Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

লেভ ইয়াসিন: দ্য ব্ল্যাক স্পাইডার

১.

গোলের খেলা ফুটবল। আর সেই খেলায় গোলকিপারদের কাজ অনেকটাই ‘থ্যাংকলেস জব’। গোল বাঁচাতে না পারলে যতটা গালাগালি তাদেরকে করা হয়, বাঁচাতে পারলে প্রশংসা শোনা যায় তার ভগ্নাংশ পরিমাণ। যেন ঠেকানোরই তো কথা ছিল, এ নিয়ে এত বাড়াবাড়ির আছেটা কী? এরপরও কিছু গোলকিপার হয়ে ওঠেন কিংবদন্তি, গোলবারকে বানিয়ে নেন নিজের একচ্ছত্র সম্পত্তি, ‘অতন্দ্র প্রহরী’ শব্দ দুটিকে পরিণত করেন নিজের নামের প্রতিশব্দে।

তাকে ডাকা হতো বহুবিধ নামে, ব্ল্যাক প্যান্থার, ব্ল্যাক স্পাইডার অথবা ব্ল্যাক অক্টোপাস – তিন নামেই পরিচিত ছিলেন। কালো পোশাক ছিল তার ভীষণ পছন্দের, গোলবারে দাঁড়াতেনও সবসময় কালো পোশাক পরে। ‘ব্ল্যাক’ নামাংশের উৎপত্তিও এখান থেকেই। অতিমানবীয় সব সেভ আর ক্ষিপ্রগতিতে লাফানোর ক্ষমতা থেকেই ‘প্যান্থার’, ‘স্পাইডার’ কিংবা ‘অক্টোপাস’ এ সকল নামের উৎপত্তি। দুই হাত, দুই পা বিশিষ্ট রক্তমাংসের একজন মানুষ ঠিক কতটা অতিমানবীয় পারফরম্যান্স দেখালে তাকে স্পাইডার আর অক্টোপাসের মতো আট পা বিশিষ্ট প্রাণীর সাথে তুলনা করা হয়, তা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন।

তার পরিচয়টা দিয়ে দেয়া যাক এবার। সর্বকালের সেরা ফুটবলার কে, এটা নিয়ে বিস্তর তর্ক হতে পারে; তবে সর্বকালের সেরা গোলকিপার নিয়ে একেবারেই কোন তর্ক নেই। তিনিই সর্বকালের সেরা গোলকিপার, তার নাম লেভ ইয়াসিন

লেভ ইয়াসিন; Image Credit: Getty Images

২.

১৯২৯ সালের রাশিয়া, ২২ অক্টোবরের সকাল। মস্কোয় এক শ্রমিক পরিবারে জন্ম নিল একটি শিশু। শিশুটির পিতামাতা তার নাম রাখলেন ইয়াসিন।

এমনিতেই শ্রমিক পরিবার, হতদরিদ্র অবস্থা এককথায়। এর সাথে যুক্ত হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। চাইলেই বসে থাকার সুযোগ ছিল না। যে বয়সে মনের আনন্দে খেলে বেড়ানোর কথা, সে বয়সে তাকে লাগিয়ে দেয়া হলো কারখানার কাজে। কঠোর পরিশ্রম করতে হতো কারখানায়, বিশ্বযুদ্ধ চলায় গুলি বানাতে হতো ইয়াসিন ও তার মতো আরও অনেককে। সে সময়ে তার বিনোদনের একমাত্র উৎস ছিল ফুটবল। কাজের ফাঁকে অবসর পেলেই ফুটবল খেলতো শ্রমিকের দল, সেখানে ভিড়ে যেত কিশোর ইয়াসিনও। লম্বা, হ্যাংলা-পাতলা থাকায় স্বাভাবিকভাবেই অবস্থান হতো গোলপোস্টে। তখন থেকেই কিপিং করতেন দারুণ দক্ষতার সাথে। সেদিন সেসব শ্রমিকদের কেউই কি ভেবেছিলো যে এই কিশোরই একদিন সর্বকালের সেরা গোলকিপার হবেন?

