ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, যারা একসময় দাপিয়ে বেড়িয়েছে পুরো ইউরোপ, যাদের সাথে খেলার আগে প্রতিপক্ষ দলের খেলোয়াড়দের বুকে কাঁপন ধরত, সেই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের আজকে খেলার মাঠে একেবারেই দৈন্যদশা। কিংবদন্তি কোচ স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের বিদায়ের পর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড যেন হারিয়ে খুঁজছে নিজেদের। একের পর এক বড় সাইনিং, নামকরা সব কোচের আগমন ঘটছে; কিন্তু কিছুতেই যেন কিছু হচ্ছে না। ফার্গুসন-পরবর্তী সময়ে দলকে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে নিয়ে গিয়েছিলেন তারই শিষ্য, ওলে গানার সোলশার। ওলে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে ২০২০-২১ মৌসুমে লিগে দ্বিতীয় অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছিলেন, নিয়ে গিয়েছিলেন ইউরোপার ফাইনালে।
২০২১-২২ সিজনের শুরুটাও ইউনাইটেড ফ্যানদের কাছে ছিল স্বপ্নের মতো। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এসময় দলে ভেড়ায় সময়ের তরুণ 'সেনসেশন' জ্যাডন স্যাঞ্চোকে। ডিফেন্স এর সমস্যা মেটাতে রিয়াল মাদ্রিদ থেকে কিনে আনে রাফায়েল ভারানকে। সবচেয়ে আশ্চর্যজনকভাবে ট্রান্সফার উইন্ডোর শেষ দিকে তারা ঘরে ফেরায় ১২ বছর আগে ছেড়ে যাওয়া সময়ের অন্যতম সেরা ফুটবলার ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে। এত এত সাইনিংয়ের পর ইউনাইটেডের মৌসুমের শুরুটাও হয়েছিল উড়ন্ত। লীডস ইউনাইটেডকে সিজনের প্রথম ম্যাচে ৫-১ গোলের বড় ব্যবধানে হারিয়ে মৌসুমের শুভসূচনা করে রেড ডেভিলরা।
তবে শুরুটা ভালো হলেও দিন গড়ানোর সাথে সাথে ইউনাইটেডের পারফরম্যান্সের গ্রাফ নিম্নমুখী হতে থাকে। ১২ বছর আগে ক্লাব ছেড়ে যাওয়া তরুণ রোনালদো আর এই রোনালদোর মাঝে অনেক তফাৎ, বয়সের ভারে তাল মেলাতে পারছেন না প্রিমিয়ার লিগের মতো দ্রুতগতির লিগে। বাকিদের অফফর্ম আর দলের ধারবাহিক বাজে পারফরম্যান্সের ফলস্বরূপ মৌসুমের মাঝপথে চাকরিচ্যুত হন ইউনাইটেডের কোচ ওলে গানার সোলশার।
ওলে-পরবর্তী সময়ে ইউনাইটেড এর অন্তর্বর্তীকালীন কোচ হয়ে আসেন জার্মান কোচ রাল্ফ রাঙনিক। তবে কোচ পরিবর্তন করেও আখেরে লাভের কিছু হয়নি। রাঙনিকের অধীনেও ইউনাইটেডের কাঙ্ক্ষিত সাফল্য ধরা দিচ্ছে না। অলৌকিক কিছু না ঘটলে লিগে টপ ফোর প্রায় অনিশ্চিতই বলা চলে।
রাঙনিক ম্যানচেষ্টার ইউনাইটেডকে ৪-২-২-২, ৪-২-৩-১ এবং ৪-৩-৩ ফর্মেশনে খেলিয়েছেন। শুরুর দিকের ম্যাচগুলোতে তিনি ৪-২-২-২ ফর্মেশন ব্যবহার করেছেন। কিন্তু এ ফর্মেশনের সাথে ইউনাইটেডের খেলোয়াড়রা মানিয়ে নিতে না পারায় তিনি পরবর্তীতে তার ফর্মেশন পরিবর্তন করতে বাধ্য হন। আজ আমরা রাঙনিকের এই ফর্মেশন বেছে নেওয়া এবং এই ফর্মেশনে ইউনাইটেডের ভালো না করতে পারার কারণ নিয়ে আলোচনা করবো।
