Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

হাঙ্গেরির ম্যাজিকাল ম্যাগিয়ার্স: আধুনিক ফুটবলের বিপ্লব ঘটেছিল যাদের হাত ধরে

সর্বকালের সেরা দলগুলোর তালিকা করলে অনেকগুলো দলের নামই চলে আসবে, যেমন- ১৯৭০ এর ব্রাজিল, ১৯৭৪ এর নেদারল্যান্ডস, ১৯৮২ এর ব্রাজিল, ২০০২ এর ব্রাজিল কিংবা হালের ২০১০ এর স্পেন। ক্লাব ফুটবলের দলগুলোকে বিবেচনা করলে এই তালিকা আরো দীর্ঘ হবে! এখন প্রশ্ন হচ্ছে কেন এই দলগুলো সর্বকালের সেরাদের কাতারে? প্রথম কারণ অবশ্যই সাফল্য; তবে শুধুমাত্র সাফল্যই একমাত্র কারণ হলে, বিশ্বকাপজয়ী আরো অনেক দলের নাম এই লিস্টে চলে আসতো। সাফল্যের সাথে খেলার ধরনটাও গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময়ে একটা দলের খেলার ধরনে দর্শকরা এতটাই মুগ্ধ হন যে, সেই দল পরাজিত হলেও ইতিহাসের পাতায় ঠিকই জায়গা করে নেয়। ১৯৮২ এর ব্রাজিল এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

খেলার ধরনে মুগ্ধ করার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ খেলার পুরনো প্রথাগত কৌশলে বড়সড় পরিবর্তন আনা, এই কাজটি খুব কম দলই করতে পেরেছে। কিন্তু যারা পেরেছে তারা বিশ্বকাপ না জিতেও সেরাদের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। ১৯৭৪ এর রাইনাস মিশেল-ইয়ুহান ক্রুইফের নেদারল্যান্ডস এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ, টোটাল ফুটবলের ধারণা ফুটবল বিশ্বে প্রতিষ্ঠা করায় ওই দলটাকে মানুষ আজীবন মনে রাখবে। তবে নেদারল্যান্ডসের আগেই টোটাল ফুটবলের প্রাথমিক ধারণাটা কিন্তু অন্য একটি দল এনেছিলো, তারা প্রথাগত ফুটবলে যেই পরিবর্তনটা এনেছিলো সেটা ১৯৭৪ এর নেদারল্যান্ডসের চেয়েও বেশি প্রভাবশীল। আর সেই দলটি হচ্ছে ১৯৫০-৫৬ সালের হাঙ্গেরি ফুটবল দল। ইতিহাসের পাতায় যারা “ম্যাজিকাল ম্যাগিয়ার্স” নামেই বেশি পরিচিত।

যেভাবে গড়ে উঠলো হাঙ্গেরির এই দলটি

বর্তমানে হাঙ্গেরির ফুটবলের অবস্থা বেশ হতাশাজনক হলেও, আমরা যেসময়ের কথা বলছি তখন কিন্তু এমনটা ছিল না! ১৯৩৮ বিশ্বকাপের রানার্স আপ ছিল হাঙ্গেরি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ওই ১৯৩৮ বিশ্বকাপের পরের যুগের খেলোয়াড়দের নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে থাকে হাঙ্গেরির ফুটবল ফেডারেশন। আর এই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ফেডারেশন ১৯৪৯ সালে কোচ হিসেবে বেছে নেয় গুস্তাভ সেবেসকে। সেবেস দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই খেলোয়াড়দের ফিটনেসের ব্যাপারে গুরুত্ব দেন, তবে তারচেয়েও বেশী গুরুত্ব দেন খেলোয়াড়দের বিভিন্ন পজিশনে খেলার ব্যাপারে দক্ষ করে তোলার ব্যাপারে।

