Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কেমন ছিল গার্দিওলার অধীনে বায়ার্ন মিউনিখ?

সম্প্রতি উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতে ইউরোপের শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট জয় করে নিয়েছে জার্মান ফুটবলের পরাশক্তি বায়ার্ন মিউনিখ। এ মৌসুমের শুরুর দিকে নিকো কোভাচ যখন বায়ার্নের কোচ ছিলেন, তখনও খোদ বায়ার্ন ভক্তদেরও যদি জিজ্ঞেস করা হতো এই মৌসুমে বায়ার্ন ইউ সি এল জিততে পারবে কি না, ভক্তরা হয়তো দ্বিধামিশ্রিত হাসি দিয়ে বলতেন, ‘নাহ, এবারেও সম্ভব নয় বোধহয়!’

কিন্তু নিকো কোভাচ ক্লাবের দায়িত্ব ছাড়ার পর হান্সি ফ্লিক যখন দায়িত্ব নিলেন, তখনই বায়ার্নের জন্য পুরো চিত্রটাই পাল্টে গেল লিগে ও ইউরোপের সবচেয়ে বনেদি আসরে। দায়িত্ব নিয়ে মাত্র দশ মাসের মধ্যে বায়ার্নকে জিতিয়েছেন চ্যাম্পিয়নস লিগ এবং নিজেদের ক্লাব ইতিহাসের দ্বিতীয় ট্রেবল। প্রথম ট্রেবল এসেছিল ২০১২-১৩ মৌসুমে, ইয়ুপ হেইংকেস যখন কোচ। সেবারের পর ইউসিএল জিততে বায়ার্নকে অপেক্ষা করতে হলো সাতটি বছর। মাঝে সুযোগ এসেছিল ইউসিএল জেতার বৈকি, কিন্তু শিরোপার খুব কাছে গিয়েও হারতে হয়েছে তাদের।

ইউসিএলে আধিপত্য ধরে রাখতে বায়ার্ন মিউনিখের কোচ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় বার্সেলোনার সদ্য সাবেক হওয়া কোচ পেপ গার্দিওলাকে। তিন ফুটবল মৌসুমে সাতটি ট্রফি; বায়ার্ন মিউনিখে পেপ গার্দিওলা যে দারুণ সফল ছিলেন, তা মানতে আপত্তি থাকার কথা নয় কারোরই। 

বায়ার্ন মিউনিখের হয়ে প্রথমদিনে পেপ গার্ডিওলা

বায়ার্ন মিউনিখের ড্রেসিংরুমে পেপ গার্দিওলার প্রথম দিন; Image Source: Bleacher Report

যখন ঘোষণা করা হলো যে বার্সেলোনার সাবেক কোচ পেপ গার্দিওলা বায়ার্ন মিউনিখের সদ্য ট্রেবলজয়ী কোচ ইয়ুপ হেইংকেসের উত্তরসূরী হতে যাচ্ছেন, গোটা ফুটবল বিশ্ব বেশ চমকে গিয়েছিলো। সাগ্রহে তারা পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করতে থাকে বায়ার্ন মিউনিখের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ঠিক কী হতে চলেছে তা নিয়ে। একে তো মাত্রই ট্রেবল জিতে সংবাদ শিরোনামের নিয়মিত নাম হয়ে গিয়েছিল বায়ার্ন মিউনিখ। তার ওপর তাদের ছিল প্রবল সম্ভাবনাময় তরুণ ও অভিজ্ঞতার মিশেলে দুর্দান্ত একটি দল। এবার সেই দলের কোচ হতে যাচ্ছেন বার্সেলোনার অন্যতম সফল কোচ। বাভারিয়ার দিকে মনোযোগ দেওয়া ছাড়া উপায়ই বা কী ফুটবলবোদ্ধাদের!

