Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মেকিং অফ অ্যান ইনভিন্সিবল: থিয়েরি অঁরি

ফুটবল ইতিহাসে আমরা অনেক কিংবদন্তি ক্লাবের পারস্পরিক দ্বৈরথ নিয়ে গল্প শুনেছি। এমনই একটি ছিল প্রিমিয়ার লিগে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সাথে আর্সেনালের দ্বৈরথ। আর্সেনাল ডিভিশন-১’এ প্রমোশন পাওয়ার পর থেকেই দুই দলের মধ্যে একটি পরোক্ষ মনস্তাত্ত্বিক লড়াই শুরু হয়ে যায়। ঘরোয়া প্রতিযোগিতাগুলোয় এভাবেই বাড়তে থাকে তাদের এই দ্বৈরথ।

সময়ের পরিক্রমায় ইউনাইটেডে আসেন স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন, আর্সেনালে আসেন আর্সেন ওয়েঙ্গার। এবার শুধু লড়াইটা মাঠের ভেতর নয়, শুরু হয়ে যায় মাঠের বাইরেও। মুখের কথা দিয়ে প্রতিপক্ষকে কীভাবে আগেই হারিয়ে দেয়া যায়, তা নিয়ে বলতে গেলে প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন তারা। হাড্ডাহাড্ডি একটি লড়াইও চলেছিল তাদের  মধ্যে যে কে কত বেশি লিগ জিততে পারেন। লিগের লড়াইয়ে পরিষ্কারভাবেই ওয়েঙ্গারকে হারিয়ে দেন ফার্গুসন। আর ২০০৬ এর পর ক্লাবের অভ্যন্তরীণ সংকটের মুখে দল দাঁড় করাতেই হিমশিম খাওয়া শুরু করেন ওয়েঙ্গার। অবশ্য এতে ওয়েঙ্গারের দোষও ছিল বা কোথায়! অধরা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের দ্বারপ্রান্তে এসেও বাজে রেফারিংয়ের শিকার হয়ে বার্সেলোনার কাছে ১-২ গোলে তারা হারে ফাইনালে, মানসিকভাবে যা একটা দলকে ভেঙে দিতে যথেষ্ট। এরপর নতুন স্টেডিয়াম এমিরেটস বানানোর প্রেক্ষিতে দলের বাজেটেও অনেক কাটছাঁট হয়; যে কারণে কয়েক বছর ধরে আনা যাচ্ছিল না বিশ্বমানের কোনো খেলোয়াড়, উল্টো বিক্রি করে দিতে হচ্ছিল নিজেদের সেরাদের।

তবে আর্সেনাল ক্যারিয়ারের বিদায়লগ্নে ৪ বছরে ৩টি এফএ কাপ জিতে এই টুর্নামেন্টে সবাইকে ছাড়িয়ে যান আর্সেন ওয়েঙ্গার। ওয়েঙ্গার তার ক্যারিয়ারের শেষ লিগ জেতেন ২০০৩ সালে। ২০০২-০৩ মৌসুমটি আরো একটি কারণে বিখ্যাত। প্রিমিয়ার লিগের ইতিহাসে এটিই একমাত্র সোনালি বর্ণের অপরাজেয় ট্রফি, যা নিজেদের করে নেয় আর্সেনালে। বলতে গেলে এই জয়ের পুরো ক্রেডিট দলের। কিন্তু তাদের মধ্যেও কয়েকজনের কথা আলাদা করে বলতে হয়, যাদের মধ্যে একজন ফরাসি ফরোয়ার্ড – থিয়েরি অঁরি।

শতাব্দীর শুরুতে আর্সেনাল ও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মধ্যকার খেলাগুলোয় এমন মারামারির দৃশ্য ছিল খুবই স্বাভাবিক; Image Credit: Getty Image

আর্সেন ওয়েঙ্গারের একটি বিখ্যাত দল গোছানোর প্রক্রিয়া ছিল, তা হচ্ছে ব্রিটিশ প্লেয়ারদের সাথে ফরাসি প্লেয়ারদের সংমিশ্রণে দলে অসাধারণ একটি আউটপুট নিয়ে আসা। একসময় ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে কেবল ব্রিটিশদের আধিপত্য ছিল। তাদের এই একচ্ছত্র প্রভাবে ব্যাঘাত ঘটাতে চলে আসেন এই ফরাসি তরুণ।

