Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

একজন রাজিন সালেহ’র বিদায় ও স্বপ্ন

নভেম্বর, ২০০০। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম।

ভারতের বিপক্ষে অভিষেক টেস্ট খেলছে বাংলাদেশ। স্বাগতিক দলের ঐতিহাসিক প্রথম ইনিংসের জবাব দিতে গিয়ে পা পিছলাচ্ছে ভারতের। উইকেটে তখন শচীন টেন্ডুলকার। অধিনায়ক নাঈমুর রহমান দুর্জয়ের বল টেন্ডুলকারের ব্যাট ছুঁয়ে উঠে গেলো ক্লোজে। বাজ পাখির মতো ঝাঁপিয়ে বল ধরে নিলো ছোটখাটো গড়নের এক কিশোর। এর একটু আগেই এই কিশোরটাই লুফে নিয়েছে মুরালি কার্তিকের ক্যাচ।

পরপর এই দুই অসাধারণ ক্যাচ নেওয়ার পর বিশ্বজুড়ে টেলিভিশনের সামনে প্রশ্ন উঠলো, কে এই কিশোর? বাংলাদেশ দলে এত অল্পবয়সী ছেলেটি কে? সে কি টেস্ট খেলছে?

নাহ। সেই টেস্টের একাদশে ছিল না ছেলেটির নাম। দ্বাদশ খেলোয়াড় হিসেবে, ভবিষ্যতের এক তারকা হিসেবে সেদিন মাঠে নেমেছিলো ছেলেটি। সেদিন তার মধ্যে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেছিলো গোটা বিশ্ব। সেদিন একজন ভবিষ্যতের তারকা হয়ে উঠতে চেয়েছিলেন রাজিন সালেহ আলম।

হ্যা, আমাদের রাজিন সালেহ।

যতটা স্বপ্ন রাজিন সালেহকে নিয়ে দেখা হয়েছিলো, তার সবটা হয়তো পূরণ করতে পারেননি এই ব্যাটসম্যান। এক সময় মনে করা হতো, রাজিন হবেন ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের সেরা টেস্ট ব্যাটসম্যান, অধিনায়ক। জাতীয় দলে অধিনায়কত্ব করেছেন তিনি হাবিবুল বাশারের অনুপস্থিতিতে। কিন্তু অধিনায়ক বা ব্যাটসম্যান, কোনো চেহারাতেই প্রতিশ্রুতির মতো করে বড় হয়ে উঠতে পারেননি।

সেঞ্চুরি করার পর বন্ধু অলক কাপালির সাথে; Image Source: Tiger Cricket

জাতীয় দলের হয়ে ২৪টি টেস্টে ২৫.৯৩ গড়ে ১১৪১ রান করেছেন, ৪৩টি ওয়ানডেতে ২৩.৯২ গড়ে ১০০৫ রান করেছেন। জাতীয় দলে সেভাবে পূর্ণ বিকশিত না হলেও প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে নিজেকে মেলে ধরতে পেরেছেন অনেকটাই। এ নিয়ে আফসোসও আছে। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে যখন ক্যারিয়ারের সেরা ফর্মে ছিলেন, সেই সময়টাতেই জাতীয় দলে সুযোগ হয়নি কখনো।

তারপরও ঘরোয়া প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলে গেছেন রাজিন পূর্বাঞ্চল ও সিলেটের হয়ে। অবশেষে ১৪৮টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলার পর ইতি টেনেছেন ক্যারিয়ারের। এই মৌসুমেই সব ধরনের প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটকে বিদায় বলে দিয়েছেন রাজিন। শেষ হয়েছে একটা ইতিহাসের পর্ব।

কেন এই সময়ে অবসর নিলেন, সে কথা বলতে গিয়ে রাজিন বলছিলেন,

‘আমি বাংলাদেশ দলে খেলেছি। জাতীয় লিগ, বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগ খেলেছি, ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ খেলেছি। এখন দেশে যে কম্পিটিটিভ ক্রিকেট শুরু হয়েছে, তাতে যুদ্ধ করে টিকে থাকাটা একটু কঠিন হয়ে যাচ্ছিলো। জাতীয় লিগ বা বিসিএলে সমস্যা হচ্ছিলো না; ওখানে আমি পারফরম করছিলাম, ফলে খেলার সুযোগও পাচ্ছিলাম। কিন্তু ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে গত বছর আমি টিম পাইনি। যদিও এর আগের বছর পারফরম করেছিলাম। কেন পাইনি, জানি না। এই অবস্থায় ভাবলাম, সম্মান থাকতে থাকতে খেলা ছেড়ে দেওয়া ভালো। যতটুকু খেলেছি, সম্মান নিয়েই খেলেছি।’

