Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

দিয়াগো ম্যারাডোনা: জনগণের হৃদয়ে যিনি সর্বকালের সেরা


যেকোনো বিষয়ে সেরা নির্বাচন করার মূলত দুটি পদ্ধতি আছে। এর একটি হলো, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দক্ষ লোক দিয়ে বিচার করা; আরেকটি হলো, সাধারণ জনগণের ভোটে নির্বাচন করা। দক্ষ লোক দিয়ে নির্বাচন করাটাই নিঃসন্দেহে বেশি গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি। কিন্তু এর সাথে সাথে সাধারণ মানুষের নির্বাচনকেও অবজ্ঞা করা যায় না। সাধারণ মানুষের নির্বাচনে মূলত দুটো সমস্যা হয়। একটি হচ্ছে, তারা আবেগের আশ্রয় বেশি নেয়; আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা সমসাময়িকদের এগিয়ে রাখে। ফুটবলের ইতিহাসে অল্প কিছু খেলোয়াড় আছেন যারা কিনা দক্ষ বিচারক আর সাধারণ জনগণ দু’দিকের ভোটেই প্রথম দিকেই থাকেন।

এরকম একজন খেলোয়াড় হচ্ছেন দিয়াগো ম্যারাডোনা। গত শতাব্দীর সেরা খেলোয়াড় নির্বাচন করার সময় ফিফা প্রথমে সিদ্ধান্ত নেয়, ইন্টারনেটে ভোটিংয়ের মাধ্যমে সেরা নির্বাচন করা হবে। সেভাবে ভোটিংও হয়। তবে ফলাফল দেখে ফিফা কমিটি চোখে সর্ষে ফুল দেখে। ম্যারাডোনা ভোট পান ৫৩.৬%, পক্ষান্তরে পেলে পান মাত্র ১৮.৫৩%।

এরপরই ফিফা আরেকটি কমিটি গঠন করে, যেখানে ভোট গ্রহণ করা হয় তাদের অফিশিয়াল ওয়েবসাইট ও ম্যাগাজিনের পাঠক আর জুরি বোর্ডের সদস্যদের কাছ থেকে। এই নির্বাচনে পেলে প্রথম হন। শেষ পর্যন্ত গত শতাব্দীর সেরা খেলোয়াড়ের দুটো পুরষ্কার দেওয়া হয়; একটি জনগনের সেরা, আরেকটি বিশেষজ্ঞদের সেরা। অনলাইনের ভোটিং আসলে গ্রহণযোগ্যতা হারায় তখন, যখন দেখা যায় ম্যারাডোনা-পেলের পরের ক্রমগুলো হচ্ছে ইউসেবিও, ব্যাজিও, রোমারিও, ভ্যান বাস্তেন, রোনালদো লিমা। ক্রুয়েফ আছেন ১৩ নম্বরে, ডি স্টেফানো ১৪ নম্বরে, প্লাতিনি ১৫ নম্বরে। যে জায়গার ফলাফল আপনাকে দেখাবে ক্রুয়েফ, ডি স্টেফানো কিংবা প্লাতিনির চেয়ে ব্যাজিও কিংবা রোমারিও (তখন পর্যন্ত তারা ক্যারিয়ার শেষ করেননি) ভালো, সেই ভোট গ্রহণ করা আসলে কষ্টকর। এছাড়া অনলাইনে সাধারণত নতুন প্রজন্মের মানুষরাই ভোট দিয়েছিল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, শতাব্দীর সেরা নির্বাচন করার মতো এত বড় বিষয়ে এই দিকগুলো ফিফা কমিটি আগে খেয়াল করল না কেন, কেন নির্বাচনটি প্রশ্নবিদ্ধ হলো। যদি অনলাইনের বিচারেও পেলে সেরা হতো, তখন কি আরেকটি নির্বাচন করা হতো?

