Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

জাপান নারী ফুটবল দল ‘১১: ধ্বংস ভুলিয়ে বিজয় এনে দেওয়া একদল যোদ্ধা

২০১১ সালের ১৬ই জুলাই। জাপানের বিখ্যাত দৈনিক আসাহি সিমবান তড়িঘড়ি করে একটি বিশেষ সংখ্যা ছাপালো ভোরের দিকে। গোলাপী রঙের আভায় সেই বিশেষ সংখ্যায় লেখা ছিল “নাদেশিকো! সাহসী মেয়েরা”। পেছনে জাপান নারী ফুটবল দলের ছবি। নাদেশিকো শব্দটি জাপানি ভাষায় খুবই সন্মানীয় একটি উপমা। নাদেশিকো বলা হতো বিশ্বযুদ্ধের সময় নীরবে নিভৃতে যে সকল নারী অকাতরে নিজেদের জীবন বিপন্ন করে বিভিন্ন কাজ করে দিতেন তাদের। কেন তাদের এ উপমা দেয়া হয়েছিল? তার পেছনে আছে একটি ঘটনা।

পূর্ব প্রেক্ষাপট

১১ ই মার্চ, ২০১১; ভূমিকম্পের দেশ জাপানে আঘাত হানলো প্রলয়ঙ্করী এক ভূমিকম্প। ৯ মাত্রার সেই ভূমিকম্পে জাপানের দক্ষিণ অংশ প্রায় লণ্ডভণ্ড। এরপর আঘাত হিসেবে এলো সুনামি। সর্বোচ্চ ১৩৩ ফুট উচ্চতার ঢেউ এসে বিধ্বংসের পূর্ণতা দিয়ে যায়। সে অঞ্চলে থাকা পারমাণবিক কেন্দ্রের অনেক কিছুই বিকল হয়ে যায়, দেখা দেয় দীর্ঘমেয়াদী ধ্বংসযজ্ঞের সমূহ সম্ভাবনা। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ১০ হাজার মৃত্যুর খবর শোনা যেতে থাকে। পরে এটি বেড়ে দাঁড়ায় ১৬ হাজারে। পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেল একটি অঞ্চল। জাপান শোকের সাগরে নিমজ্জিত হলো। ভূমিকম্পে সদা অভ্যস্ত দেশটির জনগণ দেখলো প্রচণ্ড ধ্বংসলীলা।

২০১১ সালের সুনামির একটি ভয়াবহ চিত্র; Source: YouTube

কোনো আশার ছলনে ভোলেনি আম-জাপানীরা  

জুন মাসে যখন জাপান নারী দল বিশ্বকাপে অংশ নিতে জার্মানি যাচ্ছে তখন বিমানবন্দরে বিদায় দিতে আসা কর্তাদের মুখে কোনো ভাবলেশ নেই। কেনই বা থাকবে? দেশের ধ্বংসলীলা বাদ দিন, যদি এই মহিলা দলের অর্জনের দিকে তাকান তবে আহামরি কিছুই নেই। ২০০৮ অলিম্পিকে চতুর্থ, মহাদেশীয় কাপে মোটামুটি আর বিশ্বকাপ শেষ ছয়বারের মধ্যে দুইবার বাছাইপর্বই পার হতে পারেনি। চিরাচরিত নিয়মেই নারী দলের পেছনে ফুটবল কর্তৃপক্ষের অর্থবরাদ্দ অতি নগণ্য। নারীদের লিগের অবস্থাও শোচনীয়। জাপান বা কোরীয়দের যে সমস্যাটা সবচেয়ে বেশী হয় ফুটবলে তা হলো তাদের উচ্চতা। জাপান নারী দলেরও তার ব্যতিক্রম ছিল না। গড় উচ্চতা ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি, যেটা আমেরিকা বা জার্মান নারীদের চেয়ে গড়ে ৪.৮ ইঞ্চি কম! বলে রাখা ভালো, নারী ফুটবলে ব্রাজিল, জার্মানি এবং আমেরিকা হলো ‘জায়ান্ট’ তকমাধারী, জাপান কোনো কুলীন কেউ নয়।