৪-২-২-২ ফর্মেশন অনেকটাই ৪-৪-২ ফর্মেশনের মতো দেখতে হলেও ৪-৪-২ এর সাথে এই ফর্মেশনের মূল পার্থক্য হচ্ছে এই ফর্মেশনে ৪-৪-২ ফর্মেশনের মতো টাচলাইনে অবস্থান করা উইঙ্গার থাকেনা। এর পরিবর্তে দুইপাশে দুজন নাম্বার টেন বা প্লেমেকার থাকেন যারা সাধারণত দুই হাফস্পেসে অবস্থান করেন। এরবাইরে ৪-২-২-২ ফর্মেশন ৪-৪-২ ফর্মেশনেরই অনুরূপ।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, রাঙনিক কেন ৪-২-২-২ এর মতো ব্যতিক্রমী একটি ফর্মেশন বেছে নিয়েছেন?
রাঙনিক মূলত দ্রুতগতির পাসিংনির্ভর ফুটবল খেলাতে পছন্দ করেন। তিনি বলের দখল নিজেদের কাছে রাখার চেয়ে ক্রমাগত ফরোয়ার্ড পাসের মাধ্যমে গোলের সুযোগ তৈরি করার দিকে বেশি মনোযোগ দেন। ৪-২-২-২ ফর্মেশনে চার ডিফেন্ডার, দুই মিডফিল্ড পিভট, দুই প্লেমেকার এবং দুই স্ট্রাইকার মিলে ভিন্ন ভিন্ন ৪টি লাইন তৈরি হয়। এতে করে প্রতিটি খেলোয়াড়ের সামনে বাড়তি পাসিং লাইন থাকে, যার ফলে খুব অল্প পাসের মাধ্যমেই নিজেদের রক্ষণভাগ থেকে দ্রুতগতিতে আক্রমণে উঠে আসা যায়।
আধুনিক ফুটবলে প্রতিটি দলই সর্বপ্রথম নিজেদের রক্ষণভাগ নিচ্ছিদ্র রাখার দিকে মনোযোগ দেয়৷ এ কারণে প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারদের রক্ষণভাগ সুগঠিত করার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত কাউন্টার অ্যাটাকের মাধ্যমে গোলের সুযোগ তৈরির চেষ্টা করা, এটাই হচ্ছে রাঙনিকের ৪-২-২-২ ফর্মেশন বেছে নেওয়ার মূল কারণ।
৪-২-২-২ ফর্মেশনের বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে। এই ফর্মেশনে ডাবল পিভট থাকায় বিল্ডআপের সময় সেন্টারব্যাকদের সামনে একাধিক পাসিং অপশনের তৈরি হয়৷ ফলে বিল্ডআপের সময় প্রেস করে বল কেড়ে নেওয়াটা প্রতিপক্ষের জন্য কঠিন কাজ, সেটা বলাই বাহুল্য। আবার প্রতিপক্ষের মিডফিল্ডাররা যদি দুই পিভটকে ম্যানমার্ক করে রাখে, তখন দুই ফুলব্যাকই ম্যান মার্কিং ফ্রি হয়ে পড়ে। তাই তারা তখন বল সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট সুযোগ পায়।
এই ফর্মেশনের আরেকটি বড় সুবিধা হচ্ছে, দু'জন প্লেমেকার বা নাম্বার টেন ফুটবলারের ব্যবহার। সাধারণত সরাসরি গোলের সুযোগ তৈরি করার কাজটি প্লেমেকাররাই করে থাকে। এজন্য প্লেমেকারের ভূমিকায় খেলা ফুটবলার প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডার এবং মিডফিল্ডারদের মধ্যবর্তী 'বিটুইন-দ্য-লাইনের' ফাঁকা জায়গায় পজিশন নিয়ে সেখান থেকে স্ট্রাইকারের উদ্দেশ্যে ফাইনাল পাস বাড়ানোর চেষ্টা করে। তবে