তখনকার ফুটবলে পুরনো ইংলিশ ট্যাকটিসই বেশি প্রচলিত ছিল। W-M ফর্মেশনখ্যাত এই ট্যাকটিসে একজন নির্দিষ্ট খেলোয়াড় পুরো ম্যাচজুড়ে প্রতিপক্ষের একজন নির্দিষ্ট খেলোয়াড়কেই মার্ক করে যেতেন! এই ট্যাকটিস অনুযায়ী পুরো খেলায় সেন্টারব্যাকের দায়িত্ব থাকতো প্রতিপক্ষের সেন্টার ফরোয়ার্ডকে মার্ক করা, এভাবে খেলোয়াড়েরা একজন নির্দিষ্ট খেলোয়াড়কে মার্ক করার দায়িত্ব ভাগ করে নিতেন। এখনকার ফুটবলে ডিফেন্ডারদের কাছ থেকে আক্রমণের প্রথম ধাপ শুরু হয় কিন্তু সেসময়ে ডিফেন্ডাররা অ্যাটাকিং বিল্ড-আপে কোনো ভূমিকাই রাখতো না!  কোনো খেলোয়াড়ই নিজেদের মধ্যে প্লেয়িং পজিশন পরিবর্তন করতেন না বলে খেলার কৌশল কিছুটা একঘেয়ে ও অনুমেয় ছিল।

সেবেস এই ধারণায় আমূল পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত নিলেন, আগের W-M ফর্মেশন বাদ দিয়ে তিনি দলকে ২-৩-৩-২ ফর্মেশনে খেলানো শুরু করেন। এই ফর্মেশনে সেন্টারব্যাকদের কাছ থেকেই আক্রমণের সূচনা হতো, উইঙ্গাররা শুধুমাত্র প্রতিপক্ষের আক্রমণভাগে স্থির না থেকে দলের প্রয়োজনে মিডফিল্ডে নেমে এসে মিডফিল্ড নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতেন। এমন ডায়নামিক ফর্মেশনের কারণে খুব কম সময়ের মধ্যে হাঙ্গেরি ডিফেন্স থেকে অ্যাটাক কিংবা অ্যাটাক থেকে ডিফেন্সে যেতে পারতো। তবে হুট করে এমন পরিবর্তনে মানিয়ে নেওয়াটা যেকোনো দলের জন্যই কষ্টকর হওয়ার কথা। কিন্তু সেবেসের হাঙ্গেরির জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসেন বুদাপেস্ট হনভেদ ক্লাবটি। সেবেসের দলের ছয়জন খেলোয়াড়ই হনভেদের হয়ে খেলতেন। সারাবছর একসাথে খেলায় এই খেলোয়াড়দের নিজেদের মধ্যে বেশ ভালো বোঝাপড়া ছিল আর সেবেসের কৌশল রপ্ত করার ক্ষেত্রে এই বোঝাপড়াটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলো।

হাঙ্গেরির সেই বিখ্যাত দল, নিচের সারিতে রয়েছেন দলটির লেফটব্যাক ল্যান্টোস, অধিনায়ক পুসকাস ও গোলকিপার গ্রসিক্স। উপরের সারিতে রয়েছেন সেন্টারব্যাক লর‍্যান্ট, রাইটব্যাক বুজান্সকাই, ডিপ লাইং ফরোয়ার্ড হিডেগকুটি, স্ট্রাইকার ককেসিস, লেফট হাফ জ্যাকারিয়াস, রাইট উইঙ্গার জিবর, রাইট হাফ বোজসিক ও লেফট উইঙ্গার বুদ্যাই (বাম থেকে ডানে);  Image Source: Wikipidea

সেবেসের নতুন কৌশলের প্রাণভোমরা ছিলেন তার ফরোয়ার্ড লাইনের তিন তারকা – ফেরেঙ্ক পুসকাস, ন্যান্ডর হিডেগকুটি ও সান্দ্রো ককেসিস। দলে হিডেগকুটির দায়িত্ব ছিল ডিপ লাইং সেন্টার ফরোয়ার্ডের, বারবার জায়গা বদল করে প্রতিপক্ষের সেন্টারব্যাকদের নিজের জায়গা থেকে সরিয়ে দিতেন হিডেগকুটি; যার ফলে বাকি দুই ফরোয়ার্ড পুসকাস ও ককেসিস প্রতিপক্ষের সীমানায় যথেষ্ট পরিমাণ জায়গা পেতেন। তখনকার দলগুলোর কাছে নিজেদের পজিশনে এমন অদলবদল ছিল চিন্তার বাইরে, আর এই  ট্যাকটিসে এমন বিপ্লবী পরিবর্তনই হাঙ্গেরি দলটাকে অপ্রতিরোধ্য গড়ে তুলতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে।

