প্রধান নির্বাচক যখন দল ঘোষণার সময় সাব্বির রহমানের নাম পড়ছিলেন, ঠিক সেই মুহূর্তে চোখ কপালে উঠেছিল সবার। আরে! সাব্বির তো নিষিদ্ধ। সেই সাব্বির নিউজিল্যান্ড সফরে জায়গা পেলেন! এ নিয়ে কম জল কম হয়নি। একাধিক শৃঙ্খলা বহির্ভূত কর্মকাণ্ডের কারণে ছয় মাসের জন্য তিনি বাংলাদেশের জার্সিতে মাঠে নামার সুযোগ হারিয়েছিলেন। কিন্তু সময় শেষ হওয়ার আগেই তার দলে ফেরার খবর হয়তো সবাইকে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) গায়ে দায়িত্বহীনতার পোস্টার ছাপিয়ে দিতে চাইবে।
সাব্বির রহমান; Image Source: Cricbuzz
সেদিন সাব্বির প্রসঙ্গে প্রধান নির্বাচক জানিয়েছিলেন, সাব্বিরকে নাকি অধিনায়ক মাশরাফ বিন মুর্তজা চেয়েছেন। তাই নিষিদ্ধ থাকার পরও তাকে দলে নেওয়া হয়েছে, নিষেধাজ্ঞার সময়ও কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।
নির্বাচকের দায়ভার এড়িয়ে যাওয়া দেখে অবাক হয়েছিলেন অধিনায়ক। তার দাবি, তিনি কখনোই সাব্বিরকে দলে নেওয়ার ব্যাপারে 'চাপ' প্রয়োগ করেননি। তিনি বলেছিলেন,
AVERTISEMENT
আমার তো মতামত দেওয়ার চেয়ে বেশি কিছু করার নেই। অন্য অনেক দেশের নির্বাচক প্যানেলে অধিনায়ক থাকেন। আমাদের দেশে তা নেই। সাব্বিরকে আমি একক সিদ্ধান্তে দলে নিয়ে নেবো, সে প্রশ্নই ওঠে না। আমি শুধু নিজের মতামত জানিয়েছিলাম।
মাশরাফি ও সাব্বির; Image Source: Daily Star
মাশরাফি কেন সাব্বিরের ব্যাপারে মত দিয়েছিলেন, সেটিও পরিষ্কার করেছেন। ওই সময়ে নিউজিল্যান্ড সফরের জন্য স্কোয়াডের ১৪ জনের নাম ঠিক হয়ে গিয়েছিলে। ১৫ নম্বর সদস্যের জন্য যে নামগুলো মাশরাফি দেখেছিলেন, সেখানে তার মনে হয়েছিল সাব্বিরকে নেওয়া যায়। কারণ, বিশ্বকাপে সাত নম্বরে প্রতিপক্ষের সেরা পেস বোলারদের সামলানোর সামর্থ্য বাংলাদেশের অন্য ব্যাটসম্যানদের তুলনায় সাব্বিরেরই বেশি বলে মনে করেন মাশরাফি। তাই সামর্থ্যের কথা চিন্তা করে সাব্বিরের ব্যাপারে বলেছিলেন তিনি।
সাব্বিরকে ছাড়া চলেছে না? চলেছে তো। আর এর আগেও তো অনেককে নেওয়ার মত দিয়েছি, কিন্তু নির্বাচকরা নেননি।
এতকিছুর মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই অনেকখানি চাপে ছিলেন সাব্বির। চাপটা ছিল নিজেকে প্রমাণ করার। নিউজিল্যান্ড সফরে গিয়ে বাংলাদেশ যখন বাজেভাবে ওয়ানডে ম্যাচগুলো হারছে, তখন প্রথম ম্যাচে সাব্বিরও দাঁড়াতে পারেননি। দ্বিতীয় ম্যাচে আশা জাগিয়েও ফিরে আসা। সিরিজের শেষ ওয়ানডে ম্যাচে তার ব্যাটে এক ঝলক স্নিগ্ধতার পরশ পায় বাংলাদেশ। ৮৮ রানের বিশাল ব্যবধানে ম্যাচ হারলেও, সাব্বিরের সেঞ্চুরিটি ছিল মনে রাখার মতোই। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের যেকোনো ফরম্যাটেই এটি ছিল তার প্রথম সেঞ্চুরি। সেই সাব্বিরের সেঞ্চুরি, যাকে দলে নেওয়ার ব্যাপারে পাল্টাপাল্টি দায় না নেওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছিল বোর্ড কর্তা পর্যন্ত।
AVERTISEMENT
দিন শেষে সাব্বির নিজেকে প্রমাণ করতে পারলেন, মুখটা বন্ধ করে দিলেন শতক দিয়ে।
১.