প্রতিপক্ষের ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার তাকে সরাসরি ম্যান মার্ক করে রাখলে তার পক্ষে ফাঁকা জায়গায় অবস্থান করে সেখান থেকে দ্রুত সময়ে বক্সে পাস দেওয়াটা কঠিন হয়ে পড়ে। এই ফর্মেশনে দু'জন প্লেমেকার থাকায় তাদের সরাসরি মার্ক করে রাখাটা একরকম অসম্ভব। প্রতিপক্ষ মিডফিল্ডাররা যদি দু'জন প্লেমেকারকেই সরাসরি ম্যান মার্ক করে রাখে, তাহলে মিডফিল্ডে দুই পিভটের সামনে প্রচুর ফাঁকা জায়গা তৈরি হয়; যাতে করে তারা সহজেই আক্রমণে উঠে আসার সুযোগ পাবে। আবার প্রতিপক্ষের মিডফিল্ডাররা যদি দুই পিভটকে প্রেস করতে উপরে উঠে যায়, তখন দুই প্লেমেকার ম্যান-মার্কিং ফ্রি হয়ে যাবে৷ তখন তাদের সামনে বল রিসিভ করে বক্সে ফাইনাল পাস দেওয়ার মতো জায়গা ও সময় দুটোই থাকবে।
মিডফিল্ডে দুই পিভট এবং দুই প্লেমেকার, মোট চারজন ফুটবলার অবস্থান করায় মিডফিল্ডে 'নিউমেরিক্যাল সুপিরিওরিটি' অর্জন করাটাও বেশ সহজ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এতে করে মিডফিল্ডাররা নিজেদের মধ্যে ক্রমাগত বলের আদান-প্রদান করে প্রতিপক্ষের মিড ব্লক প্রেসিং লাইন অতিক্রম করে স্ট্রাইকারদের উদ্দেশ্যে বল বাড়াতে পারে।
রাঙনিক কেন শুরুতে ৪-২-২-২ ফর্মেশন বেছে নিয়েছিলেন সেটা তো জানা হয়ে গেল। এবার স্বাভাবিকভাবেই পাঠকের মনে প্রশ্ন আসতে পারে, "তবে কেনই বা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের এই বেহাল দশা!"
চলুন এবার তাহলে তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা ছেড়ে বাস্তবতায় ফিরে আসি। প্রথমত, রাঙনিক বেশ ভালোভাবেই জানতেন, তার খেলার ধরনের সাথে মানিয়ে নেওয়ার সক্ষমতা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড বর্তমান স্কোয়াডের অনেক ফুটবলারেরই নেই। কিন্তু তাদের যে এতটাই বেহাল দশা, সেটা হয়তো বা তিনি ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারেননি।
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ফুটবলাররা কেন এখন পর্যন্ত রাঙনিকের খেলার ধরনের সাথে মানিয়ে নিতে পারছে না, তার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। এখন আমরা সেসব কারন নিয়েই আলোচনা করার চেষ্টা করব।
বল প্রোগ্রেশনে দুর্বলতা
রাঙনিকের সিস্টেমে বিল্ডআপ প্রক্রিয়া গোলকিপার থেকে শুরু করে খেলোয়াড়দের ক্রমাগত ফরোয়ার্ড পাসের মাধ্যমে চলতে থাকে৷ ডিফেন্স থেকে দ্রুতগতির বিল্ডআপের জন্য গোলকিপার এবং সেন্টারব্যাকদেরকে বল পায়ে দক্ষ এবং দ্রুততার সাথে ফরোয়ার্ড পাস দেওয়ার সামর্থ্য থাকা উচিত। কিন্তু ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের খেলোয়াড়দের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সমস্যা হচ্ছে, রক্ষণ থেকে আক্রমণভাগের দিকে কার্যকরীভাবে বলকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তাদের বেশ ঘাটতি রয়েছে।