ম্যাজিকাল ম্যাগিয়ার্সের তিন প্রাণভোমরা জোল্টান জিবর, ন্যান্ডন হিডেগকুটি ও সান্দ্রো ককেসিস; Image Source : 90min.in

প্রথম সাফল্য

সেবেসের দল ১৯৫০ সালের পর থেকেই দাপট দেখাতে শুরু করে তবে প্রথম বড় সাফল্য পায় ১৯৫২ সালে। সেবারের সামার অলিম্পিক ফুটবলে রোমানিয়া, ইতালি ও সুইডেনকে হারিয়ে ফাইনালে যায় হাঙ্গেরি। ফাইনালে পুসকাস ও জিভরের গোলে তৎকালীন যুগোস্লাভিয়াকে ২-০ গোলে হারিয়ে অলিম্পিক ফুটবলে স্বর্ণপদক জিতে নেয় হাঙ্গেরি। আন্তর্জাতিক ফুটবলে এটাই ছিল হাঙ্গেরির প্রথম সাফল্য, যা হাঙ্গেরির আত্মবিশ্বাসকে অনেকগুণ বাড়িয়ে দেয়। এ ব্যাপারে ফেরেঙ্ক পুসকাস পরবর্তীতে বলেন, “অলিম্পিকের সময়েই আমাদের দলটা নিজেদের সেরা ফুটবল খেলা শুরু করে। আমাদের দল যখন আক্রমণে যেতো তখন সবাই আক্রমণে যেতো, ডিফেন্সের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটতো। আমাদের খেলার ধরণটা ছিল ডাচদের টোটাল ফুটবলের আদিরূপ।” এই টুর্নামেন্ট জয়ের পরেই হাঙ্গেরির ওই দলটাকে কেউ ‘মাইটি ম্যাগিয়ার্স’, কেউ আবার ‘ম্যাজিকাল ম্যাগিয়ার্স’ বলে ডাকা শুরু করে।

হাঙ্গেরির সেই অলিম্পিক স্বর্ণজয়ী দল; Image Source: World Soccer

পরের বছর সেন্ট্রাল ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ খেলতে যায় হাঙ্গেরি আর সেখানেও অনায়াসে সব ম্যাচ জিতে ফাইনালে চলে যায় মাইটি ম্যাগিয়ার্সরা। ফাইনালে ইতালির মুখোমুখি হয় হাঙ্গেরি, যেখানে পুসকাসের জোড়া গোল ও হিডেগকুটির গোলে ৩-০ গোলে ম্যাচটা জিতে শিরোপা জিতে নেয় হাঙ্গেরি। অলিম্পিক ফুটবলে স্বর্ণপদকের পরে এই শিরোপা জয়ের ফলে হাঙ্গেরির শক্তিমত্তাকে পুরো বিশ্বই সমীহ করা শুরু করে।

ইংলিশদের বিপক্ষে সেই ঐতিহাসিক ম্যাচ অফ দ্য সেঞ্চুরি

পুরো বিশ্ব হাঙ্গেরির শক্তিমত্তাকে সমীহ করা শুরু করলেও একটা দল তখনো হাঙ্গেরির উত্থানকে ঠিক মেনে নিতে পারছিলো না। আর তারা হলো ইংল্যান্ড।

এই ইংলিশদেরই হাতে গড়া প্রাচীন ফুটবলের ফর্মেশন ভেঙ্গে অন্যধারার ফুটবল চালু করেছিলেন হাঙ্গেরির কোচ গুস্তাভ সেবেস। অথচ তখনো নিজেদের মার্কিং ভিত্তিক ফর্মেশনকেই শ্রেয় ভাবতো ইংলিশরা। অবশ্য তখনকার ফুটবলে ইংলিশদের দাপটও দেখার মতন ছিল, ১৯৫৩ সালের আগে নিজেদের মাঠে একটা ম্যাচ বাদে বাকি সব ম্যাচে অপরাজিত ছিল ইংলিশরা। তাই হাঙ্গেরির দলটাকে নিয়ে এত মাতামাতি ইংলিশদের ঠিক সহ্য হলো না। মূলত হাঙ্গেরিকে একটা শিক্ষা দেওয়ার জন্যই ১৯৫৩ সালের শেষদিকে তাদেরকে খেলার আমন্ত্রণ জানায় ইংল্যান্ড।

