ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনাল ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হেরে গেল বাংলাদেশ। সেই ফাইনাল ম্যাচ, যেবার সাকিব আল হাসান হাতে চোট পেলেন, যা এখনও তাকে ভোগাচ্ছে। কোনোরকম কোচ ছাড়াই মাঠে নেমেছিলো স্বাগতিকরা। ম্যাচ শেষ হলো, বিষণ্ন বদনে সংবাদ সম্মেলন শেষ করে বিদায় নিল বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কা আরো আগেই মাঠ ছেড়েছিলো, জয়ের বেশে। ক্রমশ ফ্লাডলাইটগুলো বন্ধ হতে শুরু করলো, ঝুপ করে অন্ধকারের মেঘে ঢেকে গেল মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়াম।
ঢাকায় তখন কনকনে শীত। হোম অব ক্রিকেটের আঙিনায় একটা বাস দাঁড়িয়ে আছে। সেটা গণমাধ্যমকর্মীদের নেওয়ার জন্য বিসিবির দেওয়া বাস।
এমন সময় মূল ফটকের ভিতর দিয়ে ঢুকলো ছ ফুটের একটা ছেলে। দু হাত জাতীয় দলের প্র্যাকটিস জ্যাকেটের মধ্যে গলানো। অন্ধকার হলেও, টিমটিমে সোডিয়াম আলোয় তাকে চিনতে ভুল হয়নি কারোরই। ছেলেটি ছিল নাঈম হাসান। বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দল তখন বিশ্বকাপের আসরে। ঠিক ওই অবস্থা থেকে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট খেলার জন্য উড়িয়ে আনা হলো তাকে।
জাতীয় দলে খেলার স্বপ্নে বিভোর ছেলেটি রোমাঞ্চিত হয়েছিলো দলে নাম লেখাবার পর থেকেই। খুব করে চেয়েছিলেন, অভিষেকটা যেন নিজের শহর চট্টগ্রামেই হয়। সেটাই হওয়ার কথা ছিল। কারণ প্রথম টেস্ট ম্যাচটি ছিল সাগরিকার জহুর আহমেদ চৌধুরী ক্রিকেট স্টেডিয়ামে।
শেষতক নাঈম হাসানের স্বপ্ন পূরণ হয়নি। সেবার দীর্ঘ চার বছর পর দলে ফিরেছিলেন আব্দুর রাজ্জাক। তার ফেরার ম্যাচের পারফরম্যান্সের ঝলকানিতে ম্লান হয়েছিলো নাঈমের অভিষেক ভাবনা, থেমে গিয়েছিলো প্রায় সবটুকুই।
থেমে গিয়েছিলো বটে, কিন্তু শেষ হয়নি। বিধাতা নাঈমের স্বপ্ন পূরণ করেছেন তারই মতো করে। ঠিক ১০ মাস পর শ্রীলঙ্কা নয়, উইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক হলো তার। যেখানে চেয়েছিলেন, সেই জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামেই। ১৭ বছর বয়সী ডানহাতি এই অফস্পিনার কেবল অভিষিক্ত হননি, অভিষেকটা রাঙিয়েও গেছেন। সুযোগ পেয়েই নিজের প্রথম ইনিংসে তুলে নিয়েছেন ৫ উইকেট, যা তাকে দিয়েছে প্রথম ম্যাচেই রেকর্ড গড়ার গৌরব। ৬ ফুট ২ ইঞ্চি উচ্চতার সেই নাঈম বাংলাদেশ তো বটেই, পুরো ক্রিকেট দুনিয়ায় অভিষেক টেস্টে সবচেয়ে কম বয়সে ৫ উইকেট নেওয়া ক্রিকেটার।
যে চমকে তার শুরুটা হলো, সেটা হয়তো নাঈম ধরে রাখতে চাইবেন পুরো ক্যারিয়ার জুড়েই। শুরুর কাজটা শতভাগ নম্বর পেয়েই উৎরে গিয়েছেন নাঈম, এবার কেবল নিজের চাওয়াটা বাস্তবায়নই লক্ষ্য। সঙ্গী শুধু সময়, ভাগ্য আর পরিশ্রম। যে উল্কার মতো সাফল্যের ঝড় দেখালেন নাঈম, তা যেন খসে না পড়ে। নাঈম নক্ষত্র হয়ে উঠুন, নিজের আলোয় আলোকিত হন।
১.