৪-২-২-২ ফর্মেশনের সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে, বিল্ডআপের সময় ডিফেন্ডারদের সামনে বাড়তি পাসিং লাইনের তৈরি হয়, যে কারণে ডিফেন্ডারদের মূল দায়িত্ব থাকে ফরোয়ার্ড পাসের মাধ্যমে বলকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে চেষ্টা করা। আক্রমণে বাড়তি সুবিধা পাওয়ার জন্য বলকে দ্রুত উলম্বভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটা অপরিহার্য। ইউনাইটেডের ডিফেন্ডাররা বল প্রোগ্রেশনে তেমন কার্যকরী না হওয়ায় তাদের বিল্ডআপ সিস্টেম অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়ে।
উপরের ডেটা বিশ্লেষণের দিকে যদি লক্ষ্য করি, ম্যানচেষ্টার ইউনাইটেডের সেন্টারব্যাকদের মধ্যে হ্যারি ম্যাগুয়ের প্রতি ৯০ মিনিটে গড়ে ৭.৬৭টি প্রোগ্রেসিভ পাস সম্পন্ন করেন, যা কি না ইউনাইটেডের সেন্টারব্যাকদের মধ্যে সর্বোচ্চ। কিন্তু প্রিমিয়ার লিগের অন্যান্য সেন্টারব্যাকদের মধ্যে তুলনা করলে তার এ পরিসংখ্যান যথেষ্ট গড়পড়তা মানের হয়ে দাড়ায়। অপর দুই সেন্টারব্যাকের মধ্যে ভিক্টর লিন্ডেলফ এবং রিয়াল মাদ্রিদ থেকে আগত রাফায়েল ভারান প্রোগ্রেসিভ পাস সম্পন্ন করেছেন যথাক্রমে ৫.৯৯ এবং ৫.৪৪টি। অর্থাৎ, নিজেদের পাসিং দুর্বলতার কারণে তারা সরাসরি সামনে পাস দেওয়ার পরিবর্তে নিজেদের মধ্যে ক্রমাগত সাইডপাস বা ব্যাকপাস খেলে বল প্রোগ্রেশনকে বিলম্বিত করছে, যার ফলে দ্রুতগতির 'ভার্টিকাল প্লে' বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছেনা।
মিডফিল্ডে দুর্বলতা
রাঙনিকের সিস্টেমে মিডফিল্ডে ফ্রেড এবং ম্যাকটমিনেকে ডাবল পিভটের ভূমিকায় খেলতে দেখা যাচ্ছে। বল প্রোগ্রেশনে তাদের পরিসংখ্যান ইউনাইটেডের ডিফেন্ডারদের তুলনায় বেশ ভালো, তবে তা কোনোমতেই যথেষ্ট নয়। একই সাথে তারা প্রতিপক্ষের প্রেসিংয়ের বিপক্ষে বলের দখল নিজেদের কাছে রেখে আক্রমণ গড়ে তোলার দিক থেকেও যথেষ্ট দুর্বল।
উপরের চার্টটিতে প্রিমিয়ার লিগের প্রথম সারির দলগুলোর মিডফিল্ডারদের পাসিং এবং প্রেসিংয়ের বিপক্ষে তাদের পাসিংয়ের হার দেখানো হয়েছে। প্রিমিয়ার লিগের সেরা মিডফিল্ডারদের সাথে তুলনা করলে ম্যাকটমিনের অবস্থান স্পষ্টতই গড়পড়তা মানেরও নিচে, তার পিভটসঙ্গী ফ্রেড তার তুলনায় ভালো হলেও তা একেবারেই যথেষ্ট নয়। প্রেসিং করা দলগুলোর বিপক্ষে ইউনাইটেডের অপর মিডফিল্ডার মাতিচের পরিসংখ্যান তুলনামূলক ভালো; কিন্তু এই ৩৩ বছর বয়সী মিডফিল্ডারের যা স্ট্যামিনা, তাতে করে তাকে ৬০ মিনিটের পর মাঠে খুঁজে পাওয়াটা বেশ দুষ্কর!
