Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কাকা: ফুটবলের এক অভাগা রাজপুত্র

‘রাজপুত্র’, ছোটবেলায় যারা রূপকথা পড়েছেন, তাদের সবার এই শব্দটার সাথে পরিচয় থাকার কথা। রূপকথা না পড়লেও এই শব্দটি শোনেননি এরকম মানুষ পাওয়া বিরল হবে। শব্দটি শোনার সাথে সাথে জমকালো পোশাক পরা খুব সুদর্শন কোনো একটি অবয়ব মনের কোনে ভেসে ওঠে। রূপকথায় রাজপুত্রের শৌর্য-বীর্য হয় অনন্য, তার উপস্থিতি যেন উদ্ভাসিত করে চারপাশ। ফুটবলের তেমন একজন রাজপুত্র হচ্ছেন রিকার্ডো কাকা।

কাকা; source: sportskeeda.com

কাকার বয়স যখন মাত্র সাত, তখনই তার পরিবার সাও পাওলোতে বসতি গড়ে। মাত্র আট বছর বয়সেই তিনি সাও পাওলোতে ক্যারিয়ার শুরু করেন। পনের বছর বয়সে তিনি ক্লাবের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন এবং সাও পাওলোর যুব দলের হয়ে কোপা ডি জুভেনিল জয়ে নেতৃত্ব দেন।

যুব দলের হয়ে তার পারফর্মেন্স তাকে মূল দলে সুযোগ পাইয়ে দেয় ২০০১ সালের জানুয়ারিতে। ২৭ ম্যাচে তিনি গোল করেন ১২টি। তবে এই ক্লাবের হয়ে খুব বেশি কিছু অর্জন নেই কাকার। ব্রাজিলে অনেকদিন ধরেই সাও পাওলো আর রিও ডি জেনিরো শহরের দলগুলো নিয়ে একটি ঐতিহ্যবাহী টুর্নামেন্ট হয়, যেটি Torneio Rio নামে পরিচিত। সাও পাওলোর হয়ে এই একটি টুর্নামেন্টই জেতেন কাকা, তবে সেটিও পুরোপুরি নিজের কৃতিত্বেই।

প্র্যাকটিসে; source: Globo Esporte

বোটাফোগোর বিপক্ষে ফাইনালে বদলি হিসেবে মাঠে নেমে দুই মিনিটের ব্যবধানে ২টি গোল করেন কাকা, সাও পাওলোকে ২-১ গোলে ম্যাচ জেতান। সেই মৌসুমে কাকা ২২ ম্যাচে ১০ গোল করে ইউরোপিয়ান ক্লাবগুলোর নজরে পড়েন।

ইউরোপ যাত্রা

২০০৩ সালে কাকা ইউরোপের স্বনামধন্য ক্লাব এসি মিলানে যোগদান করেন। প্রথম মৌসুমেই পারফর্মেন্স দিয়ে মিলানের প্রথম একাদশে নিজের জায়গা করে নেন। সেই মৌসুমে সিরি এ আর উয়েফা সুপার কাপ জেতেন, কিন্তু ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ আর ইতালিয়ান সুপারকোপাতে রানার্স আপ হন। এই পারফর্মেন্সের জন্যেই পরবর্তী বছরে ‘সিরি এ’ এর বর্ষসেরা বিদেশী ফুটবলারের পুরষ্কারটি জিতে নেন কাকা।

এসি মিলানের হয়ে প্র্যাকটিসে; source: zimbio.com

তবে মিলানের হয়ে কাকা একটা বড় দুঃখ পান ২০০৫ সালের চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে। ৩-০ গোলে এগিয়ে থেকেও ম্যাচটা হারতে হয় লিভারপুলের অবিস্মরণীয় কামব্যাকে। অথচ প্রথমার্ধে দুর্দান্ত খেলেছিলেন কাকা। ম্যাচের প্রথম গোলটা হয় কাকার ফ্রি কিক থেকে। সেই ম্যাচে একটি অ্যাসিস্টও করেন তিনি। সেই টুর্নামেন্টের সবচেয়ে বেশি অ্যাসিস্ট প্রোভাইডার (৫টি) ছিলেন কাকা। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ না জেতার দুঃখ তিনি ভুলে যান ২০০৬-০৭ মৌসুমে।

