১
টেস্ট ক্রিকেটে চতুর্থ ইনিংসে রান তাড়া করা সবসময়েই কঠিন, সেটা যত ছোট লক্ষ্যই থাকুক না কেন। সেজন্য ১৯৯৩ সালে অস্ট্রেলিয়া যখন মাত্র ১৮৬ রান তাড়া করতে নামলো, তখনও কেউ কেউ ওয়েস্ট ইন্ডিজকে পরাজিত দলের তালিকায় ফেলে দিতে পারেনি। এছাড়া পরিস্থিতিটাও এমন ছিল যে সিরিজে ফিরে আসতে হলে টেস্টটা ওয়েস্ট ইন্ডিজকে জিততেই হবে। মরিয়া ওয়েস্ট ইন্ডিজের ফিরে আসার রূপ আগেও অনেকবার দেখা হয়েছে বিধায় নিজের দেশে খেলা হওয়া সত্ত্বেও অস্ট্রেলিয়ার জয়ের ব্যাপারে অনেকেই সন্দিহান ছিলেন।
খেলা শুরু হবার পর দেখা গেলো, বোদ্ধারা ভুল ভাবেননি। এমব্রোস, বিশপ, বেঞ্জামিন আর ওয়ালশের তোপে পড়ে একে একে ডেভিড বুন, মার্ক টেলর, ওয়াহ ব্রাদার্স, অ্যালান বোর্ডাররা সাজঘরে ফিরে গেলেন। মাত্র ৭৩ রানেই ৬ উইকেট পড়ে যাওয়ায় অস্ট্রেলিয়ার পরাজয় চোখের সামনে ফুটে উঠেছিল। ঠিক সেই সময়ে খর্বাকৃতির একজন ব্যাটসম্যান লোয়ার অর্ডারের টিম মে’কে নিয়ে মোটামুটি একাই ওয়েস্ট ইন্ডিজের ভয়ংকর পেস আক্রমণের বিপক্ষে লড়াই করে যাচ্ছিলেন। সমস্যা হচ্ছে, সেই খর্বাকৃতির ব্যাটসম্যানের সেটাই ছিলো অভিষেক টেস্ট। আর অভিষেক টেস্টে ফর্মে থাকা এমব্রোসকে সামলানো মোটেও সহজ কিছু নয়।
তবে প্রথম ইনিংসে মাত্র ২০ রান করে আউট হয়ে গেলেও দ্বিতীয় ইনিংসে লড়াই করে খেললেন ৫৪ রানের এক অসাধারণ লড়াকু ইনিংস। অবশ্য এই লড়াকু ইনিংসও অস্ট্রেলিয়াকে হারের হাত থেকে বাঁচাতে পারলো না। অস্ট্রেলিয়া ম্যাচটা হারলো মাত্র ১ রানে। টেস্ট ক্রিকেটের এতদিনের ইতিহাসে ১ রানে জয়-পরাজয়ের রেকর্ড কেবলমাত্র এই একটি ম্যাচেরই। ম্যাচটি হেরে গেলেও তাই সেই ব্যাটসম্যান নজরে পড়ে গেলেন অস্ট্রেলিয়ান নির্বাচকদের।
২
সর্বকালের সেরা টেস্ট ওপেনার কে?