সবচেয়ে বড় বিতর্কের দুই পাত্র; source: Top Drawer Soccer

এখানে দোষ পেলে কিংবা ম্যারাডোনা কারোরই নয়, দোষটা আসলে ফিফার উপরেই বর্তায়। এত বড় একটি সংস্থা এত বড় একটি নির্বাচনে ভুল কেন করল? সে যা-ই হোক, সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। আজকের লেখার মূল আলোচ্য বিষয় ম্যারাডোনা।

একটি প্রোডাক্ট কতটা মূল্যবান, তার ব্যাপারে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায় তার ‘মার্কেট ভ্যালু’ দেখে। ফুটবলারকে যদি প্রোডাক্ট হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তাহলে ম্যারাডোনা ঠিক কতটা মূল্যবান ছিলেন, সেটা অনুমান করা সম্ভব না। তবে এরপরও যখন আপনি জানবেন যে, ম্যারাডোনা ফুটবল ইতিহাসের প্রথম খেলোয়াড়, যিনি কিনা দু’বার ট্রান্সফার ফির রেকর্ড গড়েছেন, তখন কিছুটা ধারণা করা হয়তো সম্ভব। ম্যারাডোনার পরে এই রেকর্ড আছে শুধুমাত্র আর একজনের, রোনালদো লিমার।

ম্যারাডোনাকে জানতে ‘ম্যারাডোনা কে ছিলেন?’- এই প্রশ্নটির চেয়ে জরুরি প্রশ্ন হওয়া উচিত, ‘ম্যারাডোনা কী ছিলেন?’

ম্যারাডোনা ছিল একটি বিশ্বাসের নাম। আজকের যুগের সেরা খেলোয়াড় মেসি অথবা রোনালদোকে যদি মালাগায় (স্প্যানিশ লিগের একটা দল) খেলতে দিয়ে বলা হয়, দলকে লিগ চ্যাম্পিয়ন করাতে হবে, তাহলে কি সেটা তাদের জন্য সম্ভব হবে? রিয়াল মাদ্রিদ কিংবা বার্সেলোনাকে টপকিয়ে কাজটা করা মোটামুটি অসম্ভবই বলা যায়। পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে মোটামুটি এ ধরনের অসম্ভব কাজকেই সম্ভব করেছিলেন ম্যারাডোনা।

‘৮৬র বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে বেলজিয়ামের বিরুদ্ধে গোলের পর ম্যারাডোনা; source: AFP

এই পর্যন্ত যতগুলো সর্বকালের সেরা একাদশ হয়েছে, তাতে দুজনের নাম অটোমেটিক চয়েজ হিসেবে ছিল, এর একজন হচ্ছেন ম্যারাডোনা। ‘৮০র দশকে একক কৃতিত্বে পুরো ফুটবল বিশ্বকেই চমকে দিয়েছেন তিনি। আজ বিশ্বজুড়ে আর্জেন্টিনার যত সমর্থক, তার শুরুটা হয়েছিল ম্যারাডোনার দ্বারা। শুধুমাত্র একজন খেলোয়াড়ের কারণে কোনো দেশের এতটা সমর্থক, সেটা ম্যারাডোনাকে না জানলে বিশ্বাস হবে না। বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন কিংবা ক্লাবে লিগ চ্যাম্পিয়ন অনেক খেলোয়াড়ই হন, কিন্তু শুধুমাত্র নিজের উপস্থিতি দ্বারা কোনো দলকে এতটা উদ্বুদ্ধ করার রেকর্ড ম্যারাডোনা ছাড়া ইতিহাসে আর কারো নেই।

ম্যারাডোনার জন্ম বুয়েন্স আয়ার্স প্রদেশের লানুস শহরের পলিক্লিনিকো এভিতা হাসপাতালে। সময়টা ১৯৬০ সাল, আরো নির্দিষ্টভাবে বললে সে বছরের ৩০ অক্টোবর। দরিদ্র পরিবারে তিন কন্যা সন্তানের পর তিনিই প্রথম পুত্র সন্তান। ১০ বছর বয়সে তার খেলা নজরে পড়ে যায় এক স্কাউটের। তারপর তিনি সুযোগ পান আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্সের যুব দলে। ১২ বছর বয়সে বলবয় হিসেবে ম্যারাডোনা ম্যাচের অর্ধবিরতির সময় দর্শকদের বল নিয়ে খেলা দেখিয়ে মুগ্ধ করতেন।

মিডফিল্ডে খেলেও তিনি পাঁচবার আর্জেন্টিনার প্রিমিয়ার ডিভিশনের টপ স্কোরার হন। এরই মাঝে ১৯৭৯ সালে যুব বিশ্বকাপ জেতেন আর্জেন্টিনার হয়ে। যুব বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতাও হন। এই সফলতা তাকে ১৯৭৯ সালের সেরা আর্জেন্টাইন খেলোয়াড়ের পুরস্কার এনে দেয়। এছাড়া ফিফা থেকেও সেই বছরের দক্ষিণ আমেরিকার সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার অর্জন করেন। পরের বছরেও দক্ষিণ আমেরিকার সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জেতেন। তবে এসব পুরস্কার জেতার কারণে কিন্তু ম্যারাডোনা ‘গ্রেট’ নন।