পড়তে পারেন: আর্সেন ওয়েঙ্গার: দ্য প্রফেসর

অঁরি যখন অবসরে যান, তখন তার নামের পাশে জ্বলজ্বল করছিল আর্সেনাল ও ফ্রান্সের ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতার খেতাব। দ্যুতিময় এই ক্যারিয়ারে জিতেছিলেন দু’টি প্রিমিয়ার লিগ, একটি বিশ্বকাপ, উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, দু’টি লা লিগা ও ক্লাব বিশ্বকাপ। তার ক্যারিয়ারের এই মহাযাত্রা শুরু হয় মোনাকোতে, যেটি ছিল তার বড় ক্লাবে যাওয়ার সিঁড়ি। এরপর নানা ঝামেলায় থিতু হতে পারেননি জুভেন্টাসেও। এরপর লন্ডনে এসে যোগ দেন তার সাবেক মোনাকো কোচ ওয়েঙ্গারের সাথে। আর্সেনালে কেবল অধরা ছিল একটু চ্যাম্পিয়ন্স লিগের, যা জিততে তিনি শেষে পর্যন্ত পাড়ি জমান বার্সেলোনাতে। স্বপ্নপূরণ করতে পেরেছিলেন, এরপর তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে যান আটলান্টিকের ওপারের নিউ ইয়র্ক রেড বুলসে। ২০১৪ সালে ক্যারিয়ার শেষ করেন এখানেই। মাঝে অবশ্য আর্সেনালের খেলেছিলেন একমাসের ধারের চুক্তিতে। স্ট্রাইকার সংকট থাকায় আর্সেন ওয়েঙ্গার ডেকেছিলেন তার এই বিশ্বস্ত ছাত্রকে। ২০১২ সালের ৯ই জানুয়ারিতে মহারাজার এমিরেটসে প্রত্যাবর্তন ঘটে।

২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে এমিরেটস স্টেডিয়ামের বাইরে বসানো হয় থিয়েরি অঁরির এই ভাষ্কর্য। টটেনহ্যামের বিপক্ষে গোলের পর তার বিখ্যাত হাঁটু দিয়ে পিছলিয়ে গিয়ে উদযাপনের মুহূর্তটিকে স্মরণ করে নির্মাণ করা হয় ভাষ্কর্যটি; Image Credit: Getty Images

তবে তাকে কিন্তু সেরাদের কাতারে নিয়ে এসেছিল হাইবোরিতে কাটানো ঐ ৮টি বছরই। আর্সেনালে যখন এলেন, তখনই তার মাথার উপর একটি বিশাল চাপ, তা হলো ইয়ান রাইটের রেখে যাওয়া শূন্যতা পূরণ করা। অবশ্য আর্সেনাল আরো আগেই রাইটের রিপ্লেসমেন্ট নিয়ে এসেছিল, আরেক ফরাসি সেনসশন নিকোলাস আনেলকাকে। কিন্তু অঁরি যে মৌসুমের আর্সেনালে আসেন, তার পরেই আনেলকা বিদায় নিয়ে রিয়ালে যোগ দেন।

সিরি আ’তে জুভেন্টাসের হয়ে খেলেছিলেন মাত্র ৬ মাস। এই ৬ মাস তার জন্য এত হতাশাজনক ছিল যে সেখানেই ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যেতে পারত। তবে সঠিক সময়ে দলবদল করে নিজের ক্যারিয়ার তো রক্ষা করেছিলেনই, পাশাপাশি ফুটবল বিশ্বকে উপহার দিয়েছিলেন সময়ের অন্যতম সেরা এক ফরোয়ার্ড। আর্সেনালে যোগ দেয়ার পর এই অঁরির মধ্যে জুভেন্টাসের অঁরির ছিটেফোঁটাও দেখা যায়নি। উল্টো বিস্ফোরক সব পারফরম্যান্স দিয়ে নাম তুলেছিলেন প্রিমিয়ার লিগের সর্বকালের সেরাদের তালিকায়।

তার ১৩ বছর বয়সে মোনাকোর একজন স্কাউট যখন তাকে খুঁজে বের করে, তখন তার খেলা দেখে এতই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তাকে কোনোরকম ট্রায়াল ছাড়াই মোনাকোতে আনার প্রস্তাব দেন। কাতালানো নামের সেই স্কাউটের তদবিরে তার সুযোগ হয় ফ্রান্সের অভিজাত ফুটবল একাডেমি ক্লেয়ারফন্টেইন থেকে প্রশিক্ষণ নেয়ার। পেশাদার ফুটবলার হিসেবে সেখানে তার অভিষেক হয় ১৯৯৪ সালে। মোনাকোর কোচ তখন আর্সেন ওয়েঙ্গার। সেখানে অঁরির ক্যারিয়ার শুরু হয় একজন উইঙ্গার হিসেবে। ওয়েঙ্গার এই ৬ ফুট ২ ইঞ্চির সেন্টার ফরোয়ার্ডকে উইংয়ে নিয়ে আসেন তার পেস এবং বল কন্ট্রোলের জন্য। এই দিকে অঁরি আবার পেতে শুরু হয়েন এরিয়াল অ্যাডভান্টেজ। কারণ সচরাচর ফ্ল্যাঙ্কে থাকা উইঙ্গার কিংবা ফুলব্যাকের উচ্চতা তুলমূলক কম হয়। ওয়েঙ্গার অঁরি থেকে এভাবে নিজের সুবিধা আদায় করে নেন।