যদি ক্রিকেটের মনোযোগী ছাত্র হন, তাহলে আপনার মাথায় কয়েকটি নাম ঘুরপাক পাবার কথা। গর্ডন গ্রিনিজ, ডেসমন্ড হেইন্স, সুনীল গাভাস্কার, বীরেন্দর শেবাগ, জ্যাক হবস, অ্যালিস্টার কুক, ম্যাথু হেইডেনসহ আরো অনেকে। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, আপনাকে যখন প্রশ্ন করা হবে, টেস্টের সর্বকালের সেরা ওপেনিং জুটি কোনটি, তখন এমন কিছু ব্যাটসম্যানের নাম আপনি বলবেন, যারা কি না আলাদা আলাদাভাবে সেরার সংক্ষিপ্ত তালিকায় থাকবেন না।
এমনই একজন ব্যাটসম্যান হচ্ছেন জাস্টিন ল্যাঙ্গার। টেস্ট ক্রিকেটে ওপেনিং জুটিতে ল্যাঙ্গার-হেইডেনের চাইতে বেশি রান করেছেন কেবলমাত্র হেইন্স-গ্রিনিজ জুটি, তবে ৮২৭ রান বেশি করার জন্য তাদেরকে ৩৫টি ইনিংস বেশি খেলতে হয়েছিল।
মজার বিষয় হচ্ছে, সর্বকালের সেরা ওপেনিং জুটিতে নাম থাকলেও ল্যাঙ্গার কিন্তু ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান হিসেবে। মূলত ফাস্ট ডাউন ব্যাটসম্যান হিসেবেই তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের শুরু। কিন্তু শুরুর দিকে ক্যারিয়ারে উত্থান-পতনের মুখোমুখি হচ্ছিলেন ল্যাঙ্গার। এছাড়াও দলে তখন জায়গা পাওয়ার জন্য তীব্র প্রতিযোগীতা। ডেমিয়েন মার্টিন প্রতিভাবান হয়েও অনেকদিন যাবত দলের বাইরে, সাইমন ক্যাটিচ ধারাবাহিকভাবে রান করে চলেছেন, ম্যাথু হেইডেন আর ডারেন লেহম্যানও রান করাতে পিছিয়ে ছিলেন না, ওদিকে স্টুয়ার্ট ল কাউন্টি ক্রিকেটে রানের ফোয়ারা তুলছেন। সেই সময়টাতে দলে সুযোগও কম।
এর মাঝে মোটামুটি রান করতে থাকলেও সেটা দলে নিশ্চিতভাবে জায়গা করে নেয়ার জন্য যথেষ্ট হচ্ছিল না। ক্যারিয়ারের দশম টেস্টে প্রথম সেঞ্চুরি পাওয়ার পরেও গড় গিয়ে দাঁড়ালো মাত্র ২৬.৮০ তে। এই গড় নিয়ে সেই আমলে অস্ট্রেলিয়ার মতো দলে টিকে থাকাটা আসলেই বিস্ময় জাগানিয়া ঘটনা।
ক্যারিয়ারের স্থিতিশীল হবার জন্য নিজেকে প্রমাণ করার জন্য একটা সুযোগ প্রয়োজন ছিল ল্যাঙ্গারের। সেই সুযোগটা ল্যাঙ্গার পেয়ে গেলেন ১৯৯৯ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজে।
৩.
তখনও অস্ট্রেলিয়া টেস্ট ক্রিকেটে অন্য সবার চেয়ে এগিয়েই ছিল, তবে সেটা একচেটিয়াভাবে নয়। একক সাম্রাজ্যটা শুরু হয় আরো কয়েকদিন পর, কিংবা বলা যায় এই ম্যাচের মাধ্যমেই হয়তো সেটার সূত্রপাত।
সময়টা ১৯৯৯ সাল, ওয়ানডে ক্রিকেটে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হবার পর বছরের শেষপ্রান্তে ঘরের মাঠে পাকিস্তানের মুখোমুখি হয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। প্রথম টেস্টটা সহজেই (১০ উইকেটে) জিতলেও দ্বিতীয় টেস্টে দুর্দান্তভাবে ঘুরে আসে পাকিস্তান। প্রথম ইনিংসে মাত্র ২২২ রানে অল আউট হওয়ার পর যখন মাত্র ১ উইকেট হারিয়ে অস্ট্রেলিয়ার সংগ্রহ দাঁড়ালো ১৯০ রান, তখন ধারণা করা হচ্ছিল যে এই টেস্টের পরিণতিও প্রথম টেস্টের মতোই হতে যাচ্ছে।
‘দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেই পাকিস্তানীদের সেরাটা বেরিয়ে আসে’– এই কথারই বাস্তব প্রতিফলন যেন দেখা গেল এর পরপরই। ১৯০ থেকে ২৪৬– মাত্র ৫৬ রানের মাঝে অস্ট্রেলিয়াকে অলআউট করে বেশ ভালোভাবেই ম্যাচে ফিরে আসলো পাকিস্তানীরা। এরপর ইনজামাম উল হকের সেঞ্চুরিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তারা দাঁড় করালো ৩৬৯ রানের এক লক্ষ্যমাত্রা।
চতুর্থ ইনিংসে ৩৬৯ রানের লক্ষ্যমাত্রা যেকোনো যুগের বিবেচনাতেই অনেক বড়। এর সাথে ওয়াসিম, ওয়াকার, সাকলাইন মুস্তাকের সমন্বয়ে গড়া বোলিং লাইন আপ সেই সময়ের সবচেয়ে বিধ্বংসী বোলিং লাইন আপ বলেই পরিচিত ছিল। ১২৬ রানেই ৫ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর ম্যাচ শেষ হয়ে যাওয়াটা কেবলমাত্র সময়ের অপেক্ষাই ছিল।
মাঠে তখন ব্যাট করছেন আগের টেস্টেই অভিষেক হওয়া অ্যাডাম গিলক্রিস্ট এবং দলে জায়গা পেতে লড়াই করা জাস্টিন ল্যাঙ্গার। এই দুজনের ২৩৮ রানের জুটিই অবিশ্বাস্য এক জয় উপহার দিল অস্ট্রেলিয়াকে। ল্যাঙ্গার খেললেন ৩৩৮ মিনিটে ১২৭ রানের এক ইনিংস, যা কি না অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট ইতিহাসে সবচেয়ে মন্থরতম সেঞ্চুরি।
মন্থরতম ইনিংস হলেও সেটা ছিল লড়াকু একটি ইনিংস, যা ক্যারিয়ারের প্রায় সবসময়ই খেলে গিয়েছেন তিনি।
৪.