কাতালান কোচের সিভিটাও বেশ ভারী। টানা তিনবার বার্সেলোনাকে লা লিগা জিতিয়েছেন, জিতিয়েছেন দুইটি চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপা। বায়ার্ন মিউনিখেও যে তিন মৌসুম দায়িত্বে ছিলেন, সেই তিন মৌসুমে প্রায় পার্ফেকশন’-এর কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছিলেন দলকে। দায়িত্বে থাকা তিন মৌসুমের প্রতিটিতেই জিতেছিলেন বুন্দেসলিগার শিরোপা। তিনি বায়ার্ন মিউনিখের ইতিহাসে একমাত্র বিদেশি কোচ, যিনি তিনবার লিগ শিরোপা জিতেছেন, তাও বিরতিহীনভাবে। লিগ শিরোপা ছাড়া ডিএফবি পোকাল কাপের শিরোপাও জিতেছেন দু’বার।

তবে এই স্ট্যাটসটুকু দেখেই পুরো গল্পটা আন্দাজ করতে পারবেন না। গল্পে অনেকখানি আফসোসও রয়ে গেছে। সব ট্রফি জিতলেও বায়ার্ন মিউনিখের হয়ে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপা কখনো জিততে পারেননি পেপ গার্ডিওলা। অথচ ‘ডাই রোটেন’দের ভক্তদের পেপ গার্দিওলার কাছে এই শিরোপাটির জন্যই আবদার ছিল সবচেয়ে বেশি।

২০১২-১৩ মৌসুমের শুরুতেই যখন ইয়ুপ হেইংকেস ঘোষণা দিয়েছিলেন যে তিনি এই মৌসুমের পরেই অবসরে যাচ্ছেন, উলি হোয়েনেস এবং কার্ল হেইঞ্জ রুমেনিগেকে খুব বেশি ভাবতে হয়নি আসলে পরবর্তী কোচ কে হবেন তা নিয়ে।  পরিকল্পনা যেন আগে থেকেই করা ছিল। বায়ার্ন মিউনিখের বোর্ড প্রেসিডেন্ট উলি হোয়েনেস বলেছিলেন,

“ইয়ুপ হেইংকেসের যোগ্য উত্তরসূরির প্রশ্নে পেপ গার্দিওলা ছাড়া আর কোনো উত্তর থাকতে পারে না।”

২০১৩ সালের জানুয়ারিতে পেপ গার্দিওলাকে যেদিন বায়ার্ন মিউনিখের কোচ হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেওয়া হয়, সেদিন উলি হোয়েনেস আরও বলেছিলেন,

“পেপ গার্দিওলা বিশ্বের সবচেয়ে সফল কোচদের একজন। আমরা নিশ্চিত, বায়ার্ন মিউনিখে পেপ গার্দিওলা সফল হবেন। বায়ার্ন এবং জার্মান ফুটবল উভয়ের জন্যই পেপ গার্দিওলা আশীর্বাদের মতো আবির্ভূত হবেন বলেই আমরা বিশ্বাস করি।”

৬ মাস পর জুলাই মাসে পেপ গার্দিওলা বাভারিয়ার মাটিতে পা রাখেন।  পেপ গার্দিওলার প্রথম প্রেস কনফারেন্স, কানায় কানায় পূর্ণ অ্যালিয়াঞ্জ অ্যারেনার অডিটোরিয়াম। বছরের সেরা ম্যানেজারিয়াল সাইনিং বলে কথা! পেপ গার্দিওলা দেখেছিলেন কিছুদিন আগেই ওয়েম্বলিতে হয়ে যাওয়া বরুশিয়া ডর্টমুন্ড ও বায়ার্ন মিউনিখের মধ্যকার উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনাল ম্যাচ, সাক্ষী হয়েছিলেন বায়ার্ন মিউনিখের ঐতিহাসিক ট্রেবল জয়ের। সেদিন ইয়ুপ হেইংকেসের সাথে তার দেখা হয়েছিলো।  স্মিত হেসে তিনি পেপ গার্দিওলাকে জার্মান ভাষায় বলেছিলেন, “Guten Tag und Grüß Gott” – বাংলায় যার অর্থ অনেকটা এরকম দাঁড়ায়, “শুভ সকাল, তোমার দিন শুভ হোক।”  

পেপ গার্দিওলা বায়ার্ন মিউনিখের দায়িত্ব বুঝে পাওয়ার সাথে সাথেই মাঠে এবং মাঠের বাইরে তার প্রভাব খুব দ্রুত টের পেতে শুরু করেন ভক্ত-সমর্থকরা।