ওয়েম্বলিতে ইংল্যান্ড বনাম হাঙ্গেরির সেই বিখ্যাত ম্যাচ শুরুর আগে রেফারির সাথে দুই দলের অধিনায়কেরা; Image Source: 90min.in

১৯৫৩ সালের ২৫ শে নভেম্বর ইংল্যান্ডের বিখ্যাত ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে মুখোমুখি হয় ইংল্যান্ড ও হাঙ্গেরি। ইংল্যান্ড মাঠে নামে তাদের প্রথাগত W-M শেপড ফর্মেশনে আর হাঙ্গেরি ম্যাচ শুরু করে তাদের ডায়নামিক ২-৩-৩-২ ফর্মেশনে। বরাবরের মতো ককেসিস আর পুসকাস ছিলেন দুই স্ট্রাইকারের ভূমিকায় আর তাদের ঠিক পিছনেই ডিপ লাইং সেন্ট্রাল ফরোয়ার্ডের ভূমিকায় ছিলেন হিডেগকুটি। ম্যাচ শুরু হওয়ার প্রথম মিনিটেই ইংলিশদের বড় ধাক্কাটা দেন এই হিডেগকুটি, তার গোলে প্রথম মিনিটেই এগিয়ে যায় ম্যাগিয়ার্সরা।

এরপর পুরো খেলা জুড়ে হিডেগকুটি-পুসকাস-ককেসিস ত্রয়ী নিজেদের মধ্যে পজিশন অদলবদল করে ইংলিশ ডিফেন্ডারদের নাজেহাল করে ছাড়েন। ইংলিশরা তাদের প্রথাগত ফর্মেশন অনুযায়ী একজন খেলোয়াড় শুধুমাত্র প্রতিপক্ষের নির্দিষ্ট এক খেলোয়াড়কেই মার্ক করে যাচ্ছিলো। W-M ফর্মেশনে সাধারণত বিপক্ষ দলের নাম্বার নাইনকে মার্ক করার দায়িত্ব পালন করতো ইংলিশ সেন্টার হাফ হ্যারি জনস্টন। সেদিন হাঙ্গেরির নাম্বার নাইন জার্সি পড়ে খেলছিলেন হিডেগকুটি, তাই অন্যদিনের মতো সেদিনও হিডেগকুটিকে মার্ক করতে থাকেন জনস্টন। কিন্তু সমস্যা হলো, হিডেগকুটি ৯ নাম্বার জার্সি পরলেও খেলতেন তো মিডফিল্ডে। তাই হিডেগকুটিকে মার্ক করতে গিয়ে বারবার নিজেদের রক্ষণ ছেড়ে মিডফিল্ডে চলে আসতে হচ্ছিলো জনস্টনকে। ফলে ইংলিশ রক্ষণভাগ বারবার অরক্ষিত হয়ে যাচ্ছিলো আর সেই সুযোগটা নির্মমভাবে কাজে লাগাচ্ছিলেন ককেসিস আর পুসকাস।

শুধু এই অ্যাটাকিং ট্রায়ো না, পুরো দলই নিজেদের মধ্যে বারবার জায়গা অদলবদল করার ফলে ইংলিশ খেলোয়াড়েরা কখন কাকে মার্ক করবে এব্যাপারে দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলো।  শেষপর্যন্ত হিডেগকুটির হ্যাটট্রিক ও ককেসিসের জোড়া গোলে ঘরের মাঠে ইংলিশদের ৬-৩ গোলে হারানোর লজ্জা উপহার দেয় হাঙ্গেরি। ফিরতি লেগের স্কোরলাইন তো আরো ভয়াবহ। ১৯৫৪ সালের ২৩ মে বুদাপেস্টে ইংল্যান্ডকে ৭-১ গোলে বিধ্বস্ত করে হাঙ্গেরি। যে পুসকাসকে ইংলিশরা খেলা শুরু হওয়ার আগে “খাটো মোটা ছোকরা ” বলে ক্ষেপাচ্ছিলো, সেই ছোকরাই দুই ম্যাচ মিলিয়ে করলেন চার গোল!

