Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

যুদ্ধের ধ্বংসস্তুপ থেকে এশিয়ান কাপে যেভাবে এলো ইয়েমেন

২৭ মার্চ, ২০১৮; কাতারের দোহায় যুদ্ধবিধ্বস্ত ইয়েমেনের ফুটবল দল মাঠে নেমেছে দক্ষিণ এশিয়ার নেপালের বিপক্ষে। এশিয়া কাপ বাছাইপর্বের শেষ ম্যাচ এটি। বাছাইপর্বের লড়াইয়ে প্রতিপক্ষ নেপাল কিংবা অন্য যেকোনো প্রতিপক্ষের বিপক্ষে ইয়েমেনের কোনো খেলোয়াড়ই সম্ভবত তেমন একটা ভয়ে ছিল না। কারণ, প্রতিযোগিতার ফুটবল মাঠ পর্যন্ত তাদের এই দলটিকে পৌঁছাতে হয়েছে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে পরিবার-পরিজনকে রেখে, জীবন হাতে নিয়ে বিপদজনক পথ পাড়ি দিয়ে, এমনকি সহ-খেলোয়াড়দের লাশ পেছনে ফেলে।

এত আত্মত্যাগের পর ফুটবল মাঠে নামা দলটির বুকে প্রতিপক্ষ নিঃসন্দেহে কোনো ভয়ের কাঁপন ধরাতে পারেনি, সবচেয়ে কঠিন প্রতিপক্ষদের তো তারা সেই ইয়েমেনেই পরাজিত করে এসেছে। তাছাড়া, বাছাইপর্বের এই গ্রুপে ইয়েমেন তখন কোনো ম্যাচ না হেরে অপরাজিত! সত্যি বলতে দলটির হারানোর কিছু ছিল না, প্রতি ম্যাচ, প্রতিটি মুহূর্তই তাদের অর্জন। দোহার সুহেইম বিন হামাদ স্টেডিয়ামে নেপালের বিপক্ষে প্রথমার্ধে ১-১ গোলে সমতায় থাকা ইয়েমেন জয়সূচক গোলটি পায় ৮৪ মিনিটে পেনাল্টি থেকে। আব্দুলওয়েসেয়া আল-মাতারির দ্বিতীয় গোলের পর ম্যাচটি ২-১ গোলে জিতে নিয়ে ইয়েমেন অর্জন করে এশিয়া কাপ শিরোপার মূল পর্বের টিকিট। শেষ বাঁশি বাঁজার পর মাঠে দলটির ইথিওপিয়ান কোচ আব্রাহাম মেব্রাতুর বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস, খেলোয়াড় ও সমর্থকদের আনন্দের সাথে কোনো কিছু তুলনা হয় না। ১৯৯০ সালে উত্তর ও দক্ষিণ ইয়েমেনের পুনর্মিলনের পর, আন্তর্জাতিক কোনো বড় আসরে এটিই ইয়েমেনের প্রথম অংশগ্রহণের সুযোগ।

নেপালের বিপক্ষে ইয়েমেনের জয়ের নায়ক, মাতারি; Image Source: foxsportsasia.com

চার বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধে দেশটিতে প্রায় ৮০,০০০ মানুষ নিহত হয়েছে, ধ্বংস হয়ে গেছে অবকাঠামো ব্যবস্থা এবং দেখা দিয়েছে দুর্ভিক্ষ। একদিকে ইরান সমর্থিত হুথি বিদ্রোহী, অন্যদিকে পশ্চিমাদের মদদপুষ্ট সৌদি ও আরব আমিরাত জোটের ক্রমবর্ধমান সামরিক আগ্রাসন। সৌদি জোটের গোলাবর্ষণে অবকাঠামো তো ধ্বংস হয়েছেই, মানবিক সাহায্যের অপ্রতুলতায় দেশটির নাগরিকরা ভুগছে মারাত্মক খাদ্যাভাবে। প্রায় ১৩ মিলিয়ন মানুষ অনাহারে দিন কাটাচ্ছে, মৌলিক চিকিৎসার অভাবে কলেরার মতো রোগ মহামারীর রূপ নিচ্ছে। সবকিছুর ভয়ংকর প্রভাব পড়ছে বেসামরিক নাগরিকদের উপর। মধ্যপ্রাচ্যের সাম্প্রতিক সংকটগুলোতে যেমন দেখা যায়, ইয়েমেনেও তার ব্যতিক্রম নয়ই, বরং আরও বেশি সংকটে রয়েছে দেশটি। সৌদি জোটের আক্রমণ থেকে রেহাই পায়নি শিশুরাও, স্কুল বাসে তাদের মিসাইল হামলায় মারা যাওয়া ৪০ জনের সবার বয়স ছিল ৬-১১ বছর। সবমিলিয়ে দেশটি নরকে পরিণত হয়েছে।

