ট্র্যাজেডি আর প্রোটিয়া ক্রিকেট– এরা যেনো মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। সেই শুরু থেকেই বহু দুঃখজনক ঘটনার কারণে প্রোটিয়া ক্রিকেট বারবার হোঁচট খেয়েছে। বর্ণবাদ বিতর্কের জন্য দীর্ঘদিনের জন্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ হওয়া, ১৯৯২ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে বৃষ্টি আইনের তামাশায় লড়াই করার সুযোগ না পাওয়া, ১৯৯৯ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে হাস্যকর এক রান আউটে অজিদের সাথে ম্যাচ টাই করা, ম্যাচ গড়াপেটা বিতর্কে হ্যান্সি ক্রনিয়ের মতো একজন নেতাকে হারানো– এই তালিকা শেষ হওয়ার নয়।
তবে প্রোটিয়া ক্রিকেটে সবচেয়ে কম আলোচিত হওয়া ট্র্যাজেডিটা সম্ভবত বাঁহাতি পেসার লোনওয়াবো সোতসোবের জীবনেই ঘটে গেছে, যদিও তার গল্পটাও বেশ নাটকীয়।
ক্রিকেট দুনিয়ার নিয়মিত দর্শকদের কাছে এই নামটি অপরিচিত হওয়ার কথা নয়, পাঁচ বছর আগেও এই সোতসোবে ছিলেন প্রোটিয়া ক্রিকেট দলের একজন নিয়মিত খেলোয়াড়। বিশেষ করে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে তিনি ছিলেন ভীষণ কার্যকরী একজন বোলার। দলের এমন নিয়মিত একজন সদস্য কেন এভাবে হুট করে হারিয়ে গেলো? এই ব্যাপারটি ভালোভাবে বুঝতে গেলে আগে সোতসোবের উত্থানের ব্যাপারটি জানতে হবে।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সোতসোবের অভিষেক ঘটে ২০০৯ সালে, সেই সময়ে ডেল স্টেইন ও মরনে মর্কেলের মতো দুজন ডানহাতি পেসারকে যোগ্য সঙ্গ দেওয়ার জন্য একজন বাঁহাতি পেসারের অভাব অনুভব করছিলো দক্ষিণ আফ্রিকা। ক্যারিয়ারের প্রথম ওয়ানডে ম্যাচে ৪ উইকেট তুলে নিয়ে শুরুটাও করেছিলেন দারুণভাবে। এরপর থেকে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে দলের নিয়মিত সদস্য হয়ে যান তিনি।
টেস্ট অভিষেকের জন্য আরো এক বছর অপেক্ষা করতে হয় সোতসোবেকে। আসলে সেই সময়ে টেস্টে বাঁহাতি পেসার হিসেবে ওয়েইন পার্নেলই ছিল প্রোটিয়াদের প্রথম পছন্দ। কিন্তু পার্নেলের অফ ফর্মে কপাল খুলে যায় তার, ২০১০ সালে উইন্ডিজের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট খেলতে নামেন তিনি। যদিও দুই ম্যাচের সেই টেস্ট সিরিজে মাত্র ২ উইকেট নিয়েছিলেন সোতসোবে, কিন্তু মিতব্যয়ী বোলিং করে দারুণভাবে একপ্রান্ত আগলে রেখে স্টেইনদের কাজ বেশ সহজ করে দিয়েছিলেন তিনি।
সেই বছরে ভারতের বিপক্ষে তিন ম্যাচের টেস্ট সিরিজেও দলে ডাক পান লোনওয়াবো সোতসোবে, দ্বিতীয় টেস্টে দুই ইনিংস মিলিয়ে ৮৩ রানে তুলে নেন ৫ উইকেট। ২০১১ বিশ্বকাপের প্রোটিয়া দলেও সুযোগ পান তিনি। সেই বিশ্বকাপের পরেই তার ক্যারিয়ারের প্রথম ধাক্কাটা আসে।
সেবার কাউন্টি দল অ্যাসেক্স তাদের বিদেশী খেলোয়াড় কোটায় লোনওয়াবো সোতসোবেকে দলে নেয়। কিন্তু কাউন্টিতে প্রত্যাশার ছিটেফোঁটাও পূরণ করতে পারেননি তিনি। তিন টেস্টে নিয়েছিলেন মোটে ৫ উইকেট আর উইকেটপ্রতি খরচ করেছিলেন প্রায় ৭৭.৬ রান। এর চেয়েও অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে পাঁচ দিনের টেস্টে তার ইকোনমি রেট ছিল ৬ এর উপরে! একজন আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়ের কাছে এমন পারফর্মেন্স সত্যিই ভীষণ হতাশাজনক।
