Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

অভিমানী মাশরাফিকে ফেরানো গেলো না

২০১১ ওয়ানডে বিশ্বকাপ দলে নিজের নামটা দেখতে পাননি মাশরাফি বিন মুর্তজা। তাই কেঁদেছিলেন। মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে গণমাধ্যমের সামনেও নিজেকে সামলাতে পারেননি তিনি। বাসায় ফিরে হু-হু করে কেঁদেছিলেন। কারণ ইনজুরিতে শতভাগ ফিট না হওয়ায় দলে  জায়গা হয়েনি তার। আর ২০১৭ সালে সবাইকে কাঁদিয়েছেন। শ্রীলঙ্কায় কোচ চান্দিকা হাতুরুসিংহের ‘চাপে’ পড়লেন। ৩৩ বছর বয়স হওয়ায় তিনি এখন বুড়োদের কাতারে। তাই হাতুরুসিংহের পছন্দের তরুণ নির্ভর দলে জায়গা হবে না। মুখের উপর তো সে কথা বলা যায় না! তাই সাবেক কোচের কাজটুকু করে দিতে চাইলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন। মাশরাফি ১৮ বছর ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলছেন। তাই ‘অ থেকে অজগর’ বুঝে নিয়েছিলেন। অধিনায়কত্ব নয়, বাংলাদেশের জার্সিতে টি-টোয়েন্টিকেই বিদায় বললেন তিনি।

ঘটনার ছয় মাসও পার হলো না, বদলে গেল গুটির ছক। যে মাশরাফিকে আয়োজন করে দলের বাইরে ছুঁড়ে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিলো, সেই মাশরাফিই এখন সমস্যা সমাধানের বালাই হয়ে উঠেছেন। নতুন চকচকে বলে তার মতো কার্যকরী আর কোনো পেসার হতে পারছেন না। তাই তার অবসর ভাঙাবার চেষ্টা। তাতে কি ফিরবেন মাশরাফি? ফেরেননি। আবেগী মন্তব্য ছুঁড়ে দিয়েও লাভ হয়নি। হয়তো বুঝেই নিয়েছিলেন, প্রয়োজনে যারা তাকে ত্যাগ করতে পারে তারা আবারও ছুঁড়ে ফেলবে না এমন নিশ্চয়তা কেউ তাকে দেবে না। অভিমানী রাজপুত্র নিজেকে গুটিয়ে নিলেন কেবল ওয়ানডের রাজত্বে।

শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দুই ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজ ছিলো। ভেন্যু কলম্বোর প্রেমাদাসা ক্রিকেট স্টেডিয়াম। মাঠে টস করতে নামলেন, দল বদলের তথ্য জানাতে গিয়ে বলে দিলেন, এটাই ২০ ওভারে বাংলাদেশের জার্সিতে তার শেষ ম্যাচ। সবচেয়ে বোধহয় অবাক হয়েছিলেন দলের ম্যানেজার খালেদ মাহমুদ সুজন। খুব কাছে থেকেও মাশরাফির অবসরের কথা জানা ছিলো না তার। যদিও ড্রেসিংরুমে সতীর্থদের সাথে টসে নামার আগে বলে গিয়েছিলেন সবকিছু। মাশরাফির অমন সিদ্ধান্তে খুব কেঁদেছিলেন মুশফিকুর রহিম- মাহমুদউল্লাহ রিয়াদরা। তাই পণ করেছিলেন, অন্তত মাশরাফির ‘ফেয়ারওয়েল’টা মনে রাখার মতো হওয়া চাই। তা-ই হয়েছিলো। সাকিব আল হাসান-সাব্বির রহমানরা উঠে পড়ে লেগেছিলো স্রেফ ‘মাশরাফি ভাই’ এর জন্য। জয় তুলে এনেছিলো ৪৫ রানে।

আক্রমণে, উদযাপনে মাশরাফি; Source: CrickGreek

সিরিজ শেষ করে যখন বিমানবন্দরে নামলেন মাশরাফিরা, ফুলেল শুভেচ্ছা নিয়ে অপেক্ষা করছিলো বিসিবি কর্মকর্তারা। সেখানে বোর্ড কর্তারা ফুলেল শুভেচ্ছা দিলেন ক্রিকেটারদের। মূলত, মাশরাফির টি-টোয়েন্টি থেকে এমন অবসরের কাণ্ডে খানিকটা হলেও নাকাল হয়েছিলো বিসিবি। সভাপতি পাপন তো বলেই ফেললেন, “মাশরাফিকে আমি অধিনায়কত্ব থেকে সরে দাঁড়াতে বলেছিলাম, অবসর নিতে বলিনি। আর মাশরাফি অবসর নেয়নি, শুধু অধিনায়কত্ব ছেড়েছে।

এমন মন্তব্যে বিমানবন্দরে পাশে বসে শুধু মুচকি হেসেছিলেন বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সফলতম এই অধিনায়ক। যেন বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন, সিদ্ধান্তটা একবারই নিয়েছেন। যা নড়চড় হওয়ার নয়। দুই পায়ে সাতবার অস্ত্রোপচার করেও যে সফর কেউ থামাতে পারেনি, সেই সফরের সিদ্ধান্ত তার হয়ে অন্য কেউ নিয়ে দেবে এটাও হয়তো চাননি তিনি।

তবে টি-টোয়েন্টিতে তিনি যে এখনও অপ্রতিরোধ্য, সেটা প্রমাণ করলেন দেশে ফিরেই। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) রংপুর রাইডার্সের হয়ে জিতলেন শিরোপা। বিপিএলের ইতিহাসে চারবার শিরোপা জয়ের রেকর্ডটা আরও একটু পোক্ত করে নিলেন। উল্লেখ্য, সেটা ‘অধিনায়ক কোটা’ ছিলো না। ১৪ ম্যাচে বল হাতে ১৫ উইকেট আর ব্যাটে ১৩১ রান তুলে নিজের নামের সাথে যথেষ্ট সুবিচার করেছেন তিনি।

২.

