Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ষষ্ঠবারের মতো ইউরোপসেরা লিভারপুল

এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগের দুই ফাইনালিস্ট লিভারপুল ও টটেনহ্যামের মধ্যে বেশ কিছু সাদৃশ্য ছিল। দুই দলই ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব সেটা সকলেই জানেন। এছাড়া দীর্ঘদিন শিরোপা জিততে না পারার ব্যাপারটাও দুই দলের মাঝে একটা সেতুবন্ধন গড়ে দিয়েছিল। এই ফাইনালের আগে লিভারপুল সর্বশেষ শিরোপার দেখা পেয়েছিলো আজ থেকে সাত বছর আগে, টটেনহ্যামের শেষ ট্রফি জয়ের গল্প তো আরও চার বছর আগের। তাই এই দু’দল ফাইনালে উঠার পর এদের একজনের শিরোপার আক্ষেপ ঘুচতে যাচ্ছে সেটা নিশ্চিত হয়ে গেছিলো। আর এক্ষেত্রে স্পার্সের অপেক্ষা আরও দীর্ঘ করে নিজেদের ষষ্ঠ উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা ঘরে তুললো লিভারপুল।

লিভারপুল ও টটেনহ্যাম– দুটি দলই নাটকীয় প্রত্যাবর্তনের কীর্তি গড়ে এই ফাইনালের টিকিট পেয়েছিলো। ফাইনালে দুই দলের কোচই তাদের সেই নাটকের মূল নায়কদের বেঞ্চে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। লিভারপুল কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপ তার চিরায়ত ৪-৩-৩ ফর্মেশনেই দলকে ফাইনালে নামিয়েছিলেন, যেখানে বার্সার বিপক্ষে জোড়া গোল করা ডিভক অরিগিকে বেঞ্চে বসিয়ে ইনজুরি থেকে ফিরে আসা রবার্তো ফিরমিনোকে একাদশে নামান। তবে সেমিফাইনালে হ্যাটট্রিক করা লুকাস মৌরাকে বাদ দিয়ে ৪-২-৩-১ ফর্মেশনে একাদশ সাজিয়ে বড় চমকটা উপহার দেন স্পার্স কোচ মাউরিসিও পচেত্তিনো। 

সেমিফাইনালের নায়ক লুকাসকে মূল একাদশে না নামিয়ে আলোচনার জন্ম দেন পচেত্তিনো; Image Source: FootballCoin

ওয়ান্ডা মেট্রোপলিটন স্টেডিয়ামে খেলা শুরুর মাত্র ২৯ সেকেন্ডে এগিয়ে যাওয়ার দারুণ এক সুযোগ পেয়ে যায় লিভারপুল, পেনাল্টি বক্সের একদম শেষপ্রান্তে সাদিও মানের পাস ঠেকাতে গিয়ে বাহুতে বল লাগিয়ে ফেলেন টটেনহ্যামের ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার মুসা সিসোকো, সাথে সাথে পেনাল্টির বাঁশি বাজান স্লোভেনিয়ান রেফারি দামির স্কোমিনা। সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা পরীক্ষা করার জন্য ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারির পরামর্শও তিনি নিয়েছিলেন, সেখানেও পেনাল্টির সিদ্ধান্ত বহাল থাকে।

চলতি মৌসুমেই তিনটি পেনাল্টি সেভ করেছেন স্পার্স গোলরক্ষক হুগো লরিস। তবে এবার আর পারলেন না, খেলা শুরুর ২ মিনিটের মাথায় মো. সালাহর গোলে ১-০তে এগিয়ে যায় লিভারপুল। গতবছর এই চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালেই আহত হয়ে হয়ে ভেজা নয়নে মাঠ ছেড়েছিলেন সালাহ, সেই দুঃখ ভুলতে এরচেয়ে ভালো শুরু আর কীইবা হতে পারতো? সালাহর এই গোল অবশ্য চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালের ইতিহাসে দ্বিতীয় দ্রুততম। ২০০৫ সালে ইস্তাম্বুলের সেই ঐতিহাসিক ফাইনালে, লিভারপুলের বিপক্ষেই ৫০ সেকেন্ডে এসি মিলানের পাওলো মালদিনি ফাইনালের দ্রুততম গোলটি করেছিলেন। 

