পাকিস্তানের ১৯৯২ বিশ্বকাপ জয়ের রূপকথার গল্প তো অনেকেই জানেন। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে গ্রুপ পর্বে ৭০ রানে অলআউট হয়ে গেলেও বৃষ্টির কল্যাণে ম্যাচটা পরিত্যক্ত হওয়ায় ১ পয়েন্ট পেয়ে চতুর্থ দল হিসেবে সেমিফাইনালে উঠে যায় পাকিস্তান। পুরো টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত খেলতে থাকা নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে ফাইনালে উঠে শেষ পর্যন্ত চ্যাম্পিয়নই হয়ে যায় পাকিস্তান।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, পাকিস্তানের চ্যাম্পিয়ন হবার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদানটা কার? অনেকে বলে অধিনায়ক ইমরান খানের, অনেকে বলে তরুণ ইনজামামের সেমিফাইনালে ৩৭ বলে ৬০ রানের ইনিংসটির, আবার অনেকে বলে 'ভাগ্য'।
এখন এর মাঝে কিছু কিছু মানুষের ধারণা যে পাকিস্তান আসলে সেমিতেই বাদ পড়ে যায়, সেখানে জিততে পেরেছে কেবল একজন মানুষের জন্য।
মানুষটার নাম হচ্ছে মার্টিন ক্রো।
কে ছিলেন এই মার্টিন ক্রো?
সেই বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের অধিনায়ক ছিলেন।
তাহলে পাকিস্তানের বিপক্ষে সেমিফাইনালে বাদ পড়ার পেছনে ওনার ভূমিকাটা কী?
সেটা বলার আগে ১৯৯২ বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের পারফরম্যান্স সম্পর্কে একটু জানা যাক।
সেই বিশ্বকাপে টপ ফেভারিট দল ছিল অস্ট্রেলিয়া, আগের বিশ্বকাপ জয়ের পাশাপাশি স্বাগতিক দল। কিন্তু বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দিয়ে সবাইকে চমকে দিল নিউজিল্যান্ড। ১০০ রান করে দলকে শক্ত একটা অবস্থানে পৌছে দেবার পেছনে মূল অবদান ক্রো’রই। শুধু সেই ম্যাচেই নয়, পুরো টুর্নামেন্টেই অসাধারণ ফর্মে ছিলেন ক্রো। ৯ ম্যাচে ১টি সেঞ্চুরি আর ৪টি হাফসেঞ্চুরি, ১১৪ গড় আর ৯০.৮৩ স্ট্রাইক রেটের সাহায্যে করেছেন ৪৫৬ রান, যা কি না টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ। টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গড় পিটার কার্স্টেনের ৬৮.৩৩। নূন্যতম ২২৫ রান করেছেন, এমন ব্যাটসম্যানদের মাঝে তার চেয়ে বেশি স্ট্রাইক রেট কেবলমাত্র ইনজামাম-উল হকের (৯৩.৭৫), যদিও তার গড় মাত্র ২২.৫০।
তবে মার্টিন ক্রো’র অবদান কেবলমাত্র ব্যাটিংয়ে ছিল না। পুরো বিশ্বকে চমকে দিয়েছিলেন আরো কিছু উদ্ভাবনী সিদ্ধান্ত নিয়ে।
সেই সময়ে প্রতিটি দলের লক্ষ্য ছিল প্রথম দিকে উইকেট ধরে রেখে শেষ ১০-১৫ ওভারে রান তোলার চেষ্টা করা। কিন্তু মার্ক গ্রেটব্যাচকে পিঞ্চ হিটার হিসেবে ব্যবহার করে ক্রো ক্রিকেট খেলার ধরণটাকেই পাল্টে দিয়েছিলেন। ৭ ম্যাচে ৩টি হাফসেঞ্চুরির সাহায্যে ৪৪.৭১ গড় আর ৮৭.৯২ স্ট্রাইক রেটের সাহায্যে ৩১৩ রান করে ক্রো'র পরিকল্পনাটাকে বেশ ভালোভাবেই সফল করেছিলেন গ্রেটব্যাচ। সেই বিশ্বকাপে তার চেয়ে বেশি রান করতে পেরেছিলেন মাত্র ৩ জন ওপেনার। কিন্তু ডেভিড বুন (স্ট্রাইক রেট ৬৮.৯১), রমিজ রাজা (স্ট্রাইক রেট ৬৪.৭৪) আর আমির সোহেল (স্ট্রাইক রেট ৬৩.৩০)-দের পরিসংখ্যানই সাক্ষ্য দেয়, সময়ের চেয়ে কতটা এগিয়ে ছিলেন গ্রেটব্যাচ।