বারোসিকে বিভ্রান্ত করে বল নিয়ে বেরিয়ে গেলেন; Source: Here Is The City

বর্তমান যুগের অনেকেরই ধারণা, ম্যারাডোনা গ্রেট কারণ তিনি বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। আসলেই কি তাই? ম্যারাডোনা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন ১৯৮৬ সালে। এরপর বিশ্ব আরো ৭টি বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন দল দেখেছে, এদের মাঝে ৭ জন বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়ও হয়েছেন। তারপরেও কেন তাদেরকে ম্যারাডোনার সমতুল্য বলা হয় না? বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়া অবশ্যই অনেক বড় বিষয়, কিন্তু এটাই সবকিছু নয়। মুলারের জার্মানির বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়া আর বেলের ওয়েলসের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গুরুত্ব নিশ্চয়ই এক না। আজ যদি বেল ওয়েলসকে নিয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হন, তা কি অসম্ভব মনে হয় না? বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার কাজটাও অনেকটা সেরকমই ছিল। একনজরে তার বিশ্বকাপ পারফর্মেন্সটা একটু দেখা যাক।

‘৮২ এর বিশ্বকাপ

১৯৮২ সালে ম্যারাডোনা প্রথম বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ পান। প্রতিযোগিতার উদ্বোধনী খেলায় বেলজিয়ামের মুখোমুখি হয় আর্জেন্টিনা। ম্যাচটা ছিল ন্যু ক্যাম্পে, দর্শকরা ম্যারাডোনাকে নিয়ে খুব উচ্ছ্বসিত ছিল। কারণ ম্যারাডোনা তখন মাত্র বার্সেলোনায় যোগ দিয়েছেন। কিন্তু ম্যাচে ম্যারাডোনা তার নৈপুণ্য দেখাতে ব্যর্থ হন। ম্যাচটা আর্জেন্টিনা হেরে যায় ১-০ গোলে। তবে এই হার তেমন কোনো সমস্যা সৃষ্টি করেনি তাদের পরের পর্বে উঠতে। অপর দুই খেলায় হাঙ্গেরি আর স্যালভাদরকে হারিয়ে আর্জেন্টিনা পরের পর্বে ওঠে। হাঙ্গেরির বিপক্ষে ম্যাচে ম্যারাডোনা দুটো গোলও করেন। কিন্তু পরের পর্বে ইতালি আর ব্রাজিলের বিপক্ষে হেরে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নেয় আর্জেন্টিনা। ব্রাজিলের বিপক্ষে ম্যাচটিতে ম্যারাডোনা লাল কার্ড দেখেন।

‘৮৬ এর বিশ্বকাপ

এই পর্যন্ত যত বিশ্বকাপ ফুটবল হয়েছে, তার মাঝে ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপেই খুব সম্ভবত সবচেয়ে বেশি তারকার আবির্ভাব হয়েছিল। ইংল্যান্ডের গ্যারি লিনেকার; ব্রাজিলের জিকো, সক্রেটিস; ফ্রান্সের প্লাতিনি; জার্মানির রুডি ভয়েলার, লোথার ম্যাথিউস- এদের প্রত্যেকেই তাদের নিজ নিজ দেশের সর্বকালের সেরা একাদশে অনায়াসে সুযোগ পাবেন। কিন্তু এদের সবাইকে ছাপিয়ে সেবারে জ্বলে ওঠেন ম্যারাডোনা। কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ম্যাচের আগে আর্জেন্টিনা বনাম ইংল্যান্ডের মধ্যকার ফকল্যান্ডের যুদ্ধ খেলার আবহটাকে ভিন্নরকম করে ফেলে। সেই পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে যায় যখন ম্যারাডোনা হাত দিয়ে বল স্পর্শ করার পর সেটি গোল হয়। এই গোলটিই ‘হ্যান্ড অফ গড’ নামে পরিচিত।