গোলের পর উল্লসিত সালাহ; Photo Credit: Tolga Bozoğlu/EPA

গোল হজমের পর খেলায় ফেরার চেষ্টা চালাতে থাকে টটেনহ্যাম, অন্যদিকে শুরুতেই এগিয়ে যাওয়ায় নিজেদের চিরচেনা খেলার ধরন ভুলে কিছুটা রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতে খেলতে থাকে লিভারপুল। তাই টটেনহ্যাম লং পাস বাড়িয়ে বারংবার লিভারপুলের রক্ষণভাগ ভাঙার চেষ্টা করেও সফল হয়নি, উল্টো লিভারপুলই পাল্টা আক্রমণে বেশ কয়েকবার স্পার্স রক্ষণভাগে ভয় ধরিয়ে দিয়েছিলো।

বিশেষ করে ৩৮ মিনিটে জোয়েল ম্যাটিপের লং পাস থেকে বল পেয়ে অ্যান্ড্রু রবার্টসন যে দূরপাল্লার শট নিয়েছিলেন সেটা লরিস সেভ না করলে তখনই ২-০ গোলে এগিয়ে যেতো অলরেডরা। অন্যদিকে এরিকসন-আলির জুটি ফ্যাবিনহোকে মাঝমাঠে বেশ কয়েকবার একা পেলেও ফাইনাল থ্রু-পাসে সেই জাদুটা আর দেখাতে পারেনি তারা, তাই লিভারপুল ১-০ গোলে এগিয়ে থাকা অবস্থাতেই শেষ হয় প্রথমার্ধের খেলা।

ম্যাড়ম্যাড়ে প্রথমার্ধের পর দ্বিতীয়ার্ধে খেলায় কিছুটা গতি আনে টটেনহ্যাম। ৪৭ মিনিটে ট্রিপিয়ারের ক্রস থেকে বল পেয়ে গোলমুখে শট মারেন সন-হিউং মিন, কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট সেই শট লিভারপুলের কোনো বিপদ ঘটাতে পারেনি। ৫৫ মিনিটে অবশ্য লিভারপুলই ব্যবধান দ্বিগুণ করতে পারতো, রবার্টসনের করা অসাধারণ একটা ক্রস গোলপোস্ট থেকে কিছুটা এগিয়ে এসে দারুণভাবে ধরে নিয়ে স্পার্সকে বাঁচিয়ে দেন লরিস। 

রবার্টসনের সেই শট; Photo Credit: Toby Melville/Reuters

এদিকে টানা আক্রমণ চালিয়ে লিভারপুলের উপর চাপ বাড়িয়েই যাচ্ছিলো টটেনহ্যাম। কিন্তু অলরেড ডিফেন্ডারদের দৃঢ়তায় কিছুতেই কিছু হয়ে উঠছিলো না। তাছাড়া ট্যাকটিকাল দিক থেকেও স্পার্সের চেয়ে কিছুটা এগিয়ে ছিল লিভারপুল। দ্বিতীয়ার্ধের খেলা শুরুর পর ক্লপই আগে খেলোয়াড় বদল করেন। ৫৮ মিনিটে ফিরমিনোর বদলে ডিভক অরিগি ও ৬২ মিনিটে ভাইনালদুমের বদলে নামান জেমস মিলনারকে। অন্যদিকে ৬৬ মিনিটে খেলার গতিপথে বদল আনতে হ্যারি উইঙ্কসের বদলে সেমিফাইনালের নায়ক লুকাস মৌরাকে নামান পচেত্তিনো।

৬৯ মিনিটে ব্যবধান দ্বিগুণ করার দারুণ এক সুযোগ পেয়ে গেছিলো লিভারপুল, মাঝমাঠে এরিকসনকে কাটিয়ে দারুণভাবে ডিবক্সের কাছাকাছি চলে আসেন সাদিও মানে, সেখান থেকে বল বাড়িয়ে দেন সালাহর দিকে। কিছুটা ফাঁকায় দাঁড়িয়ে থাকা মিলনারের দিকে দ্রুত বল বাড়িয়ে দেন সালাহ, মিলনার শটও নিয়েছিলেন তবে অল্পের জন্য তা গোলপোস্টের বাইরে চলে যায়। 