বায়ার্ন মিউনিখের কোচ হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার পর এবং ডাগআউটে বসা, মাঝে তিনি ছয় মাস সময় পেয়েছিলেন। এই ছয় মাসে তিনি তার পরবর্তী দলটিকে নিয়ে প্রতিনিয়ত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন। কোন খেলোয়াড়টিকে মাঠের কোন পজিশনে খেলালে তার কাছ থেকে আদায় করে নেওয়া যাবে সেরা পারফরম্যান্স, বা নিজের ট্যাকটিক্সে ভবিষ্যতে প্রয়োজন হতে পারে যেসব খেলোয়াড়দের, এই সময়টাতেই তিনি তার অনেকখানি ছকই কষে রেখেছিলেন। তবে এই সময়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি তিনি করেছেন, তা হলো জার্মান ভাষাটা ভালোভাবে রপ্ত করে নিয়েছেন। যেকোনো দেশের আবহাওয়া ও মানুষের সাথে মিশতে হলে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হলো দেশটির স্থানীয় ভাষা শিখে নেওয়া। এতে করে দেশ, দেশের মানুষ ও সংস্কৃতির সাথে মিশে যাওয়া যায়। বায়ার্ন মিউনিখের সেই দলের অর্ধেকই জার্মান খেলোয়াড় ছিলেন – ফিলিপ লাম, বাস্তিয়ান শোয়াইনস্টাইগার, ম্যানুয়েল নয়্যার, জেরোমে বোয়াটেং, হোলডার ব্যাডস্টুবার, থমাস মুলার, এমরে চান, টনি ক্রুস, মারিও গোমেজ। তাই জার্মান ভাষাটা তিনি শিখে নিয়েছিলেন, যাতে খেলোয়াড়দের সাথে মিশতে পারেন, তাদের বুঝতে ও নিজের ভিশন সম্পর্কে বোঝাতে পারেন।

প্রথম প্রেস কনফারেন্সে পেপ গার্দিওলা বলেছিলেন,

“আমি প্রস্তুত। বার্সেলোনায় আমার সময়টা খুব ভালো গিয়েছে। কিন্তু আমি নতুন চ্যালেঞ্জ খুঁজছিলাম। বায়ার্নে সেই সুযোগ আমি পেয়েছি।”

পেপ গার্দিওলা চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা কতটা করতে পারেন এবং কতটা প্রস্তুত ছিলেন, তার পরীক্ষা নেওয়ার সুযোগ খুব দ্রুতই এসে গিয়েছিল ফুটবল বিশ্বের কাছে। পেপ গার্দিওলার প্রথম ম্যাচটিই ছিল ডিএফএল সুপার কাপের ম্যাচটি, বায়ার্ন মিউনিখের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের বিপক্ষে। কিন্তু শুরুটা ভালো হয়নি মোটেই, ৪-২ গোলে বায়ার্ন মিউনিখ হেরে যায় ইয়ুর্গেন ক্লপের শিষ্যদের কাছে। দু’মাস আগে চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল হারের ঘা তখনও দগদগে বরুশিয়া ডর্টমুন্ড ভক্তদের মনে। সেই ম্যাচ জিতে কিছুটা প্রতিশোধ নিতে পেরেছিল ডর্টমুন্ড। 

ডিএফএল সুপার কাপের ম্যাচে ইয়ুর্গেন ক্লপ ও পেপ গার্দিওলা প্রথম মুখোমুখি হন; Image Credit: Sky Sports

তবে খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয় নিজেকে প্রমাণ করতে; উয়েফা সুপার কাপের ম্যাচেই সেই সুযোগ পেয়ে যান গার্দিওলা। উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ী দল ও উয়েফা ইউরোপা লিগজয়ী দলের মধ্যে যে ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হয়, সেটিই উয়েফা সুপার কাপ হিসেবে পরিচিত। উয়েফা সুপার কাপের ম্যাচে দীর্ঘদিনের শত্রু জোসে মরিনহোর চেলসিকে পেনাল্টি শ্যুটআউটে হারায় গার্দিওলার শিষ্যরা। ফলে প্রথম জার্মান ক্লাব হিসেবে উয়েফা সুপার কাপ জয়ের গৌরব অর্জন করে বায়ার্ন মিউনিখ। উয়েফা সুপার কাপের ইতিহাসে এটিই প্রথম ম্যাচ ছিল, যেটির ফল পেনাল্টি শ্যুটআউটের মাধ্যমে নির্ধারণ হয়েছিল। 