ইংল্যান্ডকে ৭-১ গোলে হারানোর ফলে উল্লসিত হাঙ্গেরির সমর্থকরা; Image Source: europebetweeneastandwest

হাঙ্গেরির সাথে ইংলিশদের ম্যাচ দুটো প্রীতি ম্যাচ হলেও আন্তর্জাতিক ফুটবলের চিত্রপট পাল্টে যায় এই ম্যাচ দুটোর ফলাফলের কারণেই। ইংলিশদের মার্কিং ভিত্তিক W-M ফর্মেশনে খেলতে থাকলে ভবিষ্যতেও ডায়নামিক ফুটবলের কাছে এভাবে নাকানি চুবানি খেতে হবে, এটা বাকি দলগুলোও তখন বুঝতে পেরেছিল। ফলে তারাও W-M ফর্মেশন থেকে বের হয়ে আসতে শুরু করে। এমনকি ইংলিশরাও এই হারের পর নিজেদের ফুটবলে পরিবর্তন আনে, সেকেলে ফর্মেশন থেকে বের হয়ে নিজেদের ট্যাকটিসে আমূল পরিবর্তন আনা শুরু করে ইংলিশরা।

ঘটনাবহুল ১৯৫৪ বিশ্বকাপ

সাফল্যের চক্রপূরণ করতে তখন হাঙ্গেরি ফুটবল দলের প্রয়োজন ছিল একটি বিশ্বকাপ জয় আর সেটার জন্য যথাযথ সময় ছিল ১৯৫৪ বিশ্বকাপ। বিশ্বকাপ শুরুর মাসখানেক আগে ইংলিশদের ৭-১ গোলে হারানোয় হাঙ্গেরি দলটাও ভীষণ উজ্জীবিত ছিল। শুরুটাও হয় অসাধারণভাবে, ককেসিসের হ্যাটট্রিক ও পুসকাসের জোড়া গোলে দক্ষিণ কোরিয়াকে ৯-০ গোলে বিধ্বস্ত করে সুপার ম্যাগিয়ার্সরা। দ্বিতীয় ম্যাচে হ্যাটট্রিক ছাড়িয়ে চার গোল করলেন ককেসিস সাথে হিডেগকুটির জোড়া গোল এবং পুসকাস ও টথের এক গোলে তৎকালীন পশ্চিম জার্মানিকে ৮-৩ গোলে উড়িয়ে দিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়েই কোয়ার্টার ফাইনালে যায় হাঙ্গেরি। কিন্তু এই ম্যাচেই হাঙ্গেরির বড় সর্বনাশ হয়ে যায়, জার্মান ডিফেন্ডার ওয়ের্নার লিয়েব্রিখের করা ফাউলে ইনজুরড হয়ে কোয়ার্টার ফাইনাল আর সেমিফাইনাল তো বটেই, ফাইনাল খেলাটাও অনিশ্চিত হয়ে যায় হাঙ্গেরির অধিনায়ক ফেরেঙ্ক পুসকাসের।

ব্যাটল অফ বার্ন

কোয়ার্টার ফাইনালে আগের আসরের রানার্স আপ ব্রাজিলের মুখোমুখি হয় হাঙ্গেরি। দু’দলই আক্রমণাত্মক ফুটবলের পূজারী, তাই সবাই সুন্দর ফুটবল দেখার প্রত্যাশায় ছিল। কিন্তু আগের আসরে ঘরের মাঠে ফাইনাল হারার ক্ষত তখনো শুকায়নি ব্রাজিলের, তাই সেবার শিরোপা জিততে খুব বেশি মরিয়া ছিল সেলেসাওরা। এদিকে দলের সেরা খেলোয়াড় পুসকাস না খেলায় হাঙ্গেরিও ফলাফলের ব্যাপারে কিছুটা শঙ্কিত ছিল। খেলার তিন মিনিটের মাথায় হিডেগকুটির গোলে এগিয়ে যায় হাঙ্গেরি। ৭ মিনিটে ব্যবধান দ্বিগুণ করেন ককেসিস, ২-০ গোলে পিছিয়ে পড়ে গোলশোধের জন্য মরিয়া হয়ে উঠে ব্রাজিল। ১৮ মিনিটে পেনাল্টি থেকে ব্যবধান ২-১ এ কমিয়ে আনেন ব্রাজিলের রাইটব্যাক দিজালমা সান্তোস। দ্বিতীয়ার্ধে ৬০ মিনিটে পেনাল্টি থেকে গোল করে হাঙ্গেরিকে ৩-১ গোলে এগিয়ে নেন ল্যান্টোস কিন্তু এই পেনাল্টিকে কেন্দ্র করে পুরো পরিস্থিতি ভীষণ উত্তপ্ত হয়ে যায়। মাঠের খেলোয়াড়েরা তো বটেই, ব্রাজিলের কিছু অফিসিয়াল ও সাংবাদিকরাও মাঠে নেমে ঝামেলায় জড়িয়ে যান। পরে পুলিশের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসলে খেলা আবার শুরু হয় কিন্তু ওই ঘটনার পর দু’দলই খুব বেশি বাজে ট্যাকল করা শুরু করে।

