১.
এখনও বিশ্বকাপ জয়ের রেশ কাটেনি ইংল্যান্ডের। এর মধ্যেই আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে লর্ডসে টেস্ট খেলতে নেমে পড়ে ইংল্যান্ড। এই লর্ডসেই নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে রুদ্ধশ্বাস এক ম্যাচে শিরোপা জিতেছিল স্বাগতিক ইংল্যান্ড। অ্যাশেজকে সামনে রেখে দলের বেশ কয়েকজন নিয়মিত সদস্যকে বিশ্রাম দিয়ে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে মাঠে নামে ইংল্যান্ড। ম্যাচের তৃতীয় দিনেই আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ১৪৩ রানের বড় জয় পায় ইংল্যান্ড। ফলাফল দেখে সবাই-ই বলবে, এটা তো অনুমেয় ছিল। বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতাই অর্জন করতে না পারা আয়ারল্যান্ডের এমন পরাজয়ে কপালে ভাজ ফেলবার কী আছে! কিন্তু ম্যাচের প্রথম দুই সেশনে দুর্দান্ত পারফর্ম করা আয়ারল্যান্ডের এমন পরাজয় বেশ হতাশাজনক।
লর্ডসে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে টসে জিতে প্রথমে ব্যাটিং করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের টেস্ট অধিনায়ক জো রুট। এই ম্যাচের মধ্য দিয়ে সাদা পোশাকে অভিষেক ঘটে জেসন রয়ের। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে দুর্দান্ত ব্যাটিং করে আসা এই ব্যাটসম্যান টেস্ট ক্রিকেটে কেমন করেন অ্যাশেজের আগে তা পরীক্ষা করে নিচ্ছিল ইংল্যান্ড। তবে প্রথম ইনিংসে খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি রয়। দলীয় আট রানে এবং ব্যক্তিগত পাঁচ রানে টিম মুরতাঘের প্রথমে শিকারে পরিণত হয়ে সাজঘরে ফেরেন তিনি। দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে জো ডেনলি এবং রোরি বার্ন্স ৩১ রান যোগ করে প্রাথমিক বিপর্যয় সামলানোর চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু ইংল্যান্ড-বংশোদ্ভূত আইরিশ পেসার মুরতাঘের দুর্দান্ত বোলিংয়ে ৩৬ রানে এক উইকেট থেকে ৪৩ রানে সাত উইকেট হারিয়ে বসে তারা।
টিম মুরতাঘ মাত্র ১৩ রানের বিনিময়ে পাঁচ উইকেট শিকার করে প্রথম আইরিশ বোলার হিসাবে টেস্ট ক্রিকেটে পাঁচ উইকেট তুলে নিয়ে লর্ডসের অনার্স বোর্ডে নাম লেখান। তার দুর্দান্ত বোলিংয়ে ইংল্যান্ড প্রথম ইনিংসে মাত্র ৮৫ রানে গুটিয়ে যায়। ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপজয়ী তিন সদস্যা জনি বেয়ারস্টো, মঈন আলী এবং ক্রিস ওকসকে রানের খাতাই খুলতে দেননি তিনি। শেষদিকে স্যাম কারেন ১৮ রান এবং ওলি স্টোন ১৯ রান করেও দলকে ১০০ রানের পুঁজি এনে দিতে পারেননি। ইংল্যান্ডের সাবেক টেস্ট ক্রিকেটার বয়েড র্যানকিন পাঁচ রানের বিনিময়ে দুই উইকেট শিকার করে তাদেরকে ৮৫ রানে আটকে রাখেন।
২.