পেপ গার্দিওলা প্রথম মৌসুমের প্রথম ১৮টি ম্যাচের মধ্যে ১৫টি ম্যাচই জিতেছিলেন, যেটি বায়ার্ন মিউনিখের ক্লাব ইতিহাসের সেরা সূচনাগুলোর একটি। ৩-০ গোলে বরুশিয়া ডর্টমুন্ডকে, ৪-০ গোলে শালকে এবং ৭-০ গোলে ওয়ের্দার ব্রেমেনকে হারানো – এই স্কোরলাইনগুলো বায়ার্ন মিউনিখের ঐ মৌসুমের পারফরম্যান্স কতটা বিধ্বংসী ছিল, তার কয়েকটি নমুনামাত্র। 

পেপ গার্দিওলা তার বার্সেলোনার সাবেক শিষ্য থিয়েগো আলকান্তারাকে মিউনিখ শিবিরে ভেড়াতে একপ্রকার জোর-জবরদস্তিই করেছিলেন কার্ল হেইঞ্জ রুমেনিগে ও উলি হোয়েনেসের সাথে। তাই গার্দিওলার ইচ্ছার সম্মান রাখতে বাধ্য হয়েই থিয়েগো আলকান্তারাকে সাইন করায় বায়ার্ন মিউনিখ।

থিয়েগো ছিলেন গার্দিওলার ৪-১-৪-১ ফর্মেশনের পিভট বা মাঝমাঠের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়। থিয়েগোকে দলে এনে ঠকতে হয়নি, ফ্রাংক রিবেরি, টনি ক্রুস, মারিও গোৎজে, থমাস মুলার, আরিয়েন রোবেনের সাথে ভয়ঙ্কর কার্যকর এক মিডফিল্ড তৈরি হয় বায়ার্নে। বাস্তিয়ান শোয়াইনস্টাইগার ও ফিলিপ লামের ওপর চাপ কিছুটা কমে আসে থিয়েগোর জন্য, আরও বেশি ফ্লেক্সিবল হয়ে যায় বায়ার্নের ডিফেন্স। থিয়েগো আলকান্তারাকে ইনজুরি অবশ্য ভুগিয়েছে। প্রথম মৌসুমের শেষদিক থেকে ৪-২-৩-১ ফর্মেশনে খেলতে অভ্যস্ত হয়ে যায় বায়ার্ন মিউনিখ। প্রথম মৌসুমে গার্দিওলার মূল অস্ত্র ছিল রোবেন ও রিবেরি।

থিয়েগো আলকান্তারাকে ২৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে বার্সেলোনা থেকে নিজেদের ক্লাবে ভেড়ায় বায়ার্ন; Image Credit: Paul White/Associated Press

লিগে দুর্দান্ত সময় কাটালেও পেপ গার্দিওলার জন্য আসল পরীক্ষা অপেক্ষা করেছিল উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগে। চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে বায়ার্ন মিউনিখের প্রতিপক্ষ ছিল পেপ গার্দিওলার সাবেক দলের চিরশত্রু রিয়াল মাদ্রিদ। দুই লেগ মিলিয়ে ৫-০ গোলে মাদ্রিদের কাছে লজ্জাজনকভাবে হেরে যায় বায়ার্ন মিউনিখ। গার্দিওলা যখন বার্সেলোনার কোচ ছিলেন, সে সময়ে লিগে রিয়াল মাদ্রিদ খুব একটা সুবিধা করতে না পারলেও বায়ার্ন মিউনিখকে হারিয়ে তারা যেন পেপ গার্দিওলার উপরে এক প্রকার প্রতিশোধ তুলে নেয়। যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চাইলো, পেপ গার্দিওলাকে আরও অনেকটা লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে নতুন চ্যালেঞ্জে জয়ী হতে হলে।  

উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগে রিয়াল মাদ্রিদের কাছে শোচনীয় পরাজয় হলেও লিগে তার ছাপ পড়েনি একদমই।  মাত্র ২৭টি ম্যাচ খেলেই বুন্দেসলিগার শিরোপা নিশ্চিত করে বায়ার্ন মিউনিখ। এত দ্রুত কখনোই কোনো দল বুন্দেসলিগার শিরোপা জিততে পারেনি। মৌসুমশেষে রেকর্ড ৯০ পয়েন্ট ও দ্বিতীয় স্থানে থাকা বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের থেকে রেকর্ড ১৯ পয়েন্টের ব্যবধানে লিগ শেষ করে বায়ার্ন মিউনিখ। মোট ৯৪টি গোল করেছিল বায়ার্ন। এক কথায়, বুন্দেসলিগায় রেকর্ডের বন্যা বইয়ে দিয়েছিল পেপ গার্দিওলার বায়ার্ন মিউনিখ। 

দ্বিতীয় মৌসুমের শুরুতেই বরুশিয়া ডর্টমুন্ড থেকে ফ্রিতে বায়ার্ন মিউনিখে যোগ দেন বুন্দেসলিগার অন্যতম সেরা খেলোয়াড় রবার্ট লেভানডস্কি। রবার্ট লেভানডস্কি বায়ার্নে যোগ দেওয়ার পর বায়ার্ন মিউনিখের ফ্রন্টলাইন নতুন এক চেহারা ধারণ করে। ১৮ নম্বর ম্যাচে গিয়ে হারার আগে, দ্বিতীয় স্থানে থাকা উলফসবার্গের সাথে ততদিনে বায়ার্নের পয়েন্ট ব্যবধান দাঁড়িয়েছে ১১, রবার্ট লেভানডস্কি বল পায়ে আগুনের তুফান ছোটাচ্ছেন, ৭টি গোল করা হয়ে গিয়েছে তার এরই মধ্যে। তখনও পেপ গার্দিওলা উলফসবার্গকে ঠিক আমলে নিচ্ছিলেন না, কিন্তু উলফসবার্গের কাছে ৪-১ গোলে হারার পর পেপ গার্দিওলা একটা ‘রিয়েলিটি চেক’ পান; বিশেষ করে জোড়া গোল করেছিলেন বলে কেভিন ডি ব্রুইনের নাম ভালোমতো মাথায় গেঁথে যায় তার। এরপর তিনি যখন ম্যানচেস্টার সিটির দায়িত্ব নেন, কেভিন ডি ব্রুইনকে সেখানে তিনি শিষ্য হিসেবে পেয়েছিলেন। 

ফ্রি ট্রান্সফারে বরুশিয়া ডর্টমুন্ড থেকে মিউনিখে যোগ দেন রবার্ট লেভানডস্কি; Image Credit: Matthias Schrader/Associated Press

জার্মানির মাটিতে বায়ার্ন যে কারও ধরাছোঁয়ার বাইরে তখন। লিগ প্রায় একচেটিয়াভাবে নিয়ন্ত্রণ করে যাচ্ছিল তারা। কিন্তু উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগে ভাগ্যটা এবারও সঙ্গ দিল না পেপ গার্দিওলার। চ্যাম্পিয়নস লিগে এবারও সেমিফাইনালে ওঠে বায়ার্ন মিউনিখ, আর এবার তাদের প্রতিপক্ষ গার্দিওলার সাবেক দল বার্সেলোনা। ক্যাম্প ন্যু’তে বার্সেলোনার কাছে ৩-০ গোলে হেরে যায় বায়ার্ন মিউনিখ। ঘরের মাঠে ঘুরে দাঁড়ানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিল বায়ার্ন; ৩- ২ গোলে ম্যাচ জিতলেও দুই লেগ মিলিয়ে সম্মিলিত ৫-৩ গোলের ব্যবধানে ফাইনালে চলে যায় বার্সেলোনা। সে বছর অবশ্য জুভেন্টাসকে ৩-১ গোলে হারিয়ে বার্সেলোনাই চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপা উঁচিয়ে ধরেছিল। এভাবেই সাবেক ক্লাবের কাছে সেমিফাইনালে হেরে দ্বিতীয় কোনো ক্লাবের সাথে পেপ গার্দিওলার চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার স্বপ্নটা ধূলিস্মাৎ হয়ে যায়। এর প্রভাব পড়ে সে বছরের ডিএফবি পোকাল কাপেও, সেমিফাইনালে পেনাল্টি শ্যুটআউটে বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের কাছে হেরে বিদায় নেয় বায়ার্ন মিউনিখ। সবাইকে চমকে দিয়ে ডর্টমুন্ডকে হারিয়ে পোকাল কাপের শিরোপা জিতে নেয় কেভিন ডি ব্রুইনের উলফসবার্গ।