মোনাকোর হয়ে তরুণ অঁরি; Image Credit: Hulton Archive 

অঁরি বিশ্বের কাছে নিজেকে চেনাতে শুরু করেন ১৯৯৬-৯৭ মৌসুমে। এ মৌসুমে মোনাকো জিতেছিল ফ্রান্সের ১ম ডিভিশন লিগ, বর্তমানে যা ‘লিগ-ওয়ান’ নামে পরিচিত। সেই মৌসুমের অসাধারণ নৈপুণ্য তাকে সুযোগ করে দিয়েছিল আরো বড় মঞ্চে নিজেকে চেনানোর। পরের মৌসুমে লিগজয়ী হিসেবে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে জায়গা করে নেয় মোনাকো। কিন্তু এখানেই থেমে থাকা নয়, জিন তাইগানার দলটি রীতিমতো সেমিফাইনাল পর্যন্ত চলে যায়। এই পথে অঁরির পা থেকে এসেছিল ৭টি গোল। সদ্য টিনএজ পার করা একজন ফরোয়ার্ডের, কিংবা আরো নির্দিষ্ট করে বললে একজন উইঙ্গারের এমন পারফরম্যান্স ইউরোপের বড় বড় ক্লাবগুলোর নজর কাড়ে।

যখন তিনি ২১-এ পা দেন, তখন তাকে ইউরোপের ফুটবলে সবাই চেনে একটি ‘হটেস্ট প্রোডাক্ট’ হিসেবে। আমরা এমবাপেকে যেভাবে দেখি, ২৫ বছর আগে ফুটবল বিশ্ব অঁরিকেও সেভাবে দেখেছিল।  তার প্রজন্মের অন্য ফরাসি খেলোয়াড়দের তুলনায় তিনি ততদিনে নিজেকে আকাশছোঁয়া উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালে সেরা তরুণ ফরাসি খেলোয়াড়ের খেতাব জিতেছিলেন ফ্রান্সকে অনুর্ধ্ব-২১ ইউরো জিতিয়ে। এর বাইরে আরেকটি পুরষ্কার পান, এইম জ্যাক্যুর অধীনে ফ্রান্সের জাতীয় দলের জার্সি।

বিশ্বকাপের জন্য ২১ বছরের এই তরুণকে হঠাৎ দলে ডাকায় অবাক হয়েছিলেন অনেকেই। কোচ জ্যাক্যুর একদম শেষ মুহূর্তের সিদ্ধান্তে নিকোলাস আনেলকায় জায়গায় দলে আসেন অঁরি। সিদ্ধান্তটি স্বাভাবিকভাবেই বিতর্কের মুখে পড়ে। কারণ সেই মৌসুমে আনেলকাও আর্সেনালের হয়ে রীতিমতো উড়ছিলেন। ফ্রান্সের বাইরে প্রতিষ্ঠিত একজন খেলোয়াড় নিজের ক্রীড়ানৈপূণ্য ছাড়াও অন্যান্য দেশের খেলোয়াড় এবং খেলার ধরন সম্পর্কে একগাদা অভিজ্ঞতা ঝুলিতে ভরে নিয়ে আসতে পারতেন তা নিয়েও ছিল অনেকের অভিযোগ। কিন্তু এই সমালোচনা অঁরিকে স্পর্শ করতে পারেনি। ঘরের মাঠে তারা ফ্রান্সকে জেতাতে সক্ষম হন তাদের ইতিহাসের প্রথম বিশ্বকাপ। হয়তো বা ঘরের মাঠে খেলা বলেই ঘরোয়া লিগের খেলোয়াড়দের এত প্রাধান্য দেয়া হয়েছিল।

সুযোগটির সদ্ব্যবহার করতে মোটেও ভুল করেননি অঁরি। ফ্রান্স টুর্নামেন্টটি জেতে, ৩ গোল করা অঁরি হন দলের সর্বোচ্চ গোলদাতা। গ্রুপপর্বে অঁরির করা গোলগুলোই টুর্নামেন্টের বাকি পথে তাদের জন্য হেডস্টার্ট হিসেবে কাজ করেছে। ব্রাজিলের সাথে ফাইনালে ৩-০ গোলে জয়ের ম্যাচে তার বদলি হিসেবে নামার কথা ছিল। কিন্তু খেলার মাঝে মার্সেল ডেজাইলি লাল কার্ড দেখায় ফ্রান্স বাকি সময়টা রক্ষণাত্মক কৌশলে খেলা শুরু করে। তাই কোচ আর তাকে নামাননি।

সদ্য জেতা বিশ্বকাপে চুমু এঁকে দিচ্ছেন অঁরি ও ডিওর্কায়েফ; Image Credit: Gabriel Bouys

বিশ্বকাপের এই অভিজ্ঞতা অঁরির ক্যারিয়ার অগ্রগতিতে ভাল একটি প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। কিন্তু একজন বিশ্বজয়ী হিসেবে তিনি যখন তার ক্লাব মোনাকোতে ফিরে আসেন, সেখানে তিনি আর আগের মতো বাকিদের সমর্থন পাচ্ছিলেন না। তখনই আস্তে আস্তে তার ক্লাব ছাড়ার গুঞ্জন উঠতে থাকে। আর্সেন ওয়েঙ্গার তখন আর্সেনালে। তিনি চেয়েছিলেন অঁরিকে তখনই হাইবোরিতে নিয়ে আসতে। কিন্তু এই ট্রান্সফার একদমই অঁরির হাতে ছিল না। অঁরি নিজেও অবশ্য চাচ্ছিলেন আর্সেন ওয়েঙ্গারের সাথে আবারও কাজ করতে। কিন্তু বাদ সাধে মোনাকো কর্তৃপক্ষ। তারা অঁরির মধ্যে সোনার ডিম পাড়া হাঁসের অস্তিত্ব খুঁজে পায়। মোনাকো আগে থেকেই প্লেয়ার সেলিং ক্লাব। তাদের কাজই ভালো খেলোয়াড় তৈরি করে তাদের বেশি দামে বিক্রি করে দেয়া। আর্সেনালের কাছ থেকে তেমন ভালো অফার না পেয়ে তাই তারা অঁরিকে বিক্রি করে দেয় জুভেন্টাসে।

