জেন্টিনাকে খেলালেন ৩-৫-২ ছকে। নিচ থেকে লং বল অথবা ডামফ্রিস এবং মেমফিসের বোঝাপড়া সেদিন আর হলো না একমাত্র স্কালোনির কৌশল বদলে ফেলানোর জন্য। ফন হালের কথার বিপরীতে স্কালোনি ঠিকই মাঠে উত্তর দিলেন। যদিও প্রতিপক্ষের কৌশল বুঝে এমন পরিবর্তন স্কালোনি বিশ্বকাপের প্রায় প্রতিটি ম্যাচেই করেছেন। এজন্য তাকে এবারের বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা ‘ট্যাকটিক্যাল কোচ’ খেতাব দিলেও বিশেষ ভুল হবে না।

Image Credit: AFP/JUAN Mabromata

৩৬ বছর ধরে আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জেতে না। ম্যারাডোনা ঐ অ্যাজটেকে শেষ বিশ্বকাপ উচিয়ে ধরলেন, এরপর দুটো বিশ্বকাপ ফাইনালে উঠলেও খুব কাছে গিয়েও ঐ সোনালী ট্রফি আর ঘরে তোলা হয়নি তাদের। অনেক আর্জেন্টিনা সমর্থক এই বিশ্বকাপ-খরাকে মনে করেন ‘তিলকারার অভিশাপ’-এর ফলাফল।

তিলকারার ‘ভার্জিন অফ কোপাকাবানা’র মূর্তিকে সেখানকার মানুষ প্রচণ্ড ভক্তি করে। প্রচলিত আছে এই মূর্তির সামনে গিয়ে কেউ যদি মন থেকে কিছু চায়, তাহলে সে অবশ্যই তা পায়। কিন্তু একটি শর্ত আছে, এই মূর্তির সামনে গিয়ে কোনো কথা দিয়ে আসলে, সেটা অবশ্যই রাখতে হবে। ১৯৮৬ সালে ম্যারাডোনার দল এই মূর্তি দর্শন করতে গিয়েছিল। চেয়েছিল বিশ্বকাপ জিততে পারার আশীর্বাদ। সাথে প্রতিশ্রুতি ছিল, বিশ্বকাপ জিততে পারলে আবার এই মূর্তির সামনে এসে কৃতজ্ঞতা জানাবে তারা। কিন্তু আর্জেন্টিনা দল আর কখনোই তিলকারাতে ফেরত যায়নি।

তিলকারা; Image Credit: Mandy Pirch

লোকে বলে, এই অভিশাপের ফলই আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ-খরা। আরও একবার স্কালোনির নেতৃত্বে মেসির দল বিশ্বকাপ ফাইনালে। ঘুচিয়েছেন আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ-খরা। কিছুদিন আগে আর্জেন্টিনার ফুটবল-প্রধান ক্লাদিও তাপিয়া গিয়েছিলেন তিলকারা। অভিশাপ বলে যদি কিছু থাকে, তাহলে তিনি হয়তো পুরো দলের হয়েই শাপমোচন করে এসেছেন। আর শূন্য থেকে উঠে এসে লিওনেল স্কালোনি আর্জেন্টিনাকে ঢেলে সাজিয়েছেন, প্রাণ সঞ্চার করেছেন। এক নতুন আর্জেন্টিনা, স্কালোনির আর্জেন্টিনা, অভিশাপমুক্ত আর্জেন্টিনা।

আর্জেন্টিনার ভাগ্য পাল্টনোর জন্য প্রথম ধন্যবাদটা অবশ্যই লিওনেল স্কালোনির প্রাপ্য।

This article is in Bangla language. It is about Lionel Scaloni, the argentine coach who stepped up at the lowest of Argentina and brought them up to the world cup final 2022.

Featured Image: GettyImages

Related Articles