উইন্ডিজ ক্রিকেট দলে পাওয়েল নামের খেলোয়াড়ের অভাব নেই, গত দশকের মাঝামাঝিতে ড্যারেন পাওয়েল নামক এক বোলার বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। বর্তমান উইন্ডিজ দলেই তো দুজন পাওয়েল– একজন দলের ওপেনিং ব্যাটসম্যান কিয়েরন পাওয়েল, অন্যজন হার্ডহিটার মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান রোভম্যান পাওয়েল। তবে উইন্ডিজ ক্রিকেটে যে পাওয়েল সবচেয়ে বেশি আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন তিনি এই তিন ব্যক্তির কেউ নন, তিনি রিকার্ডো পাওয়েল।
নব্বইয়ের দশকের একদম শেষদিকে রাজকীয় এক অভিষেকের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখেন এই মারকুটে ব্যাটসম্যান। তার ক্যারিয়ারের শুরু দেখে অনেকেই ভেবেছিলেন, এবার বুঝি উইন্ডিজ আরো একজন বিশ্বমানের ব্যাটসম্যান পেতে যাচ্ছে। কিন্তু সেটা হয়নি! অল্প কিছুদিন পরে পথ হারিয়ে অকালেই ঝরে গিয়েছিলেন রিকার্ডো পাওয়েল।
আশির দশকের স্বর্ণযুগ পার করার পর উইন্ডিজ ক্রিকেটে বিশ্বমানের ব্যাটসম্যান সত্যিই সেভাবে আর উঠে আসেনি। ব্যতিক্রম শুধু একজন, তিনি ক্রিকেটের বরপুত্র ব্রায়ান চার্লস লারা। স্বভাবে ভীষণ খেয়ালি ধরনের হলেও সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এই বাঁহাতি স্টাইলিশ ব্যাটসম্যান। পরিস্থিতি বা উইকেট যা-ই হোক না কেন, নিজের দিনে লারা একাই ম্যাচ জিতিয়ে আনার সামর্থ্য রাখতেন। এ কারণে অনেকেই তাকে সর্বকালের সেরা ম্যাচ উইনার হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
২০০৭ সালে লারার অবসরের পর এমন আরেকজন বিশ্বমানের ব্যাটসম্যান হন্য হয়ে খুঁজে চলেছে ক্যারিবীয়রা। সেই কারণে নতুন কোনো তরুণ একটু ভালো খেললেই ক্যারিবীয়রা সাথে সাথেই লারার সাথে সেই তরুণের মিল খুঁজতে শুরু করে। ২০০৭ এর পর যত তরুণ ব্যাটসম্যান উইন্ডিজ দলে এসেছেন, তাদের মধ্যে ড্যারেন ব্রাভোর সাথেই লারার ব্যাটিং স্টাইলের সবচেয়ে বেশি মিল খুঁজে পাওয়া গিয়েছিলো। কিন্তু সেই প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছেন ব্রাভো।
সাম্প্রতিক সময়ে আরেক তরুণ ব্যাটসম্যানকে দেখে সেই লারার ছায়া খুঁজে পাচ্ছে উইন্ডিজ। তার ব্যাটিং স্টাইল ঠিক কতটা লারার মতো এটা নিয়ে প্রশ্ন আছে, তবে নিজের দিনে তিনি যে ঠিক লারার মতোই একা হাতে ম্যাচ বের করে আনতে পারেন, এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই। তিনি বাঁহাতি মারকুটে ব্যাটসম্যান শিমরন হেটমায়ার।
লারার মতো হেটমায়ারের উত্থানটাও যুব বিশ্বকাপের মাধ্যমে। ২০১৬ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠেয় সেই যুব বিশ্বকাপে তার নেতৃত্বে খেলেই সেই আসরের শিরোপা জেতে উইন্ডিজের যুবারা। সেই বিশ্বজয়ের ক্ষেত্রেও ব্যাট হাতে আলো ছড়িয়েছিলেন হেটমায়ার, কোয়ার্টার ফাইনাল ও সেমিফাইনালের মতো গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে ফিফটি করেছিলেন। আর ফাইনালে ভারতের ছুঁড়ে দেওয়া ১৪৬ রানের স্বল্প পুঁজি তাড়া করতে নেমে নিজের চিরচেনা ব্যাটিং স্টাইল ভুলে ৫৩ বলে ২৩ রানের দায়িত্বশীল ইনিংস খেলেছিলেন তিনি।