জাপানিদের উচ্চতা সমস্যাটা প্রকট; Source: Zimbio

কোচ সাকাসি যখন দায়িত্ব পান, তখন দেখেন, তার দলের মেয়েরা বছরে ৩৬৫ দিনই অনুশীলনের মানসিকতা রাখে। তখন ইউরোপীয় ফুটবলে বার্সার একাধিপত্য চলে। বার্সা একাডেমি থেকে আগত মেসি, জাভি, ইনিয়েস্তা, পেদ্রোদের মতো শারীরিকভাবে দুর্বল, খর্বকায় খেলোয়াড়দের নিয়েও পেপ গার্দিওলা তার পাসিং বেজড টিকিটাকা ঘরানার খেলা দিয়ে দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছেন বাকি দলগুলোকে। সাকাসি সেখান থেকে তার দলের জন্য ফর্মুলা পেয়ে যান। জাপানীদের প্রাণশক্তি সন্দেহাতীত, সমস্যা ছিল উচ্চতা। সেই সময়ে বার্সার খেলার ধরন সাকাসির পরিকল্পনা ঘুরিয়ে দিল অন্যদিকে।

স্বপ্ন দেখার শুরু

সিনেমার মতোই কাহিনী যেন। জাপান নারী দল জার্মানি গেলো একটি দেশের দুঃখগাঁথাগুলো মাথায় নিয়ে। তাদের প্রতি ছিল নিরাশা। গ্রুপ পর্বে প্রথম গোলটি আসে ৫ মিনিটে, দলের সবাই একসাথে হয়ে উদযাপন করলেন এমনভাবে যেন তারা দুর্দশাগ্রস্থ মানুষদের বোঝাচ্ছিলেন ভয় নেই, আমরাও তোমাদের জন্যই। টানা দুই ম্যাচ জিতে নিলো জাপান নারী দল। বেশ প্রত্যাশিত জয়ই ছিল এগুলো। তৃতীয় ম্যাচে ইংল্যান্ডের কাছে যথারীতি হেরে যায়। অতি স্বপ্নালু জাপানি ব্যক্তিটিও হয়তো সে সময় বোঝে যায়, তাদের দৌড় আর যাই হোক ইতিহাসের গণ্ডি পার হতে যথেষ্ট নয়।

কোয়ার্টার ফাইনালে খেলা পড়ে যায় জার্মানির সাথে। জার্মানরা তো চিরাচরিত যান্ত্রিক, চুলসম দুর্বলতাকেও যারা পাখির চোখ করতে ছাড়ে না, তাদের সামনে খর্বাকৃতি জাপানী মেয়েরা। জার্মানির মাটিতেই বিশ্বকাপ, তারা আবার টুর্নামেন্টে ফেভারিট। পুরো স্টেডিয়াম জার্মানির পক্ষে। কিন্তু মাঠে জার্মানি পেল অবাক এক জাপানকে। ছোট ছোট পাসে নিজেদের মাঝে বল রেখে খেলছে জাপান। এ কি জাপান, নাকি নারী বার্সা দল? ৯০ মিনিট গোলশূন্য থাকার পর অতিরিক্ত সময়ে সায়েয়া যখন গোল করেন, স্বাগতিকদের স্টেডিয়ামে পিনপতন নীরবতা। সেখানে নিরবতা হলেও প্রাণস্পন্দন ফিরে আসে আনন্দহীন একটি জনপদে? তবে কি আসলেই অসাধ্য সাধন হতে যাচ্ছে?

ক্ষিপ্রতায় জাপান সবসময়ই দারুণ; Source: zimbio.com

জার্মান কোচ বললেন, তাদের চেয়ে জাপানীদের জেতার উদগ্র বাসনাটা ছিল বেশী। পরিসংখ্যান তা-ই বলে। সে ম্যাচে গড়ে একেকজন জাপানী নারী জার্মানদের চেয়ে ১.৬ কিলোমিটার করে বেশি দৌড়েছেন। সেমিফাইনালে সুইডেনের সাথে খেলা। আদতে সুইডেন জাপানের চেয়ে ভালো দল হলেও সদ্য জার্মানিকে হারিয়ে আসা জাপানিদের আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে, সাথে ছিল দেশকে খুশি এনে দেয়ার তাগিদ। সুইডেন নিয়তির পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। ৩-১ গোলে জাপান হারিয়ে দেয় সুইডেনকে। ফাইনালে জাপান মুখোমুখি আমেরিকার সাথে। আমেরিকা সদ্য হারিয়ে এসেছে মার্তার ব্রাজিলকে। খুব আশাবাদী ব্যক্তিটিও জাপানের পক্ষে বাজি লাগানোর জন্য তৈরি ছিল না। নারী ফুটবলে আমেরিকার দাপট মাথায় রেখে সবাই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, জাপানের স্বপ্নযাত্রার সমাপ্তি হতে যাচ্ছে।