এই ট্রান্সফার এক কথায় বলা যায় অঁরির ক্যারিয়ারকে খাদের কিনারায় নিয়ে আসে।  মাত্র ৬ মাসের মধ্যে দুই কোচের অধীনে খেলেন জুভেন্টাসে। মার্সেলো লিপ্পি আর কার্লো আনচেলত্তি – দুইজনের কৌশল ছিল দুইরকম। উইঙ্গার হিসেবে নাম করা অঁরিকে তারা খেলান লেফট উইংব্যাক আর লেফট মিডফিল্ডার হিসেবে। এমন রক্ষণাত্মক ইতালীয় কৌশলে মোটেও খাপ খাওয়াতে পারেননি অঁরি। ইতালিতে খেলার কৌশলই তখন এমন যে পুরো দলকেই রক্ষণে অংশ নেয়া লাগবে। আনচেলত্তির অধীনে তাকে আলাদা করে এই ডিফেন্সিভ ডিউটি পালন করতে হত। কিন্তু এদিকে অঁরির কৌশল আবার সম্পুর্ণ আলাদা। তাকে ডিফেন্সিভ ডিউটি থেকে অব্যাহতি দিতে হবে। পিছনে কী হচ্ছে ওই চিন্তা বাদ দিয়ে পুরো ফোকাসটাই তার আক্রমণে। তার স্বভাবজাত উইংয়ে দৌড়ে বেড়ানো কিংবা একজন লিথাল ফিনিশারের যে ভূমিকা ছিল মাঠে তার কোনো কিছুই তাকে করতে দেয়া হয়নি ইতালিতে – যে কারণে পরে জুভেন্টাসের প্রথম একাদশে তাকে জায়গা হারাতে হয় জিয়ানলুকা জ্যামব্রোত্তার কাছে। ইউরোপের যেকোনো বড় ক্লাবে ট্রান্সফার হওয়া যেকোনো খেলোয়াড়েরই একটা স্বপ্ন। কিন্তু অঁরি জুভেন্টাসে গিয়ে এমন পরিস্থিতির সামনে পড়লেন, তার সেই স্বপ্ন পরিণত হয় দুঃস্বপ্নে। জুভেন্টাসে যে সবকিছু তার জন্য অপরিচিত ছিল, তা-ও নয়। ফ্রান্স জাতীয় দলের সতীর্থদের মধ্যে ইমানুয়েল পেতিত, দিদিয়ের দেশাম, জিনেদিন জিদানরা তখন খেলতেন তুরিনের এই ক্লাবেই। কিন্তু পরিবেশ-পরিস্থিতির চাইতে গুরুতর বিষয় হয়ে দাঁড়ায় জুভেন্টাসে অঁরির গেমটাইম না পাওয়া।

অঁরি নিজেও হয়ত বা ভুলে যেতে চান এই সাদা-কালো জার্সিটি গায়ে জড়ানোর কথা; Image Credit: Pinterest

ফুটবলে অনেক গ্রেটদের ক্যারিয়ারের দিকে তাকালে দেখবেন তাদের ক্যারিয়ারের কোনো না কোনো একটি কঠিন সময়ে কেউ একজন ত্রাণকর্তা হিসেবে হাজির হয়েছিলেন। অঁরির ক্ষেত্রেও এমন একজন ছিলেন – আর্সেন ওয়েঙ্গার; যিনি তার পুরোনো শিষ্যকে বলতে গেলে জেল থেকে ছাড়িয়ে এনেছিলেন।

মোনাকোতে অঁরির ক্যারিয়ার যখন অঙ্কুরিত হচ্ছিল, তখন থেকেই তাকে নজরে রেখেছিলেন ওয়েঙ্গার। জর্জ গ্রাহামের ক্লাব ছাড়ার পর অন্তর্বর্তী কোচের অধীনে যখন আর্সেনালের অবস্থা শোচনীয়, দলের প্রধান তারকা ইয়ান রাইট কোচের সাথে ঝামেলায় ক্লাব ছাড়ার দ্বারপ্রান্তে, তখন ওয়েঙ্গারের হাতে তুলে দেয়া হয় ক্লাবের দায়িত্ব। ওয়েঙ্গার এসেই অঁরিকে নিয়ে আসার চেষ্টা করেন। অঁরিকে না পেয়ে নিয়ে আসেন আনেলকাকে। তবে অঁরির উপর থেকে নজর সরান নি। অঁরি ইউভেন্টাসে যোগে দেয়ার ৬ মাস পরেই আবার সেই সুযোগ আসে, এইবার ওয়েঙ্গার আর সুযোগ হাতছাড়া করেন নি। প্রায় চুপেচাপেই তাদের মধ্যে চুক্তি সম্পন্ন হয়ে যায়। 