হেটমায়ারের ব্যাটিং স্টাইল দেখলে প্রথমেই যে কথাটি সবার মনে আসে, সেটি হচ্ছে ‘ক্লিন হিটার’। বাঁহাতি এই ব্যাটসম্যান তার নিজের দিনে যেন নিজের ইচ্ছামতো ব্যাটে বলে সংযোগ ঘটাতে পারেন। আর এমন একজন ক্লিন হিটার ব্যাটে-বলে ঠিকমতো সংযোগ ঘটালে বলের গন্তব্য হয়ে যায় সীমানাছাড়া। পেস বলের বিরুদ্ধে ভীষণ শক্তিশালী হেটমায়ার, পুল কিংবা হুক দুটি শটই দারুণ খেলেন। স্পিন বলের বিপক্ষে স্লগ সুইপে বিশাল ছক্কা হাঁকাতেও দারুণ পটু এই তরুণ।
হেটমায়ারের এই বৈশিষ্ট্যগুলোর সাথে লারার মিল খুব কমই পাওয়া যাবে। লারা ছিলেন বাঁহাতি এক শিল্পী, যিনি আলতো ছোঁয়ায় ব্যাট চালিয়ে একটি ভালো বল থেকেও বাউন্ডারি আদায় করে নিতে পারতেন। সেখানে হেটমায়ার মানেই বলের উপর নির্মম অত্যাচার! তবে আগেই বলা হয়েছে, নিজের দিনে ম্যাচ বের করে আনার যে গুণ লারার মধ্যে ছিল, সেই একই গুণ হেটমায়ারের মধ্যেও আছে, আর ঠিক এ কারণেই মাত্র ২০ বছর বয়সে উইন্ডিজ জাতীয় দলের হয়ে অভিষেক ঘটে যায় তার!
২০১৭ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে অভিষেক টেস্টে অবশ্য তেমন সুবিধা করতে পারেননি হেটমায়ার। আসলে তার যে ব্যাটিং স্টাইল সেই অনুযায়ী তাকে সীমিত ওভারের ক্রিকেটেই প্রথম সুযোগ দেওয়া উচিত ছিল। সেই বছরের ডিসেম্বরেই ওয়ানডে ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে যায় তার, হেটমায়ার তার জাত চেনান পরের বছর বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিপক্ষে ক্যারিয়ারের তৃতীয় ওয়ানডে ম্যাচে মাত্র ৯৩ বলে ১২৭ রানের ইনিংস খেলে জিতে নেন ম্যাচসেরার পুরস্কার।
ঘরের মাঠে বাংলাদেশের বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে হেটমায়ার খেলেন অনবদ্য এক ইনিংস। দলের সবাই যখন আসা-যাওয়ার মিছিলে ব্যস্ত, তখন তিনি একা বুক চিতিয়ে লড়ে গেলেন। এই দফায় ৯৩ বল খেলে করলেন ১২৫ রান। তার এই ইনিংসে ভর করেই এই ম্যাচে ২৭১ রানের পুঁজি পায় ক্যারিবীয়রা, যা পরবর্তীতে ম্যাচ জয়ের জন্য যথেষ্ট বলে প্রমাণিত হয়।
২০১৮ সালের অক্টোবরে ভারত সফরে যায় উইন্ডিজ। সেখানে টেস্ট সিরিজে স্বাগতিকদের কাছে একপ্রকার খড়কুটোর মতো উড়ে গিয়েছিলো দলটি। এসব দেখে মনে হচ্ছিলো, ওয়ানডেতেও ভারতের কাছে পাত্তা পাবে না ক্যারিবিয়রা। তবে ওয়ানডে সিরিজে পাশার দান উল্টাতে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন শিমরন হেটমায়ার। প্রথম ওয়ানডেতে তার করা ৭৮ বলে ১০৬ রানের ইনিংসে ভর করেই ভারতকে ৩২৩ রানের লক্ষ্যমাত্রা ছুঁড়ে দেয় উইন্ডিজ, যদিও ম্যাচটি শেষপর্যন্ত জিততে পারেনি তারা।
