বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল)-এর পর্দা নেমেছে। এবার সময় হয়েছে প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তির খাতা খুলে দেখার। যেখানে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সাফল্য আর ব্যর্থতার খাতায় নাম লিখিয়েছেন দেশি ও বিদেশি; উভয় ক্রিকেটাররাই। ব্যাটম্যানদের হিসেব-নিকেশের খাতায় সেরা পাঁচে এগিয়ে আছে বিদেশি ক্রিকেটাররা। স্থানীয় ক্রিকেটারদের মধ্যে দেশসেরা 'হাই প্রোফাইল'দের অনেকেই তেমন কোনো সুবিধা করতে পারেননি।
টুর্নামেন্ট শুরুর আগেই যেভাবে ক্রিকেটবিশ্বে বিতর্কের মুখোমুখি হচ্ছিল এবারের বিপিএল, বেলাশেষে তাতে সাফল্যের রঙ লেগেছে অনেকখানি। তারপরও কিছু তো না পাওয়ার বেদনা আছেই।
নিষেধাজ্ঞার কারণে দেশের ক্রিকেটের পোস্টারবয় সাকিব আল হাসানের 'শো' দেখতে না পাওয়ার আফসোস থাকবেই সবার মাঝে। দীর্ঘদিন পর বিপিএলে ব্যাটিংয়ের সেরা পাঁচের তালিকা থেকে ছিটকে পড়েছেন তামিম ইকবাল। ইমরুল কায়েসের ফর্ম ফিরে পাওয়া, নাজমুল হাসান শান্ত'র ঝড় তোলা সেঞ্চুরি, কিংবা মুশফিকের দুই রানের জন্য সেঞ্চুরি না পাওয়া; সবই মনে রাখার মতো ছিল। ছিল আরও নানান ঘটনা।
সবকিছু পিছনে ফেলে টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টের মূল আকর্ষণ ব্যাটিং। চলুন, দেখে নেওয়া যাক, কেমন ছিল এবারের বিপিএলের সেরা পাঁচ ব্যাটসম্যানদের অবস্থা।
রাইলি রুশো
বঙ্গবন্ধু বিপিএলে পুরো টুর্নামেন্টজুড়ে রাইলি রুশোর রানের খাতার পৃষ্ঠা সবচেয়ে ভর্তি। টুর্নামেন্টের রানার্সআপ দল খুলনা টাইগার্সের এই সাবেক প্রোটিয়া ব্যাটসম্যান ৪৫.০০ গড়ে ১৪ ম্যাচে তুলেছেন সর্বমোট ৪৯৫ রান। স্ট্রাইকরেটেও এগিয়ে সবার চেয়ে, সেটি ১৫৫.১৭। সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ৭১ রানের অপরাজিত ইনিংসের সাথে রয়েছে মোট চারটি হাফ সেঞ্চুরি তুলে নেওয়ার অর্জন।
দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে জাতীয় দলে সর্বশেষ ২০১৬ সালে মাঠে নামা এই ক্রিকেটার দেশটির হয়ে খেলেছেন ৩৬ ওয়ানডে এবং ১৫টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ। বঙ্গবন্ধু বিপিএলজুড়ে ফর্মের তুঙ্গে থাকা এই ক্রিকেটার সামনে এবার জাতীয় দলের দরজাটা খোলে কি না, সেটাই দেখার বিষয়।
মুশফিকুর রহিম
দারুণ কেটেছে মুশফিকের বিপিএল। অধিনায়ক হিসেবে ফাইনাল খেলা, প্রথমবারের মতো শিরোপা জয়ের খুব কাছে যাওয়া। কিন্তু শেষ হাসিটা হাসা হয়নি তার দল খুলনা টাইগার্সের। থামতে হয়েছে রানার্সআপ হয়েই। দেশসেরা এই উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান ফাইনাল ম্যাচ পর্যন্ত টুর্নামেন্ট সেরা হওয়ার দৌড়েও এগিয়েও ছিলেন। যদিও তা হয়নি, সেই পুরস্কার জিতেছেন শিরোপাজয়ী দলের অধিনায়ক আন্দ্রে রাসেল।