পড়তে পারেন: ইয়ান রাইট: রক্তেই যার আর্সেনাল

হাইবোরিতে এসে প্রমিসিং উইঙ্গার অঁরি হয়ে যান পুরোদস্ত একজন স্ট্রাইকার। উত্তর লন্ডনের ক্লাবে তার জন্য আগেই অপেক্ষা করছিলেন তার দুই ফরাসি সতীর্থ পেতিত ও ভিয়েরা। ক্লাব, সমর্থক, ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং প্রিমিয়ার লিগে খেলার অভিজ্ঞতা সব বিষয়েই তারা অবহিত করেন তাদের এই নতুন ফরোয়ার্ডকে।

এই ছবির জন্য কোনো ক্যাপশন বরাদ্দ নেই, দুঃখিত; Image Credit: Getty Image

অঁরি আর্সেনালে আসার দুই মৌসুম আগে আর্সেনাল লিগ জেতে, পরের মৌসুমে একদম শেষ দিনে তারা শিরোপা হারায় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কাছে। আর্সেনালের কাছে তাই ১৯৯৯-২০০০ মৌসুমটা ছিল হারানো মুকুট পুনোরুদ্ধারের মিশন। তৎকালীন ইংলিশ ফুটবলে রাজ করবার হুঙ্কার দেয়া আর্সেনাল এবার অঁরিকে দায়িত্ব দেয় পরবর্তী শতাব্দিতে তাদের রাজত্বের বিস্তার ঘটানোর। তবে অঁরির ভাগ্যে আনেলকার সাথে জুটি করার সুযোগ লেখা ছিল না। অঁরি আসার সাথে সাথে আনেলকাও ক্লাব ছেড়ে চলে আসেন রিয়াল মাদ্রিদে। তবে অঁরিকে সঙ্গ দেয়ার আরেকজন ছিলেন ক্লাবে, নন-ফ্লাইং ডাচম্যান নামে খ্যাত ডেনিস বার্গক্যাম্প। এই দুইজনের জুটি আর্সেনালের ১৪ আর ১০ নাম্বার জার্সিকে এত গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।

প্রিমিয়ার লিগে তখন আর্সেনাল-ইউনাইটেড দ্বন্দ্ব; কে কাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে, তা নিয়েই চলছিল প্রতিযোগিতা। অঁরিকে ওয়েঙ্গার একদম যথাযথভাবে ব্যবহার করেন সেরাদের মুকুট নিজেদের মাথায় তুলতে। ওয়েঙ্গারের আর্সেনাল ছিল একদম মডার্ন ফুটবলের জন্য আদর্শ একটি স্কোয়াড, যে স্কোয়াডে অভিজ্ঞতা আর তারুণ্যের মিশেল হয়েছিল বিদেশি খেলোয়াড়দের সাথে স্থানীয় একাডেমির খেলোয়াড়দের সংমিশ্রণে। আরো নির্দিষ্ট করে বললে, ব্রিটিশ খেলোয়াড়দের সাথে ফরাসি খেলোয়াড়দের সংমিশ্রণে। আর্সেনালের স্কোয়াডটা ভিয়েরা–বার্গক্যাম্পদের নিয়ে তখন অনেকটাই দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত। তাদের সাথে পরে অঁরি, ল্যাংবার্গ, পিরেস মিলে দলটিকে প্রস্তুত করেন একটি শিরোপাজয়ী দলে। শিরোপাও তাদের হাতে ধরা দিয়েছিল; এই স্কোয়াডটাই ২০০৩-০৪ মৌসুমে কোনো ম্যাচ না হেরে লিগ জেতে। এ সবের কেন্দ্রবিন্দুতে তখন অঁরি। নিজের সক্ষমতার সবটুকুই তিনি তখন ঢেলে দিচ্ছিলেন ক্লাবের জন্য।

কিন্তু আর্সেনাল ক্যারিয়ারের শুরুতে অঁরি আরেক বড় ধাক্কার খাওয়ার মুখে চলে যান, প্রথম ৮ ম্যাচেই কোনো গোলের দেখা পাননি। বলতে গেলে জুভেন্টাসের মানসিক ধকল কাটাতে সময় লেগেছিল তার। কিন্ত মৌসুমশেষে দেখা গেল এই অঁরির নামের পাশেই ২৬টি গোল।

বলকে এত নিখুঁতভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন যেন মনে হতো বলটি লোহার আর তার পা চুম্বকের তৈরি; Image Credit: PA Archive/PA Images