অ্যালিসন যেন এদিন চীনের প্রাচীর হয়ে দু’দলের মাঝে দাঁড়িয়েছিলেন; Photo Credit:  Susana Vera/Reuters

এরপর লিভারপুলের রক্ষণভাগে একের পর আক্রমণের তোড় চালিয়ে গেছে টটেনহ্যাম; কিন্তু প্রতিবারই বাঁধার দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছেন অলরেডদের ব্রাজিলিয়ান গোলরক্ষক অ্যালিসন বেকার। ৮০ মিনিটের সময় ২৫ গজ দূর থেকে শট নেন সন; সেই শট রুণ দক্ষতায় ফিরিয়ে দেন অ্যালিসন, এর পরপরিই লুকাস ফিরতি শট নিলে আবারো বাঁধার দেয়াল হয়ে দাঁড়ান সেই অ্যালিসনই। ৮৪ মিনিটে ডিবক্সের একপ্রান্তের কিছুটা বাইরে ফ্রি কিক পায় টটেনহ্যাম, সেখান থেকে এরিকসনের শটটাও বেশ ভালো ছিল কিন্তু বাঁ পাশে ঝাঁপিয়ে পড়ে আবারো লিভারপুলকে বাঁচিয়ে দেন অ্যালিসন।   

খেলার ৮৮ মিনিটে মিলনারের নেওয়া কর্নার ক্লিয়ার করতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলে স্পার্সের রক্ষণভাগ। সেখান থেকে বল পেয়ে ফাঁকায় দাঁড়িয়ে থাকা অরিগির কাছে বল পাঠিয়ে দেন ম্যাটিপ, এই দফায় অবশ্য কোনো ভুল হয়নি। অরিগির বাঁ পায়ে নেওয়া শট জালে জড়ালে ২-০ গোলে এগিয়ে যায় লিভারপুল। মৌসুমের অধিকাংশ সময়ে যে কাটিয়েছে সাইডবেঞ্চে বসে সেই অরিগিই চ্যাম্পিয়নস লিগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে দলের ত্রাণকর্তা হয়ে এলেন! স্টেডিয়ামে উপস্থিত লিভারপুল ভক্তরা তখন বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে মাতোয়ারা। 

অরিগির নেওয়া সেই শট; Photo Credit: Michael Regan/Getty Images

বাকিটা সময়েও অবশ্য ব্যবধান কমানোর চেষ্টা চালিয়ে গেছে টটেনহ্যাম কিন্তু অ্যালিসনের দৃঢ়তায় প্রতিবারই ব্যর্থ হতে হয়েছে তাদের। শেষ বাঁশি বাজার সাথে সাথে ষষ্ঠ চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের আনন্দে উল্লাসে ফেটে পড়ে পুরো লিভারপুল দল, রিয়াল মাদ্রিদ ও এসি মিলানের পর চ্যাম্পিয়নস লিগ ইতিহাসে সফল দলের তকমাটা এককভাবে মার্সিডাইডের এই ক্লাবের দখলেই চলে গেলো।

এমন একটি রাত কত বছর পর লিভারপুল ভক্তদের জীবনে এলো! সেই যে ২০০৪-০৫ মৌসুমে ইস্তাম্বুলে রূপকথার জন্ম দিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা ঘরে তোলা হয়েছিলো, এরপর শুধু ব্যর্থতার দীর্ঘশ্বাসেই কেটে গেছে অনেকগুলো দিন। মাঝে বেশ কয়েকবার প্রিমিয়ার লিগের অধরা শিরোপার খুব কাছে গিয়েও ব্যর্থ হতে হয়েছে, এমনকি এবারের মৌসুমে ৯৭ পয়েন্ট পেয়েও মাত্র এক পয়েন্টের ব্যবধানে খোয়াতে হয়েছে লিগ শ্রেষ্ঠত্ব। চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালেও তো গতবার তীরে এসে তরী ডুবেছিলো, রিয়াল মাদ্রিদের কাছে সেই ফাইনাল হারার দুঃখটা তো খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। এসব দুঃখগাঁথার কারণেই হয়তো চ্যাম্পিয়নস লিগের ট্রফিটা হাতে নেওয়ার সাথে সাথে বাঁধভাঙা উল্লাসে ফেটে পড়েছিলো পুরো লিভারপুল দল। 

