Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ক্রুয়েফ: ফুটবল ইতিহাসের পরশপাথর  

পরশপাথর, এক কাল্পনিক বস্তু, যার স্পর্শে সাধারণ ও মূল্যহীন কোনো বস্তু স্বর্ণে পরিণত হয়। এ ধরনের পাথরের অস্তিত্ব বাস্তবে কখনো পাওয়া যায়নি। তবে রূপক অর্থে অনেক সময় এই শব্দটি ব্যবহৃত হয় কিছু বিশেষ মানুষের ক্ষেত্রে। যারা তাদের প্রভাব দিয়ে সাধারণ কোনো দল কিংবা গোষ্ঠীকে অসাধারণ করে তোলেন তাদেরকে বলা যায় পরশপাথর। এমন একজন পরশপাথর মানুষকে নিয়েই আজকের আলোচনা। বিশেষ সেই মানুষটির নাম ইয়োহান ক্রুয়েফ।

আয়াক্সে পথচলা

ক্রুয়েফের জন্ম ১৯৪৭ সালের ২৫শে এপ্রিল নেদারল্যান্ডের আমস্টারডামে। বাবা-মায়ের দ্বিতীয় সন্তান। ফুটবলের প্রতি আগ্রহ শুরু হয় বাবার মাধ্যমেই। ১০ বছর বয়সেই আয়াক্স ক্লাবে যোগ দেন। আয়াক্সের যুব দলের কোচ ভ্যান ডার ভিন প্রতিবেশীদের সাথে খেলার সময় ক্রুয়েফকে লক্ষ্য করেন এবং তার প্রতিভা বুঝতে পেরে কোনো ট্রায়াল ছাড়াই তাকে দলে নিয়ে নেন। কিন্তু আচমকা হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ক্রুয়েফের বাবা মারা গেলে হোঁচট খেতে হয় তাকে। তখন তার বয়স মাত্র ১২ বছর। ধীরে ধীরে শোক কাটিয়ে উঠেন তিনি। মাত্র ১৭ বছর বয়সেই আয়াক্সের মূল দলে তার সুযোগ হয়।

ডাচ লিগ শুরুর পর থেকে আয়াক্স সেই লিগের শীর্ষ ক্লাবের মধ্যে একটি ছিল। তবে কোনো এক বিচিত্র কারণে ১৯৬০ সালের পর থেকে টানা ৫ বছর তারা আর শিরোপা পাচ্ছিল না। এমনকি পরপর ৪ বছর তাদের লিগে অবস্থান ছিল যথাক্রমে ২য়, ৪র্থ, ২য় এবং ৫ম। ক্রুয়েফ সিনিয়র ক্লাবে পারফর্ম করা শুরু করেন ১৯৬৪-৬৫ সালে। কিন্তু সেই মৌসুমে ১০ ম্যাচে চার গোল করার পরেও লিগে আয়াক্সের অবস্থান হয় ১৩তম, যা কিনা ক্লাবের ইতিহাসে সবচেয়ে নিম্নতম অবস্থান।

আয়াক্সের জার্সি গায়ে; Source: nss magazine

পরের মৌসুম থেকে ক্রুয়েফ ধীরে ধীরে ক্লাবের প্রথম একাদশে নিজের অবস্থান দৃঢ় করে তোলেন। সেই সিজনে ক্রুয়েফ সব মিলিয়ে ২৩ ম্যাচে ২৫ গোল করেন ক্লাবের পক্ষে। জিতে নেন ডাচ লিগ শিরোপা। পরের মৌসুমে লিগ জেতার সাথে সাথে কাপ জিতে ডাবল অর্জন করেন। সেই মৌসুমে লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা হন ক্রুয়েফ। এরপরের মৌসুমেও লিগ জেতা হয় আয়াক্সের এবং ক্রুয়েফ জিতে নেন টানা দুইবারের মতো ডাচ বর্ষসেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার। তবে ক্রুয়েফ মুল চ্যালেঞ্জটা দেখান চ্যাম্পিয়ন্স লিগে (তৎকালীন ইউরোপিয়ান কাপ)।

১৯৬৮-৬৯ মৌসুমে আয়াক্স তাদের ক্লাবের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ফাইনালে ওঠে। তবে ফাইনালে মিলানের কাছে পরাজিত হয়ে রানার্স আপ শিরোপা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাদেরকে। সেই টুর্নামেন্টে ক্রুয়েফ দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ছয়টি গোল করেন, যা ছিল টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সর্বোচ্চও।

