মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ: ভাগ্যের সঙ্গে যার আজন্ম শত্রুতা

দু’প্রান্তে কুশল মেন্ডিস আর ধনঞ্জয়া ডি সিলভা এক রকম পেয়ে বসেছে বাংলাদেশকে। উইকেটে সানজামুল ইসলাম থেকে শুরু করে মুস্তাফিজুর রহমান, সুবিধা করতে পারছেন না কেউই। মিড অনে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছেন অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। মাথার মধ্যে হয়তো আলোর গতিতে চিন্তা করছেন কিভাবে লঙ্কানদের আটকানো যায়। কিছুতেই যেন কিছু হচ্ছে না। দুজন ব্যাটসম্যান ডানহাতি বলে দ্বিতীয় দিনে ৩২ ওভার বল করালেন দুই বাঁহাতি স্পিনার তাইজুল ইসলাম ও সানজামুল ইসলামকে দিয়ে। কাজের কাজ কিছুই হলো না। ভাগ্যটাও যেন পেয়ে বসেছে। দুই দুইটি রিভিউ জলে গেল। একাধিক ‘ক্লোজ কল’ ফসকে গেল। সঙ্গে মিরাজের ক্যাচ মিসের ঘটনা তো সেই কষ্টের আগুনে স্রেফ তেল ঢেলে দেওয়ার মতো হয়েছে।

আর মাহমুদউল্লাহ? ভাগ্যকে তিনি আর কতই বা দোষ দেবেন! সাকিব আল হাসানের চোটের কারণে টেস্টে অধিনায়ক হিসেবে অভিষেক হলো। ব্যাট হাতে ছিলেন রেকর্ডের সামনে। হলো না। কখনোই হয় না, শুধু তার সাথেই হয় না। তারপরও নতুন সব গল্প লিখে যান তিনি। আড়ালে দাঁড়িয়ে ছড়ান আলোর রোশনাই।

সেদিনই টেস্টের অধিনায়কত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হল মুশফিকুর রহিমকে। দায়িত্ব পেলেন সাকিব আল হাসান। সঙ্গে ডেপুটি মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। অবশ্য আগেও তিনি ডেপুটি ছিলেন। নিজের বাজে পারফরম্যান্সের কারণে দায়িত্ব ছেড়ে দেন। সেটা আবার কাঁধে উঠে এলো। শ্রীলঙ্কা ও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ত্রিদেশীয় সিরিজের পর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজ খেলবে বাংলাদেশ, সেখানেই মিশন শুরু হবে সাকিব-মহমুদউল্লাহর।

সাগরিকায় ৮৩ রানের ইনিংস খেলার পথে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ; Source: Daily Star

ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, দ্বিতীয় দফায় টেস্ট অধিনায়কত্ব পাওয়া সাকিব পড়লেন চোটে। মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে লঙ্কানদের বিপক্ষে ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে ফিল্ডিং করতে গিয়ে আঙ্গুলে চোট পেলেন। সঙ্গে সঙ্গে মাঠ থেকে বের করে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। তখনই জানা যায়, সেলাই নিচ্ছেন সাকিব। অর্থাৎ, ফাইনাল ম্যাচ তো গেলই, টেস্টেও পাওয়া যাবে না তাকে। তখন প্রথাগতভাবেই অধিনায়কের দায়িত্ব পেলেন মাহমুদউল্লাহ। হয়ে গেলেন বাংলাদেশের দশম টেস্ট অধিনায়ক। চট্টগ্রামে এসে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে এসে বললেন, ”এভাবে অবশ্যই অধিনায়কত্ব চাইনি।”

না, আসলেও এভাবে অধিনায়কত্ব চাননি তিনি। সাকিবের খারাপ সময়ে তাকে দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। অথচ সাকিবের অভাবটা তাকে অনেকখানি ভোগাবে তা জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “সাকিব আমাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ একজন খেলোয়াড়। ওকে হারানো আমাদের দলের জন্য বড় একটা বিপর্যয়ই বলতে হবে। ওর মতো শীর্ষ শ্রেণীর ক্রিকেটারকে ছাড়া মাঠে নামা দলের জন্য অবশ্যই ক্ষতিকর। তারপরও দিন শেষে আমরা সবাই বাংলাদেশ দলকে প্রতিনিধিত্ব করছি। বাংলাদেশ দলকে প্রতিনিধিত্ব করাও একটা সুযোগ। সেদিক থেকে আমরা সবাই বেশ এক্সাইটেড।”