ক্যারিয়ার সেরা মৌসুম

শেভচেঙ্কো চেলসিতে যাওয়ার পর মিলানের মূল পরিকল্পনা কাকাকে ঘিরেই শুরু হয়। সেই মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতার সাথে সাথে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা (১০ গোল) হন তিনি। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন তার চেয়েও ৪ গোল পিছিয়ে। এছাড়া সেই টুর্নামেন্টে ৩টি অ্যাসিস্টও করেন কাকা। তবে শুধুমাত্র গোল সংখ্যা দিয়ে কাকার পারফর্মেন্স বিচার করে তার পুরো কৃতিত্বটা বোঝা যাবে না। গ্রুপ পর্বেই কাকা তার প্রথম চ্যাম্পিয়ন্স লিগ হ্যাট্রিক করেন

এরপর দ্বিতীয় পর্বে সেল্টিকের বিপক্ষে দুই লেগ মিলিয়ে ১-০ গোলে জেতা ম্যাচের একমাত্র গোলটি করেন কাকা দ্বিতীয় লেগের ৯৩ তম মিনিটে। কোয়ার্টার ফাইনালে এসি মিলান মুখোমুখি হয় আরেক জায়ান্ট বায়ার্ন মিউনিখের। ঘরের মাঠে প্রথম লেগে ম্যাচটা ২-২ গোলে ড্র হয়। ম্যাচে কাকা ১টি গোল করেন। পরের লেগে ২-০ গোলে জেতা ম্যাচেও ১টি অ্যাসিস্ট করেন তিনি

source: YouTube

তবে কাকা তার ক্যারিয়ার সেরা পারফর্মেন্স করেন সেমিফাইনালে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে। প্রথম লেগটা ছিল ম্যানইউর ঘরের মাঠে। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর ১টি আর ওয়েইন রুনির ২ গোলে প্রত্যাশিত জয়ই পায় তারা। তবে মূল্যবান ২টি অ্যাওয়ে গোল করে মিলানের আশাটা বাঁচিয়ে রাখেন কাকা। প্রথম গোলটা করেন তিনি দুই ডিফেন্ডারের মাঝখান দিয়ে বাঁ পায়ে। কিন্তু দ্বিতীয় গোলটায় তিনি যেন মুগ্ধতার সীমা ছাড়িয়ে যান।

উঁচু হয়ে আসা বলটা রিসিভ করে দুর্দান্তভাবে নিয়ন্ত্রণ নেন, মাথা দিয়ে আলতো করে সামনে বাড়িয়ে একজনকে বিট করেন, এরপর আরেকজন ডিফেন্ডারের মাথার উপর দিয়ে বলটা নিজের নিয়ন্ত্রণেই রাখেন, পাশ থেকে আরেকজন ডিফেন্ডারকে আসতে দেখে মাথা দিয়ে আরেকবার বলটাকে সামনে বাড়িয়ে দেন। সম্পূর্ণ কাজটা করতে তিনি সময় নিয়েছিলেন মাত্র কয়েক সেকেন্ড। দুই জন ডিফেন্ডার নিজেদের মাঝে ঠোকাঠুকি খেয়ে আবিষ্কার করলো, বল পায়ে কাকার সামনে শুধু মাত্র গোলকিপার! এরপর ঠাণ্ডা মাথায় ফিনিশিংটা দিলেন কাকা।

ম্যাচের হাইলাইটস

ঘরের মাঠে পরের লেগে ৩-০ গোলে ম্যাচটা জিতে মিলান চলে যায় ফাইনালে। ফাইনালে প্রতিপক্ষ সেই লিভারপুল, যাদের কাছে দুই মৌসুম আগে স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল মিলানের। তবে এবার আর ভুল করেনি মিলান। ২-১ গোলে জেতা ম্যাচে ১টি অ্যাসিস্ট করেন কাকা।