তবে ক্রুয়েফ এই শিরোপা হারানোর দুঃখ ভুলে যান পরের তিন মৌসুমে টানা ইউরোপিয়ান কাপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে। এর মাঝে ১৯৭২ সালের দ্বিতীয় শিরোপা জয়ের সময় ইন্টার মিলানকে ২-০ গোলে হারানো ম্যাচের দুটি গোলই করেন ক্রুয়েফ। এই মৌসুমে ইউরোপিয়ান কাপের সর্বোচ্চ গোলদাতাও হন তিনি। পরের মৌসুমের ফাইনালে জুভেন্টাসকে ১-০ গোলে হারান আয়াক্স, যেখানে ক্রুয়েফের পারফর্মেন্সকে বর্ণনা করা হয়েছিল ‘Greatest 20 minutes spells of football’ হিসেবে

আয়াক্সের হয়ে প্রথম দফায় ক্রুয়েফের অর্জন ছয়টি লিগ শিরোপা, চারটি ঘরোয়া কাপ, তিনটি ইউরোপিয়ান কাপ ও একটি ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ। ক্রুয়েফ আয়াক্সের জন্য কতটা প্রভাবশালী ছিলেন, তা একটি তথ্যে বোঝা যায়। ক্রুয়েফের দল ত্যাগের পরের মৌসুমেই লিগ শিরোপা হারায় আয়াক্স, যা পরের তিন বছরও অব্যাহত ছিল। ক্লাবটি ঘরোয়া কাপ জেতে আরো সাত মৌসুম পর। আর ইউরোপিয়ান কাপ জেতে ২২ বছর পর।

বার্সেলোনা অধ্যায়

১৯৭৩ সালের দিকে ক্রুয়েফ ট্রান্সফার ফি-এর রেকর্ড গড়ে বার্সেলোনায় আসেন। তিনি যখন বার্সেলোনায় আসেন, তখন বার্সেলোনা আগের ১৩ বছরে লিগ শিরোপা জিততে পারেনি। এই সময়ে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ লিগ জেতে নয় বার। ট্রান্সফার ফি-এর রেকর্ড করে ক্লাবে আসা ক্রুয়েফের তাই কিছু করে দেখানোর তাড়না ছিল। ক্লাবে আসার পর অফিশিয়াল জটিলতার কারণে মৌসুমের প্রথম সাতটি ম্যাচে ক্রুয়েফ খেলতে পারেননি। এই সাত ম্যাচে বার্সেলোনা মাত্র সাত গোল করে দুটি জয় পেয়ে লিগের ১৪ নম্বরে অবস্থান করছিল, যা কিনা শেষের দিক থেকে চার নম্বরে। এই সময়ে ঘরের মাঠে গোলশূন্য ড্র হয়।

বার্সার ১৪ বছরের আক্ষেপ মিটিয়েছিলেন তিনি; Source: SoccerBible

ঘরের মাঠে গ্রানাডার বিপক্ষে ক্রুয়েফ ফেরত এলেন। ৪-০ গোলে জয় পাওয়া ম্যাচে নিজে গোল করলেন দুটি। দ্বিতীয় এল ক্লাসিকো ম্যাচের আগ পর্যন্ত স্পোর্টিং গিজনকে ৫-০ গোলে, মালাগাকে ৪-০ গোলে এবং সেল্টা ভিগোকে ৫-০ গোলে হারিয়ে ক্রুয়েফের অভিষেকের পর অপরাজিতভাবেই বার্সেলোনা গেল এল ক্লাসিকো খেলতে রিয়াল মাদ্রিদের মাঠে। ১৪ নম্বর থেকে বার্সেলোনা মাদ্রিদে গেল প্রথম পজিশনে থেকে যেখানে দ্বিতীয় ক্লাবের সাথে তাদের পয়েন্টের ব্যবধান ছিল ৬। এছাড়া গোল ব্যবধান ছিল ৩১, যা কিনা পরবর্তী সেরা অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদের চেয়ে ১৮টি বেশি।