এই পারফর্মেন্সের পর সোতসোবে টুইটারে ক্লাবটিতে কাটানো দুই মাস সময়কালকে তার জীবনের সবচেয়ে বাজে সময় হিসেবে অভিহিত করেন। তবে অ্যাসেক্সের কোচ পল গ্রেসন পুরো ঘটনার জন্য সোতসোবেকেই দায়ী করেন। তিনি বলেন, সোতসোবে অনুশীলনে মোটেও মনোযোগী ছিলেন না এবং তার আচরণও বেশ ঔদ্ধত্যপূর্ণ। এই অ্যাসেক্স অধ্যায়টায় সোতসোবের ক্যারিয়ারে পতনের প্রথম ভাগ।
সেই বছরেই অজিদের বিপক্ষে দুর্দান্ত পারফর্মেন্স উপহার দিয়ে স্টেইন-মর্কেলের সঙ্গী হিসেবে নিজের জায়গা পাকা করে ফেলেন ভার্নন ফিল্যান্ডার, ফলে টেস্ট দলের দরজাটা সোতসোবের জন্য একপ্রকার বন্ধই হয়ে যায়।
তবে টেস্টের দরজা বন্ধ হয়ে গেলেও ওয়ানডেতে দারুণ পারফর্ম করতে থাকেন সোতসোবে। ২০১১/১২ মৌসুমে নিউজিল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ওভারপ্রতি মাত্র ৪.৫ রান দিয়ে ১৭ উইকেট তুলে নিয়েছিলেন এই পেসার। পরের মৌসুমেও এই পারফর্মেন্সের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখেন তিনি, যার ফলে ওয়ানডেতে আইসিসি বোলার র্যাংকিংয়ে শীর্ষে চলে যান তিনি।
কিন্তু খামখেয়ালি আচরণের জন্য এই সুসময়েও বারবার বিতর্কিত হচ্ছিলেন সোতসোবে। সময় দিতে না পারার কারণে মাত্র এক মৌসুম পরেই তাকে দল থেকে ছেঁটে ফেলতে বাধ্য হয় ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্লাব ডলফিন্স। ক্লাবটির ক্ষেপে যাওয়াটা অবশ্য যুক্তিসঙ্গত, এক বছরে যে খেলোয়াড় মাত্র নয়টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলে, তাকে দলে ধরে রেখে সেই ক্লাবের কী লাভ?
খামখেয়ালি আচরণ তার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও প্রভাব ফেলতে শুরু করে, ২০১৩ সালে শ্রীলঙ্কা সফরের জন্য ঘোষিত দলে সোতসোবে থাকলেও পরে ফিটনেস টেস্ট উৎরাতে ব্যর্থ হন তিনি! যদিও শেষপর্যন্ত দলের সাথে সেই সফরে যান তিনি এবং সেই সিরিজের মাঝপথে ফিটও হয়ে গিয়েছিলেন। তার এই অবস্থা দেখে প্রোটিয়া কোচ রাসেল ডোমিঙ্গো বলেছিলেন যে সোতসোবে নাকি আগের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছেন এবং এখন তিনি কাজের ব্যাপারে বেশ মনোযোগী।
ডোমিঙ্গোর এই কথার প্রমাণ অবশ্য সোতসোবের পারফর্মেন্সই দিয়ে যাচ্ছিলো, পাকিস্তান ও ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে তার পারফর্মেন্স বেশ ভালো ছিল। ভারতের বিপক্ষে দ্বিতীয় ওয়ানডেতে তো মাত্র ২৫ রানে ৪ উইকেট তুলে নিয়েছিলেন তিনি! তবে দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, প্রোটিয়া জার্সিতে এটিই ছিল তার শেষ ওয়ানডে সিরিজ।
বাংলাদেশে অনুষ্ঠেয় টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলে হাঁটুর অস্ত্রোপচার করান সোতসোবে। এমন একটি ইনজুরি থেকে ফেরার পর আগের ফর্মে ফেরার জন্য প্রয়োজন ছিল কঠোর পরিশ্রমের।
কিন্তু সেসব না করে নিজের স্বভাবসুলভ আচরণে গা ভাসিয়ে চলা শুরু করেন তিনি। আগের ক্লাব ডলফিন্সের মতো নতুন ক্লাব লায়ন্সেও নিজের ইচ্ছামতো ম্যাচ মিস করতে থাকলেন। তার এই আচরণের কারণে ২০১৫ বিশ্বকাপে প্রোটিয়াদের চূড়ান্ত দলেও তাকে ডাকা হয়নি। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, ২০১৩ সালেও যিনি ছিলেন র্যাংকিংয়ের সেরা বোলার, সেই তিনি ১৫ সদস্যের দলেই জায়গা পেলেন না!