তারপরও দলের নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগকে সর্বোচ্চ কাজে লাগাবেন বলে আশা করে গেলেন। শুরু হলো বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসের নতুন অধ্যায়, হয়তো আনুষ্ঠানিকভাবে সবচেয়ে ছোট অধ্যায়।

বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার ইচ্ছা মাহমুদউল্লাহর অনেকদিনের। তাই মিশনটা যতই দুই টেস্টের হোক না কেন, বাংলাদেশের এই ব্যাটিং অলরাউন্ডার নিজের দায়িত্ব খুব ভালো করেই জানেন। সঙ্গে নিজেকে প্রমাণ করার ব্যাপার তো ছিলই। সেই প্রমাণটা যেমন নিজের সঙ্গে, টিম ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে, সমর্থকদের সঙ্গে, সর্বোপরি চান্দিকা হাতুরুসিংহের সঙ্গে। শ্রীলঙ্কার বর্তমান এই কোচ ক’দিন আগেও বাংলাদেশের দায়িত্বে ছিলেন। তখন তার অধীনে কম হেনস্তা হতে হয়নি মাহমুদউল্লাহকে।

সর্বশেষ শ্রীলঙ্কা সফরেও একটি টেস্টে ড্রেসিংরুমে বসে ছিলেন তিনি। সেটাও আবার বাংলাদেশের শততম টেস্টে! ঐ টেস্টের পর তার কোনো প্রয়োজনীয়তাই বোধ করেননি হাতুরুসিংহে। ওয়ানডে ক্রিকেটে আগেভাগেই দলে রাখা হবে না বলে দেশে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছিল। পরে মাশরাফি বিন মুর্তজার হস্তক্ষেপে সে যাত্রা বেঁচে যান তিনি।

ভারতের বিপক্ষে হায়দ্রাবাদ টেস্টে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ; Source: AP

পৃথিবীটা গোল বলেই কিনা আবারও মুখোমুখি হয়ে গেলেন হাতুরুসিংহে- মাহমুদউল্লাহ। যাকে দল থেকে সরিয়ে দিচ্ছিলেন, সেই ক্রিকেটারই এবার বাংলাদেশের নেতৃত্বে। প্রতিপক্ষে হাতুরুসিংহেরই শ্রীলঙ্কা। জবাবটা ভালোই দিয়েছেন মাহমুদউল্লাহ। অন্তত প্রথম ইনিংসে তার নেতৃত্বে ৫১৩ রান তোলে বাংলাদেশ। নিজের ব্যাটে ছিল অপরাজিত ৮৩ রানের ইনিংস। হাঁটছিলেন রেকর্ডের পথে। দুর্ভাগা মাহমুদউল্লাহ উইকেটে পাননি যোগ্য সঙ্গী। তাই তো অধিনায়ক হিসেবে অভিষেক টেস্টে বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরিয়ান হিসেবে নিজের নামটা লেখানো হলো না তার।

সাগরিকায় বাংলাদেশ প্রথম দিন শেষ করে মুমিনুল হক ও মাহমুদউল্লাহর ব্যাটে। শেষ বিকেলের আলোয় হাতুরুসিংহে হয়তো খেয়াল করেছিলেন, এ দুজনকেই কলম্বো টেস্টে বসিয়ে রেখেছিলেন তিনি। আর মুমিনুল যেন তার কাছে এক ‘ভুলে ভরা’ ব্যাটসম্যান। অফস্পিনে দুর্বলতা, ফুটওয়ার্ক; সবকিছুই সমস্যা বাঁহাতি এই ব্যাটসম্যানের। এমনকি অতীতে পেস বোলিংয়েও দুর্বলতা খুঁজে পেয়েছেন তার!