রিয়াল মাদ্রিদের অবস্থাও তখন বেশ বাজে, শীর্ষ থেকে নয় পয়েন্ট পিছিয়ে লিগে তাদের অবস্থান সপ্তম। তবুও এই দুই দল যখন মুখোমুখি হয়, তখন নির্দিষ্ট দিনের সেরা দলটাই জয়ী হয়। সেই ম্যাচে রিয়াল মাদ্রিদকে ৫-০ গোলে হারায় বার্সেলোনা। ম্যাচে ক্রুয়েফ মাত্র ১টি গোল করলেও তার প্রভাব ছিল অনেক বেশি।

সেই ম্যাচের পর নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক লিখেছিলেন, “ক্রুয়েফ ৯০ মিনিটে কাতালনদের যে আনন্দ দিয়েছে, সেটি রাজনীতিবিদরাও অনেকদিন যাবত দিতে পারেনি।” সেই সিজনে ১৪ বছরের মাঝে প্রথম বারের মতো লা-লিগার শিরোপা জেতে বার্সেলোনা। বার্সেলোনায় খেলাকালীন সেই লা-লিগা বাদে ক্রুয়েফ আর একটা শিরোপা জেতে, সেটা কোপা দেল রে।

নেদারল্যান্ডের হয়ে টোটাল ফুটবল

১৯৭৪ বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ড ফেভারিট হিসেবেই যাত্রা শুরু করে। আয়াক্সের হয়ে ইতিহাস গড়া মিশেল-ক্রুয়েফ জুটিটাই মূল কারণ ছিল, সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে সেই বিশ্বকাপের আগ পর্যন্ত বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ডের অবস্থানটা খুব সুবিধের ছিল না। আগের নয়টি বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ড শুধুমাত্র ১৯৩৪ আর ১৯৩৮ বিশ্বকাপে খেলে। ১৯৩৪ সালে বিশ্বকাপে ১৬ দলের মাঝে হয় নবম। ১৯৩৮ সালের বিশ্বকাপে ১৫ দলের মাঝে হয় ১৪তম। এর পরের দুটি বিশ্বকাপে খেলেনি, তার পরের চারটি বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পায়নি। এরকম একটি ইতিহাসকে বদলে দেবার প্রত্যয় নিয়েই নেদারল্যান্ডের বিশ্বকাপ যাত্রা শুরু হয়।

মিশেলকে নিয়ে সূচনা করেছিলেন টোটাল ফুটবল; Source: These Football Times

‘৭৪ সালের বিশ্বকাপের ফরম্যাটটা একটু ভিন্ন ছিল। নেদারল্যান্ডের গ্রুপে সঙ্গী ছিল সুইডেন, উরুগুয়ে ও বুলগেরিয়া। প্রথম ম্যাচে উরুগুয়ের বিপক্ষে ২-০ গোলের সহজ জয় পায় ডাচরা। নেদারল্যান্ডের পরের ম্যাচটি ছিল সুইডেনের বিপক্ষে। সে ম্যাচ গোলশূন্য ড্র হয়। গ্রুপ স্টেজের গোলশূন্য একটি ম্যাচ সাধারণভাবেই কারো মনে থাকার নয়, কারো মনে নেইও, কিন্তু ফুটবলপ্রেমীরা আজও এই ম্যাচটি স্মরণ করে একজন মানুষের জন্য, তিনি হলেন ইয়োহান ক্রুয়েফ। ম্যাচের ২৩তম মিনিটে ক্রুয়েফ ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে এমনভাবে বল কন্ট্রোল করলেন যে, তাকে মার্কে রাখা সব খেলোয়াড়রাই ধোঁকা খেয়ে গেল। বল কন্ট্রোলের এই ক্লাসিক টার্নের নামই হয়ে গেল ‘ক্রুয়েফ টার্ন’। গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচেও বুলগেরিয়াকে ৪-১ গোলে হারায় নেদারল্যান্ড, ফলে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়েই পরের পর্বে যায় তারা।

প্রথম পর্বের পর দ্বিতীয় রাউন্ডে নেদারল্যান্ডের গ্রুপে ছিল আগের চার আসরের মাঝে তিনবারের চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা এবং পূর্ব জার্মানির মতো দল। এদের মাঝে একটি দল যাবে ফাইনালে।

