একজন পেশাদার ফুটবলার অবসরের পর কী করেন?
অধিকাংশ ঝুঁকে যায় ব্যবসা- বাণিজ্যের দিকে। আর খেলোয়াড় অবস্থায় যারা ফুটবল দর্শন বেশ ভালোভাবে বুঝতেন, তারা হয় ফুটবলবোদ্ধা বনে যান, অথবা কোচের লাইসেন্স নিয়ে পুনরায় কোচরূপে ফুটবল দুনিয়ায় ফেরত আসেন। তবে ভালো খেলোয়াড় হলেই যে ভালো কোচ হবেন, সেই সম্ভাবনায় যেমন সংশয় থাকে, তেমনই ফুটবলের সাথে কোনো সম্পর্ক না থাকার পরও অনেকে কোচ হিসেবে নিজেকের সুপ্ত প্রতিভা তুলে ধরার ক্ষমতা রাখেন। ব্যাংকার থেকে কোচ বনে যাওয়া মরিজিও সারি তার অন্যতম উদাহরণ। এছাড়াও বলা যায় আর্সেন ওয়েঙ্গার, জোসে মরিনহো বা আরিগো সাচ্চির মতো কোচেরা খেলোয়াড় জীবনে সেভাবে ভালো ফুটবলের সংস্পর্শে কখনোই ছিলেন না।
আজকের এ আর্টিকেল সাজানো হয়েছে বর্তমান সময়ের সেরা পাঁচজন ফুটবলারদের নিয়ে, যারা একসময় ফুটবলার হয়ে সুনাম কুড়িয়েছেন, এবং পরবর্তীতে কোচ হিসেবে ফিরে এসে ক্লাবের হাল ধরেও সাফল্য পাচ্ছেন।
জেনারো গাত্তুসো - এসি মিলান
২০১৭ সালে এসি মিলানের মালিকানা পরিবর্তন হয়, আসে চাইনিজ যুগ। তারা প্রথমে এসে দলকে ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু ভরসা রাখেন পুরনো কোচ ভিনসেঞ্জো মন্তেয়ার উপর। তবে নতুন ও প্রতিভাবান কিছু খেলোয়াড় দলে থাকার পরও মন্তেয়া কোনো আশার বাণী শোনাতে যখন পারলেন না, তখন বোর্ড তাকে বরখাস্ত করে নিয়ে আসে মিলানের ইতিহাসের কিংবদন্তি খেলোয়াড় জেনারো গাত্তুসোকে।
জেনারো গাত্তুসোকে আশা করি পরিচয় করিয়ে দিতে হবে না। ১৯৯৯ থেকে ২০১২ দীর্ঘ ১৩ বছর তিনি কাটিয়েছেন ইতালির মিলানে, ক্লাবের হয়ে খেলেছেন ৩৮৭টি ম্যাচ। যখন খেলতেন, মিলানের মধ্যমাঠের মস্তিষ্ক ছিলেন তিনি। এসি মিলানের হয়ে দুইবার চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছেন, দুইবার ইতালীয় লিগ শিরোপা। কিন্তু খেলোয়াড়ি জীবনে মানুষটা একটু উগ্র মেজাজের ছিলেন। পান থেকে চুন খসলেই রাগে ফেটে পড়তেন ম্যাচের মাঝেই। এমন মেজাজের মানুষ এসি মিলানের মতো দলের দায়িত্ব কি বইতে পারবেন?
অথচ গাত্তুসো আসার পর মিলান অদ্ভুত কোনো কিছু করে বসেনি। কোনো ট্রফিও জিততে পারেনি বটে, তবে গাত্তুসো দলে সূক্ষ্ম বদল এনেছেন। দলে যেমন কিছু তরুণ প্রতিভা এনেছেন, তেমনই অ্যাকাডেমি থেকেও অনেককে সুযোগ করে দিয়েছেন। মিলানের খেলার ধরণেও এসেছে বদল। এ মৌসুমে তারা সিরি আ'তে শেষ চারে থেকে চ্যাম্পিয়নস লিগ খেলার স্বপ্ন দেখছে, যার জন্য রোজ্জানেরিরা কোনো বড় সাফল্য ছাড়াই গাত্তুসোর মিলানকে নিয়ে খুশি।
আর্নেস্তো ভালভার্দে - বার্সেলোনা
ভালভার্দে একজন কাতালান হলেও ক্যাম্প ন্যুতে তিনি খেলেছেন মাত্র দুইটি মৌসুম। ১৯৯৪ থেকে ২০০০ সালে ২০ ম্যাচে নেমে তিনি করেছেন ৭ গোল। তবে তার খেলোয়াড়ি জীবন থেকে একজন কোচ হিসেবে তিনি বেশি পরিচিত। অ্যাথলেটিক বিলবাও'তে কোচ থাকার সময় তার নামডাক ছড়িয়ে পড়ে, এবং বার্সেলোনা ২০১৭-১৮ মৌসুমে লুইস এনরিকের পরিবর্তে কোচ হিসেবে তাকেই বেছে নেয়।
ট্রেবল জেতানো এনরিকের বার্সেলোনা শেষের দিকে একটু অগোছালো ছিল। কয়েকটি পজিশনে প্রয়োজনীয় খেলোয়াড় নেই, এবং কয়েকজন খেলোয়াড় দীর্ঘদিন ধরে ফর্মহীনতায় ভুগছেন। তার উপর নেইমারের মতো খেলোয়াড় চলে যাবার সমস্যা ভালভার্দে খুবই ঠান্ডা মাথায় পার করেছেন। ক্লাবের বোর্ড যেমন তাকে আর্থিক সহায়তা করেছে, তেমনই তিনি তার চাহিদামতো খেলোয়াড় খুঁজেও নিয়েছেন।