তার এই পারফর্মেন্সের জন্যই সেই মৌসুমের ব্যালন ডি অর আর ফিফা বর্ষসেরা সহ মোটামুটি সব বড় ধরনের পুরস্কারই চলে যায় কাকার দখলে। সেই মৌসুমের ফিফা বর্ষসেরা ভোটিংয়ে কাকা পান ১,০৪৭টি ভোট; যেখানে মেসি আর ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো পান যথাক্রমে ৫০৪ আর ৪২৬টি করে ভোট।

প্রতিদ্বন্দ্বীতা হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু ইনজুরি তাকে পিছিয়ে দেয়; source: thescore

পরের সিজনে কাকা মিলানের হয়ে উয়েফা সুপার কাপ জেতেন, যেখানে তিনি ফাইনালে ১টি গোলও করেন। এছাড়া ক্লাব বিশ্বকাপও জেতেন, যেখানে তিনি ফাইনালে ১টি গোল করেন এবং টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জিতে নেন

স্পেন যাত্রা

২০০৯ সালে BBC একটি ফিচার করে এই বলে, ম্যানচেস্টার সিটি কাকার জন্য ১০০ মিলিয়ন ইউরো খরচ করতে চায়। কাকা প্রথমে সংবাদ মাধ্যমকে জানান, তিনি ক্লাব পাল্টাতে আগ্রহী নন। তবে পরবর্তীতে বলেন, “আমি ততক্ষণ পর্যন্ত দল ছাড়তে আগ্রহী নই যতক্ষণ পর্যন্ত মিলান আমাকে রাখতে চাইবে। তবে যদি মিলান আমাকে বিক্রি করতে চায়, তাহলে আমি বিবেচনা করতে পারি।

মিলানের সমর্থকেরা ক্লাবের হেড কোয়ার্টারের বাইরে আন্দোলন করতে থাকে এবং এক পর্যায়ে কাকার বাসার বাইরে গিয়ে পৌঁছে। কাকা জানালা দিয়ে তাদের আশ্বস্ত করেন যে, তিনি মিলানেই আছেন।

কিন্তু সেই মৌসুমে কাকা থেকে গেলেও পরের সিজনে আর থাকতে পারেননি। রিয়াল মাদ্রিদ ৬৭ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে কাকাকে কিনে নেয়। মিলানের ক্লাব প্রেসিডেন্ট জানান, কারণটা অর্থনৈতিক। ক্লাবকে বাঁচানোর জন্য সেই মূহুর্তে টাকার প্রয়োজন ছিল।

রিয়াল মাদ্রিদের জার্সিতে; source: Marca

রিয়াল মাদ্রিদের কাকার ক্যারিয়ারটা খুব ভালোভাবে কাটেনি। ইনজুরি তাকে বেশ ভুগিয়েছে। প্রায়ই তাকে লম্বা সময়ের জন্য মাঠের বাইরে কাটাতে হয়েছে। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে ১২০টি ম্যাচে মাত্র ২৯টি গোল করেন তিনি। দলের হয়ে মাত্র ১টি লা লিগা, ১টি কোপা দেল রে আর ১টি স্প্যানিশ সুপার কাপ জিততে সমর্থ হন।

মিলানে প্রত্যাবর্তন

মাদ্রিদের প্রত্যাশা অনুযায়ী সফলতা না পাওয়ার পরে ২০১৩ সালে আবার এসি মিলানে ফিরে আসেন কাকা। তবে এবারের প্রত্যবর্তনটা আগের মতো স্মরণীয় করতে পারেননি তিনি। একটি মৌসুম খেলে ৩৭ ম্যাচে তিনি করেন ৭টি গোল।

মিলানের হয় শততম গোল করার পর; source: fifa.com

এর পরেই কাকা চলে যান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের MLS (Major league soccer) দলে। সেখানে তিনি MLS এর ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি বেতনভুক্ত খেলোয়াড়ে পরিণত হন। মাঝে ১টি মৌসুম সাও পাওলোতে ধারে খেললেও অরল্যান্ডো সিটিতেই ক্যারিয়ার শেষ করেন কাকা।

