Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মার্তা: ব্রাজিলের সাড়া জাগানো নারী ফুটবলার

মেয়েদের ফুটবলের পেলে হিসেব স্বীকৃতি পাওয়া মার্তা মহিলা ফুটবলের ইতিহাসে এক সাড়া জাগানো নাম। স্বয়ং পেলেও তার সাথে এই তুলনা মেনে নেন নির্দ্বিধায়। তার অসাধারণ পায়ের কাজে মুগ্ধ হয়েছেন তামাম ফুটবল বিশ্ব। সেকারণেই ২০০৬-১০ পর্যন্ত টানা পাঁচবার মেয়েদের ফুটবলে বর্ষসেরার পুরস্কার উঠেছে তার হাতেই। মেয়েদের বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ গোলদাতার রেকর্ডটিও এখন তার কব্জায়। নারী বিশ্বকাপে এ পর্যন্ত ১৫টি গোল করে হয়েছেন সর্বোচ্চ গোলদাতা।

শৈল্পিক ফুটবলের দেশ ব্রাজিল। সেই দেশে ফুটবল প্রতিভার কোনো অভাব নেই। তেমনি এক প্রতিভার নাম মার্তা। তার জন্ম ১৯৮৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি। পুরো নাম মার্তা ভিয়েরা দ্য সিলভা। তবে ফুটবল বিশ্ব মার্তা নামেই তাকে সবচেয়ে বেশি চেনে। বয়স তখন তার সবে ১৪ পেরিয়েছে। আর পাঁচটা সাধারণ পরিবারের মেয়ের মতোই কাটছিলো তার ছেলেবেলা। তবে ছোট থেকেই ফুটবল হয়ে উঠেছিল মেয়েটির ধ্যান-জ্ঞান এবং সবচেয়ে ভাল লাগার এক বিষয়। পাড়ার রাস্তায় প্রতিবেশী ছেলেমেয়েদের সাথে খেলার মধ্য দিয়ে ফুটবলে তার হাতেখড়ি। পাড়ার ছেলেরাও তার দুর্দান্ত স্কিলে নাস্তানাবুদ হতো প্রতিনিয়ত। বল নিয়ে ছেলেদের সাথে মাঠে নেমে পড়া সেদিনের সেই ছোট্ট মেয়েটিই আজকের মহিলা ফুটবল জগতে আলোড়ন ফেলা তারকা মার্তা।

মার্তা; Source: thesefootballtimes.co

ওই বয়সেই তাই কোচের নজরে পড়ে গেলো মেয়েটি। ব্রাজিলের বিখ্যাত মহিলা ফুটবল কোচ হেলেনা পাচেকোর নজরে পড়ে যান মার্তা। মূলত তার তত্ত্বাবধানে ফুটবলার হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলেন মার্তা। মাত্র ১৪ বছর বয়সে ভাস্কো দা গামা মহিলা ক্লাবের সাথে প্রশিক্ষণের জন্য রিও ডি জেনেইরোতে চলে আসেন তিনি। প্রফেশনাল লীগে খেলা শুরু করেছিলেন রিও ডি জেনেইরোর বিখ্যাত ক্লাব ভাস্কো দা গামায়। ফরোয়ার্ড হিসেবে মাঠে নেমে মার্তা গোল করেছেন অসংখ্য। ডি বক্সে প্রতিপক্ষের ত্রাসের অপর নাম যেন তিনি। তাকে বলা হয় এই গ্রহের সবচেয়ে ট্যালেন্টেড আর পরিশ্রমী খেলোয়াড়। তার অসাধারণ ড্রিবলিং ও দক্ষতা প্রশ্নাতীত। স্কিল দিয়ে প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগকে নাকানি-চুবানি খাইয়ে প্রতিপক্ষের জালে বল জড়াতে সিদ্ধহস্ত তিনি।

ক্লাব ভাস্কো দা গামায় নাম লেখানোর মধ্য দিয়ে প্রফেশনাল লীগে খেলা শুরু করেন মার্তা; Source: Tomboy Tarts

ভাস্কো দা গামার পর সান্তাক্রুজ, উমেয়া আইকে, লস অ্যাঞ্জেলেস সোল, স্যান্টোসের মতো দলের হয়েও ফুটবল খেলেছেন মার্তা। ইউরোপের ক্লাব ফুটবলেও পেয়েছেন সাফল্য। ২০০৪-০৮ সাল পর্যন্ত সুইডেনের উমেয়া আইকে দলের হয়ে ১০৩ ম্যাচে গোল করেছেন ২১০টি। সুইডিশ ঘরোয়া ফুটবলে উমেয়া আইকে অনেক সাফল্য এনে দিয়েছেন মার্তা। এই দলের হয়ে জিতেছেন উয়েফা কাপ। সুইডেনের এই ক্লাবটিতে খেলেছেন চার বছর। পরবর্তীতে খেলেছেন সুইডেনের আরেক ক্লাব রোজেনগার্দের হয়ে।