১৪ ম্যাচে ৭০.১৪ গড়ে মুশফিকুর রহিমের সংগ্রহ ছিল ৪৯১। স্ট্রাইক রেট ১৪৭.০০, সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংসটি ছিল অপরাজিত ৯৮ রানের। বিপিএলে এ বছরের প্রথম সেঞ্চুরিয়ান ও ক্যারিয়ারের প্রথম টি-টোয়েন্টি সেঞ্চুরি পেতে পারতেন মুশফিক। কিন্তু আদতে তা হয়নি। টুর্নামেন্টজুড়ে রুশোর মতো তার নামের পাশেও যোগ হয়েছে চারটি হাফসেঞ্চুরি।
তবে এই আসরে নিজের ও স্থানীয় ক্রিকেটারদের পারফরম্যান্স নিয়ে বেশ সন্তুষ্ট মুশফিক। ফাইনাল ম্যাচে রানার্সআপ হওয়ার পর আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন,
আইপিএলের পর এটি বিশ্বের সেরা লিগগুলোর একটি। নাম যদি বলেন, এখানে অনেক বড় বড় ক্রিকেটার খেলেন। বিশ্বমানের ক্রিকেটারদের সঙ্গে খেলে আমাদের অনেক উন্নতি হয়েছে। এবার উইকেটগুলো ভালো ছিল। স্থানীয় ক্রিকেটাররা ভালো করেছে। অনেক ইতিবাচক দিক আছে। পরের মৌসুম থেকে যদি আমাদের পারিশ্রমিক আরেকটু বাড়ে, তাহলে আরও ভালো কিছু হবে আশা করি।
এবার রান পাওয়ার পিছনে উইকেটকে বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন খুলনার অধিনায়ক। প্রশংসায় ভাসিয়েছেন কিউরেটরদের,
কিউরেটদের অভিনন্দন জানাই। এক-দুই ম্যাচ ছাড়া প্রায় পুরো টুর্নামেন্ট আমরা ভালো উইকেট পেয়েছি। যদি অন্য বিপিএলের সঙ্গে তুলনা করেন, ব্যাটসম্যানদের স্ট্রাইক রেট দেখেন, বোলারদের ইকোনমি দেখেন। দেশের বাইরে খেলতে গেলে এমন উইকেটেই খেলতে হবে। ব্যাটসম্যানদের জন্য রান থাকবে, বোলারদের জন্য উইকেট নেওয়ার কিংবা রান আটকানোর চ্যালেঞ্জ থাকবে। কেবল স্পোর্টিং উইকেটে খেলেই সম্ভব সেসব চ্যালেঞ্জের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া।
লিটন দাস
এবারের বিপিএল দিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন লিটন দাস। ১৫ ম্যাচে মোট ৪৫৫ রান সংগ্রহ করে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের তালিকায় রয়েছেন তৃতীয় অবস্থানে। শিরোপাজয়ী রাজশাহী রয়্যালসকে ফাইনালে নেওয়ার সফরে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তিনি। ম্যাচ প্রতি ৩২.৫০ গড় এবং স্ট্রাইকরেট ১৩৪.২১। সর্বোচ্চ রানের ইনিংস ৭৫। তিনটি হাফ সেঞ্চুরি থাকলেও, নেই কোনো সেঞ্চুরির মাইলফলক।
বাংলাদেশ জাতীয় দলের এই উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান নিজের ব্যাটিংয়ের ব্যাখ্যা দিয়েছেন এভাবে,