বায়ার্ন মিউনিখে পেপ গার্দিওলার তৃতীয় ও শেষ মৌসুমেও কিছু রেকর্ড করেছিল বায়ার্ন মিউনিখ। টানা ১০টি ম্যাচ জিতেছিল বায়ার্ন মিউনিখ, ১১ নম্বর ম্যাচে গিয়ে আইনট্রাখ্ট‌্‌ ফ্রাংকফুর্টের সাথে ড্র করার আগে। সেবারেও বোঝা যাচ্ছিল, এইবারও বুন্দেসলিগার শিরোপা বায়ার্ন মিউনিখের কাছেই থেকে যাবে। কিন্তু ইউরোপের বড় মঞ্চে কি এবার কিছু করে দেখাতে পারবেন গার্দিওলা? আগের দু’বার থেকে তিনি কি শিক্ষা নিয়েছিলেন? গার্দিওলার হাতে কী রয়েছে চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার জন্য বিকল্প কোনো উপায়? সেমিফাইনালে যখন এইবারেও প্রতিপক্ষ পড়লো আরেক স্প্যানিশ ক্লাব অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ, গার্দিওলা ও বায়ার্ন মিউনিখকে ঘিরে এই প্রশ্নগুলোই ঘুরপাক খাচ্ছিল বারবার। এবারই গার্দিওলার সামনে বায়ার্নকে ইউসিএল জেতানোর শেষ সুযোগ।

কিন্তু বিধি বাম। ডিয়েগো সিমিওনের শাণিত ফুটবল-মস্তিষ্কের কাছে পরাজিত হতে হয় গার্দিওলাকে। ১-০ গোলে অ্যাটলেটিকোর মাঠে হারায়, ঘরের মাঠে ২-১ গোলের জয় বিফলে যায়, অ্যাওয়ে গোলের নিয়মানুযায়ী ফাইনাল খেলে অ্যাটলেটিকো। অবশ্য রিয়াল মাদ্রিদের কাছে হেরে রানার্সআপ হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিলো তাদের। 

হ্যানোভারের সাথে ৩-১ গোলে জিতে টেবিলের শীর্ষে থেকে লিগ শেষ করে বায়ার্ন। ১০২ লিগ ম্যাচে ৮২টি ম্যাচে জয় পেয়েছিল ক্লাবটি। 

শতকরার হিসেবে পেপ গার্দিওলা রেকর্ড ৮৫ শতাংশ ম্যাচ জিতেছিলেন ২০১৩/১৪ সালে। পরবর্তীকালে হ্যান্সি ফ্লিকের অধীনে এই রেকর্ড অবশ্য ভেঙে যায় ২০১৯-২০ মৌসুমে। দায়িত্ব নেওয়ার পর হান্সি ফ্লিক সব ধরনের কম্পিটিশন মিলিয়ে মোট ৩৫টি ম্যাচের মধ্যে ৩২টিই জিতেছেন।

গার্দিওলার বায়ার্ন ১০২ লিগ ম্যাচে ২৫৪ গোল করেছিল, যেটি বুন্দেসলিগা রেকর্ড। তিন মৌসুমে গোল হজম করতে হয়েছিল ৫৮টি, প্রতি ম্যাচে ০.৬ গড়ে। পেপ গার্দিওলার অ্যাটাকিং লাইনআপ যতটা বিধ্বংসী ছিল,সেই তুলনায় অনেকখানিই দুর্বল ছিল তার ডিফেন্স। উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের ম্যাচের ফলগুলো তার সাক্ষ্যই দেবে। অথচ এরকম ডিফেন্স নিয়েও গার্দিওলার বায়ার্নের ছিল দুর্দান্ত ডিফেন্সিভ রেকর্ড, তিন মৌসুমে মোট ৫৯টি ক্লিনশিট।