শিরোপা নিয়ে উল্লাসে মাতোয়ারা লিভারপুল; Image Source: New York Times

অবশ্য আরেকজন মানুষের কাছেও এই ট্রফি জয়টা বড্ড বেশি জরুরী ছিল, তিনি লিভারপুল কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপ। কোচ হিসেবে ট্যাকটিকালি তিনি বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সেরা এই বিষয়ে খুব কম মানুষই দ্বিমত প্রকাশ করবে। লিভারপুলের কোচ হওয়ার পর আস্তে আস্তে তিনি যেভাবে দলটাকে পাল্টে দিয়েছেন তা সত্যিই দুর্দান্ত।

কিন্তু শিরোপার লড়াইয়ে শেষ ধাপে এসে বারবার হোঁচট খাওয়াটা তার সামর্থ্যকে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ করছিলো। এই ফাইনালের আগে ডাগআউটে বসে টানা ছয়বার নিজের দলকে ফাইনাল হারতে দেখেছিলেন ক্লপ, এরমধ্যে তিনটি হার ছিল অলরেডদের কোচ হিসেবে। তাছাড়া লিভারপুলের কোচ হিসেবে সাড়ে তিন বছর দায়িত্ব পালন করা সত্ত্বেও কোনো শিরোপা জিততে না পারায় তার উপর একটা অদৃশ্য চাপও দিনদিন বাড়ছিলো। সব প্রশ্ন, হতাশাকে উড়িয়ে দেওয়ার জন্য এরচেয়ে ভালো উপলক্ষ আর কিছু কি হতে পারতো? 

সপ্তম চেষ্টায় ফাইনাল কুফা কাটানোর পর সপ্তম স্বর্গে তো ক্লপ চড়তেই পারেন! Photo Credit: Paul Ellis/AFP/Getty Images

তবে একরাশ দুঃখ টটেনহ্যামের জন্য, কখনো চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপা জিততে না পারা দলটির জন্য শিরোপার এত কাছে এসেও ফিরে যাওয়াটা সত্যিই হতাশাজনক। বিশেষভাবে বলতে হয় স্পার্স কোচ মাউরিসিও পচেত্তিনোর কথা, টাকার ঝনঝনানি না থাকা সত্ত্বেও দীর্ঘদিন ধরে ক্লাবটির পারফরম্যান্স ছকে একটা ধারাবাহিকতা বজায় রেখে চলেছিলেন এই আর্জেন্টাইন কোচ। এমনকি নতুন স্টেডিয়াম তৈরি করতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হওয়ায় এই মৌসুমে নতুন কোনো খেলোয়াড়ও দলে ভেড়াতে পারেনি স্পার্স তবুও সীমিত শক্তি নিয়ে লড়াই করে যেভাবে তারা ফাইনালে উঠে এসেছে তা সত্যিই প্রশংসনীয়।

তবে একটা কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, নাটকীয়তার দিক থেকে এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগ সাম্প্রতিক সময়ের অন্য সব আসরকে ছাড়িয়ে গেছে। বিচিত্র সব ম্যাচ, নাটকীয় সব গল্প উপহার দেওয়ার কারণে এবারের আসর চ্যাম্পিয়নস লিগ ইতিহাসের অন্যতম সেরা আসর হিসেবেই বিবেচিত হবে। 

This article is in Bangla language. It's an analysis about the UEFA Champions League Final bwtween Livarpool & Tottenham. For references please check the hyperlinks inside the article.

Featured Image: New York Times

Related Articles