এর মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে গেল। তার বয়স যখন ১৮ বছর, তিনি কিছুটা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। কাজটা ছেড়ে দিলেন তিনি। কারখানার কাজ তার মনের উপরে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু কাজ ছেড়ে দিলে তিনি খাবেন কী? আর যে অজুহাতে তিনি কাজ ছেড়ে দিতে চাইছেন, সেটাও তো ধোপে টিকবে না। মনে রাখা প্রয়োজন, রাশিয়ায় তখন স্ট্যালিনের শাসন চলছে।

এ সময়ই তার এক বন্ধু যে প্রস্তাব দিলেন, তাতে ইয়াসিন তথা গোটা ফুটবল বিশ্ব তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকতেই পারে। সেনাবাহিনীতে নাম লেখানোর পরামর্শ দিলো সে ইয়াসিনকে। সেনাবাহিনীতে নাম লেখানোয় আগের কাজ ছাড়তে আর কোনো সমস্যা রইলো না ইয়াসিনের, সাথে ফুটবলের দিকেও মনোযোগ দিতে পারলেন তিনি।

বাহিনীতে যোগ দেয়াতে কপাল খুলে গেল তার। ১৯৪৯ সালে তার দিকে চোখ পড়লো সাবেক ফুটবল এবং আইস হকি খেলোয়াড় আর্কাডি চেরনিশেভের। পেশায় তিনি তখন ‘ডায়নামো মস্কো’র স্কাউট। পরের বছরই ‘ডায়নামো মস্কো’ থেকে ডাক এলো ইয়াসিনের। কিন্তু অভিষেক ম্যাচে তার পারফরম্যান্স হলো জঘন্য, তার ব্যর্থতায় এক প্রীতি ম্যাচে হেরে বসলো ডায়নামো।

তবে বলাই বাহুল্য, এই ব্যর্থতায় তিনি ভেঙে পড়েননি। আশ্চর্য ব্যাপার হলো, ফুটবল দলের পাশাপাশি ডায়নামোর হকি দলের গোলরক্ষক হিসেবেও লেভ ইয়াসিন খেলেছেন বেশ কিছুদিন। এবং এখানেও তিনি সফল; ১৯৫৩ সালে সংযুক্ত রাশিয়ার আইস হকি কাপ জয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন এবং আইস হকি চ্যাম্পিয়নশিপে দলকে তৃতীয় স্থান এনে দেন। বোঝাই যাচ্ছে, ফুটবল না খেলে আইস হকি খেললেও খারাপ করতেন না লেভ ইয়াসিন।

প্রথম বছরে মাত্র দুটি ম্যাচ খেললেও পরের বছর থেকে মোটামুটি সুযোগ পেতে শুরু করেন দলে। ১৯৫৩ সালে পাকাপাকিভাবে দাঁড়িয়ে যান ডায়নামো মস্কো ক্লাবের গোলপোস্টের নিচে। অবসর নেয়ার আগ পর্যন্ত সেখান থেকে তাকে আর সরাতে পারেনি কেউ।

ক্লাবের দারুণ পারফরম্যান্স তাকে টেনে নিয়ে এলো জাতীয় দলে। ১৯৫৪ সালে রাশিয়ার হয়ে অভিষেক হয় তার। এর বছর দুয়েক পরে সিডনি অলিম্পিকে ফুটবলে সোনা জেতে রাশিয়া। ইয়াসিনের খেলায় মুগ্ধ হয়ে তাকে ১৯৫৮ বিশ্বকাপের স্কোয়াডে রাখেন নির্বাচকেরা।

১৯৫৮ আর ১৯৬২ দুবারই কোয়ার্টার ফাইনালে শেষ হয় রাশিয়ার বিশ্বকাপ মিশন। তবে প্রথমবার বিশ্বকাপ খেলতে এসেই ইয়াসিন ঢুকে গেলেন বিশ্বকাপের সেরা একাদশে। ১৯৬২ বিশ্বকাপ তাকে দেখালো মুদ্রার উল্টো পিঠ। গ্রুপ পর্বের ম্যাচে কলম্বিয়ার সাথে ৪-১ ব্যবধানে এগিয়ে থেকেও ইয়াসিনের অমার্জনীয় কিছু ভুলে ৪-৪ ড্র নিয়ে মাঠ ছাড়ে রাশিয়া। সমালোচনার তীর ছুটে আসে তার দিকে; ফ্রান্সের পত্রিকা এল’ইকুইপ শিরোনাম করে- ‘ইয়াসিনের ক্যারিয়ার শেষ’।

সময়টা এতটাই খারাপ ছিল যে, ফুটবল ছেড়েই দেয়ার চিন্তা করেছিলেন তিনি। বিশ্বকাপ থেকে বিদায়ের জন্য ইয়াসিনকেই দায়ী করছিল সবাই। যেন দলের বাকি সবার কারো কোনো দায়ই নেই!

কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন, তিনি একজন লড়াকু। যে ইয়াসিনের ক্যারিয়ার শেষ হয়েছিল ‘৬২ বিশ্বকাপে, এক বছর পর সেই তিনিই ১৯৬৩ সালের ব্যালন ডি’অর জিতে নিলেন। গোলকিপার হিসেবে এখন পর্যন্ত একমাত্র তার হাতেই উঠেছে এই পুরস্কার।

ব্যালন হাতে ইয়াসিন; Image Source: russianfootballnews.com

১৯৬৬ বিশ্বকাপে আগুনের মতো জ্বলে ওঠেন ইয়াসিন, দলকে নিয়ে যান সেমিফাইনালে। ফাইনালে উঠতে ব্যর্থ হলেও চতুর্থ স্থানটাই ছিল সোভিয়েত রাশিয়ার জন্য অনেক বড় কিছু। জাতীয় দলের হয়ে তার সেরা সাফল্য এসেছিল ১৯৬০ সালে, ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত ইউরো’র প্রথম আসরের শিরোপা জিতেছিলো রাশিয়া।

১৯৭১ সালে মস্কোতে অনুষ্ঠিত নিজের শেষ খেলায় অংশগ্রহণ করেন লেভ ইয়াসিন। মস্কোর লেনিন স্টেডিয়ামে প্রায় এক লক্ষ সমর্থকের উপস্থিতিতে একটি প্রীতি ম্যাচের আয়োজন করেছিলো ফিফা।। সেই ম্যাচ খেলেছিলেন পেলে, ইউসেবিও এবং ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারের মতো ফুটবল তারকারা; সবাই এসেছিলেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ গোলকিপারকে বিদায় জানাতে।

ইয়াসিন ও পেলে; Image Source: Getty images

৩.

একজন গোলকিপার তার পুরো ক্যারিয়ারে কতগুলো পেনাল্টি সেভ করতে পারেন? ১০টি? ২০টি? অথবা ৫০টি? লেভ ইয়াসিন সেভ করেছিলেন ১৫০টি। জ্বি, সংখ্যাটা ১৫০-ই। অবাক লাগছে? আরেকটু অবাক হওয়ার মতো তথ্য দেয়া যাক। ক্যারিয়ারে প্রায় ৮১২টি ম্যাচ খেলে প্রায় ৫০০ ম্যাচে ‘ক্লিনশিট’ রাখেন তিনি।

১৯৯৪ সালে ফিফা তার স্মরণে নতুন পুরস্কার চালু করে বিশ্বকাপে। সেরা গোলকিপারকে দেওয়া হয় ‘লেভ ইয়াসিন অ্যাওয়ার্ড’। ২০০৯ সালে ‘সেন্ট্রাল ব্যাংক অব রাশিয়া’ তার স্মরণে ২ রুবলের কয়েন ছাড়ে বাজারে। দেশের মুদ্রায় একজন খেলোয়াড়ের ছবি সংবলিত থাকাই বলে দেয়, তিনি কতটা ভালো ফুটবলার ছিলেন।

ইয়াসিনের ছবি সংবলিত সেই রুবল; Image Source: numista.com

১৯৬৪ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের সবচেয়ে বড় পুরস্কার ‘অর্ডার অব লেনিন’ উপাধিতে ভূষিত করা হয় তাঁকে। ১৯৭১ সালে অবসর গ্রহণ করার পর প্রায় ২০ বছর তিনি ডায়নামো মস্কোর পরিচালনা পর্ষদের বিভিন্ন পদে কর্মরত ছিলেন। মস্কোর ডায়নামো স্টেডিয়ামে তার একটি ব্রোঞ্জের ভাস্কর্যও স্থাপন করা হয়। ভাস্কর্য আছে মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামের বাইরেও।

ডায়নামো মস্কোর স্টেডিয়ামের সামনে উড়ছেন লেভ; Image Source: skyscrapercity.com
লুঝনিকি স্টেডিয়ামের বাইরে লেভ ইয়াসিন; Image Source: progulyaemsya.ru

৪.   

বিভিন্ন সময়ে অনেক খেলোয়াড় কথা বলেছেন লেভ ইয়াসিনকে নিয়ে। সব লিখতে গেলে এই লেখা আর শেষ হবে না। বরং ‘কালো মানিক’ পেলের কথা দিয়েই লেখাটা শেষ করা যাক।

“নিঃসন্দেহে সে সর্বকালের সেরা গোলকিপার। আমার ভাগ্য ভালো ছিল যে, আমাকে কখনো লেভ ইয়াসিনের বিরুদ্ধে খেলতে হয়নি।”

আজ ২২ অক্টোবর, সর্বকালের সেরা এই গোলকিপারের জন্মদিন। শুভ জন্মদিন, লেভ ইয়াসিন।

This Article is in Bangla language. 

Featured Image : Шандрин Виктор

Related Articles