টেকনিক একটু বদলেছে। আগে এভাবে ব্যাটিং করতাম না। নিলের (জাতীয় দলের ব্যাটিং কোচ ম্যাকেঞ্জি) সঙ্গে অনেক দিন কাজ করেছি। আমার পা ঠিক না, মাথার অবস্থান একটু বদলেছে। আগে দুই-তিন ম্যাচে আমার মাথার অবস্থান ঠিক ছিল না। এই জিনিসটা নিয়ে কাজ করছি যাতে মাথার অবস্থান এলোমেলো না হয়।
তিনি আরও বলেন, আগের বিপিএলে মারলে মারতেই থাকতাম। সব ধরনের শট খেলতে পারি, যে কারণে সব শটই খেলতে চাই। এ বিপিএলে অনেক শট কমিয়ে দিয়েছি। আগে ১৫ বলে ২৭-৩০ রান থাকত। তবে আউট হয়ে যেতাম। এবার ১৫ বলে ১৭ বা ১৩ থাকছে। পাওয়ার প্লেতে বোলাররা সবসময়ই ব্যাকফুটে থাকে। আমি যদি একটা বাউন্ডারি মেরে দিই অবশ্যই বোলার চিন্তায় পড়ে যায় যে পরের বলে ব্যাটসম্যান কী করতে পারে। এখানে নিজেকে একটু বদলেছি যে, সব ধরনের শট খেলা যাবে না, শট বেছে খেলতে হবে।'
শোয়েব মালিক
এবারের বিপিএলটা শোয়েব মালিকের জন্য স্পেশাল হয়েই থাকবে। চ্যাম্পিয়ন দল রাজশাহী রয়্যালসের হয়ে মাঠে নামা সাবেক এই পাকিস্তানি অধিনায়ক ১৫ ম্যাচে ৩৭.৯১ গড়ে তুলেছেন লিটনের সমান ৪৫৫ রান। সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংস ৮৭ রানের। রয়েছে তিনটি হাফসেঞ্চুরি।
পাকিস্তানি অলরাউন্ডারের জন্য বিপিএলটি স্পেশাল এই কারণে যে, এই টুর্নামেন্টের পাফরম্যান্সের সুবাদেই তিনি ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারির পর প্রথম আবারও তিনি টি-টোয়েন্টি জাতীয় দলে জায়গা করে নিতে পেরেছেন। বাংলাদেশের বিপক্ষে তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজে জায়গা হয়েছে তার।
সাবেক সতীর্থ ও পাকিস্তান দলের বর্তমান প্রধান নির্বাচক মিসবাহ-উল-হক মালিকদের দলে ফেরানোর ব্যাপারে বলেছেন,
যে সময়ে সে (শোয়েব মালিক) দল থেকে বাদ পড়লো, তখন আমরা একবারও বলিনি যে পুনরায় তাদেরকে দলে নেওয়া হবে না হ্যাঁ, এটা ঠিক যে আমরা আমাদের দলের একটা টেকসই পুল তৈরির চেষ্টা করছি যেখানে শোয়েব মালিক-মোহাম্মদ হাফিজের জায়গা হয়নি। কিন্তু দেরিতে হলেও তাদের অভিওজ্ঞতা পাকিস্তান দলের কাজে লাগছে। সে কারণেই তাদেরকে দলে ফেরানো।
ডেভিড ম্যালান
ইংলিশ টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান ডেভিড ম্যালান এবারের আসরে পঞ্চম সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রান সংগ্রাহক। বিপিএলে কুমিল্লা ওয়ারিয়র্সের ছিটকে পড়ার আগ পর্যন্ত তিনি খেলেছেন ১৩ ম্যাচ। যেখানে ১৪৫.০৯ স্ট্রাইকরেটে ৪৯.৩৩ গড়ে মোট ৪৪৪ রান সংগ্রহ করেছেন। ম্যালান এই আসরে সেরা ইনিংসটি খেলেছেন অপরাজিত ১০০ রানের। এই সেঞ্চুরির পাশাপাশি তার নামের পাশে যোগ হয়েছে আরও তিনটি হাফসেঞ্চুরি।
This is the article based on the most run-scorers in Bangabandhu BPL. All the necessary links have been hyperlinked.
Feature Image: Daily Star/ Firoz Ahmed