ইয়েমেনের সাবেক কোচ মেব্রাতু, যার হাত ধরে ইয়েমেন জায়গা করে নিয়েছে এশিয়ান কাপে; Image Source: Hussein Sayed

‘নগরে আগুন লাগলে দেবালয় এড়ায় না’, তেমনি এই ধ্বংসযজ্ঞের আঁচড় ইয়েমেনের ফুটবলের উপরেও পড়েছে। ২০১৪ সালে তাদের লিগ বন্ধ হয়ে যায়। রাজধানী সানার বিমানবন্দরে গোলাবর্ষণের কারণে কোচ, খেলোয়াড় ও কর্মকর্তারা চাইলেও অনেক সময় তা ব্যবহার করতে পারেন না। বাধ্য হয়ে তাদের ধরতে হয় স্থলপথের আরও বিপদজনক পথ। ২০১৫ সালে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের একটি ম্যাচের পূর্বের ঘটনাতেই অনেকটা পরিষ্কার হয়ে যাবে, কী পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয় দেশটির ফুটবল দলকে। ম্যাচের জন্য খেলোয়াড়দের জড়ো হতে সময় লেগেছিল ৬ দিন। এই সময় তারা নিজ দায়িত্বে বিপদসংকুল পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছেছে নির্ধারিত গন্তব্যে। এরপর, নৌ-পথে ১৩ ঘণ্টা ভ্রমণের পর তারা জিবুতিতে পৌঁছায়। শেষপর্যন্ত, দোহায় অনুষ্ঠিত ম্যাচটিতে উত্তর কোরিয়ার বিপক্ষে দলটি মাত্র ১-০ গোলে পরাজিত হয়। বিভীষিকাময় এই পরিস্থিতিতে ফুটবলের কথা চিন্তা না করা গেলেও, ইয়েমেনের এই কঠিন সময়ে সামান্য আনন্দের সংবাদের উপলক্ষ হয়ে চলেছে এই ফুটবলই।

উত্তর কোরিয়ার বিপক্ষে বিশ্বকাপ বাছাই খেলতে ফেরিতে করে ইয়েমেন ছাড়তে হয়েছিল খেলোয়াড়দের; Image Source: bunkyo.info

তবে, ইয়েমেন ফুটবলে সমস্যা আগে ছিল না, এমন নয়। অবশ্য, এতটা প্রকট কখনোই ছিল না। উত্তর ও দক্ষিণ ইয়েমেন একত্রিত হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে বিদ্যমান সহিংসতা, আল কায়েদা ও অন্যান্য জঙ্গি গোষ্ঠীর কার্যক্রমে ইয়েমেন প্রায়শই উত্তপ্ত ছিল। এসব কিছুর সাথে ছিল কাত নামক একধরনের শক্তিবর্ধক পাতা, যা দেশটির অনেকেই চিবিয়ে গ্রহণ করতো। এই সমস্যায় ভুগছে ইয়েমেন ফুটবলও। কাত গ্রহণের দরুন ২০০৬ সালে এশিয়ান গেমসে ফুটবল দল কাতের কারণে ড্রাগ টেস্টে ব্যর্থ হয়েছিল এবং আসর থেকে বাদ পড়েছিল।

এই সমস্যার অনেকটা উন্নতি হয় ইয়েমেন ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের জেনারেল সেক্রেটারি হামিদ আল শাইবানির হাত ধরে। জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের কাত গ্রহণ নিষিদ্ধ করা হয় তখন। ২০১০ সাল আদেন ও নিকটবর্তী জিঞ্জিবারে নতুন স্টেডিয়াম তৈরির পাশাপাশি, গালফ কাপ টুর্নামেন্ট আয়োজন করে দেশটি, মাঠে যতটা সম্ভব ফুটবল ধরে রাখতে চেষ্টার কোনো কমতি রাখেনি তারা। সেই চেষ্টা অবশ্য বেশিদিন ধোপে টেকেনি। ২০১১ সালের দিকে জিঞ্জিবারের স্টেডিয়ামটি ইয়েমেন আর্মি আল-কায়েদার বিপক্ষে যুদ্ধ ও অস্ত্র সরবরাহকারী হেলিকপ্টারের অবতরণের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে শুরু করে। স্টেডিয়াম দখলের জন্য একটি সংঘর্ষে ৩০ জন যোদ্ধাসহ মারা যায় ৪৮ জন, সেই সাথে স্টেডিয়ামটিতে ফুটবলের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যায়। অন্যদিকে আদেনের মাঠটি ধ্বংস হয় যুদ্ধে কুয়েত ও সৌদির বিমান হামলায়। অস্থিতিশীল ইয়েমেনে ততদিনে কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচ আয়োজনের সুযোগ তো নেই-ই, সেই সাথে এই স্টেডিয়ামগুলো ধ্বংসের সাথে ইয়েমেনের ফুটবল অনেকটা সেদিনই সমাধিক্ষেত্রে পরিণত হয়।