গার্দিওলা ট্যাকটিক্স নিয়ে নিরীক্ষা চালাতে ভালোবাসেন। শেষ মৌসুমের অনেকগুলো ম্যাচে ২-৩-৫ ফর্মেশনে বায়ার্নকে খেলান তিনি। যে কারণে তাকে সমালোচনা শুনতে হয়েছিলো সাবেক বায়ার্ন কোচ ওটোমার হিৎজফেল্ডের কাছেও। অবশ্য প্লেয়ারদের ইনজুরিতে পড়ার কারণেও তাকে নানারকমভাবে দল সাজাতে হয়েছে। তবে গার্দিওলার সবচেয়ে বড় উপহার জার্মান ফুটবলের জন্য ইয়োশুয়া কিমিখ। স্বভাবগতভাবে মিডফিল্ডার হলেও গার্দিওলা কিমিখকে প্রায়ই রাইটব্যাকে খেলিয়েছেন। রাইটব্যাকে কিমিখের খেলা দেখে বায়ার্ন ভক্তরা তাকে ফিলিপ লামের উত্তরসূরী বলে আখ্যা দিয়ে থাকেন।

পেপ গার্দিওলার অধীনে ব্যাপক পরিবর্তন ও উন্নতি সাধিত হয় ইয়োশুয়া কিমিখের; Image Credit: Sky Sports

বায়ার্ন মিউনিখের এবারের ইউসিএল জয়ের অন্যতম দুই নায়ক রবার্ট লেভানডস্কি ও থমাস মুলার পেপ গার্দিওলার অধীনেই সবচেয়ে বেশি উন্নতি করেছিলেন। লিগে পোলিশ অধিনায়কের ৩০ গোল, মুলারের ২০ গোল, ৭ অ্যাসিস্ট লেভানডস্কি ও মুলারের সেরা পারফরম্যান্স ছিল ২০১৫-১৬ সালে, গার্দিওলার শেষ মৌসুমে।

বায়ার্ন মিউনিখকে মোট সাতটি ট্রফি জিতিয়ে, তিন মৌসুম পুরোপুরিভাবে শেষ করে ম্যানচেস্টারের নীলরঙা ক্লাবের দায়িত্ব নিতে সেখানে পাড়ি জমান পেপ গার্দিওলা। শেষ ট্রফিটি ছিল ডিএফবি পোকাল কাপের শিরোপা, বরুশিয়া ডর্টমুন্ডকে পেনাল্টি শ্যুটআউটে ৪-৩ গোলে হারিয়ে জয় নিয়েই বায়ার্ন মিউনিখের ম্যানেজারিয়াল ক্যারিয়ারের সমাপ্তি টানেন পেপ গার্দিওলা।

তবে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের পরপর তিন সেমিফাইনালে তিনটি ভিন্ন স্প্যানিশ দলের কাছে হারাটা এতটাই দৃষ্টিকটু যে বায়ার্নের হয়ে তার সাফল্য অনেকটা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েই থেকে যায়। বারবার ট্যাকটিক্সে পরিবর্তন, খেলোয়াড়দের ঘন ঘন ইনজুরিতে পড়া, প্লেয়ারদের বিভিন্ন পজিশনে খেলানোর চেষ্টা, রোবেন-রিবেরি ইনজুরিপ্রবণ হওয়া সত্ত্বেও নতুন কোনো উইঙ্গার খুঁজে বের করতে না পারা, হাই-ডিফেন্সিভ লাইনে খেলা, টনি ক্রুসের মতো একজন খেলোয়াড়কে ধরে রাখতে না পারা, বড় ম্যাচের বিকল্প প্ল্যান না থাকা ইত্যাদি নানা কারণে বায়ার্ন মিউনিখের অনেক ভক্তরাই পেপ গার্দিওলার ওপর নাখোশ। তবে ভালো-মন্দ মিলিয়ে পেপ গার্দিওলার অধীনে বায়ার্নের তিনটি বছর মনে রাখার মতো ছিল, এটুকু হয়তো মানতে আপত্তি থাকার কথা নয় কারোরই।

This article is in Bangla language. It is about the Pep Guardiola era at Bayern Munich. Here, the success and failure at Bayern under Pep are highlighted with several facts and stats. Necessary references have been hyperlinked inside.

Featured Image: Goal.com

Related Articles