ক্যারিয়ারে এমন ছন্দপতনে নিজের ভবিষ্যৎ নিজে ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়েন সোতসোবে। তার ক্যারিয়ারের এই বেহাল দশা সম্পর্কে তার কাছের বন্ধু তৎকালীন লায়ন্সের অধিনায়ক থামি শোলেকিলে বেশ ভালোভাবেই জানতেন। আর বন্ধুর এই জানাটাই কাল হয়ে হয়ে দাঁড়ায় তার জন্য!
২০১৫ সালে র্যাম স্ল্যাম টি-টুয়েন্টিতে ম্যাচ পাতানোর প্রস্তাব নিয়ে শোলেকিলের কাছে আসেন ক্লাবন্টির সাবেক খেলোয়াড় গুলাম বদি। যেহেতু শোলেকিলে ছিল দলীয় অধিনায়ক, তাই তার পক্ষে ফিক্সিংয়ের মূল কাজগুলো করাটা বেশ সহজ ছিল।
কিন্তু গোপন সূত্র থেকে খবর পেয়ে পুরো ঘটনা সম্পর্কেই দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট বোর্ড - সিএসএ জেনে যায়। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে গুলাম বদিকে মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে অভিযুক্ত করে সিএসএ তাদের তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। আর এই তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মূল কাজটি করেছিলেন লায়ন্সের অধিনায়ক থামি শোকেকিলে। শোলেকিলেকে সহায়তা করেছিলেন আলভিরো পিটারসেন, জিয়ান সিমস, এথি ভালাঠি, পুমি মাথসিকুই এবং লোনওয়াবো সোতসোবে।
ম্যাচ পাতানোর দায়ে সবাইকে বিভিন্ন মেয়াদে নিষিদ্ধ করা হয়, সোতসোবেকে নিষিদ্ধ করা হয় আট বছরের জন্য। অভিযুক্তদের তালিকা জানা গেলেও ঠিক কীভাবে এতজন খেলোয়াড়কে এমন ঘৃণ্য কাজে রাজি করানো হলো সেই ব্যাপারে বিস্তারিত কিছুই জানা যায়নি।
তবে এই ছয়জন খেলোয়াড়ের মধ্যে সোতসোবের এই ঘটনায় জড়িয়ে পড়াটাই সবচেয়ে বেশি হতাশাজনক। সাময়িক ছন্দপতনে হতাশ না হয়ে কঠোর পরিশ্রম চালিয়ে গেলে হয়তো এখনো প্রোটিয়া জার্সিতে দেখা যেতো তাকে। কিন্তু সেটা তিনি করেননি, বরং সেই কঠিন সময় থেকে দ্রুত বের হতে গিয়ে পা হড়কে পড়ে গিয়েছেন নিকষ কালো অন্ধকূপে, যেখান থেকে সত্যিই আর ফেরার উপায় নেই। এরকম ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে আর কোনো ক্রিকেটার এভাবে অকালে যাতে হারিয়ে না যায় সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।
ক্রিকেট সম্পর্কে আরও জানতে পড়ে নিন এই বইগুলো
১) শচীন রূপকথা
২) নায়ক
৩) সাকিব আল হাসান - আপন চোখে ভিন্ন চোখে
This article is in Bangla language. It's about the sudden fall of a Protea cricketer named Lonwabo Tsotsobe. For references please check the hyperlinks inside the article.
Featured Image: Teaukura Moetaua/Getty Images