আর্সেনাল ফ্যানরা অঁরিকে এক নামে ডাকে – ‘কিং’। আর্সেনালের এই যাত্রায় অবশ্যই অঁরি ছিলেন তাদের রাজা। প্রিমিয়ার লিগের ইতিহাসে অনেক স্ট্রাইকারকে দেখেছে বিশ্ব। কিন্তু অঁরি ছিলেন তাদের মধ্যে একদম আলাদা একজন। মারণকামড়ের মতো ফিনিশিংয়ের সাথে তার অস্ত্র ছিল দুরন্ত গতি ও দুর্দান্ত সব কৌশল। বল বলতে গেলে পায়ে লাগিয়ে নিয়ে তিনি নিজের পূর্ণ গতিতে দৌড়াতেন। ফার্স্ট টাচ, বল কন্ট্রোল ছিল একদম জাঁকালো। তার ট্রেডমার্ক গোলগুলো এমন ছিল যে ডিফেন্ডারদের কাটিয়ে আগে গোলরক্ষককে একা বানাবেন, এরপর ডান পায়ের ভেতরের পাশ দিয়ে সুন্দর প্লেসিং শটে বলকে জালের নিচের কোণায় পাঠাবেন। ২০১৪ সালের বিশ্বকাপের এক খেলায়, খেলা-পূর্ববর্তী আলোচনায় এই নিয়ে কথা বলেছিলেন তিনি। তার কথামতে, তিনি ওই এঙ্গেলে শ্যুট নিতেন যাতে করে বলটা মাটি কামড়িয়ে, একটু স্পিন করে, একদম জালের কোণায় চলে যায়।

জানুয়ারি ৯, ২০১২ – মহারাজের প্রত্যাবর্তন হয় এদিন। বদলি হিসেবে নেমেই গোলরক্ষককে একা পেয়ে ট্রেডমার্ক সাইড-ফুটেড শটে গোল করেন। ছবিতে সেই গোলটির দৃশ্যই। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে বল বাইরে চলে যাবে। কিন্তু বলটি আসলে আগেও যেমন জালের কোণায় গিয়ে আশ্রয় নিত, সেদিনও জালের কোণায় গিয়েই থামে; Image Credit: Getty Images

৮ বছরের আর্সেনাল ক্যারিয়ারে তিনি আর্সেনালকে দিয়েছেন অনেক কিছুই। বিনিময়ে আর্সেনাল তাকে দিয়েছে নতুন একটি পরিচয়। এই এক ক্লাবের হয়ে মোট গোল করেন ২২৮টি। একমাত্র ফরাসি খেলোয়াড় হিসেবে জিতেছিলেন ইউরোপীয় গোল্ডেন শ্যু, ৮টি হ্যাটট্রিক নিয়ে প্রিমিয়ার লিগের সর্বোচ্চ হ্যাটট্রিক এখনো তার দখলে, পাঁচবারের ফরাসি বর্ষসেরা ফুটবলার (৫ বারই আর্সেনালে থাকতে), দুইবার প্রিমিয়ার লিগের বর্ষসেরা খেলোয়াড়, ৪টি গোল্ডেন বুট, একই মৌসুমে ২০+ গোল এবং ২০+ অ্যাসিস্ট – সবই এসেছিল আর্সেনালে থাকতে। এছাড়া এমন কিছু মুহূর্তের জন্ম দিয়েছিলেন যা তাকে আরো কয়েক যুগ মনে রাখানোর জন্য যথেষ্ট।

একবার তার কাছে আসা বল সামান্য ফ্লিক করে নিজে ঘুরে সুন্দর এক ভলিতে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ফরাসি গোলরক্ষক ফ্যাবিয়ান বার্থেজের মাথার উপর দিয়ে গোল করেছিলেন। এরপর মিসাইলের গতিতে ম্যানচেস্টার সিটির সাথে বক্সের বাইরে থেকে গোল করেন, তারপর অ্যাস্টন ভিলার সাথে ফ্রি-কিকে গোল করার পর রেফারি তাকে সেই ফ্রিকিক আবার নিতে বলায় পরেরবারের ফ্রিকিক থেকে আবারও গোল করে রেফারির দিকে তাকিয়ে বলেন – “Is that enough?” আবার একবার একদম শেষ মুহূর্তের হেডে গোল করে ইউনাইটেডের সাথে জয় ছিনিয়ে আনেন। এরপর আবার অপরাজেয় শিরোপা জয়ের পথে টটেনহ্যামের মাঠে লিগ জিতে তার বুনো উল্লাস করেন। এত সবের মাঝে আপনি কি কোনোটিকে ছেড়ে কোনোটিকে এগিয়ে রাখতে পারবেন?

জিদানের বানিয়ে দেয়া বল থেকে গোল করে ২০০৬ সালের বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে ব্রাজিলকে বিদায় করে দেন অঁরি; Image Credit: Lionel Cironneau

তবে আর্সেনালের এই অপরাজেয় যাত্রার কৃতিত্ব শুধু অঁরিকে দিলে হবে না, এটি পুরো দলের প্রাপ্য। পুরো দলটি একটি ইউনিট হিসেবে খেলেছিল। কৌশল, আত্মবিশ্বাসের এক অভাবনীয় মিশেল ছিল সেখানে। অঁরি শুধু এই প্রতিভাবানদের মধ্যে ঢুকে গিয়ে ধাঁধাঁর শেষ সূত্রটি যোগ করেছেন।