গোলের সুযোগ তৈরি করার ক্ষেত্রেও ইউনাইটেডের মিডফিল্ডাররা প্রিমিয়ার লিগের এলিট শ্রেণীর মিডফিল্ডারদের থেকে অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে। ফ্রেড বরাবরের মতো গোলের সুযোগ তৈরি করার ক্ষেত্রে তুলনামূলক ভালো অবস্থানে। কিন্তু মাতিচ এবং ম্যাকটমিনের দুজনই এতটাই পিছিয়ে রয়েছেন, যা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মতো শিরোপাপ্রত্যাশী দলের মিডফিল্ডে তাদের জায়গা পাওয়াটাকে বেশ প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
আক্রমণে দুর্বলতা
আক্রমণভাগে ইউনাইটেডের দুর্বলতার বড় কারণ হচ্ছে খেলোয়াড়দের নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়ার অভাব, যেটা দিনদিন আরো বেশি করে দৃশ্যমান হচ্ছে। কিন্তু এর বাইরেও রয়েছে বেশকিছু ট্যাকটিক্যাল দুর্বলতা।
৪-২-২-২ ফর্মেশনের একটা বড় দুর্বলতা হচ্ছে এই ফর্মেশনে টাচলাইনে অবস্থান করে প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগকে প্রসারিত করার মতো প্রথাগত উইঙ্গার থাকে না, যে কারণে প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডার এবং মিডফিল্ডাররা উইং এরিয়ায় অবস্থান করার পরিবর্তে মাঠের মাঝের অংশে জমাট বেঁধে ফেলে। ইউনাইটেডের আক্রমণভাগের সব খেলোয়াড়ই আক্রমণের সময় মাঠের মাঝের অংশে অবস্থান করায় প্রতিপক্ষের আঁটসাঁট রক্ষণভাগকে ফাঁকি দিয়ে আক্রমণ করাটা বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
এই সমস্যার একটি সমাধান হতে পারে যদি দুই ফুলব্যাক ফাইনাল থার্ডের টাচলাইন এরিয়ায় অবস্থান করে, যাতে করে তাদের মার্ক করতে প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডাররা অনুভূমিকভাবে ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য হয়। এতে করে সেন্টার এরিয়া দিয়ে আক্রমণ করাটা সহজ হয়।
কিন্তু এক্ষেত্রে বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে। ওভারল্যাপ করে ফাইনাল থার্ডের টাচলাইনে উঠে আসার মতো ফুলব্যাক পুরো ইউনাইটেড স্কোয়াডে একজনই রয়েছেন, আলেক্স টেলেস। কিন্তু ক্রিয়েটিভিটিতে তার ঘাটতি এবং সঠিক সময়ে রক্ষণভাগে নামতে না পারার কারণে এই ভূমিকায় তিনি খুব একটা কার্যকরী হতে পারছেন না। অপর লেফটব্যাক লুক শ'র চান্স ক্রিয়েশন, প্রোগ্রেসিভ পাস এবং প্রতিপক্ষের কাউন্টার অ্যাটাক প্রতিহত করার ক্ষমতা - সবকিছুই দুর্দান্ত। কিন্তু তার মধ্যে টাচলাইনে অবস্থান করার পরিবর্তে লেফট হাফস্পেসে চলে আসার প্রবণতা বেশি, যে কারণে প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগকে প্রসারিত করে আক্রমণভাগের খেলোয়াড়দের জন্য ফাঁকা জায়গা তৈরি করে দিতে তিনিও খুব একটা কার্যকরী নন।