৩৮ বছর বয়সী টিম মুরতাঘ ক্যারিয়ার সেরা সময় কাটিয়েছেন ইংল্যান্ডে কাউন্টি ক্রিকেট খেলে। লন্ডনে জন্মগ্রহণ করা এই পেসার ২০১১ সাল পর্যন্ত ইংল্যান্ডে ডাক পাওয়ার অপেক্ষা করেছিলেন। তারপরেও সুযোগ না পাওয়ার পর ত্রিশ পেরোনো মুরতাঘ আয়ারল্যান্ডে পাড়ি জমান এবং নিজের জন্মভূমির বিপক্ষে প্রথম টেস্টেই পাঁচ উইকেট শিকার করে অনার্স বোর্ডে নাম লেখান। তিনি এখন পর্যন্ত ২২৯টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ খেলে ৩৫ বার ইনিংসে পাঁচ উইকেট এবং চারবার ইনিংসে দশ উইকেট শিকার করে মোট ৮০৬ উইকেট শিকার করেছেন।
ইংল্যান্ডকে ৮৫ রানে অল আউট করে নিজেদের প্রথম ইনিংস দুর্দান্তভাবে শুরু করেছিল আয়ারল্যান্ড। স্বাগতিক ইংল্যান্ডকে কোণঠাসা করে দুই উইকেটে ১২৭ রান তুলে চা-বিরতিতে যায় তারা। এরপর অভিষিক্ত ওলি স্টোন এবং অভিজ্ঞ স্টুয়ার্ট ব্রডের গতি এবং সুইংয়ের সামনে দাঁড়াতে পারেনি আয়ারল্যান্ডের মিডল-অর্ডার এবং লোয়ার মিডল-অর্ডারের ব্যাটসম্যানরা। দুই উইকেটে ১৩২ রান থেকে ২০৭ রানেই গুটিয়ে যায় তারা। ইংল্যান্ডের তিন পেসার স্যাম কারেন, ওলি স্টোন এবং স্টুয়ার্ট ব্রড তিনটি করে উইকেট শিকার করেন।
৩.
লর্ডস টেস্টের প্রথম দিনের প্রথম সেশনে ৮৫ রানে গুটিয়ে যাওয়ার পর দ্বিতীয় সেশনে পিছিয়ে পড়েছিল ইংল্যান্ড। তবে শেষ সেশনে আট উইকেট তুলে নিয়ে প্রথম দিনেই দ্বিতীয় দফা ব্যাট করতে নামে ইংলিশরা। প্রথম ইনিংসে ১২২ রানে পিছিয়ে থাকা ইংল্যান্ড দিনের শেষ ওভার মোকাবেলা করার জন্য ব্যাটিংয়ে পাঠান প্রথম ইনিংসে এগারো নাম্বারে ব্যাট করা জ্যাক লিচকে।
দ্বিতীয় দিনের শুরুতে নিয়মিত ওপেনার রোরি বার্ন্স ছয় রান করে ফিরে গেলেও অভিষিক্ত জেসন রয়কে নিয়ে রানের চাকা সচল রেখেছিলেন লিচ। লিচের দুর্দান্ত সব কাভার ড্রাইভ এবং রয়ের ফ্লিক শটে ইংল্যান্ডের রানের গতি দ্রুত বাড়ছিল। সেই সাথে আইরিশ ফিল্ডারদের ক্যাচ মিসের মহড়া তো ছিলোই। তারা দুজন সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে ১৪৫ রান যোগ করেছিলেন। নাইটওয়াচম্যান হিসেবে ব্যাট করতে নামা জ্যাক লিচ ১৬২ বলে ৯২ রানের ইনিংস খেলেছিলেন এবং জেসন রয় করেছিলেন ৭৮ বলে ৭২ রান। তাদের বিদায়ের পর ইংল্যান্ডের মিডল-অর্ডার আবারও ব্যর্থ হন। এক উইকেটে ১৭১ রান থেকে ২৪৮ রান তুলতে আট উইকেট হারিয়ে বসে তারা। শেষদিকে স্যাম কারেনের ২৯ বলে ৩৭ রান এবং ব্রডের অপরাজিত ২১ রানের উপর ভর করে ইংল্যান্ড ৩০৩ রান সংগ্রহ করে, যার ফলে জয়ের জন্য আয়ারল্যান্ডের ১৮২ রান প্রয়োজন পড়ে।
৪.