আগের বলেই টিম সাউদিকে কাভার ড্রাইভে একটা চার মেরেছিলেন সাব্বির। পরের বলে ব্যাকওয়ার্ড স্কয়ারে ঠেলে দিয়ে একটি রান। উদযাপনটা চোখে লেগে থাকার মতো। রোমাঞ্চ এনে দেয়। যেন জমে থাকা যত ক্ষোভ, যত কষ্ট সবকিছু বের করে দেওয়ার চেষ্টা। সেঞ্চুরির জন্য ব্যাটটা দেখানোর পরই, হাত দিয়ে যেন বুঝিয়ে দিলেন,
'অনেক বকবক হয়েছে।'
সাব্বিরের উদযাপনে বলে দিচ্ছিল কিছু কথা; Image Source: AFP
নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ডানেডিনে সিরিজের শেষ ওয়ানডে ম্যাচে ৮৮ রানের বিশাল ব্যবধানে হেরেছে বাংলাদেশ। কিন্তু এই ম্যাচে সেঞ্চুরি পেয়েছেন সাব্বির। বাংলাদেশের একমাত্র 'টি-টোয়েন্টি স্পেশালিষ্ট' বলা হয় তাকে। কিন্তু মাঠের বাইরের ঘটনাগুলোর বিতর্ক যেন পিছুই ছাড়ছে না তার। শেষ পর্যন্ত নিউজিল্যান্ড সফরে তার ভাগ্য খুলে দেন মাশরাফি। দলে তার ফেরা নিয়ে যতই বিতর্ক থাকুক না কেন, মাশরাফি তাকে চেয়েছিলেন তা নিয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। তবে কীভাবে চেয়েছিলেন, তা নিয়ে নির্বাচক-সভাপতি-মাশরাফিদের শব্দ চয়ন ও বাক্য গঠনে হয়তো ব্যবধান ছিল।
সে কথা থাক। ১৪ সদস্যের দল ঠিক হওয়ার পর যখন আরও একজনকে দলে অন্তর্ভুক্তি নিয়ে সংশয়, তখন সাব্বিরের নাম প্রস্তাব করেছিলেন ওয়ানডে অধিনায়ক মাশরাফি।
সাব্বিরকে দলে নেওয়ার পেছনে একাধিক কারণ ছিল বলে জানিয়েছিলেন মাশরাফি। সবার আগে আসে বিশ্বকাপ। লোয়ার অর্ডারে সাব্বিরের চেয়ে দলে আর কোনো ভালো অপশন হতে পারে না, তা অধিনায়ক বুঝতে পারেন। শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) রংপুর রাইডার্সের বিপক্ষে সাব্বিরের ৮৫ রানের ইনিংসটিও গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য বহন করেছিল।
AVERTISEMENT
নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে ১৩ রানে সাজঘরে ফিরলেও, দ্বিতীয় ম্য্যাচেই চমক দেখানোর ইশারা দিয়েছিলেন সাব্বির। সেই ম্যাচে ৪৩ রানের ইনিংস খেলেন তিনি। হয়তো নিজের সেরাটা শেষ ম্যাচের জন্যই রেখে দিয়েছিলেন।
একটি ছক্কা; Image Source: AFP
প্রথম দুই ম্যাচেই সিরিজ হার হয়েছিল বাংলাদেশের। শেষ ম্যাচেও সেই পথে হেঁটেছে লাল-সবুজ জার্সিধারীরা। তবে এই ম্যাচে জয়ের চেয়ে ব্যক্তিগত সাফল্যই ছিল বড় অর্জন। বিশেষ করে লক্ষ্য যখন বিশ্বকাপ; তখন অনেক কিছুই ভাবতে হচ্ছে টিম ম্যানেজমেন্টকে। এই ম্যাচে সাব্বিরের সেঞ্চুরির পাশাপাশি মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ৬১ রানের ইনিংস খেলেছেন।
সাব্বির অবশ্য কৃতজ্ঞতা জানাতে ভোলেননি। কঠিন সময়ে পাশে থাকার জন্য ধন্যবাদ দিয়েছেন সবাইকে। বলেছেন,
প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরি পেয়ে আমি খুশি। তার চেয়েও বড় কথা আমি টিম অফিশিয়াল ও আমার দলের সদস্যদের আস্থার প্রতিদান দিতে পেরেছি।
তিনি আরও বলেন,