ইউনাইটেডের দুই রাইটব্যাক ডালট এবং ওয়ান-বিসাকার কেউই বল পায়ে তেমন দক্ষ নন। তাই ইউনাইটেডের দুই রাইটব্যাকের থেকে গোলের সুযোগ তৈরির সম্ভাবনা স্বাভাবিকভাবেই অনেক কম। প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের পক্ষে সেটা বোঝা তেমন কঠিন কাজ নয়, তাই প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডাররা তাদের মার্ক না করে নিজেদের 'ন্যারো শেইপ' ধরে রাখার দিকেই বেশি মনোযোগী হয়।
হাফস্পেসে অপারেট করা দুই প্লেমেকারের মধ্যে ব্রুনো ফার্নান্দেজের পারফরম্যান্স নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোন সুযোগই নেই; গত মৌসুমের মতো ধারাবাহিক গোল বা অ্যাসিস্ট না পেলেও প্রতিনিয়ত গোলের সুযোগ তৈরি করে যাচ্ছেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে অপর জনকে নিয়ে। এই পজিশনে রাঙনিক এখন পর্যন্ত রাশফোর্ড, গ্রিনউড এবং সাঞ্চোকে খেলিয়েছেন। রাশফোর্ড এবং গ্রিনউড দুজনই মূলত সেকেন্ড স্ট্রাইকারদের মতো, তাই স্বাভাবিকভাবেই তারা ক্রিয়েটিভিটির চাহিদা পূরণ করতে পারছেন না। সাঞ্চো মূলত টাচলাইনে পজিশন নেওয়া 'ইনভার্টেড উইঙ্গার' হলেও হাফস্পেস প্লেমেকার হিসেবেও তিনি বেশ ভালো করছেন। তবে পুরোপুরি মানিয়ে নিতে তার আরো সময় প্রয়োজন।
দুই স্ট্রাইকার ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো এবং এডিনসন কাভানি তাদের সেরা সময় ফেলে এসেছেন অনেক আগেই। প্রতিপক্ষের বক্সে তাদের ধীরগতির মুভমেন্টের কারণে সতীর্থদের পাস থেকে সঠিক জায়গায় ঢুকে গোলে শট নিতে পারছেন না। অপর স্ট্রাইকার রাশফোর্ডও ইনজুরি থেকে ফেরার পর নিজের ছায়া হয়ে রয়েছেন। স্ট্রাইকারদের ধারাবাহিক অফ ফর্মের কারণে প্রচুর গোলের সুযোগ তৈরি করার পরও গোল করাটা ইউনাইটেডের জন্য বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
প্রেসিংয়ে দুর্বলতা
ফাইনাল থার্ডে চারজন খেলোয়াড় থাকার একটা বড় সুবিধা হচ্ছে এর মাধ্যমে বেশ কার্যকরীভাবে বল দখলের উদ্দেশ্যে কাউন্টারপ্রেস করা যায়। কাউন্টারপ্রেসের মাধ্যমে প্রতিপক্ষের থার্ডে বলের দখল কেড়ে নিয়ে আক্রমণে যাওয়ার জন্য ৪-২-২-২ একেবারেই আদর্শ ফর্মেশন।
এই ফর্মেশনে দুই ফরোয়ার্ড থাকায় তারা সরাসরি প্রতিপক্ষের দুই সেন্টারব্যাককে ম্যান-টু-ম্যান প্রেস করার সুযোগ পায়, যে কারণে প্রতিপক্ষের জন্য প্রথম প্রেসিং লাইন অতিক্রম করে মিডফিল্ডে বল পাঠানো বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
রোনালদোকে কালেভদ্রেই প্রেসিংয়ে অংশ নিতে দেখা যায়৷ এই মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগে তার প্রেসিং করার হার ফরোয়ার্ডদের মধ্যে সর্বনিম্ন, প্রতি ম্যাচে গড়ে কেবল ৬.৮১ বার প্রতিপক্ষের থেকে বল কেড়ে নিতে চেষ্টা করেছেন। ফলে অপর স্ট্রাইকার কাভানি প্রচুর প্রেস করলেও তাতে খুব একটা লাভ হচ্ছে না।