জাতীয় দল

ব্রাজিল দলে কাকার অভিষেক হয় ২০০২ সালে বলিভিয়ার বিপক্ষে একটি প্রীতি ম্যাচে। তিনি ২০০২ বিশ্বকাপের তারকাখচিত ব্রাজিল দলেও সুযোগ পান কিন্তু কোস্টারিকার বিপক্ষে মাত্র ২৫ মিনিট খেলতে পেরেছিলেন। ২০০৫ সালের কনফেডারেশন কাপে তিনি প্রতিটি ম্যাচেই খেলার সুযোগ পান এবং ফাইনালে আর্জেন্টিনাকে ৪-১ গোলে হারানো ম্যাচে ১টি গোলও করেন। ২০০৬ বিশ্বকাপে কাকা ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে ১টি গোল করেন এবং ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন। তবে কোয়ার্টার ফাইনালে জিদান ম্যাজিকের কাছে তার দল পরাজিত হয়।

রোনালদো, রোনালদিনহো আর আদ্রিয়ানোর সাথে; source: Pinterest

২০০৯ সালের কনফেডারেশন কাপে কাকা ব্রাজিলের ১০ নম্বর জার্সি পান। সেই টুর্নামেন্টের ফাইনালে যুক্তরাষ্ট্রেকে ৩-২ গোলে হারানো ম্যাচের ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন কাকা এবং টুর্নামেন্টের সেরাও হন তিনি

২০১০ বিশ্বকাপে কাকা আসেন পাদপ্রদীপের আলোয় থাকা সেরা তিন খেলোয়াড়ের একজন হিসেবে। কিন্তু টুর্নামেন্টে সবচেয়ে বেশি অ্যাসিস্ট করার পুরস্কার পেলেও কোয়ার্টার ফাইনালে নেদারল্যান্ডের কাছে হেরে টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে পড়ে ব্রাজিল।

গোল্ডেন বল আর শিরোপা হাতে; source: Daily Mail

বিশ্বকাপের পর কয়েকবার কাকা দলে ফিরে আসলেও ইনজুরির জন্য স্থায়ী হতে পারেননি। কাকার ক্যারিয়ারের একটি অন্যতম সেরা গোল হচ্ছে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ২০০৬ সালে প্রীতি ম্যাচে করা। সেই ম্যাচে বদলি হিসেবে নামা কাকা বলটা পান মাঝ মাঠেরও আরো পেছনে। সেখান থেকে মেসিকে বিট করে বলটা একাই টেনে নিয়ে গিয়ে গোল করেন।

গোলের ভিডিও

ব্রাজিলের হয়ে ৯২টি ম্যাচে অংশ নিয়ে কাকা ২৯টি গোল করেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো, কাকা গোল করেছেন এমন কোনো ম্যাচে ব্রাজিল হারেনি!

শেষ কথা

যদি প্রশ্ন করা হয়, ফুটবলার কাকার সবচেয়ে বড় শত্রু কে ছিল তাহলে চোখ বন্ধ করে ইনজুরির নামটাই বলা যাবে। মাত্র ১৮ বছর বয়সেই সুইমিং পুলে এক দুর্ঘটনায় স্পাইনাল ফ্র্যাকচারে কাকার প্যারালাইসিস হওয়ার সম্ভাবনা হয়েছিল। পরবর্তীতে তিনি সেখান থেকে আশ্চর্যজনকভাবে সেরে উঠলেও পুরো ক্যারিয়ারে বারবার ইনজুরির জন্যই পিছিয়ে গিয়েছেন।

ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ; source: Goal.com

ফুটবল ইতিহাসে হয়তো কাকার নাম তেমন উঁচু স্থানে থাকবে না, তবে তার সমকালীন ফুটবলপ্রেমীদের মনের মাঝে কাকা রাজপুত্র হয়েই থাকবেন, হয়তো অশ্রুসিক্ত নয়নে বিদায় নেওয়া এক অভাগা রাজপুত্র হিসেবেই।

ফিচার ইমেজ- orlandocitysc.com

Related Articles