যদিও তার অনেক সিদ্ধান্ত প্রশ্নবিদ্ধ, তার ট্যাকটিকসও খুবই সস্তা মানের, তবুও শিরোপা ও সাফল্য কিন্তু আসছে। গত মৌসুমে বার্সেলোনা জিতেছে লিগ ও কোপা ডেল রে। গতবার লিগে শেষ ম্যাচ বাদে বার্সেলোনা আর কোনো ম্যাচ হারেনি। গত দুই মৌসুমে বার্সেলোনার কাছে রিয়াল মাদ্রিদকে যেভাবে নাকানি-চুবানির শিকার হতে হয়েছে, ইতিহাসে এমন আর নজির নেই। চলতি মৌসুমেও বার্সেলোনা লিগ জেতার সন্নিকটে, কোপা দেল রে'র ফাইনালেও পৌঁছে গেছে। চ্যাম্পিয়নস লিগেও টিকে আছে শক্তভাবে।
তবে বার্সেলোনা দলে মেসি, সুয়ারেজের পাশাপাশি পিকে, ডেম্বেলে বা কৌতিনহো'র মত সুপারস্টাররা খেলে বলে সাফল্য আসবেই, এমন ভাবা অন্যায়। নামকরা খেলোয়াড়ভর্তি একাদশ নিয়েও অনেক ক্লাব ন্যূনতম সাফল্যের ছোঁয়া পাচ্ছে না। সেখানে ভালভার্দে ঠিকই বার্সেলোনাকে এগিয়ে যেতে সহায়তা করে যাচ্ছেন।
ডিয়েগো সিমিওনে - অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ
অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের নতুনভাবে গড়ে ওঠার যাত্রা শুরু হয়েছিলো ২০১১ সালে, যখন ডিয়েগো সিমিওনে প্রথম তার খেলোয়াড়ি জীবনের ক্লাবের হাল ধরেন। ২০১১ সাল থেকে ২০১৯, এর মাঝে মাদ্রিদ শহরের ক্লাবটি জিতেছে ৭টি ট্রফি, যার ভেতর ২টি ইউরোপা লিগ, ১টি লা লিগা অন্যতম। এর মাঝে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালেও গিয়েছিল তারা, তবে ফাইনাল জয় করা হয়নি। আর ৯ বছরে এত সব অর্জন, এত পরিবর্তন, সবই এসেছে সিমিওনের হাত ধরে, যিনি পূর্বে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের একাদশের নিয়মিত মুখ ছিলেন।
খেলোয়াড় হিসেবে সিমিওনে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদে ছিলেন ৫ বছর। খেলতেন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হয়ে, তাই গোলের পরিসংখ্যান দিয়ে তার ক্যারিয়ার বিচার করা সম্ভব নয়। দুই দফায় অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদে ছিলেন তিনি। ১৯৯৪ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত প্রথম দফায়, পরে ২০০৩ সালে আবার প্রাক্তন ক্লাবে ফিরে এসে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ছিলেন। ১৯৯৫-১৯৫৬ মৌসুমে অ্যাটলেটিকো ডাবল শিরোপা জেতে। এই ডাবল শিরোপা জেতা দলের একাদশে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় ছিলেন সিমিওনে।
একসময় খেলোয়াড় হিসেবে ক্লাবকে তুলে ধরেছেন, বর্তমানে কোচ হয়ে। শুধু পরিবর্তন নয় একটি দিকেই; খেলোয়াড়ি জীবনে খেলতেন রক্ষণের দিকে বেশি মনোযোগী হয়ে, কোচ হয়েও সে মনোভাবের কোনো পরিবর্তন নেই।
ওলে গানার সলশায়ের - ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড
ফার্গুসনের অধীনে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের স্বর্ণালী সময় যারা উপভোগ করেছেন ও মনে রেখেছেন, ওলে গানার সলশায়ের তাদের কাছে খুবই পরিচিত ও প্রিয় একটি নাম। রেড ডেভিলদের অর্জনের ইতিহাসের সাথে এ নামটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ১৯৯৯ সালে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে তিনিই গোল করে এনে দেন চ্যাম্পিয়নস লিগ। ফলে সে মৌসুমে তারা জিতে নেয় ট্রেবল। ফার্গুসনের দলে সলশায়ের অবশ্য অধিকাংশ সময়ে বেঞ্চে থাকতেন, ফার্গুসন তাকে বেঞ্চ থেকেই খেলাতে বেশি পছন্দ করতেন। কারণ সলশায়ের ম্যাচের শেষের দিকে বেঞ্চ থেকে নেমে খেলা বদলে দিতেন। তার নমুনা আছে অনেক, অনেকবার।