সৌরভছড়ানো সেই দিনগুলোতে; Image Credit: Getty Images

শুরু থেকে শুরু করা যাক।

সিলেটের অত্যন্ত ক্রীড়ামোদী একটা পরিবারে ১৯৮৩ সালের ২০ নভেম্বর রাজিন সালেহ’র জন্ম। রাজিনের বাবা নূরে আলম রীতিমতো ঢাকার প্রতিযোগিতামূলক ফুটবল ও হকি খেলতেন। রাজিন বড় হতে হতে দেখেছেন, তার বড় দুই ভাই ক্রিকেট খেলছেন। এখনই বলে রাখা ভালো, রাজিনরা চার ভাই বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলেছেন।

রাজিনের শুরু সিলেটেরই দ্বিতীয় বিভাগ ক্রিকেট খেলে। তখন রাজিনদের আর্থিক অবস্থা খুব ভালো ছিল না, এবং ক্রিকেটের মতো খাতে ব্যয় করার মতো বাড়তি টাকা জোগাড় করাটা কঠিন ছিল। তাই বেশ কষ্ট করেই ক্রিকেটের শুরুর দিনগুলো কাটাতে হয়েছে রাজিনকে।

তখন রাজিনের সম্বল বলতে ছিল একটা ট্রাউজার। ওটা পরেই প্র্যাকটিস, আবার ওটা ধুয়ে শুকিয়েই খেলা। তার স্বপ্ন ছিল তখন একটা বাড়তি ট্রাউজার। দ্বিতীয় বিভাগে খেলার আগে কর্মকর্তাদের তাই বললেন,

‘ভালো খেললে আমাকে একটা ট্রাউজার দেবেন?’

রাজিন দ্বিতীয় বিভাগের চার ম্যাচে ৩টি ফিফটি করলেন। এরপর সেই কর্মকর্তা রাজিনকে একটা নয়, দুটো ট্রাউজার কিনে দিলেন।

এভাবেই রাজিনকে ক্রিকেটই দেখে শুনে রেখেছে।

Image Credit: AFP/Getty Images

১৯৯৬ সালে ঢাকায় এলেন ঢাকা লিগের বাছাইপর্বে খেলতে। সেখানে ভালো করে দলও পেয়ে গেলেন। সেই সাথে অংশ নিলেন অনুর্ধ্ব-১৬ জাতীয় দলের বাছাইপর্বে। সেখানে চারশ’ ক্রিকেটারের মধ্যে থেকে টিকে গেলেন মূল দলে।

এখানে শুরু হলো রাজিনের সত্যিকারের লড়াই। অনুর্ধ্ব-১৬ দলের ক্যাম্প চলে, রাজিন প্রতিদিন হাত খরচ পান ১০০ টাকা করে। এ দিয়ে ঢাকা শহরে তিন বেলা খেয়ে চলা খুব কঠিন। তাই মাঝে মাঝেই এক বেলা, দুই বেলা না খেয়ে থাকতে হয়। দুই বড় ভাই ঢাকায় ক্লাবে খেলেন। তারা জিজ্ঞেস করেন, ‘কেমন চলছে?’ 

রাজিন ভাইদের মন খারাপ হতে দেন না। বলেন, ‘খুব ভালো। বোর্ড অনেক টাকা দেয়। খুব ভালো চলছে।

একদিন এক ভাইয়া বলেন, ‘শুকিয়ে যাচ্ছিস কেন?

রাজিন বলেন, ‘অনেক পরিশ্রম তো, তাই।

জাতীয় দলের নেটে; Image Source: AFP

এভাবে ক্রিকেটে লেগে থাকেন। পুরস্কার মিলতে শুরু করে এক সময়। অগ্রণী ব্যাংক দল তাদের দলে ভিড়িয়ে নেয় রাজিনকে। অন্যদিকে অনুর্ধ্ব-১৬ হয়ে একসময় অনুর্ধ্ব-১৯ দলেও জায়গা হয়ে যায়। আস্তে আস্তে রাজিন ঢাকার ক্রিকেটে নিজেকে শক্ত করে তোলেন।

২০০৩ সালে পাকিস্তান সফরে জাতীয় দলের হয়ে টেস্ট ও ওয়ানডে অভিষেক হয়ে যায়। এরপর থেকে ২০০৬ সাল অবধি ওয়ানডে খেলেছেন। টেস্ট শেষ খেলেছেন ২০০৮ সালে। এখানেই রাজিন ফুরিয়ে যাননি।