ক্যারিবিয়ানরা পেস বোলিংয়ে ভালো খেলে, সে কথা মাথায় রেখেই উইকেট গড়েছে বাংলাদেশ। যেটাকে বলে ‘হোম এডভান্টেজ’। সাগরিকার উইকেট হয়েছে ধীর, বলে আসছে মরণঘাতী টার্ন। সবমিলিয়ে পোয়াবারো হয়েছে স্পিনারদের জন্য।
সেই সুযোগটা ৪ জন বিশেষজ্ঞ স্পিনার নিয়ে ভালোই কাজে লাগিয়েছে বাংলাদেশ। প্রথম ইনিংসে নিজেরা ৩২৪ রান তোলার পর কেবল নাঈম-তাইজুল-সাকিব-মিরাজে গুটিয়ে গেছে উইন্ডিজ দল। সাকিব তিনটি, মিরাজ-তাইজুল একটি করে, আর অভিষিক্ত নাঈম একাই ৫ উইকেট।
স্পিনার হিসেবে নাঈমের সবচেয়ে বড় গুণ তার উচ্চতা। তবে অন্যান্য স্পিনারদের চেয়ে একটা বিশেষ কারণে আলাদা তিনি, স্পিনার নাঈম বাউন্স দিতে পারেন। এই কাজটা খুব কম ক্রিকেটারই আয়ত্ত্ব করতে পেরেছেন। তবে নাঈম পেয়েছেন সহজাতভাবে।
প্রতিফলন দেখা গেছে উইন্ডিজের ব্যাটিং ইনিংসে। ৬৪ ওভারে গুটিয়ে যাওয়ার পথে তারা নাঈমকে ১৪ ওভার খেলেছে; যার মধ্যে কেবল পাঁচটি উইকেটই দিয়ে আসেনি, দুটি মেইডেনও ছিল। তবে রান খরচের দিক থেকে সাকিব কিংবা তাইজুলদের চেয়ে একটুখানি উদার ছিলেন তিনি। ওভারপ্রতি ৪.৩৫ রানে খরচ করেছেন ৬১ রান।
বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে অভিষেক টেস্টে ৫ কিংবা তার বেশি উইকেট নেওয়া ক্রিকেটার হিসেবে নাঈমের অবস্থান অষ্টম। এর আগে সাবেক বর্তমান দলের মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, তাইজুল ইসলাম আর মেহেদী হাসান মিরাজ এই কীর্তি গড়েছেন। এছাড়া সোহাগ গাজী, মঞ্জুরুল ইসলাম, ইলিয়াস সানি ও সাবেক অধিনায়ক নাঈমুর রহমান দূর্জয় তাদের অভিষেক টেস্টে ৫ কিংবা তার বেশি উইকেট নিয়েছেন।
তবে বিশ্বরেকর্ডটা নাঈমের কেবলই একার। নাঈমের আগে সবচেয়ে কম বয়সে অভিষেক ম্যাচে ৫ উইকেট নেওয়ার কীর্তি ছিল অস্ট্রেলিয়ার প্যাট কামিন্সের, ২০১১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৭৯ রানের বিনিময়ে ৬ উইকেট নিয়েছিলেন এই পেসার। তখন তার বয়স ছিল ১৮ বছর ১৯৩ দিন। অন্যদিকে নাঈম ৫ উইকেট নিলেন ১৭ বছর ৩৫৬ দিন বয়সে।
এমন কীর্তি গড়ার পরও তেমন কোনো উচ্ছ্বাস নেই নাঈমের। মোদ্দা কথা, খবরটা জানতেনও না তিনি সংবাদ সম্মেলনে যাওয়ার আগ পর্যন্ত। গণমাধ্যম এ নিয়ে প্রশ্ন করলে উত্তর দিয়েছেন,
‘এমন কিছু করবো ভাবতেই পারিনি। এমনিতে যেভাবে খেলি, যেভাবে বল করি, সেভাবেই করেছি। ৫-১০ উইকেট নেওয়ার কোনো লক্ষ্য ছিল না। চেষ্টা করেছি প্রসেসটা মেইনটেন করার।’
তবে জহুর আহমেদ চৌধুরীর উইকেট মনে ধরেছে এই ক্রিকেটারের। বলেছেন,
‘এই উইকেটে বল ঘুরছে। সেই সুবিধা কাজে লাগিয়ে বল করেছি।’
প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখা। খানিকটা কি বাড়তি চাপে ছিলেন সাকিব-তাইজুলদের এই ভবিষ্যৎ উত্তরসূরী? উত্তরে গুগলি নাঈমের,
‘তেমন চাপ অনুভব করছি না। সিনিয়ররা অনেক সাহায্য করছেন। আমরা খেলোয়াড়, আমাদের তো খেলতেই হবে। জড়তা থাকলেও খেলতে হবে, না থাকলেও খেলতে হবে।’
২.