ফুটবল মাঠে পুলিশ; Image Source: ekapiens

৬৫ মিনিটে ব্রাজিলের জুলিনহোর গোলে ব্যবধান ৩-২ এ কমে এলে পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত হয়ে যায়। এর কিছুক্ষণ পর হাঙ্গেরির মিডফিল্ডার জোসেফ বসজিককে ব্রাজিলিয়ান লেফটব্যাক নিল্টন সান্তোস ফাউল করলে দুইজনে মারামারিতে জড়িয়ে পড়েন, ফলশ্রুতিতে রেফারি দুইজনকেই মাঠ থেকে বের করে দেন। খেলা শেষ হওয়ার দুই মিনিট আগে গোল করে হাঙ্গেরির ৪-২ গোলের জয় নিশ্চিত করেন ককেসিস। কিন্তু এর পরপরই হাঙ্গেরির লর‍্যান্টকে ব্রাজিলের টোজ্জি লাথি মেরে বসলে রেফারি টোজ্জিকে মাঠ থেকে বের করে দেন। পুরো ম্যাচে রেফারিকে ৪২ বার ফাউলের বাঁশি বাজাতে হয়! তবে হাঙ্গেরি ৪-২ এ ম্যাচ জিতলেও ম্যাচ শেষ হওয়ার পরেও রয়ে যায় ম্যাচের উত্তাপ। টানেলে দুই দলের খেলোয়াড়েরা মারামারিতে জড়িয়ে পড়েন যা থামে পুলিশের হস্তক্ষেপে। যেই ম্যাচটা হওয়ার কথা ছিল বিশ্বকাপের ইতিহাসে অন্যতম সুন্দর ম্যাচ! অথচ সেই ম্যাচটাই হয়ে গেলো বিশ্বকাপের ইতিহাসে অন্যতম কলঙ্কজনক ম্যাচ। এই ম্যাচটি ইতিহাসের পাতায় ‘ব্যাটল অফ বার্ন’ নামেই পরিচিত।

কোয়ার্টার ফাইনালে ১৯৫০ বিশ্বকাপের রানার্স আপকে হারানোর সেমিফাইনালে হাঙ্গেরি মুখোমুখি হয় আগের আসরের চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়ের। তখন পর্যন্ত উরুগুয়ে তাদের বিশ্বকাপের ইতিহাসে একটা ম্যাচেও হারেনি (১৯৩৪ ও ১৯৩৮ বিশ্বকাপে অংশ নেয়নি উরুগুয়ে)। তাই উরুগুয়েকে হারানোটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল ম্যাজিকাল ম্যাগিয়ার্সদের জন্য। তবে ১৩ মিনিটে জিবর ও ৩৮ মিনিটে হিডেগকুটির গোলে প্রথমার্ধেই ২-০ তে এগিয়ে গেলে উরুগুয়েকে হারানোর কাজটা কিছুটা সহজ হয়ে যায় হাঙ্গেরির জন্য। কিন্তু শেষ সময়ের নাটকে সবকিছু উলটপালট হয়ে যায়, ৭৫ ও ৮৬ মিনিটে হোহবার্গের জোড়া গোলে ম্যাচে সমতা ফেরায় উরুগুয়ে ফলে ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। পুরো টুর্নামেন্টে অসাধারণ খেলা ককেসিস ৯০ মিনিটে ব্যর্থ হলেও অতিরিক্ত সময়ে জ্বলে উঠেন, ১১১ ও ১১৬ মিনিটে ককেসিসের জোড়া গোলে ৪-২ গোলে ম্যাচটি জিতে ফাইনালের টিকিট নিশ্চিত করে হাঙ্গেরি। সাফল্যের চক্রপূরণ থেকে তখন মাত্র একটা জয় দূরে ছিল হাঙ্গেরি।