শুধু এদিকেই নয়, দলের বোলিং সাইডেও মার্টিন ক্রো কাজ করেছিলেন। স্যার রিচার্ড হ্যাডলি যাওয়ার পর থেকে নিউজিল্যান্ডে সেভাবে কোনো ফাস্ট বোলার উঠে আসছিলো না। ক্রিস কেয়ার্নস আর ড্যানি মরিসনের সাথে গেভিন লারসন, ক্রিস হ্যারিসদের মতো মিডিয়াম পেসারদেরকে নিয়ে পরিকল্পনা করলেন। উইকেট নিতে না পারলেও হালকা সুইং কিংবা বাড়তি বাউন্সের সমন্বয়ে এমনভাবে বল করতেন এই বোলাররা, যাতে ব্যাটসম্যান বিগ শট নিতে না পারেন।
তবে এর চেয়েও বড় জুয়া খেলেছিলেন অফ স্পিনার দীপক প্যাটেলকে নিয়ে।
স্পিনারদের মূল কাজটা শুরু হয় বল কিছুটা পুরনো হয়ে যাবার পর। নতুন পিচ্ছিল বলে পেসাররা সুবিধে পেলেও স্পিনারদের বল গ্রিপ করতেই সমস্যা হয়। কিন্তু ক্রো ম্যাচের শুরুতেই বল তুলে দিলেন দীপক প্যাটেলের হাতে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, প্যাটেলও অধিনায়কের আস্থার প্রতিদান দিলেন চমৎকারভাবে। ৯ ম্যাচে ৮টি উইকেট নিলেও তার মূল কাজ ছিল রান নিয়ন্ত্রণ করা। ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্যাটারসনের ১ ম্যাচে ১০ ওভার বল করে ২৫ রান দেওয়ার হিসেব বাদ দিলে টুর্নামেন্টের সবচেয়ে ইকোনোমিক্যাল বোলার ছিলেন প্যাটেলই (৩.১০)।
ব্যতিক্রমধর্মী দুর্দান্ত সিদ্ধান্তও অনেক সময় মানুষের চোখের আড়ালে চলে যায়, যদি সফলতা না আসে। গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে পাকিস্তানের বিপক্ষে বাদে আগের প্রতিটা ম্যাচই জিতেছে নিউজিল্যান্ড, সেটাও এক প্রকার হেসেখেলেই। সাধারণ একটা দলকেও অসাধারণ বানানোর পেছনে মার্টিন ক্রো’র দুর্দান্ত অধিনায়কত্ব যে একটা ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিলো, সেটা ক্রিকেট বিশেষজ্ঞেরা সকলেই একবাক্যে স্বীকার করেন।
ব্যাটিং, অধিনায়কত্ব কিংবা উদ্ভাবনী সিদ্ধান্ত - এই সবকিছুতে চমক দেখানোর পরও মার্টিন ক্রো’র কারণেই পাকিস্তান সেমিফাইনালে জিতেছিলো, কথাটা আসলে বিস্ময় জাগানোর জন্য যথেষ্ট। অথচ পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচটাতেও ৮৩ বলে ৯১ রানের একটা ঝকঝকে ইনিংস উপহার দেন মার্টিন ক্রো। যতক্ষণ ব্যাটিং করছিলেন, একটা মুহূর্তের জন্যেও মনে হয়নি, কোনো বোলার তাকে আউট করতে পারবেন। সেঞ্চুরিটাও হয়তো পেয়ে যেতেন, কিন্তু হ্যামস্ট্রিং ইনজুরিতে পড়ে যাওয়ায় রানার নিতে হলো তাকে। শেষ পর্যন্ত রানআউটই হয়েছেন। সেঞ্চুরি না হলেও তার অসাধারণ ইনিংসের সুবাদে ২৬২ রানের একটা জেতার মতো স্কোরই করেছিলো নিউজিল্যান্ড। সেই বিশ্বকাপে এর চাইতেও বেশি রান হয়েছিল আরো ৬টি ইনিংসে, তবে প্রতিটি রানই হয়েছিলো সেই সময়ের 'শিশু দল' হিসেবে পরিচিত জিম্বাবুয়ে আর শ্রীলংকার বিপক্ষে। পাকিস্তানের মতো একটা বোলিং অ্যাটাকসমৃদ্ধ দলের বিপক্ষে ২৬২ রানের মতো স্কোর করাটা আসলেই অনেক বড় বিষয় সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে।
তাহলে ক্রো’র বিষয়টা আসলে কী?