আমি মাশরাফি ভাইয়ের প্রতি কৃতজ্ঞ, আমি কৃতজ্ঞ দলের সেসব সদস্যদের প্রতি যারা প্রতিটি মুহূর্তে আমাকে সমর্থন দিয়ে গেছে। অতীতেও এই সমর্থনগুলো আমাকে অনেক সাহায্য করেছে।
নিজের প্রথম আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরিটি সাব্বির উৎসর্গ করেছেন নিজের বাবা-মায়ের জন্য। বাইরের ইস্যুগুলো থেকে বাবা-মায়ের সমর্থন ছাড়া কখনোই সামলাতে পারতেন না বলে মনে করেন সাব্বির।
বাবা-মা প্রসঙ্গে তাই বললেন,
আমি আমার সেঞ্চুরিটি বাবা এবং মায়ের প্রতি উৎসর্গ করছি। তারা সবসময় আমার পাশে থেকেছেন। শেষ কয়েকটা মাস আমার জন্য খুব বাজে সময় ছিল। এই সময়টাগুলোতে তাদের অনুপ্রেরণা ছিল বলেই ফিরতে পেরেছি।
২.
যেসব ইস্যুর কারণে বারবার বিতর্কিত হয়েছেন, সেই ব্যাপারগুলো কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন বলে মনে করেন বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে ১১ টেস্ট, ৫৭ ওয়ানডে আর ৪১ টি-টোয়েন্টি খেলা এই ক্রিকেটার। আবারও যেন একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়, সেই শিক্ষাও নিয়েছেন তিনি।
AVERTISEMENT
সাব্বিরকে দলে নেওয়ার মাধ্যমে মাশরাফিও কম বিপাকে পড়েননি। নির্বাচকরা যখন জানালেন, মাশরাফি চেয়েছেন সাব্বিরকে; তারপরই নিষিদ্ধ থাকা ক্রিকেটারকে কেন মাশরাফি দলে চেয়েছেন, তা নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। তাই নিউজিল্যান্ড সিরিজে সাব্বিরের সফলতায় তিনি খুশি হবেন, তা সন্দেহাতীত।
বাংলাদেশের বিপক্ষে জিতলেও, সাব্বিরের সামনে অসহায় ছিল ব্ল্যাক ক্যাপরা; Imagee Source: Getty Image
ও সেঞ্চুরি পেয়ে অনেক খুশি। ও ওর উদযাপন দিয়ে বোঝাতে চেয়েছে যে তার ব্যাট কথা বলতে জানে। জীবনের প্রথম সেঞ্চুরি, তাই স্বাভাবিকভাবেই আবেগপ্রবণ হওয়া স্বাভাবিক। তাছাড়া ও যা কিছুর মধ্যে দিয়ে এসেছে, এমন কামব্যাক; স্বাভাবিকভাবেই উদযাপনটা চলে এসেছে। আমি আশা করবো এটা এই সিরিজেই থেমে থাকবে না ইনশাআল্লাহ আরও কন্টিনিউ করবে।
সাব্বিরকে নিয়ে অনেক কথা হয়েছে, কাদা ছোড়াছুড়ি হয়েছে। সাব্বিরও প্রমাণ করেছেন, তার ব্যাট কথা বলতে পারে। ব্যাট দিয়ে এই কথা বলার প্রতিযোগিতা চলতে থাকুক দলের সবার মধ্যেই।
ওয়েলকাম ব্যাক, সাব্বির!
This is an article base on Sabbir Rahma, who is a cricketer in Bangladesh national cricket team. Recently he got is first ODI century. He was ban for his off-field issues. Feature Photo: AFP
Download the Roar App
Share Your Reactions or Comments Below
fascinated0 Readers
informed0 Readers
happy10 Readers
sad0 Readers
angry1 Readers
amused0 Readers
Roar Media prides itself on producing original, refreshing, and thought provoking content which aims to capture the vibrancy of the South Asian region.