দ্বিতীয় দিনের শুরুতেই যখন মুমিনুল আউট হলেন, তখন মাহমুদউল্লাহ দলের দায়িত্ব একাই কাঁধে তুলে নিয়েছেন। বরাবরের মতো এবারও অপর প্রান্তে তাকে সমর্থন দেওয়ার জন্য কাউকে পাওয়া যায়নি। কেবল অভিষিক্ত সানজামুলকে নিয়ে ৫৭ রানের জুটি গড়তে পারলেন। এর মধ্যে ৪৯ রানে অপরাজিত থাকার সময় মধ্যাহ্ন বিরতির ঘোষণা এল। ফিরে এসে হাফ সেঞ্চুরি তুলে নিলেন। দেখা গেল না তেমন আহামরি কোনো উদযাপন। আপাতত লক্ষ্য, ৫০০ রানের উপরে দলীয় রান নিয়ে যাওয়া। তাই মাটি কামড়ে পড়েছিলেন। সেটাই বা কতক্ষণ করা যায়! ওপাশ থেকেও তো টিকে থাকার চেষ্টা করতে হবে! হলো না। শেষ ব্যাটসম্যান মুস্তাফিজকে না পারতে স্ট্রাইক দিচ্ছিলেন না অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ। শেষ পর্যন্ত ২১ বল উইকেটে টিকে থাকার পর আউট হলেন বাঁহাতি পেসার মুস্তাফিজ। অন্যপ্রান্তে ৮৩ রানে অপরাজিত থেকে মাঠ ছাড়লেন মাহমুদউল্লাহ। বাংলাদেশের টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে অনন্য কীর্তির ১৭ রান দূরে থাকে শুধুই হতাশা বিলালেন

সানজামুল ইসলামের সঙ্গে ৫৭ রানের জুটি গড়ার পথে চট্টগ্রামে; Source: AP

অধিনায়ক হিসেবে অভিষেক টেস্টে বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ রান রয়েছে সাকিব আল হাসানের। ২০০৯ সালে উইন্ডিজের বিপক্ষে সেন্ট জর্জে অপরাজিত ৯৬ রানের ইনিংস খেলেছিলেন তিনি। সেটা ছিল দ্বিতীয় ইনিংসে। প্রথম ইনিংসে মাহমুদউল্লাহই সবার উপরে। ২০১১ সালে প্রথম টেস্টের অধিনায়কত্ব করতে এসে প্রথম ইনিংসে ৬৮ রান করেছিলেন মুশফিকুর রহিম। সেটাও এই জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে।

এ নিয়ে মাহমুদউল্লাহ ক্যারিয়ারের ৩৬তম টেস্ট ম্যাচ খেলছেন। চলতি শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে চট্টগ্রাম টেস্টের প্রথম ইনিংস শেষ সাদা পোশাকে তার মোট রান ২,০১৪। রয়েছে একটি সেঞ্চুরি ও ১৫টি হাফ সেঞ্চুরি। বল হাতে নিয়েছেন মোট ৩৯ উইকেট।

টেস্টে মাহমুদউল্লাহ ক্যারিয়ারের সর্বশেষ ও একমাত্র সেঞ্চুরিটি পেয়েছিলেন আট বছর আগে। ২০১০ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে হ্যামিল্টনে খেলেছিলেন ১১৫ রানের ইনিংস। আট বছর পর আবারও সেঞ্চুরির আশা দেখাচ্ছিলেন তিনি। নিজে ব্যর্থ হননি, তার কীর্তি মেলেনি সতীর্থদের কারণেই। আহা, আরেকজন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে পেলে হয়তো রেকর্ডের পাশে নাম লেখাতে পারতেন তিনি। কিন্তু যার ক্যারিয়ারটাই অন্যদের নিচে পিষ্ট হয়ে গেছে, সেই মাহমুদউল্লাহ হয়তো মানিয়ে নিয়েছেন নিজেকে। অন্তত সতীর্থরা তো বোঝেন ২২ গজে তার গুরুত্ব কতটা!

আর সমর্থকদের কাছে? মাহমুদউল্লাহ বোধ হয় বাংলাদেশের একমাত্র ক্রিকেটার যিনি পারফরম্যান্স করলে কেউ টের পায় না, কিন্তু খারাপ করলে সবাই মিলে সমালোচনার কোরাস গায়।

ফিচার ইমেজ- AP

Related Articles