টেস্ট ক্রিকেটে চতুর্থ ইনিংসে ১৮২ রান তাড়া করে জয় পাওয়া খুব একটা সহজ কাজ নয়। তাছাড়া স্বাগতিক ইংল্যান্ডের বোলিং অ্যাটাক যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল এবং আইরিশরা টেস্ট ক্রিকেটে এখনও হাঁটতে শিখেনি। ১৮২ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে ১১ রানের মাথায় অধিনায়ক উইলিয়াম পোর্টারফিল্ডের উইকেট হারায় আয়ারল্যান্ড। তখন ক'জনই ভেবেছিল সামনে কী অপেক্ষা করছে আইরিশদের সামনে। ক্রিস ওকস এবং স্টুয়ার্ট ব্রডের বিধ্বংসী বোলিংয়ে ১৮ রান থেকে ২৪ রান পর্যন্ত পৌঁছতে পাঁচ উইকেট হারায় তারা। রান সংখ্যা ২৪ এ রেখে আউট হয়েছিলেন তিন ব্যাটসম্যান। উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান গ্যারি উইলসন প্রথম ইনিংসের মতো দ্বিতীয় ইনিংসেও শূন্য রানে ফিরে গিয়েছিলেন। ইংল্যান্ডের উইকেটরক্ষক জনি বেয়ারস্টোও দুই ইনিংসে কোনো রান যোগ করতে পারেননি। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে এই প্রথম দুই দলের উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান দুই ইনিংসেই শূন্য রানে আউট হয়েছেন।
ক্রিস ওকস ১৭ রানে ছয় উইকেট এবং স্টুয়ার্ট ব্রড ১৯ রানের বিনিময়ে চার উইকেট শিকার করলে আয়ারল্যান্ড মাত্র ৩৮ রানে গুটিয়ে যায়। আয়ারল্যান্ড দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ৯৪ বলে (১৫.৪ ওভার) সবকটি উইকেট হারায়। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে সবচেয়ে কম বলে অল আউট হওয়ার দিক দিয়ে এটি যৌথভাবে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। এর চেয়ে কম বলে অল আউট হয়েছে শুধুমাত্র দক্ষিণ আফ্রিকা। তারা ১৯২৪ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মাত্র ৭৫ বলে অল আউট হয়ে যায়। আয়ারল্যান্ডের ৩৮ রান টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে সপ্তম সর্বনিম্ন সংগ্রহ। ১৯৫৫ সালের পর টেস্ট ক্রিকেটে এটিই সর্বনিম্ন দলীয় সংগ্রহ।
লর্ডস টেস্টে ইংল্যান্ড প্রথম ইনিংসে মাত্র ৮৫ রানে অল আউট হওয়ার পরও ১৪৩ রানের বড় ব্যবধানে জয় পেয়েছে। গত ১১২ বছরে টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম ইনিংসে এর চেয়ে কম রানে অল আউট হয়ে আর কোনো দল জিততে পারেনি। ইংল্যান্ড এই নিয়ে সাতবার নিজেদের প্রথম ইনিংসে একশো'র কমে অল আউট হয়েও ম্যাচ জিতেছে। আর কোন দল দুইবারের বেশি পারেনি। তারা ১৯৮৬/৮৭ মৌসুমে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম ইনিংসে ৪৫ রানে অল আউট হয়েও টেস্ট জিতেছিল।
অ্যাশেজের ঠিক আগমুহূর্তে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে একমাত্র টেস্টে ইংল্যান্ডে বোলাররা নিজেদের ঝালিয়ে নিলেও ব্যাটসম্যানরা তেমন সুবিধে করতে পারেনি। টেস্ট স্পেশালিষ্টের পাশাপাশি বিশ্বকাপজয়ী সদস্যরাও রানের মুখ দেখেনি। ম্যাচে সর্বোচ্চ ৯২ রানের ইনিংস খেলেছিলেন ম্যাচ সেরার পুরস্কার জেতা জ্যাক লিচ, যার মূল দায়িত্ব বোলিং। ব্যাটিংয়ে সফল হয়ে ম্যাচ সেরার পুরস্কার জিতলেও বল হাতে মাত্র তিন ওভার বল করে ২৬ রান দিয়ে উইকেটশূন্য ছিলেন, যার ফলে প্রথম অ্যাশেজ টেস্টের স্কোয়াডে রাখা হয়নি তাকে।
This article is in Bangla language. It is about the England vs Ireland Lord's Test Match Summary. For references please check the hyperlinks inside the article.
Featured Image: Getty Images