নেদারল্যান্ডের জার্সি গায়ে; Source: YouTube

এই রাউন্ডের প্রথম ম্যাচে আর্জেন্টিনাকে ৪-০ গোলে হারালো ডাচরা, এই ম্যাচে বিশ্বকাপে নিজের প্রথম গোলটি করেন ক্রুয়েফ। কয়েকজন খেলোয়াড়কে বোকা বানিয়ে শেষপর্যন্ত গোলকিপারকেও কাটিয়ে গোলটা করেন ক্রুয়েফ, ম্যাচে একটি অ্যাসিস্টও করেন তিনি। পরের ম্যাচে পূর্ব জার্মানকে ২-০ গোলে হারানোর ফলে সমীকরণ দাঁড়ায় ফাইনাল খেলার জন্য ব্রাজিলের বিপক্ষে ড্র করলেই হবে তাদের। এই ম্যাচে একটি অ্যাসিস্ট করেন ক্রুয়েফ, এরপর দর্শনীয় একটি ভলিতে নিজেই করেন আরেকটি গোল। নেদারল্যান্ড জেতে ২-০ গোলে।

অন্যদিকে পশ্চিম জার্মানি ছিল পুরোপুরি আন্ডারডগ। দ্বিতীয় পর্বে যে পূর্ব জার্মানকে নেদারল্যান্ড হারিয়েছিল, তাদের কাছেই গ্রুপ পর্বে হারে পশ্চিম জার্মানি। গোটা টুর্নামেন্টে নেদারল্যান্ড যা খেলেছে, তার অর্ধেকেও খেলতে পারেনি পশ্চিম জার্মানি। এ পর্যন্ত শুনে আপনার নিশ্চয়ই ধারণা হয়ে যাবার কথা যে, ফাইনালের আগে নেদারল্যান্ডের চেয়ে পশ্চিম জার্মানি অনেকাংশেই পিছিয়ে ছিল। এখন ফাইনাল ম্যাচটি সম্পর্কে শোনা যাক।

ফাইনাল ম্যাচ

ফাইনালের মঞ্চ যেন ক্রুয়েফ মহাকাব্য লেখার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত। প্রথম সেকেন্ডেই ক্রুয়েফের জাদুকরি পরশ পেল ফাইনালের বলটি। তারপর গুনে গুনে ১৩টি পাসের পর বল ফেরত এলো ক্রুয়েফের পায়ে। বল পায়ে এক ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে ডিবক্সে ঢুকে পড়লেন ক্রুয়েফ। গোল করেই ফেলবেন, এমন সময় তাকে ফাউল করে তা প্রতিরোধ করা হলো। ক্রুয়েফের কল্যাণে ডাচরা প্রথম মিনিটেই পেল পেনাল্টি। ক্রুয়েফ টুর্নামেন্টে নিজেদের সেরা স্ট্রাইকার ইয়োহান নিসকেনকে পেনাল্টি নিতে দিলেন এবং গোলও হলো। হয়তো নিজে পেনাল্টিটা না নিয়ে ভুলটাও করলেন। কারণ, রেকর্ড বলে, ক্রুয়েফ গোল করেছেন এমন কোনো ম্যাচে নেদারল্যান্ড কখনো হারেনি। মজার বিষয় হচ্ছে, তখন পর্যন্ত জার্মানরা বলে স্পর্শ পর্যন্ত করতে পারেনি।

পরবর্তী ২০ মিনিট জার্মানদের নিয়ে স্রেফ ছেলেখেলা করলো ডাচরা, দ্রুত গতির পাস দিয়ে আর বলের দখল নিজেদের কাছে রেখে জার্মানদের যেন উপহাস করতে লাগলো। বার্তাটা পরিস্কার ছিল ক্রুয়েফদের কাছ থেকে; শুধুমাত্র জয় পেলেই হবে না, জয়টা এমন হতে হবে যাতে জার্মানরা বিব্রত হয়।

১৯৭৪ বিশ্বকাপের ফাইনালে; Source: 680news

কিন্তু বিধির ইচ্ছাটা বোধহয় অন্যরূপ ছিল। নাটকের শেষটা তিনি করতে চাইলেন নাটকীয়ভাবে। ২৫ মিনিটে পশ্চিম জার্মানি পেনাল্টি থেকে গোল দিয়ে সমতায় ফেরে। ৪৩ মিনিটে গার্ড মুলারের আরেকটি অসাধারণ গোল। এরপর আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি নেদারল্যান্ড। হার নিয়েই মাঠ ছাড়তে হয় ডাচদের