সলশেয়ারের চেহারা ছিলো কিছুটা শিশুসুলভ। তাই চেহারা আর খেলার ধরন মিলিয়ে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সমর্থকেরা তাকে ভালোবেসে ডাকতো 'বেবি ফেইসড অ্যাসাসিন'। ইউনাইটেডের হয়ে দীর্ঘ ১১ বছর খেলেছেন নরওয়েজিয়ান এই স্ট্রাইকার, ৩৫৯ ম্যাচে করেছেন ১২৩ গোল।
খেলোয়াড় ছেড়ে কোচিং পেশা শুরু করেছিলেন এই ইউনাইটেডেই। তবে মোল্ড এফকে ও কার্ডিফ সিটি ঘুরে তিনি আবার ফিরে আসেন ইউনাইটেডের অন্তবর্তীকালীন কোচ হয়ে। জোসে মরিনহোর অধীনে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড যে জঘন্য খেলছিল, সলশায়ের কোচের আসন নেবার পর সেটাই হয়ে গেলো উল্টো। তাদের খেলার ধরন দেখে মনে হতে লাগলো, খেলোয়াড়রা সবাই যেন হুট করেই পরশপাথরের ছোঁয়া পেয়েছেন।
সলশায়েরকে আনা হয়েছিলো দলকে বাঁচাতে। প্রিমিয়ার লিগের তালিকায় দলকে এগিয়ে নেওয়া ও হারের বৃত্ত থেকে বের করা ছাড়া তার আর কোনো দায়িত্ব আপাতত নেই। সলশায়ের সে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হননি। ইউনাইটেড পুরনো খোলস থেকে বের হয়ে এসেছে। তাই সলশায়েরকে স্থায়ী কোচ হিসেবে নিয়োগও দেওয়া হয়ে গেছে। তবে তিনি কতটা সাফল্যের দেখা পান, তা দেখা যাবে আগামী মৌসুম থেকে।
জিনেদিন জিদান - রিয়াল মাদ্রিদ
খেলোয়াড় এবং কোচ, উভয় দিকেই জিদান যেভাবে রিয়াল মাদ্রিদকে শিরোপা জিতিয়েছেন, এমন আরেকটি উদাহরণ পাওয়া দুর্লভ। জুভেন্টাস থেকে রেকর্ড পরিমান ট্রান্সফার ফি দিয়ে তাকে দলে ভিড়িয়েছিলো রিয়াল মাদ্রিদ। ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত খেলে ১৫৫ ম্যাচে ৩৭ গোল করেছেন ফরাসি এই মিডফিল্ডার। তবে অর্জনটা অন্যখানে। এই ৪ বছরে রিয়ালের হয়ে ৬টি বড় শিরোপা জিতেছেন তিনি।
অবসর নেবার পরও জিজু ছিলেন রিয়াল মাদ্রিদের স্পর্শে, কস্তিয়ার কোচের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। রাফায়েল বেনিতেজের অধীনে যখন রিয়ালের টালমাটাল অবস্থা, তখন মূল দলের হাল ধরার দায়িত্ব বর্তায় জিদানের কাঁধে। তাতেই বাজিমাত করেছেন জিদান। আসলে তিনি যা করেছেন, বিশ্বের অন্য কোনো ক্লাব পূর্বে তা করে দেখাতে পারেনি।
প্রথম দফায় ৩ বছরে তিনি টানা ৩টি চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা এনে দিয়েছেন রিয়াল মাদ্রিদকে। এছাড়াও ছিল লা লিগা ও উয়েফা সুপার কাপের মতো ট্রফি।
টানা ৩ বছর স্বপ্নের মত সময় কাটিয়ে তিনি বিদায় নিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু তিনি বিদায়ের পর আবার রিয়াল মাদ্রিদ ফের খাদের কিনারায়। সান্তিয়াগো সোলারি বা হুলেন লোপেতেগি কেউই পারেননি রিয়াল মাদ্রিদের মেরুদন্ড সোজা করতে। তাই আরও একবার 'দ্য গ্রেট জিজু'র ডাক পরেছে রিয়াল মাদ্রিদ শিবিরে। বর্তমানে তাই দ্বিতীয় দফায় রিয়াল মাদ্রিদের কোচের দায়িত্ব পালন করছেন ফ্রান্সের বিশ্বকাপজয়ী এই কিংবদন্তি।
This article is in Bangla language. It is about the managers who have also represented the club as a player.
Feature Image: Tom Purslow/Man Utd via Getty Images