যুদ্ধে ধ্বংস হয়ে যাওয়া আদেনের স্টেডিয়াম; Image Source: twitter.com

এশিয়ান কাপে এএফসি দল সংখ্যা বর্ধিত করে ২৪ দলের আসরে পরিণত করলেও, ইয়েমেনের জন্য এই আসরে অংশ নেওয়া সহজ ছিল না। আসরে তো দূরের কথা, বাছাইপর্ব খেলতে পারার সম্ভাবনা ছিল খুবই ক্ষীণ। কোচ আব্রাহাম মেব্রাতু অলিম্পিক দল নিয়ে কিছু সফলতা অর্জনের পর চেষ্টা করছিলেন জাতীয় দলটাকে আসরের বাছাইপর্বের জন্য কিছুটা হলেও তৈরি করে নিতে। স্থানীয়ভাবে ৪০ খেলোয়াড় সংগ্রহ করে ক্যাম্প করলেন তিনি, চেষ্টা করছিলেন যতটা সম্ভব ফুটবল খেলানো তার খেলোয়াড়দের দিয়ে। যেহেতু, ঘরোয়া লিগ ফুটবল বলতে তখন আর কিছু নেই তখন। তাই তিনি সেই ৪০ জনের স্কোয়াডটিকে ৩-৪টি দলে বিভক্ত করে প্র্যাকটিস ম্যাচের আয়োজন করে দলকে ফুটবল তথা বাছাইপর্বের জন্য তৈরির চেষ্টা করছিলেন। এখান থেকেই বেছে নেওয়া হয়েছিল এশিয়া কাপের বাছাইপর্বের জন্য দল।

মেব্রাতু কতটা সফল হয়েছিলেন, তা বাছাইপর্বে ইয়েমেনের পারফরম্যান্সই বলে দেয়। প্রথম ম্যাচেই দলটি তাজিকিস্তানকে পরাজিত করে ২-১ গোলে। জয় দিয়ে শুরু করা দলটি অবিশ্বাস্য পারফরম্যান্সের মাধ্যমে নেপালকে হারিয়ে বাছাইপর্ব শেষ করে জয় দিয়েই, মাঝের ৪টি ম্যাচ শেষ হয়েছিল ড্রতে। ঘরের মাঠ বলতে যখন কিছু ছিল না, সেহেতু হোম ম্যাচগুলো তাদের খেলতে হয়েছে ভিনদেশে। আগেই বলা হয়েছিল, দেশ থেকে খেলতে যাওয়ার যাত্রাও সহজ ছিল না। বাছাইপর্বের স্কোয়াডটির মধ্যে ৯ জন ইয়েমেনেই আটকা পড়েছিল, এমনকি যুদ্ধে কেউ কেউ নিহত এবং আহত হয়েই দল থেকে ছিটকে পড়েছিল। যাদের ভাগ্য খুব বেশি ভালো ছিল, শুধু তারাই নামতে পেরেছিল মাঠে।

এশিয়া কাপে ইরানের বিপক্ষে ইয়েমেন; Image Source: foxsportsasia.com

চলতি এশিয়ান কাপে ইয়েমেনের শুরুটা অবশ্য বাছাই পর্বের রূপকথার উপাখ্যানের মতো হয়নি, প্রথম ম্যাচে শক্তিশালী ইরানের সাথে ০-৫ গোলে ও দ্বিতীয় ম্যাচে ইরাকের সাথে ০-৩ গোলে পরজয়ের পর দ্বিতীয় পর্বের কোনো আশা আর অবশিষ্ট নেই। ইথিওপিয়ার জাতীয় দলের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য ইয়েমেন দল থেকে অব্যহতি দিয়েছেন মেব্রাতু, তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন ইয়ান কতসিয়ান। স্লোভাকিয়ান এই কোচের অধীনেই এবারের এশিয়ান কাপের যাত্রা শুরু করছিল ইয়েমেন দল। এশিয়া কাপে ইয়েমেনের অংশগ্রহণের অসাধারণ যাত্রার কিংবদন্তি দেশটি কিংবা দেশটির ফুটবল অঙ্গনে কতটা প্রভাব রাখবে, তা বলার সময় এখনও হয়নি। কিন্তু, মানবিক সংকটে ভোগা দেশটিতে হয়তো সামান্য আনন্দের উৎস আপাতত এই ফুটবলই; দেশটির জন্য যা একইসাথে একতা ও কিছুটা আশার প্রতীকও।

This article is in Bangla language. It is about Yemen football and how they had struggled to take part in Asian Cup. Necessary references have been hyperlinked.

Feature Image: foxsportsasia.com

Related Articles