১৯৭৪ এর বিশ্বকাপে ক্রুয়েফ করেছিলেন ৩টি গোল। অ্যাসিস্ট করেছিলেন ৩ গোলে। গার্ড মুলার এবং বেকেনবাওয়ারকে হারিয়ে তাই তার হাতেই উঠেছিল বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার। ক্যাস্ট্রল ইনডেক্সের র‍্যাংকিংয়ে তিনি পেয়েছিলেন ৯.৮২ রেটিং, যা কিনা সেই টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ

সমকালীন প্রতিদ্বন্দী বেকেনবাওয়ারের সাথে; Source: Pinterest

১৯৭৭ সালে ক্রুয়েফ সবাইকে অবাক করে জাতীয় দল থেকে অবসর নেন, যেখানে ১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপ ছিল সন্নিকটে। কারণ হিসেবে সেই সময়ের স্বাগতিক আর্জেন্টিনার স্বৈরশাসনের কথা উল্লেখ করেন তিনি। তবে পরবর্তীতে ২০০৮ সালে এক বিবৃতিতে তিনি জানান, বার্সেলোনাতে থাকা অবস্থায় তাকে অপহরণের হুমকি দেওয়া হয়। এই কারণে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে তিনি জাতীয় দল থেকে অবসর নিয়েছিলেন। কারণ, কিছু কিছু ক্ষেত্রে জীবনে ফুটবলের চেয়েও অন্যান্য জিনিসের মূল্য অনেক বেশি।

ক্লাব ফুটবল থেকে অবসর এবং আয়াক্সে আবার ফিরে আসা

১৯৭৮ সালে ক্রুয়েফ সব ধরনের ফুটবল থেকে অবসরের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু পরবর্তীতে অবসর ভেঙে আবার ফেরত আসেন এবং আমেরিকার লিগে খেলা শুরু করেন। সেখানে মাত্র দুই মৌসুমে খেলে অল্প কিছুদিনের জন্য ফেরত আসেন স্পেনের লেভান্তে ক্লাবে। সেখানে মাত্র ১০টি ম্যাচ খেলেন।

পরবর্তীতে ক্রুয়েফ আবার আয়াক্সে ফেরত আসেন। ১৯৮০ সালের ৩০শে নভেম্বর তিনি টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার হিসাবে যোগ দেন আয়াক্সে। ক্রুয়েফ যোগ দেওয়ার পূর্বে প্রথম ১৩ ম্যাচ শেষে আয়াক্সের অবস্থান ছিল লিগে ১৩ নম্বরে, শেষপর্যন্ত সেই সিজনে দ্বিতীয় হিসেবে আয়াক্স লিগপর্ব শেষ করে। পরের দুই মৌসুমে আয়াক্সকে নিয়ে লিগ চ্যাম্পিয়ন হয় ক্রুয়েফ। এই সময়ে তিনি একটি ডাচ কাপও জিতেন।

ফেইনুর্দে ইতিহাস গড়া

১৯৮২-৮৩ মৌসুমে ক্রুয়েফের সাথে একটি দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। আয়াক্স ম্যানেজমেন্ট ক্রুয়েফের সাথে আর চুক্তি না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন। ক্ষুব্ধ অপমানিত ক্রুয়েফ রাগের বশে যোগ দেন আয়াক্সের প্রতিদ্বন্দ্বী দল ফেইনুর্দে।

ক্যারিয়ারের পড়ন্ত বেলায় ফেইনুর্দকে নিয়েও গড়েছেন ইতিহাস; Source: Squawka

সেই মৌসুমে ক্রুয়েফ ফেইনুর্দকে নিয়ে লিগ ও কাপ জয়ের ডাবল অর্জন করেন। বিষয়টিতে ক্রুয়েফের প্রভাব কতটা, সেটি এই সামান্য তথ্য বোঝাতে সক্ষম নয়। বোঝানোর জন্য আরেকটু বিস্তারিতভাবে বলা দরকার। সেই মৌসুমের আগে ফেইনুর্দ লিগ জিতেছিল ১০ বছর আগে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সেই মৌসুমে পর ক্রুয়েফের ফেইনুর্দ ছেড়ে দেওয়ার পরের লিগ টাইটেল জেতে ৯ বছর পর। এর মানে ১৯ বছরে মাত্র একবার লিগ জেতে ফেইনুর্দ। সেটাতে যে ক্রুয়েফের প্রভাব ছিল, সেটি বোধহয় না বললেও চলে। সেই মৌসুম শেষে ক্রুয়েফ সব ধরনের ফুটবল থেকে অবসর গ্রহণ করেন।