নারী ফুটবলে আমেরিকানরা যেন মহীরূহ; Source: Bleacher Report

গভীর রাতে খেলা, সাধারণত এত রাতে ফুটবল খেলা জাপানিরা দেখে না। সেদিন কর্মক্লান্ত অধিকাংশ জাপানিরা জেগেছিল ইতিহাসের সাক্ষী হওয়ার জন্য। কোচ সাকাসি ম্যাচ শুরুর আগে ড্রেসিংরুমে দেখালেন ভূমিকম্প ও সুনামি বিধ্বস্ত জাপানিদের দূরবস্থার ছবি। এই অনুপ্রেরণা দিতে যাওয়ার আবার একটা ঝুঁকিও ছিল। খুব সহজেও ম্যাচের আগে এটা জাপানী নারীদের বেশী আবেগী করে দিয়ে মনোসংযোগ ভেঙে দিতে পারতো কিন্তু তা হয়নি। তবে মনোবল ভাঙার মতো অনেক তথ্যই সামনে ছিল তাদের। র‍্যাংকিংয়ে প্রথম দল আমেরিকা। মুখোমুখি ২৩ বারের লড়াইয়ে জাপান একবারও জেতেনি, হেরেছে ২০ বার! অসাধ্য সাধন করতে হতো তাদের।

স্বপ্নপূরণের শেষ ধাপ 

শুরুতেই ধাক্কা খায় জাপান। আমেরিকা গোল দিয়ে এগিয়ে যায়। কিন্তু টাচলাইনে কোচের শান্তমূর্তি মাঠের জাপানিদের স্নায়ু ধরে রাখতে সাহায্য করছিল। গোল হজম করাটা বেশ প্রত্যাশিতই ছিল কিন্তু জাপান ছন্দে ফেরে ২০ মিনিটের দিকে। ফেরে সমতায়। প্রথম ৯০ মিনিটের খেলা ১-১ গোলে শেষ হয়। অতিরিক্ত সময়ের দশ মিনিটের দিকে আমেরিকা গোল দিয়ে দেয়। হতবাক জাপানীরা ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে খুব বেশী সময় নেয়নি। বর্ষীয়ান সাওয়া খেলার শেষ বাঁশি বাজানোর আগে স্কোরলাইন করেন ২-২। ম্যাচ গড়ায় টাইব্রেকারে। এতদূর এসে খালি হাতে ফিরতে হয়নি জাপানিদের। সাওয়ার জয়সূচক পেনাল্টিটি যখন জাল খুঁজে পায়, ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে বহুক্রোশ দূরের দেশ জাপানে শেষরাতে রাস্তায় নেমে এসেছে মানুষ। ধ্বংস ভুলিয়ে দিল এক অসামান্য বিজয়।

জয়সূচক গোলের পর সাওয়া; Source: NY Daily News

অবাক হচ্ছেন, কীভাবে এ জয় ধ্বংসের কথা ভোলাতে পারে? ইয়ুন হাজিরো নামের ৩৬ বছর বয়স্ক ভূমিকম্প বিধ্বস্ত এলাকার এক নারীর ভাষায়, “তারা কি আমাদের ভেঙে পড়া ঘর ঠিক করে দেবে? আমি তা আশাও করি না। কিন্তু যেভাবে সকল অনুমান, যুক্তি, ভবিষ্যদ্বাণী, বাঁধা সব টপকে জয় ছিনিয়ে নিল এটা আমাদের শিখিয়ে গেল যে, আমরাও পারব।” ২৩ ম্যাচে একবারও না জেতা জাপানীরা স্রেফ মনোবলের জোরে হারিয়ে দিয়েছিল প্রবল শক্তিশালী আমেরিকানদের। এ জয়ের পর জাপানী নারীদের মাঝে ফুটবলে রেজিস্ট্রেশনের হার বেড়ে গিয়েছি দ্বিগুণেরও বেশী। নারী ফুটবলে এখন পৃষ্ঠপোষকও আছে অনেক। এই দলটি বদলে দিয়েছে অনেক কিছুই। একটা প্রজন্ম তাদের মেনে নিয়েছে আদর্শ হিসেবে। চাক দে ইন্ডিয়া বা ইনভিক্টাস চলচ্চিত্রের মতো বাস্তবের রূপায়ন ছিল এই ২০১১ সালের জাপান নারী দল। এভাবেই নাদেশিকোরা একটি শোকাচ্ছন্ন দেশকে এনে দিয়েছিল একটুকরো আনন্দের উপলক্ষ।

ফিচার ছবি- Reuters Blogs

Related Articles