তবে এই বিতর্ক তিনি দূর করে ফেলেন মিনিট চারেক পরেই আরেকটি অসাধারণ গোল করে। মাঝমাঠে বল দখলে নেন ম্যারাডোনা, ইংল্যান্ডের গোলপোস্টের দিকে ঘুরে গিয়ে দৌড়ান মাঠের অর্ধেকেরও বেশি অংশ, এভাবে পাঁচ জন ডিফেন্ডার এবং গোলরক্ষককে কাটিয়ে গোল করেন তিনি। আর এই গোলটি গত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ গোল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

এরপর সেমিফাইনালে আরো দুটি গোল করে একক কৃতিত্বে ম্যারাডোনা ফাইনালে ওঠান আর্জেন্টিনাকে। ফাইনালে তাকে ডাবল মার্কিংয়ে রাখায় গোল করতে না পারলেও তারই বাড়িয়ে দেওয়া পাসে আর্জেন্টিনার পক্ষে জয়সূচক গোল করেন বুরুচাগা। পুরো টুর্নামেন্টে পাঁচ গোলের পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি ৫টি অ্যাসিস্ট করে টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরষ্কার জিতে নেন ম্যারাডোনা। প্রতিযোগিতায় আর্জেন্টিনার ১৪টি গোলের ১০টিতেই ম্যারাডোনার অবদান ছিল। এছাড়া পুরো টুর্নামেন্টে আর্জেন্টিনা প্রতিপক্ষের গোলপোস্টে যতগুলো শট নিয়েছে, তার অর্ধেকের বেশিই ম্যারাডোনার তৈরি করা।

কিন্তু এই পরিসংখ্যান দিয়েও ম্যারাডোনার কৃতিত্ব পুরোপুরি বোঝা সম্ভব নয়। সেটা বোঝার জন্য আরো কিছু তথ্য দেওয়া জরুরি।

বিশ্বকাপ হাতে ম্যারাডোনা; source: Ap Photo/Carlo Fumagalli

প্রতিটি বিশ্বকাপ শেষেই বিশ্বকাপ কর্তৃপক্ষ ‘অলস্টার টিম’ নামে একটি একাদশ প্রকাশ করা হয়। বিশ্বকাপে ভালো পারফর্ম করা খেলোয়াড়দের নিয়ে এই একাদশ গঠন করা হয়। মোটামুটিভাবে বিশ্বকাপের দুই ফাইনালিস্ট দল থেকেই বেশিরভাগ খেলোয়াড় সুযোগ পায়। এর মাঝে আবার স্বাভাবিকভাবে চ্যাম্পিয়ন দল থেকেই বেশি সদস্য সুযোগ পায়। ব্যতিক্রম ছিল ১৯৮৬ সালে। সে বছর যে একাদশ প্রকাশ করা হয়, তাতে চ্যাম্পিয়ন দল থেকে মাত্র একজন সুযোগ পায় এই দলে, ম্যারাডোনা। বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন দল থেকে এরকম একটি একাদশে মাত্র একজন খেলোয়াড়ের সুযোগ পাওয়াটা এখন পর্যন্ত একটি রেকর্ড। এ ঘটনা থেকেই ম্যারাডোনার দলের বাকি সদস্যদের শক্তিমত্তা সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যাবে।

‘৯০ এর বিশ্বকাপ

১৯৯০ এর বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা ছিল ভাঙাচোরা একটি দল। প্রথম পর্বে গ্রুপে তৃতীয় স্থানে থেকেও কোনোরকমে দ্বিতীয় পর্বের টিকেট পায় আর্জেন্টিনা। দ্বিতীয় পর্বে গিয়ে মুখোমুখি হয় ব্রাজিলের। ব্রাজিলের সাথে আর্জেন্টিনার শক্তির ব্যবধান কেমন ছিল? ধরে নিন, ঢাল-তলোয়ার সহ ১০০ সৈন্য নিয়ে বন্দুক-বোমা সহ ৩০০ সৈন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মতোই ব্যাপারটি। সবাই জানতো, ম্যারাডোনাকে আটকাতে পারলেই আর্জেন্টিনা শেষ। শেষ পর্যন্ত ম্যাচের ৮০ মিনিটে মাঝমাঠ থেকে দুজনকে কাটিয়ে তিন জন ডিফেন্ডারের মাঝ দিয়ে ম্যারাডোনা যখন ক্যানিজিয়াকে পাস দেন, তখন ক্যানিজিয়ার সামনে গোলকিপার বাদে আর কেউ নেই। মূলত বাম পায়ের খেলোয়াড় হলেও, ম্যারাডোনা ক্যানিজিয়ার যে গোলে সহায়তা করেন, তা ডান পায়ে করেছিলেন। কারণ ব্রাজিলীয় ডিফেন্ডাররা তাকে এমন অবস্থায় রেখেছিলেন যে, তিনি বাম পা ব্যবহারই করতে পারেননি!