সুইডেনের উমেয়া আইকে দলের হয়ে জিতেছেন উয়েফা কাপ; Source: CNN.com

আমেরিকায় লস অ্যাঞ্জেলেস সোল দলের হয়ে পেশাদার ফুটবল লীগে খেলতে গিয়ে ২০০৯ সালে লীগে সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করেন ব্রাজিলের এই দুরন্ত ফুটবলার। বর্তমানে মার্তা ফ্লোরিডার অরল্যান্ডো প্রাইড দলের হয়ে ফুটবল খেলছেন। এই দলের হয়ে এখন পর্যন্ত ১২ ম্যাচে ২০ গোল করেছেন। তাকে নিয়ে ২০০৫-এ ‘মার্তা, পেলে’স কাজিন’ নামে এক তথ্যচিত্র তৈরি করেছিলো সুইডিশ টেলিভিশন।

মার্তা বর্তমানে ফ্লোরিডার অরল্যান্ডো প্রাইড  দলের হয়ে খেলছেন; Source: SI.com

মার্তা ক্লাব ফুটবলের মতোই জাতীয় দলের হয়েও ছিলেন সমান উজ্জ্বল। ২০০২ সালে জাতীয় দলের হয়ে অভিষেক ঘটে তার। পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি উচ্চতার এই সুযোগসন্ধানী ফরোয়ার্ড খেলোয়াড় দেশের হয়ে মেয়েদের আন্তর্জাতিক ফুটবলে গোল করেছেন ১০৫টি, পেয়েছেন একাধিক পুরস্কারও। ২০০৪ সালে ফিফা অনুর্ধ্ব বিশ মহিলা বিশ্বকাপে তিনি ‘গোল্ডেন বল’ পান।

বল দখলের লড়াইয়ে মার্তা ও দক্ষিণ কোরিয়ার এক ফুটবলার; Source: The Conversation

২০০৭ এ ব্রাজিলের জাতীয় দলের হয়ে চীনে খেলেছেন প্রথম বিশ্বকাপ। সেই আসরে ৭ গোল করে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা হন। শুধু তা-ই নয়, মাঠে তার অসামান্য নৈপুণ্যের জন্য সেরা খেলোয়াড়ের দুটি পুরস্কার জিতে নেন মার্তা। ২০১১ সালের বিশ্বকাপে করেন ৪টি গোল এবং সতীর্থদের দুটি গোলের সুযোগ করে দেন। ২০০৪ এবং ২০০৮ সালে মার্তার পারফরম্যান্সের সুবাদেই অলিম্পিকে রৌপ্যপদক লাভ করে ব্রাজিল।

দলের জয়ে ব্রাজিলের ঐতিহ্যবাহী সাম্বা ড্যান্সের তালে মার্তা; Source: Roads & Kingdoms

প্যান আমেরিকান গেমসে দু’বার জিতেছেন সোনা। এই সময়েই ২০০৬-১০ সাল, টানা পাঁচ বছর ফিফার বর্ষসেরা মহিলা ফুটবলারের সম্মান পেয়ে গেছেন।  এ থেকেই বোঝা যায় কেমন ফুটবলার মার্তা।

ফুটবল দিয়েই দুনিয়া শাসন করেছেন মার্তা। ফুটবল সম্রাট পেলের সঙ্গে তুলনা করে তাকে বলা হয় ‘স্কার্ট পরা পেলে’। পেলের মুখ থেকেও বেরিয়ে এসেছে প্রশংসা। ২০১০ সালের ১১ অক্টোবর ইউ এন গুডউইল অ্যাম্বাসেডর হিসেবে ঘোষিত হয়েছিলো মার্তার নাম। এত সাফল্য, এত সম্মান। তবু প্রচার, গ্ল্যামার আর প্রাচুর্যে লিওনেল মেসি, ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোদের চেয়ে মার্তারা যেন অনেকটাই পিছিয়ে।

মেয়েদের বিভাগে পর পর পাঁচবার বর্ষসেরার পুরস্কার জয়ী মার্তা; Source: fr.uefa.com