আর্সেনের ৪-৪-১-১ ফরমেশনে অঁরি একদম সামনে থাকলে খেলতেন একটু বামে চেপে। বামে তার সাথে খেলতেন রবার্ট পিরেস। খেলার মধ্যে দু’জনের বোঝাপড়া দেখে মনে হতো তারা টেলিপ্যাথির মাধ্যমে যোগাযোগ করছেন। অঁরির একক প্রতিভাকে যদি আমারা আলাদা রেখে দেই, তবুও আমরা একজন টিম প্লেয়ার হিসেবে তাকে পাব। বাকি ১০ জন খেলোয়াড়ের সামনে থেকে তাদের পথ দেখানোর কাজটা খুব ভালোভাবেই পারতেন তিনি।

আর্সেনালের ৮ বছরে ঘরোয়া সব ট্রফিকেই ছুঁইয়েছিলেন। অধরা ছিল শুধু একটি ইউরোপীয় শিরোপার। অঁরির প্রথম মৌসুমে আর্সেনাল উয়েফা কাপে একদম ফাইনালে গিয়ে হারে। এরপর ২০০৬ সালে হাতের নাগালে এসেও বাজে রেফারিংয়ের খেসারত দিয়ে সেই চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপা তুলে দিতে হয় বার্সেলোনার হাতে। তার বছরদুয়েক বাদেই অঁরি যোগ দেন বার্সেলোনায়। বার্সেলোনা দলে তখন উঁকি দিচ্ছিল নতুন এক বিপ্লব। অঁরি গিয়ে সরাসরি জায়গা করে নেন সেই বিপ্লবের মধ্যে। শুধুমাত্র এই একটি চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের আশায় অঁরি চলে আসেন কাতালুনিয়ায়। বার্সেলোনায় তিনি ফিরে যান তার পুরনো লেফট উইঙ্গার ভূমিকায়। কাতালানদের হয়ে তার প্রথম মৌসুমে ১৯টি গোল করেন তিনি। তার দু’বছর বাদেই চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের স্বপ্নটি পূরণ করেন। শুধু চ্যাম্পিয়ন্স লিগ নয়, সেই মৌসুমে বার্সেলোনা জিতেছিল ট্রেবল। আর্সেনালে থাকাকালে তার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাব ছিল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, ফার্গুসনের এই ইউনাইটেডকেই তারা হারায় ফাইনালে।

‘আমি পাইলাম, আমি ইহাকে পাইলাম’; Image Credit: Giampiero Sposito/Reuters

তবে চাঁদের যেমন কলঙ্ক থাকে, অঁরির ক্যারিয়ারেও একসম্য দাগ বসায় এক কলঙ্ক। ২০১০ বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে নিজদের গ্রুপে ফ্রান্স দ্বিতীয় হয়, সার্বিয়ার পেছনে পরে তারা। বিশ্বকাপে খেলার জন্য তাই তাদের পেরোতে হত প্লে-অফের বাঁধা। প্লে-অফে তারা প্রতিপক্ষ হিসেবে পায় আয়ারল্যান্ডকে। ফ্রান্সকে খেলায় শুরু থেকেই চাপে রাখে আইরিশরা। খেলার নির্ধারিত সময় শেষে স্কোর ছিল ১-১ এ। তাই খেলাটি গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে।

অঁরি কেলেঙ্কারিটি ঘটান এরপর। আয়ারল্যান্ডের পোস্টের সামনের ৬ গজের বক্সে বল পেয়েছিলেন অঁরি। পা দিয়ে বলটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন না বুঝতে পেরে ব্যবহার করেন তার হাত। একবার নয়, দু’বার। এভাবে বলকে নিজের নিয়ন্ত্রণে এনে আলতো করে ক্রস করেন উইলিয়াম গালাসের কাছে। গালাস বলটি জালে জড়ান। এই এক গোলে শেষ হয়ে যায় আয়ারল্যান্ডের বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন। অন্যদিকে ধুঁকতে থাকা ফ্রান্স জায়গা করে নেয় বিশ্বকাপে। এই নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়তে দেরি হয়নি অঁরির।

ইতিহাসের কলঙ্কিত সেই হ্যান্ডবলের মুহুর্তটি; Image Credit: Mantey/Presse Sports/US Presswire

তবে অকপটেই মিডিয়ার সামনে নিজের দোষ স্বীকার করে নেন তিনি। কাজটি যে একদমই ঠিক হয়নি, তা বুঝতে সামান্য সময়ই লাগে তার। নিজের কার্যকলাপের জন্য ক্ষমাও চান। সেই সাথে প্রস্তাব দিয়েছিলেন এই ম্যাচটি আবার খেলার। আয়ারল্যান্ডও দাবি তুলেছিল আবার খেলার জন্য। তাদের জন্য এটিই ছিল সুবিচার। কিন্তু তাদের প্রস্তাবে সায় দেয়নি ফিফা। ফলে একরকম ভিলেন হয়ে মাথা নিচু করে ২০১০ এর বিশ্বকাপে অংশ নিতে যায় ফ্রান্স।