শেষ কথা

ফুটবলে ক্রুয়েফের অবস্থানটা আসলে কোথায়? কোনো বক্তব্যই ক্রুয়েফকে সম্পূর্ণভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারবে না। তবুও কিছুটা ধারণা পাওয়ার জন্য তার সম্পর্কে কয়েকজন কিংবদন্তির বক্তব্য শোনা যাক।

“ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, পৃথিবীর বেশিরভাগ গ্রেট কোচই গ্রেট ফুটবলার ছিলেন না, আবার বেশির ভাগ গ্রেট ফুটবলারই গ্রেট কোচ হতে পারেনি। ক্রুয়েফ দুটোই ছিলেন, সেটিও অনেক স্বতন্ত্রভাবে।” (ইয়োহান নিসকেনস)

পেলের সাথে একটা ম্যাচে ছবিসূত্র: Amino Apps

ফুটবলে চারজন রাজা আছেন। ডি স্টেফানো, পেলে, ক্রুয়েফ আর ম্যারাডোনা। (১৯৭৮ সালের আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ী কোচ সিজার মেনত্তি)

যখন দেখি ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো আর গ্যারেথ বেলের মতো খেলোয়াড়ের মূল্য ১০০ মিলিয়ন হয়, তখন ভাবি ক্রুয়েফের মূল্য কত হতে পারতো? কম করে হলেও বিলিয়ন।(বেকেনবাওয়ার)

ফুটবল নিয়ে ক্রুয়েফের ভাবনাগুলোও তার গভীরতার জানান দেয়। যেমন,

“ফুটবলে জয়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তুমি যদি এমন কিছু সৃষ্টি করতে পারো যা কিনা একটি আলাদা ঘরানা তৈরি করতে পারে এবং মানুষ সেটিকে অনুসরণ করে এবং তোমাকে সেটার জন্য মনে রাখে, তাহলে সেটি হবে এক সুন্দর উপহার।”

“ফুটবল খেলাটা খুবই সহজ, কিন্তু সহজ ফুটবল খেলাটাই সবচেয়ে কঠিন।”

তিনটি ব্যালন ডি অর পাওয়া প্রথম ফুটবলার ক্রুয়েফ। IFIHS এর করা গত শতাব্দীর সেরা খেলোয়াড়ের তালিকায় পেলের পর তালিকায় দ্বিতীয় তিনি

প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে তিনবার ব্যালন ডি অর জিতেন তিনি; Source: Wikimedia Commons

এছাড়া ফ্রান্স ফুটবলের অধীনে একটি ভোটিংয়ে এবং ওয়ার্ল্ড সকার আয়োজিত ভোটিংয়েও তিনি গত শতাব্দীর তৃতীয় সেরা খেলোয়াড় হিসাবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। টোটাল ফুটবলার হিসেবে পরিচিত ক্রুয়েফ ২০১৬ সালের ২৪শে মার্চ ৬৮ বছর বয়সে মৃত্যূবরণ করেন। তার মৃত্যূর পর ইংলিশ কিংবদন্তি গ্যারি লিনেকার বলেন,

“আজ ফুটবল এমন একজন মানুষকে হারালো, যিনি সুন্দর খেলাটাকে আরো সুন্দর করে তুলেছিলেন ইতিহাসের অন্য যে কারো চাইতে।”

আরেক কিংবদন্তি প্লাতিনি বলেন,

“আজ ফুটবল হারালো তার সবচেয়ে সেরা খেলোয়াড় এবং দূতকে। আমার হৃদয় ভারাক্রান্ত, কারণ, ক্রুয়েফ ছিলেন আমার শৈশবের নায়ক, আমার বন্ধু এবং আদর্শ।”

পরশপাথর যেমন তার স্পর্শে সাধারণ পদার্থকে স্বর্ণে পরিণত করে, ঠিক তেমনই ক্রুয়েফের স্পর্শে তার দল এমন সফলতা লাভ করেছিল যা কিনা অতীতে কখনো হয়নি। আসলে ক্রুয়েফের মতো মানুষদের মৃত্যু কেবলমাত্র শারীরিকভাবেই হয়, আত্মিকভাবে তারা বেঁচে থাকেন যুগের পর যুগ। তার কীর্তিই তাকে বাঁচিয়ে রাখবে যুগের পর যুগ।

ফিচার ছবি: O-Posts

Related Articles