বোলার হিসেবে নাঈমের আরেকটি বড় গুণ হচ্ছে, নাঈম টানা অনেকক্ষণ বল করতে পারেন। সেই ব্যাপারটা তাকে অনেক আগেই আলোচনায় এনে দিয়েছে। সে কারণে বিসিবির নজরে ছিলেন তিনি। জানুয়ারিতেই তাকে নিয়ে প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন নান্নু বলেছিলেন,
‘নাঈম অনেকদিন ধরেই আমাদের একটা প্রোগ্রামের মধ্যে আছে। তাই আমরা মনে করি ওর কাছে যে কোয়ালিটি আছে তাতে ও অনেক আত্মবিশ্বাসী হবে। আমাদের মনে হয় সে ভালো করবে।’
রঙিন পোশাক নয়, নাঈমের আগ্রহটা বরাবরই এই সাদা পোশাকের ছিল। সেটার কারণও বেশ গুরুগম্ভীর। তার মতে, রঙিন পোশাকে খারাপ করলে কামব্যাক করার খুব একটা সুযোগ পাওয়া যায় না। কিন্তু টেস্টে একেবারেই উল্টো। সময়ও বেশি পাওয়া যায়, নিজেকে নিয়ে আরও কাজ করা যায়।
এই মুহূর্তে বাংলাদেশ দলের স্পিন কোচ সুনীল যোশীও নাঈম হাসানকে গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছিলেন। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন, নাঈম দীর্ঘদিন ধরে ভালো করছে। তার মেধা ও পরিশ্রমেরও প্রশংসা করেছেন সাবেক এই ভারতীয় স্পিনার।
অফস্পিনের পাশাপাশি ব্যাটিংটাও বেশ মনোযোগ দিয়ে করেন নাঈম। নিজের অভিষেক টেস্টে তাইজুল ইসলামের সঙ্গে জুটি বেঁধে ২৬ রানের ইনিংস খেলেছেন তিনি, যা দলকে ৩০০ রানের মাইলফলক পার করিয়েছে।
প্রথম শ্রেণীতে ১৫ ম্যাচে ৪৮ উইকেট পাওয়া এই ক্রিকেটারকে মনে ধরেছিলো সাবেক শ্রীলঙ্কান কোচ চান্দিকা হাতুরুসিংহের। নিজে ডেকে জাতীয় দলের নেটে নাঈমকে অনুশীলন করাতেন তিনি, বলে দিয়েছিলেন নিয়মিত অনুশীলন করতে। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকেও আলাদা করে বলে দিয়েছিলেন নাঈমের ব্যাপারে।
সেই নাঈম আজ বাংলাদেশ দলে। খুব অল্প সময়ে সাফল্য পেয়ে স্পিনার হিসেবে নিজের নামও লেখালেন। কিন্তু ইতিহাস বলে, বাংলাদেশের ক্রিকেটে স্পিনাররা প্রায় সবাই তাদের শুরুটা মনে রাখার মতোই করেন। কিন্তু ক্রমশ কালের অতলে হারিয়ে যান উল্কাপিণ্ডের মতো।
অন্তত নাঈম যেন উল্কা হয়ে খসে না পড়েন, সেই দায়িত্বটা নিতে হবে তাকেই।
This is a Bangla Article. Its a feature on Nayeem Hasan, a Bangladeshi off-spinner, who got 5 wickets in his debut test match with WI.
Feature Image: Getty Image