হাইব্লক প্রেসিংয়ের সময় ইউনাইটেডের দুই প্লেমেকার প্রতিপক্ষের পিভটদের সরাসরি মার্ক করে। ফলে তখন তাদের ফুলব্যাকরা ম্যান-মার্কিং ফ্রি হয়ে পড়ে। তখন প্রতিপক্ষ মাঠের যেকোনো একপাশের ফুলব্যাকের মাধ্যমে বল সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে৷ এসময় ইউনাইটেডের ফুটবলাররা মাঠের সেপাশে ওভারলোড তৈরি করে ক্রমাগত প্রেস করে বল কেড়ে নিতে চেষ্টা করে। তাত্ত্বিকভাবে এই প্রেসিংয়ের ধরন অনেক কার্যকরী হওয়ার কথা হলেও তা ইউনাইটেডের ক্ষেত্রে একেবারেই ফলপ্রসূ হচ্ছে না।
তবে, রাঙনিকের এই সিস্টেম কাজ না করার কারণও রয়েছে। প্রেসিংয়ের সময় ইউনাইটেডের দুই ফরোয়ার্ড প্রতিপক্ষের ফুলব্যাকের সাথে সেন্টারব্যাকের পাসিং লাইন বন্ধ করার চেষ্টা করে না। এতে করে ফুলব্যাকদের সামনে সেন্টারব্যাককে ব্যাকপাস দিয়ে বিল্ডআপ নতুন করে শুরু করার সুযোগ রয়ে যায়। আবার দুই হাফস্পেসে অবস্থান করা ব্রুনো এবং সাঞ্চো বল পায়ে থাকা ফুলব্যাককে প্রেস করতে শুরু করার আগেই বল বাহক বল নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ পায়। তখন ইউনাইটেডের অর্ধে প্রতিপক্ষের ফুলব্যাক-উইঙ্গারের সাথে ইউনাইটেডের ফুলব্যাকের টু ভার্সেস ওয়ান অবস্থানের তৈরি হয়। এই ধরনের পরিস্থিতিতে ইউনাইটেড এই মৌসুমে বেশ কয়েকবার গোল হজমও করেছে।
রাঙনিকের সিস্টেমের সাথে ইউনাইটেডের ফুটবলাররা মানিয়ে নিতে পারছেন না, সেটা একেবারেই স্পষ্ট। সেটা বুঝতে পেরেই রাঙনিক তার খেলার ধরনে অনেক পরিবর্তন এনেছেন, আবারও ফিরে গেছেন ৪-২-৩-১ ফর্মেশনে। তবে তাতেও ইউনাইটেডের অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন ঘটেনি, এখনো তারা ব্যর্থতার বৃত্তেই খাবি খাচ্ছে। লিগের সর্বশেষ পয়েন্ট টেবিলে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড পাঁচে অবস্থান করছে। চ্যাম্পিয়নস লিগের নকআউট রাউন্ডের প্রথম পর্ব থেকেই অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের কাছে হেরে বাদও পড়েছে তারা। ধারাবাহিক এই ব্যর্থতা কাটিয়ে মৌসুমের বাকি সময়ে রাঙনিক তার দলকে সঠিক পথে ফেরাতে পারেন কি না, সেটা সময়ই বলে দেবে।
This article is in Bangla language. It is about the tactical analysis of Ralf Rangnick's 4-2-2-2 formation and reasons behind failure of Manchester United in this system.
Feature Image: Reuters
Background Image: Getty Images
References:
1. Why Ralf Rangnick's Early United Tactics Failed | Rangnick 4-2-2-2 Tactical Analysis | - YouTube
2. Ralf Rangnick at Manchester United 2021/22: Tactical Analysis (totalfootballanalysis.com)
3. Manchester United’s Midfield: Problems and Solutions – Breaking The Lines