সেই ট্র্যাজিক মিরাকল অফ বার্ন

বার্নে বিশ্বকাপ ফাইনালে পশ্চিম জার্মানির মুখোমুখি হয় হাঙ্গেরি, গ্রুপপর্বে এই জার্মানিকেই ৮-৩ গোলে বিধ্বস্ত করেছিলো হাঙ্গেরি। তাছাড়া এই ম্যাচের আগে টানা ৩১ ম্যাচে অপরাজিত থাকায় ম্যাচ জয়ের ব্যাপারে পরিষ্কার ফেভারিট ছিল হাঙ্গেরি। অন্যদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়া পশ্চিম জার্মানি তখনো দল পুনর্গঠন করছিলো, দলের খেলোয়াড়েরা পুরোপুরি পেশাদারও ছিল না। এমন একটা আধা পেশাদার দল হাঙ্গেরির ওই মাইটি ম্যাগিয়ার্সকে হারাবে তা কেউই ম্যাচ শুরুর আগে কল্পনা করেনি। তবে আধা পেশাদার হলেও জার্মান কোচ ছিলেন জাত ট্যাকটিশিয়ান, তিনি ব্রিটিশ W-M ফর্মেশনে না খেলিয়ে ফরোয়ার্ডদের নিজেদের মধ্যে পজিশন অদলবদল করানোয় বিশ্বাসী ছিলেন। তাছাড়া খুব বেশি আন্তর্জাতিক ম্যাচ না খেলায় এই দলটার ব্যাপারে কারোরই তেমন পরিষ্কার ধারণা ছিল না।

পুরোপুরি ফিট না হলেও এই ম্যাচে শুরু থেকেই খেলেন হাঙ্গেরি অধিনায়ক ফেরেঙ্ক পুসকাস। সেদিন আকাশ ছিল বৃষ্টিস্নাত ফলে কাদাভরা মাঠে হাঙ্গেরি নিজেদের পাসিং ফুটবল কতটা খেলতে পারবে সেব্যাপারে কিছুটা সংশয় ছিল তবে ম্যাচ শুরুর ছয় মিনিটের মাথায় অধিনায়ক পুসকাসের গোলে লিড নেয় হাঙ্গেরি। এর দুমিনিট পর জিবরের গোলে ২-০ গোলে এগিয়ে যায় হাঙ্গেরি, তখন মনে হচ্ছিলো বৃষ্টিস্নাত আবহাওয়াও পশ্চিম জার্মানির হার ঠেকাতে পারবে না। কিন্তু এরপরেই ম্যাচের মোড় ঘুরতে শুরু করে, ১০ মিনিটে মরলোকের গোলে ব্যবধান ২-১ এ কমিয়ে আনে পশ্চিম জার্মানি। এর আট মিনিট পর হেলমাট র‍্যাহনের গোলে খেলায় ২-২ গোলের সমতা ফিরে আসে।

হাঙ্গেরির বিপক্ষে মরলোকের সেই গোল; Image Source: Irish Times

এই গোলের পর অল আউট অ্যাটাকে যায় হাঙ্গেরি। কিন্তু প্রতিটা আক্রমণই শেষ মুহূর্তে খেই হারিয়ে ফেলায় কিছুতেই গোল পাচ্ছিলো না হাঙ্গেরি। পশ্চিম জার্মানি যখন শুধুমাত্র হাঙ্গেরির টানা আক্রমণ ঠেকাতেই ব্যস্ত, তখনই ঘটিয়ে ফেলে অঘটন, কাউন্টার অ্যাটাক থেকে গোল করে পশ্চিম জার্মানিকে ৩-২ গোলে এগিয়ে নেন র‍্যাহন। এর দু’মিনিট পরেই গোল করেন পুসকাস। কিন্তু হায়! রেফারি অফসাইডের পতাকা উত্তোলন করায় গোলটা বাতিল হয়ে যায়, অথচ তখন মাঠে যারা ছিল তাদের সিংহভাগের মতেই পুসকাস তখন অনসাইডেই ছিল। এই একটা বিতর্কিত সিদ্ধান্ত হাঙ্গেরির বিশ্বজয়ের স্বপ্নকে দুমড়ে মুচড়ে দেয়, টানা ৩১ ম্যাচ হারার পর হাঙ্গেরি হেরে বসে তাদের ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচটিই!