প্রতিপক্ষের ট্যাকেল; source: Getty Images

প্রতিপক্ষের ট্যাকেল; source: BT Sport

দল দুর্বল হওয়ার কারণে ম্যারাডোনা খেলার কৌশলে পরিবর্তন আনেন সেবারে। রক্ষণাত্মক খেলে বেশিরভাগ ম্যাচ ট্রাইবেকারে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। কোয়ার্টার ফাইনালে যুগোস্লাভিয়াকে টাইব্রেকারে হারিয়েই সেমিতে উঠে যায় আর্জেন্টিনা। সেই টুর্নামেন্টে ইতালি ছিল দুর্দান্ত এক দল। তাদের গোলকিপার ওয়াল্টার জেঙ্গার পরপর পাঁচ ম্যাচে গোল না খাওয়ার এবং সর্বমোট ৫১৮ মিনিট গোল না খেয়ে থাকার বিশ্বরেকর্ড করেন। তার উপর তারা ছিল স্বাগতিক, ১৯৯০ বিশ্বকাপের একমাত্র দল হিসেবে সবকটি ম্যাচ জিতে সেমিফাইনালে উঠেছিল তারা। তাদের বিরুদ্ধে খর্ব শক্তির দল আর্জেন্টিনার কি কোনো তুলনা চলে? আর সেই অসম্ভব একতরফা ম্যাচটিও আর্জেন্টিনা জিতে যায় টাইব্রেকারে!

‘৯০ এর বিশ্বকাপ ফাইনাল হারের পর; source: lanacion.com.ar

সেই ম্যাচের পর ফাইনালে জার্মানি ছিল দলগত বিচারে আর্জেন্টিনা থেকে যোজন যোজন এগিয়ে। তারা ছিল সেই বিশ্বকাপে টানা তৃতীয়বারের ফাইনালিস্ট। অথচ সেই জার্মানিকেও কিনা জিততে হলো বিতর্কিত পেনাল্টিতে। আর সেই ম্যাচ সরাসরি দেখা অনেকই বিশ্বাস করেন, ট্রাইবেকারে গেলে হয়তো আর্জেন্টিনাই জিতে যেত ফাইনাল। সে ম্যাচে হেরে গিয়েও পুরো পৃথিবীর ফুটবলপ্রেমী মানুষের চোখে নায়ক হয়ে যান ম্যারাডোনা।

‘৯৪ এর বিশ্বকাপ

১৯৯৩ সালের বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ম্যাচে ঘরের মাঠে কলম্বিয়ার কাছে ৫-০ গোলে হারার পর পুরো গ্যালারি জুড়ে ছিল শুধু একটি নামই- ম্যারাডোনা। অবসর ভেঙে ‘৯৪ এর বিশ্বকাপে ফিরে এসে ম্যারাডোনা চমক দেখান। প্রথম দুই ম্যাচে আর্জেন্টিনা অনায়াসে জয় পায়। এর মধ্যে প্রথম খেলায় গ্রিসের বিপক্ষে ম্যারাডোনা একটি গোল করেন। কিন্তু এরপরেই ডোপ কেলেঙ্কারিতে বাদ পড়তে হয় তাকে। মানসিকভাবে ভেঙে পড়া আর্জেন্টিনা দ্বিতীয় রাউন্ডে রোমানিয়ার কাছে হেরে বিশ্বকাপ থেকেই ছিটকে পড়ে।

ম্যারাডোনার গোটা ক্যারিয়ার জুড়েই তার বিপক্ষ দলের জানা ছিল, কেবল এক ম্যারাডোনাকে আটকাতে পারলেই চলবে। ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই তাকে প্রচুর ফাউলের মুখোমুখি হতে হয়েছে। ১৯৮২ সালের বিশ্বকাপে ইতালির বিপক্ষে ২৩ বার ফাউলের শিকার হন তিনি, যা বিশ্বকাপে এক ম্যাচে সবচেয়ে বেশি ফাউল হবার রেকর্ড। আর ১৯৯০ এর বিশ্বকাপে তাকে সর্বমোট ৫০ বার ফাউল করা হয়েছে, যা কিনা এক বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি ফাউল হওয়ার রেকর্ড! এত কিছুর পরেও কিন্তু তাকে আটকানো যায়নি। বুকের উপর সরাসরি বুট দিয়ে মারার পরেও পেইনকিলার খেয়ে মাঠে নেমেছেন ম্যারাডোনা, সত্যিকারের নেতার মতো সামনে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন দলকে।