দ্বিতীয় ওয়ানডেতেও ব্যাট হাতে জ্বলে উঠলেন হেটমায়ার। ভারতের দেওয়া ৩২২ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে ৭৮ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে যখন ধুঁকছিলো উইন্ডিজ, তখনই পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে দলকে খেলায় ফিরিয়ে আনেন তিনি। মাত্র ৬৪ বলে ৯৪ রানের বিধ্বংসী এক ইনিংস খেলে খেলার মোড় পুরোপুরি ঘুরিয়ে দেন তিনি। তার গড়ে দেওয়া ভিত কাজে লাগিয়ে দারুণ এক সেঞ্চুরি তুলে নিয়ে ম্যাচ টাই করে ফেলেন শাই হোপ। ভারতের বিপক্ষে এমন পারফর্মেন্সের কারণে এবারের আইপিএলের নিলামে তাকে ৪.২০ কোটি রুপি দামে কিনে নেয় রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোর।
হেটমায়ারের এই ইনিংসগুলো সত্যিই লারার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। সেই যুগে দেখা যেতো, বাকি ক্যারিবীয় ব্যাটসম্যানরা আসা-যাওয়ার মিছিলে ব্যস্ত হলেও শুধুমাত্র লারার ব্যাটে ভর করে লড়াই চালিয়ে যেতো উইন্ডিজ। নভেম্বরে বাংলাদেশের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজেও ঠিক সেভাবে একা লড়ে গেছেন হেটমায়ার। মিরাজ-সাকিব-নাইমের স্পিন আক্রমণে উইন্ডিজ ব্যাটসম্যানরা অসহায় আত্মসমর্পণ করলেও ব্যতিক্রম ছিলেন তিনি। দ্বিতীয় টেস্টে উইন্ডিজ ইনিংস ব্যবধানে হারলেও একা লড়ে দ্বিতীয় ইনিংসে ৯২ বলে ৯৩ রানের মারমুখী এক ইনিংস খেলে সমালোচকদের প্রশংসা কুড়ান তিনি।
তবে এরপর মুদ্রার অন্য পিঠটাও দেখা হয়ে গেছে হেটমায়ারের। ওয়ানডে ও টি-টুয়েন্টি সিরিজে বাংলাদেশের বিপক্ষে একদমই সুবিধা করতে পারেননি তিনি। বিশেষ করে মেহেদি মিরাজের বিপক্ষে তাকে বেশ অস্বস্তিতে পড়তে হয়েছিলো। যদিও তার বয়সটা খুব কম, তাই এসব দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার যথেষ্ট সুযোগ তিনি পাবেন বলেই আশা করা যাচ্ছে।
মহানায়ক ব্রায়ান চার্লস লারাও কিন্তু শুরুর দিকে ওয়ার্ন কিংবা মুরালির স্পিনবিষে ভালোই নাজেহাল হয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে নিজের দুর্বলতা নিয়ে কাজ করে নিজের ভুলত্রুটি কাটিয়ে উঠে উল্টো ওয়ার্ন-মুরালিকে শাসন করেছেন বীরদর্পে। এভাবে নিজের দুর্বলতাকে শক্তির জায়গা বানাতে পেরেছিলেন বলেই লারা সর্বকালের অন্যতম সেরা।
হেটমায়ার যদি লারার মতো নিজের দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠেন, তবে নিঃসন্দেহে বলা যায় আগামী কয়েক বছরের মধ্যে তিনি বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যানে পরিণত হবেন। কিন্তু সেটা যদি না হয়? যদি এই দুর্বলতার কারণে বারবার তাকে নাজেহাল হতে হয়, তখন কী হবে? তেমনটা হলে হয়তো আরেকজন রিকার্ডো পাওয়েলের কাহিনীর পুনর্মঞ্চায়ন হবে। এখন দেখার বিষয়, হেটমায়ার কার উত্তরসূরি হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেন, লারা নাকি পাওয়েল।
This article is in Bangla language. It's a story about a rising West Indian batsman named Shimron Hetmyer. For references please check the hyperlinks inside the article.
Featured Image: The Indian Express