খেলোয়াড়ি জীবনে মার্তার বেশ কিছু অপূর্ণতা রয়েই গেল। ফুটবলে এত সমৃদ্ধ ক্যারিয়ার যে ফুটবেলারের, অথচ ক্যারিয়ারে জাতীয় দলের হয়ে জিততে পারলেন না কিছুই! এজন্য অনেকেই তাকে মেসির সাথে তুলনা করেন। বিশ্বের বিভিন্ন লীগে বিভিন্ন দলের হয়ে যার অসাধারণ পারফরম্যান্স, সেই মার্তা জাতীয় দলের হয়ে এনে দিতে পারেনি কোনো শিরোপা। ২০০৪, ২০০৮ এবং ২০১৬- তিন অলিম্পিকে ব্রাজিলের হয়ে অংশগ্রহণ করলেও একবারও সোনা জয় করতে পারেননি। ২০০৪ সালে এথেন্স এবং ২০০৮ সালে বেইজিং অলিম্পিকে দেশের হয়ে জিতেছেন রুপো।

মেসির মতোই বিশ্বকাপে দলের হয়ে শিরোপা জেতা অধরাই থেকে গেলো মার্তার; Source: The Sun

কিন্তু ২০১৬ এ নিজের দেশে আয়োজিত অলিম্পিকে সবার আশা ছিল সোনা উঠবে ব্রাজিল মহিলা দলের। ৩০ বছর বয়সী মার্তার জন্য এই অলিম্পিকেই শেষ সুযোগ বলে অনেক বিশেষজ্ঞরেই অভিমত ছিল। সে আশায় গুড়েবালি। ব্রাজিলের সেই স্বপ্ন হোঁচট খেলো সেমিফাইনালে। টাইব্রেকারে সুইডেনের কাছে হেরে বিদায় নিলো মার্তার দল। তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে কানাডার সাথে ২-১ গোলে হেরে যায় ব্রাজিল। ফলে ব্রোঞ্জও জিততে পারেনি তারা। কিন্তু গ্রুপ পর্বের ম্যাচে এই সুইডেনকেই  ৫-১ গোলে উড়িয়ে দিয়েছিল ব্রাজিল। সেই ম্যাচে মার্তা একাই করেছিলেন দুই গোল। এ নিয়ে তৃতীয়বারের মতো অলিম্পিক সোনার এত কাছে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছেন মার্তা ও তার দল।

২০১৬ এর অলিম্পিকে সেমিফাইনালে হেরে  মর্মাহত মার্তা ও দলের সহ খেলোয়াড়রা; Source: nation.com.pk

এমনই হতাশার ছবি ফুটে উঠেছিল নারী বিশ্বকাপেও। ছেলেদের বিশ্বকাপে পাঁচবার বিশ্বকাপ ট্রফি জিতলেও ১৯৯১ সাল থেকে শুরু হওয়া ফিফা প্রমীলা বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি ব্রাজিল। মহিলা বিশ্বকাপে ব্রাজিলের সেরা ফলাফল রানার্সআপ। ফাইনালে ২০০৭ সালে এই মার্তার অসাধারণ নৈপু্ণ্যের পরেও ফাইনালে এসে জার্মানির কাছে হেরে যায় ব্রাজিল। রানার্স-আপের ট্রফি নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাদের।

২০০৭ নারী বিশ্বকাপে অসাধারণ নৈপুণ্যের স্বীকৃতিস্বরূপ জিতে নেন গোল্ডেন বুট ও গোল্ডেন বল; Source: sites.duke.edu

২০১১ সালে বেকেন বাওয়ারের দেশ জার্মানিতে দ্বিতীয়বার বিশ্বকাপে অংশ নিলেও সুবিধা করতে পারেনি ব্রাজিল। কোয়ার্টার ফাইনালে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে হেরে যায় তারা। ২০১৫ সালে কানাডায় আয়োজিত বিশ্বকাপে ব্রাজিল গ্রুপ পর্বের বেড়া টপকাতে ব্যর্থ হয়। ২০০৭ সালে মার্তার দুঃখের স্রোতে ​মিশেছিল কোপা আমেরিকা হতাশাও। ২০১৫ আর ২০১৬ সালেও তা-ই। ফুটবল বিশ্লেষকদের তাই অভিমত, মার্তা পেলে হতে পারলেন না, মেসি হয়েই থেকে গেলেন।

এখন তার বয়স ৩১ অতিক্রম করেছে। আরেকটি বিশ্বকাপ দোড়গোড়ায়। এটিই হতে পারে তার শেষ বিশ্বকাপ। লিওনেল মেসির মতো আরেকবার লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নিবেন কিনা তা দেখার অপেক্ষায় ব্রাজিলের আপামর জনগণ এবং তার ফুটবল ভক্তরা। মার্তার দক্ষতা ও নৈপুণ্যের একঝলক দেখে নিন এই ভিডিও থেকে।

ফিচার ইমেজ: Olympic Channel

Related Articles