প্রিয় সতীর্থ ক্যানিজিয়ার সাথে; source: 100% Authentic

গ্রেট খেলোয়াড়দের একটি অন্যতম গুণ হলো, তারা তাদের আশেপাশের খেলোয়াড়দের মাঝেও একটা আত্মবিশ্বাসের প্রেরণা ছড়িয়ে দেন। ১৯৯০ বিশ্বকাপের আগে গয়াকোচিকার নাম কেউ শুনেছে? তার ক্লাব ক্যারিয়ারও খুব একটা উজ্জ্বল ছিল না। অথচ ম্যারাডোনার ছোঁয়ায় তার মতো সাধারণ একজন খেলোয়াড়ও হয়ে উঠলেন অসাধারণ। আর্জেন্টিনার হয়ে ৫০ ম্যাচে মাত্র ১৬ গোল করা ক্যানিজিয়ার ক্লাব ক্যারিয়ারও ছিল সাদামাটা। কিন্তু ম্যারাডোনাকে পাশে পেলেই যেন অন্য রকম হয়ে যেতেন তিনি। ম্যারাডোনা দলে থাকলে দলের সবার ভেতর যে সাহস ফুটে উঠতো, তা নিজের চোখে না দেখলে কেউ বুঝতে পারবেন না। এই কাজটি ম্যারাডোনার চেয়ে ভালো আর কোন খেলোয়াড় করতে পেরেছেন ইতিহাসে? বিশ্বকাপের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নিরপেক্ষভাবে খুঁজে দেখলে এমন খেলোয়াড় হয়তো পাওয়া অসম্ভবই হবে।

ক্লাব ক্যারিয়ার

ম্যারাডোনা ক্লাব ক্যারিয়ার শুরু করেন আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্সের হয়ে। সেখানে ১৬৭টি খেলায় ১১৫টি গোল করেন তিনি। এরপর তিনি চলে যান বোকা জুনিয়র্সে। এখানে তিনি লিগ চ্যাম্পিয়নশিপ জেতেন। এখান থেকে ১৯৮২ সালে ম্যারাডোনা বার্সেলোনায় যোগ দেন।

বার্সেলোনা

বার্সেলোনায় ম্যারাডোনা তার সর্বোচ্চ সফলতা পাননি। এখানে তিনি গোড়ালির ইনজুরিতে পড়েন। এছাড়া হেপাটাইটিসের সাথেও তাকে লড়াই করতে হয়। এত প্রতিকূলতার মাঝেও ম্যারাডোনা বার্সেলোনার হয়ে ৫৮ ম্যাচে ৩৮ গোল করেন। বার্সার হয়ে শেষ মৌসুমে মাত্র ১ পয়েন্টের জন্য লিগ শিরোপা জিততে পারেননি ম্যারাডোনা। তবে রিয়াল মাদ্রিদকে হারিয়ে কোপা দেল রে জেতেন। এছাড়া একটা স্প্যানিশ সুপার কোপাও জেতেন তিনি।

কিন্তু বার্সার হয়ে ম্যারাডোনার কৃতিত্ব আসলে অন্য একটি জায়গায়। ১৯৮৩ সালের ২৬ জুন বার্সেলোনা বনাম রিয়াল মাদ্রিদের খেলায় বিশ্ব নতুন এক জিনিস দেখতে পায়। বার্সা রিয়াল মাদ্রিদের মাঠে গিয়ে তাদেরকে হারায়, তবে এটি ম্যাচের হাইলাইটিং পয়েন্ট না। ম্যাচে ম্যারাডোনা একটি গোল করেন। সেটিও বিশেষ কিছু নয়। বিশেষ কিছু হচ্ছে, গোলটা তিনি কীভাবে করলেন?