জাতীয় দলে শেষ দিকে পারফরম্যান্স ভালো না হলেও ঘরোয়া ক্রিকেটে দারুন পারফর্ম করেন ২০১১ ও ২০১২ সালে। ছিলেন সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকদের মধ্যে। তারপরও জাতীয় দলে ডাক আসেনি। এই সময়টা নিয়ে একটু হতাশা আছে রাজিনের। বলছিলেন,

‘একটা সময় পর্যন্ত স্বপ্নটা ছিল। ২০০৮ সালে শেষ ম্যাচ খেলেছি। এরপর অন্তত ৫ বছর আমার ওই স্বপ্নটা ছিল। এর মধ্যে ২০১১ আর ২০১২ সালে আমি জাতীয় লিগে সেরা দুই রান সংগ্রাহকের মধ্যে ছিলাম। তখন আশা করেছিলাম যে, জাতীয় দল না হোক, অন্তত ‘এ’ দলে ডাক পাবো। সেখান থেকে নিজেকে প্রমাণ করতে পারলে হয়তো জাতীয় দলে যেতে পারবো, আশা ছিল। যেকোনো কারণেই হোক, সেটা হয়নি। কিন্তু ২০১৩-১৪ সাল পর্যন্ত সেই সুযোগটা যখন এলো না, তখন আমি শুধু ঘরোয়া ক্রিকেটেই মন দিয়েছি। শেষ দিকে আর ওরকম কোনো স্বপ্ন ছিল না।’

এখন অবশ্য পেছন ফিরে আর খুব বেশি আফসোস করেন না। জাতীয় দল এখন যে অবস্থায় আছে, তা দেখে খুবই খুশি এই সিলেটের সাবেক ক্রিকেটার। নিজেদের সময়ের সাথে তুলনা করতে গিয়ে বলছিলেন,

‘আমাদের সময়ের সাথে এখন রাত আর দিন তফাৎ। আমরা যখন বাংলাদেশ দলে খেলেছি, তখন ম্যাচ উইনার খুঁজে পাওয়া কঠিন ছিল। হয়তো কেউ একজন অসাধারণ খেললে একটা জয় আসতেও পারতো। আর এখন দলে পাঁচজন সিনিয়র ক্রিকেটার আছে, এরা নিয়মিত ম্যাচ জেতাচ্ছে। তরুণও অনেক ভালো ক্রিকেটার। এই দল নিয়মিত জয় পায়। এদের সঙ্গে আমাদের তুলনাই হয় না।’

রাজিন এখন ক্রিকেটকেই নিজের বাকি সময়টা দিতে চান। ক্রিকেট থেকে যা পেয়েছেন, সেই জ্ঞানটা ক্রিকেটেই ফিরিয়ে দিতে চান।

সতীর্থ জাভেদ ওমরের সাথে টেস্ট মাঠে; Image Source: AFP

সিলেটে একটা অ্যাকাডেমি আছে, সেটা নিয়ে ব্যস্ততা আছে। এ ছাড়া একটা স্পন্সর প্রতিষ্ঠানের সাথে সারা দেশে কিছু কোচিং করান তিনি। তবে সবচেয়ে বড় সময়টা দিচ্ছেন মেট্রোপলিটান বিশ্ববিদ্যালয়ে। সিলেটের এই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্পোর্টিং ডিরেক্টর তিনি। এই প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করছেন সিলেটের উঠতি সব ক্রিকেটাররা। এই প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য জায়গায় ক্রিকেট নিয়ে কাজ করাটাই এখন রাজিনের স্বপ্ন। এই স্বপ্নপূরণে বিসিবিও হয়তো তার পাশে থাকবে। সবমিলিয়ে রাজিন স্বপ্ন দেখেন। বলছিলেন,

‘আমাদের সিলেট থেকে ভালো খেলোয়াড় বের হচ্ছে না। ব্যাটসম্যানদের মধ্যে জাতীয় দলের আশেপাশে কেবল জাকির হাসান আছে। এছাড়া আর ব্যাটসম্যান নাই। সিলেট দলও জাতীয় লিগে ভালো ফল পায় না অনেকদিন। ছেলেরা পরিশ্রম করে, কিন্তু ভালো ফল আসছে না। আমি মনে করি, এখানে সঠিক প্রশিক্ষণ এই ছেলেরা পাচ্ছে না। আমি সেটা করতে চাই। বাংলাদেশের ক্রিকেট, সিলেটের ক্রিকেট আমাকে অনেক দিয়েছে। আমি এখন ক্রিকেটের জন্যই কিছু করতে চাই।’

রাজিনের এই চাওয়া সত্যি হোক।

This article is in Bangla language. It is an article about retired Bangladeshi cricketer Rajin Saleh. 

Feature Image: Independent

Related Articles