এই বিশ্বকাপটি ছিল ফ্রান্সের জন্য একরকম দুঃস্বপ্নের মত। ড্রেসিংরুমে শুরু হয় কোচ আর খেলোয়াড়দের মধ্যে ঝামেলা। কোনো ম্যাচ না খেলেই লন্ডনে ফিরে এসেছিলেন নিকোলাস আনেলকা। সবকিছু মিলিয়ে একদম ব্যর্থ হওয়া রেমন্ড ডমিনিখের দল গ্রুপপর্ব থেকেই বিদায় নেয়।

অঁরির জাতীয় দলের যাত্রা এভাবেই অন্তিমের দিকে চলে যায়। আর কখনো তার ফেরা হয়নি কোনো বড় মঞ্চে। বিশ্বকাপের পর বার্সেলোনা ছেড়ে পাড়ি জমান যুক্তরাস্ট্রের নিউ ইয়র্ক রেড বুলস ক্লাবে। মাঝে ২০১২ সালে ২ মাসের জন্য এসেছিলেন আর্সেনালে। এরপর ২০১৪ সালে স্থায়ীভাবে অবসরে যান তিনি।

আর্সেনালের ইনভিন্সিবল স্কোয়াডের অনেকেই বর্তমানে বিভিন্ন দলে কোচিং প্যানেলে কাজ করছেন। অঁরিও এর ব্যতিক্রম নন। তার কোচিং ক্যারিয়ারের শুরুটা হয়েছিল আর্সেনালের যুবদলে। একাডেমির প্রধান আন্দ্রিয়েস জোংকারের কাছ থেকে পেয়েছিলেন অনূর্ধ্ব-১৮ দলের কোচ হওয়ার প্রস্তাব। কিন্তু আর্সেন ওয়েঙ্গার দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের খোঁজে অঁরির এই অ্যাপয়েন্টমেন্ট আটকিয়ে দেন। পরবর্তীতে তিনি বেলজিয়াম জাতীয় দলে রবার্তো মার্টিনেজের দ্বিতীয় সহকারীর দায়িত্ব পান। ২০১৮ বিশ্বকাপের পরে তিনি পদোন্নতি পান সহকারী কোচের পদে। কিন্তু সেই দায়িত্ব না নিয়ে নিয়েছিলেন মোনাকোর প্রধান কোচের দায়িত্ব। কিন্তু এখানে আবার উল্টো ধ্বস নামে।

এবারের গল্পটি একটু নিষ্ঠুর। ২০টি খেলার ১১টিতেই হেরে মোনাকোর কোচের পদ থেকে চাকুরিচ্যুত হন অঁরি; Image Credit: PUNCH

অঁরি মোনাকোতে টিকে ছিলেন কেবল ২০ ম্যাচের জন্য। এই ২০ ম্যাচের মধ্যে তারা জেতে ৪টি, ড্র করে ৫টি, হেরে যায় ১১টি খেলায়। তাই ওই মৌসুমের জানুয়ারিতে লিগে ২৯তম থাকা অবস্থায় রেলিগেশনের শঙ্কায় তাকে বিদায় করে দেয়া হয়। এরপর কোচ হিসেবে চলে আসেন আমার এমএলএস-এ। মন্ট্রিয়েল ইমপ্যাক্টের দায়িত্ব নেন। কিন্তু এর মাঝে হানা দেয় কোভিড-১৯। ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা থাকায় এক বছর চোখের দেখাও দেখতে পারেননি তার সন্তানদের। তাই চাকরির ইস্তফা দিয়ে ফিরে আসেন ইউরোপে। ফিরে এসে আবার বেলজিয়ামের কোচিং স্টাফে যোগ দেন ২০২০ ইউরোর জন্য।

গত বছর থেকে প্রিমিয়ার লিগে ‘হল অফ ফেম’ পদক দেয়া শুরু করে লিগের কিংবদন্তিদের। শুরুটা হয় অঁরিকে দিয়েই। আরেক সেরা স্ট্রাইকার অ্যালান শিয়েরারের সাথে একই দিনে এই তালিকার অন্তর্ভুক্ত হন তিনি।

প্রিমিয়ার লিগের ‘হল অফ ফেম’ খেতাব হাতে প্রিমিয়ার লিগের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দুই স্ট্রাইকার; Image Credit: Premier League

একথা সত্য যে আন্তর্জতিক অঙ্গনে সবচেয়ে বেশি আলোচিত-সমালোচিত হবে অঁরির এই হ্যান্ডবলটি। কিন্তু এতে তিনি ক্লাব ও জাতীয় দলের হয়ে যা জিতেছেন, তা ফিকে হয়ে যায় না। তার ক্যারিয়ারের পরিসংখ্যান তাকে ইতিহাসের সেরাদের কাতারে নিয়ে আসে। সর্বকালের সেরাদের তালিকায় তর্কসাপেক্ষে তাকে জায়গাও দেয়া যায় অনেক সময়।

তবে সবধরনের অর্জন আর পরিসংখ্যান মিলিয়ে হয়তো বা অনেকের চাইতেই পিছিয়ে পড়বেন তিনি, কিন্তু এতে তার কৃতিত্বে কোনো ভাটা পড়বে না। তার অসাধারণ ক্রীড়াপ্রতিভাকে সবাই মনে রাখবে। তার ক্রীড়াশৈলী ভক্তদের মনে আজীবন গেঁথে থাকবে।

Related Articles