মাঝ মাঠ থেকে বল পাওয়ার পর তার সামনে ছিল কেবল গোলকিপার। গোলকিপারকে কাটিয়ে নেওয়ার পরে ফাঁকা পোষ্ট পেয়েও তিনি গোল করেননি! গোলটা করেন রিয়ালের আরেকজন এসে তাকে আটকানোর চেষ্টা করার পর।

ম্যাচ শেষে রিয়াল মাদ্রিদের সমর্থকরা ম্যারাডোনাকে দাঁড়িয়ে অভিনন্দন জানান, যা কিনা একজন বার্সেলোনা খেলোয়াড়ের জন্য প্রথম ছিল। এত কিছুর পরেও ম্যারাডোনা ক্লাব কর্মকর্তাদের সাথে ঘন ঘন বিবাদে জড়িয়ে পড়েন। শেষ পর্যন্ত ১৯৮৪ সালে ইতালিয়ান ক্লাব নাপোলিতে যোগ দেন তিনি।

নাপোলি

ইতালিয়ান ক্লাব নাপোলি কখনোই ইতালির শীর্ষ ক্লাবের একটি ছিল না। ম্যারাডোনা আসার আগে কখনো লিগও জিততে পারেনি তারা। ১৯৬৮ এবং ১৯৭৫ সালে রানারআপ হওয়াই ছিল তখন পর্যন্ত তাদের সেরা সাফল্য। তবে ১৯৮৩-৮৪ মৌসুমে তারা চলে যায় পয়েন্ট তালিকার ১২ নম্বর পজিশনে। মাত্র ১ পয়েন্টের জন্য রেলিগেশন থেকে বেঁচে যায় ক্লাবটি। এরকম এক ক্লাবে ম্যারাডোনার মতো খেলোয়াড়ের আগমন কিছুটা বিস্ময়েরই। প্রথম মৌসুমে ম্যারাডোনা ১৪ গোল করলেও দুর্বল ডিফেন্সের কারণে নাপোলি লিগে ৮ম হয়। এর পরের মৌসুমে ম্যারাডোনা দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ১১টি গোল করেন, সাথে নাপোলি উঠে আসে লিগ টেবিলের ৩ নম্বরে।

রুদ খুলিতের সাথে মাঠের লড়াই; source: goal.com

পরের মৌসুমে নাপোলি জোর প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফিরে আসে। বিশ্বকাপজয়ী ম্যারাডোনাও দলকে নিয়ে নতুন ভাবে নামেন মাঠে। আর এই মৌসুমেই নাপোলি লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়, যা তাদের ক্লাব ইতিহাসে প্রথম। এছাড়া ম্যারাডোনা থাকাকালীন তারা আরো একবার লিগ জেতে। একটি কোপা ইতালিয়া, উয়েফা কাপ আর একটি ইতালিয়ান সুপারকোপাও জেতে তারা। মাঝে ১৯৮৭-৮৮ মৌসুমে ম্যারাডোনা লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা হন।

নাপোলিতে ৭ মৌসুম খেলে মাত্র ৫টি ট্রফি জয়কে আপাতদৃষ্টিতে খুব সাধারণ অর্জন মনে হতে পারে। কিন্তু আপনি জেনে বিস্মিত হবেন যে, ম্যারাডোনা থাকাকালীন যে দু’বার নাপোলি লিগ শিরোপা জিতেছে, সেটাই তাদের একমাত্র অর্জন হয়ে রয়েছে। নাপোলি তাদের ইতিহাসে সর্বমোট ১০টি মেজর শিরোপা জিতেছে ,যার ৫টিই ম্যারাডোনার আমলে। আর নাপোলির ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতাও ম্যারাডোনাই!

সমকালীন সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী প্লাতিনির সাথে ম্যারাডোনা; source: blog.guerinsportivo.it

নাপোলির ইতিহাসে ম্যারাডোনার অবদান কী, সেটা বোঝার জন্য একটি তথ্যই যথেষ্ট। ম্যারাডোনার প্রতি সম্মান দেখিয়ে নাপোলি তাদের ১০ নম্বর জার্সিটিকে অবসরে পাঠিয়ে দিয়েছে, এই জার্সি পরেই সেখানে খেলতেন ইতিহাসের এই জাদুময় ফুটবলার।