ম্যাজিকাল ম্যাগিয়ার্সের করুণ সমাপ্তি

এই এক হারের কারণে পুরো হাঙ্গেরিই ক্ষোভে ফুঁসতে থাকে, যেই সেবেস পুরো হাঙ্গেরি দলকেই বদলে দিয়েছিলেন তাকে সমালোচনার তীরে বিদ্ধ করতে থাকে হাঙ্গেরির মিডিয়া, বেশ কিছু খেলোয়াড়কে গৃহবন্দী করে রাখা হয়। হাঙ্গেরির এই ফুটবল দলের পিঠে শেষ পেরেকটি গেঁথে যায় ১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরিয়ান বিপ্লবের ফলে, বিপ্লবের আগেই কোচের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিলো গুস্তাভ সেবেসকে আর বিপ্লবের পর পুসকাস, জিভর ও ককেসিসসহ দলের তারকা খেলোয়াড়েরা হাঙ্গেরি থেকে অন্য দেশে পাড়ি জমাতে শুরু করেন। ফলে ১৯৫৮ বিশ্বকাপের হাঙ্গেরি দলে ম্যাজিকাল ম্যাগিয়ার্সের মাত্র চারজন খেলোয়াড় ছিলেন! যারা প্রাচীন ধারার ফুটবলকে আধুনিক ধারায় আনতে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছিলো সেই দলটা এভাবেই ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। এই দল ভেঙ্গে যাওয়ার পর হাঙ্গেরির ফুটবলও উল্টোপথে হাঁটা শুরু করে, এখন বিশ্বজয় তো বহুদূর বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করার আশেপাশেও হাঙ্গেরি যেতে পারে না!

১৯৫০-৫৬ এই ছয় বছরে ৫০ ম্যাচ খেলে ৪১ ম্যাচেই জিতেছিলো হাঙ্গেরি, ড্র করেছিলো আটটি ম্যাচে। হেরেছিলো মাত্র একটি ম্যাচে কিন্তু ওই এক হারই অনেক হিসাব উলটপালট করে দিয়েছিলো। পশ্চিম জার্মানির সাথে ওই ম্যাচটা জিতলে “সর্বকালের অন্যতম সেরা দল” এর বদলে ম্যাজিকাল ম্যাগিয়ার্সকে “সর্বকালের সেরা” দল বলেই ডাকা হতো। তবে সর্বকালের সেরা হতে পারে নি বলে ফুটবল মাঠে হাঙ্গেরির বৈপ্লবিক পরিবর্তনগুলো ব্যর্থ হয়ে গেছে এটা কিন্তু কোনোভাবেই বলা যাবে না। বিপ্লবীদের কাজ জনতার মাঝে বিপ্লব ছড়িয়ে দেওয়া, ক্ষমতার মসনদে বসাটা তো বিপ্লবীদের মূল লক্ষ্য না আর একথা সত্য হলে ম্যাজিকাল ম্যাগিয়ার্সের বিপ্লব পুরোপুরি সফল। হাঙ্গেরির ২-৩-৩-২ ফর্মেশনকে কিছুটা ঘষেমেজে ৪-২-৪ এ রূপান্তরিত করে পরবর্তীতে ব্রাজিল জিতেছিলো তিন তিনটি বিশ্বকাপ। যেই নাক উঁচু ইংলিশদের W-M ফর্মেশনকে অকেজো প্রমাণ করেছিলো হাঙ্গেরি সেই ইংলিশদের ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কোচ ম্যাট বাসবি হাঙ্গেরির দেখানো পথ ধরেই গড়েছিলেন তার বিখ্যাত দল “দ্য বাসবি বেবস”। আশির দশকে ডাচদের টোটাল ফুটবল হাঙ্গেরির ফুটবল দর্শনেরই আরেক রূপ। হাঙ্গেরির কারণেই সেসময়ের ফুটবল একলাফে ২০-২৫ বছর এগিয়ে গিয়েছিলো। ফুটবলের আধুনিকায়নে বিশাল অবদান রাখায় কোনো বিশ্বকাপ না জিতেও বিশ্বফুটবলে চিরঅমর হয়ে থাকবে হাঙ্গেরির সেই ম্যাজিকাল ম্যাগিয়ার্স।

This article is in Bangla language. It's an article about the golden generation of Hungary football.

Featured Image: 90min.in

For references please check the hyperlinks inside the article.

Related Articles