সত্যি কথা হচ্ছে, ব্যাটিং করার সময় ইনজুরিতে পড়ে যাওয়ার কারণে ফিল্ডিংয়ে আর নামতে পারেননি। অনেকে ধারণা করেন যে, নিউ জিল্যান্ডের সেই ম্যাচ হারার মূল কারণটা ছিল সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে না পারাটাই। নয়তো শেষ ১৫ ওভারে ১২৩ রানের করার মতো অস্বাভাবিক (সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে) কাজটাও কেমন করে পাকিস্তান করে ফেলতে পারলো? ধারণা করা হয়, মার্টিন ক্রো মাঠে উপস্থিত থাকলে বিকল্প কিছু তিনি অবশ্যই বের করে ফেলতেন। এরকম একজন মানুষের উপস্থিতিই অন্যান্য খেলোয়াড়দের জন্য বাড়তি প্রেরণা। জিততে থাকা ম্যাচটাতে পাকিস্তানের পাল্টা আক্রমণে হতচকিত নিউজিল্যান্ড আর বেরিয়ে আসতে পারেনি।
ক্রো থাকলেই কি পারতো নিউ জিল্যান্ড? জানার উপায় নেই। তবে সাধারণ একটা দলকেও যেহেতু বিশ্বকাপের মতো টুর্নামেন্টে অজেয় বানিয়ে ফেলতে পেরেছিলেন, তাই তার পক্ষে শেষ ১৫ ওভারে ১২৩ রান আটকানোর কৌশল আশা করাটাও অমূলক ছিল না। শেষ পর্যন্ত সেমিফাইনালে বাদ পড়লেও সিরিজ সেরার পুরস্কারটা ঠিকই জিতে নেন মার্টিন ক্রো।
৭৭ টেস্টে ৪৫.৩৬ গড়ে ৫,৪৪৪ রান এবং ১৪৩টি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে ৩৮.৫৫ গড়ে ৪,৭০৪ রান করা একজন ব্যাটসম্যানকে পরিসংখ্যানের দৃষ্টিতে সাধারণ মনে করাই স্বাভাবিক। অথচ তিনি তার যুগের বিশেষজ্ঞদের প্রতিনিয়ত মুগ্ধ করে গিয়েছেন।
সর্বকালের সেরা ফাস্ট বোলার হিসেবে বিবেচিত ওয়াসিম আকরামের মন্তব্য শুনলে কিছুটা ধারণা পেতে পারেন,
'সেই সময়ে রিভার্স সুইং সম্পর্কে পাকিস্তানীদের বাইরে কেউ কিছু জানতো না। অথচ তিনি অবলীলায় সেগুলো মোকাবেলা করতেন। পুরনো বলে রিভার্স সুইং মোকাবেলা করতে পারার দক্ষতার পাশাপাশি নতুন বলেও তিনি সমানভাবে দক্ষ। যখন আমি আর ওয়াকার প্রতিটি ডেলিভারিতে ৬-১২ ইঞ্চি সুইং করাতাম, তখনও তিনি চমৎকারভাবে রান করতেন, স্রেফ অবিশ্বাস্য। কোনো সন্দেহ নেই যে, আমি যাদেরকে বল করেছি, তাদের মাঝে সবচেয়ে দুরূহ হচ্ছেন মার্টিন ক্রো।'
মনে রাখতে হবে যে, শচীন টেন্ডুলকার, ব্রায়ান লারা, জ্যাক ক্যালিস, মার্ক ওয়াহ, স্টিভ ওয়াহ, ডেসমন্ড হেইন্স, অ্যালান বোর্ডার কিংবা সুনীল গাভাস্কারদের মতো ব্যাটসম্যানদেরকেও বোলিং করার অভিজ্ঞতা রয়েছে ওয়াসিম আকরামের।
খেলা ছাড়ার পর ধারাভাষ্যকার এবং লেখক হিসেবেও কাজ করে গিয়েছেন এই অসাধারণ ব্যাটসম্যান। তবে '৯২ ট্র্যাজেডির মতো জীবন যুদ্ধেও তিনি ট্র্যাজেডির মুখোমুখি হন। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৫৩ বছর বয়সেই পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। জীবিত থাকাকালীন অসংখ্যবার ট্র্যাজেডির শিকার হওয়া মার্টিন ক্রো ওপারে ভালো থাকুন, সেটাই সকল ক্রিকেটপ্রেমীর চাওয়া।
This article is in Bangla language. This article is about Martin Crowe, former New Zealand cricketer. Crowe's 92 world cup's performance describes in this feature. References are given inside as hyperlinks.
Feature Image: radionz.co.nz