ড্রাগ টেস্টে পজিটিভ প্রমাণিত হয়ে ম্যারাডোনা ১৫ মাসের জন্য ফুটবল থেকে নিষিদ্ধ হন। নিষেধাজ্ঞা থেকে ফিরে নাপোলি ছেড়ে দেন তিনি। এরপর রিয়াল মাদ্রিদের মতো দল তার প্রতি আগ্রহী হলেও তিনি যোগ দেন সেভিয়াতে। সেখানে ১ বছর খেলে চলে যান নিউ ওল্ড বয়েজে। সেখান থেকে আবার ফেরেন বোকা জুনিয়র্সে। এখান থেকেই ১৯৯৭ সালে অবসর নেন ম্যারাডোনা।

ম্যারাডোনার সময়ে তার সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আরেক গ্রেট মিশেল প্লাতিনি। তিনি ম্যারাডোনা সম্পর্কে বলেছিলেন,

“আমি বল নিয়ে যা করতে পারি, দিয়েগো সেটা কমলা দিয়েই করতে পারবে!”

ধারণা করা হয়, ক্যারিয়ারে সবচেয়ে ভালোভাবে ম্যারাডোনাকে সামলাতে পারতেন লোথার ম্যাথিউজ; source: Frankfurter Neue Presse

শুধু পুরস্কার দিয়ে বিবেচনা করলে ম্যারাডোনাকে মোটামুটি সাধারণ একজন খেলোয়াড়ই মনে হবে। কিন্তু ইতিহাস ম্যারাডোনাকে বিবেচনা করে ‘গ্রেট’ হিসেবেই, সেটাও ফুটবল ইতিহাসের সর্বকালের সেরা দুজনের একজন হিসেবে। তার মানে, বিশেষজ্ঞরা ম্যারাডোনার কীর্তিগুলোকে ‘বিশেষ কিছু’ হিসেবেই বিবেচনা করেন।

গাড়ির রেসে ফেরারি গাড়ির সাথে অন্য গাড়িকেও প্রতিযোগিতায় নামতে হয়। সব ড্রাইভারই তো ফেরারি গাড়ি পান না। অনেক রেসারকে ফেরারির চেয়ে অনেক সাধারণ মানের গাড়ি নিয়েই ট্র্যাকে নামতে হয়। ম্যারাডোনার কৃতিত্ব হচ্ছে এটাই যে, তিনি সাধারণ মানের গাড়ি নিয়ে ট্র্যাকে শুধু লড়াই করে যাননি, বরং সমসাময়িক অনেক ফেরারি গাড়ি সহ ভালো ড্রাইভারদের হারিয়ে দিয়েছেন।

বেলজিয়ামের বিপক্ষে ম্যাচে ম্যারাডোনার সামনে খেলোয়াড়দের দুর্গ; source: Sports Illustrated

পাঁচজনের মধ্য দিয়ে বল নিয়ে বের হচ্ছেন ম্যারাডোনা; source: YouTube

ম্যারাডোনার চেয়ে সমসাময়িক অনেক খেলোয়াড়েরই বল নিয়ে ছোটার গতি হয়তো বেশি ছিল, কোনো খেলোয়াড় হয়তো ম্যারাডোনার চেয়ে ভালো ড্রিবলিং করতে পারতেন। কিন্তু এখানে পার্থক্যটা গড়ে দেয় প্রেশার, মানসিক চাপ। চাপের মধ্যে সবাই ভালো খেলতে পারেন না। চাপ থাকলে দেখা যায়, হিগুয়েনের মতো ভালো ক্লাবের ভালো খেলোয়াড়ও গোলকিপারের মাথার উপর দিয়ে বল বাইরে পাঠিয়ে দেন। বেকহামের মতো খেলোয়াড়, যিনি কিনা স্পট কিকের জন্য বিখ্যাত, তিনিই ইংল্যান্ডের হয়ে পরপর চারটি পেনাল্টি মিস করেন। অথচ অন্যান্য সময় ফ্রি কিক থেকে গোল করাটা বেকহামের কাছে ছিল যেন ‘ডাল ভাত’। চাপে থেকেও স্বাভাবিক খেলতে পারাটাই একজন খেলোয়াড়ের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আর তুলনামূলক দুর্বল দল নিয়েও এই কাজটি ম্যারাডোনার চেয়ে ভালো আর কে করতে পেরেছে ফুটবল ইতিহাসে?

এখানেই ম্যারাডোনা আর সব গ্রেটের চেয়ে আলাদা, এ কারণেই তিনি গ্রেটদেরও গ্রেট!

ফিচার ইমেজ- sportskeeda.com

Related Articles