মূলত তিন নম্বর পজিশনের খেলোয়াড় হলেও ২০০১ সালে ওপেনিংয়ে খেলার একটি সিদ্ধান্ত ল্যাঙ্গারের অবস্থান পাল্টে দেয়। অস্ট্রেলিয়ার ওপেনিংয়ে তখন প্রথম পছন্দ ছিলেন ম্যাথু হেইডেন আর মাইকেল স্ল্যাটার। কিন্তু ২০০১ সালের অ্যাশেজের প্রথম ৪ টেস্টে স্ল্যাটার আশানুরুপ ভালো খেলতে ব্যর্থ হলে ওপেনিংয়ে জায়গা পান আগের ৪ টেস্ট মিস করা ল্যাঙ্গার। সুযোগ পেয়ে প্রথম ইনিংসেই সেঞ্চুরি করে লড়াইটাকে জমিয়ে দেন ল্যাঙ্গার। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে পরের টেস্টে আরেকটি সেঞ্চুরি করে দলে নিজের জায়গাটা পাকা করে ফেললেন তিনি। এরপর আর মাইকেল স্ল্যাটার দলে ফিরে আসতে পারেননি। অপরদিকে ম্যাথু হেইডেনের সাথে ওপেনিং জুটিটাও বিধ্বংসী হওয়া শুরু করে। ক্যারিয়ারের ২৩টি সেঞ্চুরীর ১৬টি আসে ওপেনিংয়ে নামার পর থেকে।
অস্ট্রেলিয়ার সর্বজয়ী টেস্ট দলে ল্যাঙ্গারের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। সমস্যা একটিই ছিল, তার ব্যাটিংয়ে আক্রমণাত্মক ভঙ্গীটা না থাকায় ব্যাটিংটা তেমন আকর্ষণীয় ছিল না। এজন্য তার রানের বেশিরভাগই পরিচিত ছিল ‘আগলি রান’ হিসেবে। কিন্তু দলের প্রয়োজনে এই আগলি রানের গুরুত্ব কোনো অংশেই কম ছিল না। বিশেষ করে মার্ক ওয়াহ, গ্রেগ ব্লিউয়েট, রিকি পন্টিংয়ের মতো স্ট্রোক খেলোয়াড়দের ভিড়ে কাউকে না কাউকে ইনিংস ধরে রাখার কাজটা করতেই হতো। আশির দশকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিখ্যাত ব্যাটিং লাইন আপে ল্যারি গোমস নামের বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যান যে কাজটা করতেন, অস্ট্রেলিয়া দলে সেই একই ভূমিকা পালন করতেন ল্যাঙ্গার।
তার ব্যাটিং সৌন্দর্য পিপাসুদের মন না ভরাতে পারলেও কার্যকারিতার জন্য দলের প্রথম পছন্দে পরিণত হয়ে গিয়েছিলেন। পর্যাপ্ত প্রতিভা না থাকলেও পরিশ্রম করে যে জীবনে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত যাওয়া সম্ভব, সেটার উদাহরণ হিসেবে কাউকে দেখাতে চাইলে অনায়াসে জাস্টিন ল্যাঙ্গারের নাম নিয়ে নিতে পারেন।
This article is in Bangla langguage. It discussed about the journey of Australian cricketer Justin Langer. References have been hyperlinked inside the article.
Feature Image: Sporting News