জানুয়ারি, ২০১৮। ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনাল থেকে বিদায়  নিলো মাশরাফির বাংলাদেশ। এরপর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দুটি টেস্ট ও দুটি টি-টোয়েন্টির সিরিজ। সাদা পোশাকে খেলেন না  মাশরাফি, টি-টোয়েন্টিতে অবসরে। ঢাকা আর সিলেটে ২০ ওভারের দুই ম্যাচেই হারলো বাংলাদেশ। একে তো ইনজুরির কারণে দলে নেই বাংলাদেশের বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান, সাথে মাশরাফির অনুপস্থিতি। সব মিলিয়ে কুশল মেন্ডিস-ধনঞ্জয়া ডি সিলভাদের সামনে টিকতে পারেনি টাইগাররা। সাকিবের অনুপস্থিতিত অবশ্যই ব্যাট-স্পিনে ভুগিয়েছে বাংলাদেশকে। একই সঙ্গে পেস আক্রমণে মাশরাফির অভাবটা যেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে দলকে। নতুন বলে তার মতো করে কার্যকরিতা এনে দিতে পারেনি কেউ। দুই ম্যাচে ছয়জন ক্রিকেটারকে অভিষেক করানো হয়েছে। পেসারদের হাল দেখে স্পিন সহায়ক উইকেট করা হয়েছে। কিন্তু লাভ হয়নি।

মাশরাফি বিন মুর্তজা; Source: Dhaka Tribune

তাই মার্চে শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠেয় বাংলাদেশ, ভারত ও স্বাগতিক শ্রীলঙ্কার ত্রিদেশীয় টি-টোয়েন্টি সিরিজে মাশরাফিকে অবসর ভাঙানোর চেষ্টায় টিম ম্যানেজমেন্ট। অভাবটা টের পেয়েই মাশরাফিকে টি-টোয়েন্টি দলে টানার ভাবনা আসে। তাতে দিন শেষে সবাই ব্যর্থ হয়েছে। মাঝখান দিয়ে বিপাকে পড়েছে দলের অন্যান্য পেসাররা। কেন মাশরাফির মতো সুবিধা এনে দিতে পারছেন না তারা, তা  নিয়ে চলছে কাটাছেঁড়া। তা নিয়ে শেষপর্যন্ত বাঁহাতি পেসার আবু হায়দার রনি তো বলেই দিলেন, ‘মাশরাফি ভাই একদিনে মাশরাফি হয় নাই। অনেকদিন খেলতে খেলতে আজ এখানে এসেছেন। তিনি অনেক অভিজ্ঞ। নতুন যারা আছে তারাও খেলতে খেলতে ভবিষ্যতে ভালো করবে।’

তারও আগে সভাপতি পাপন গণমাধ্যমে হাসিমুখে বলে দিলেন, তিনি বললেই নাকি মাশরাফি ফিরবে। তিনি বলেন, ‘আমি চাইবো মাশরাফি অবসর ভেঙ্গে ফিরে আসুক টি-টোয়েন্টিতে। আমি জানি, আমি বললে ও ঠিকই ফিরবে। তার আগে আমি বাকিদের দায়িত্ব দেব আলাপ করার।’

তার অমন মন্তব্য ফলাও করে প্রকাশিত হলো সংবাদমাধ্যমগুলোতে। কোনোকিছুই চোখ এড়ায়নি মাশরাফির। নিজের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে চাননি তিনি। তবে ফিটনেসের কারণে টেস্টে ফিরতে আগ্রহ দেখিয়েছিলেন, তাতে আবার বিসিবি  নিমরাজি। শেষ পর্যন্ত তার সাথে আলোচনা করে ‘বুঝিয়ে শুনিয়ে’ দলে ফেরানোর দায়িত্ব নিলেন খালেদ মাহমুদ সুজন।  তিনিও সুবিধা করতে পারেননি।

সে প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘এটা সম্পূর্ণ মাশরাফির উপর নির্ভর করে। ও এখনও সামর্থ্যপূর্ণ। যেহেতু ও অবসর ঘোষণা করেছে তাই ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ওর উপর। যদি ও খেলতে চায় তাহলে বোর্ডকে জানাতে হবে, নির্বাচনের বিষয়টা আমরা চিন্তা করবো। ও খুবই গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়, বিশেষ করে নতুন বলে। আমরা সবাই জানি নতুন বলে পাওয়ার প্লেতে আমাদের বোলিংটা ভালো হচ্ছে না। বিশেষ করে টি-টুয়েন্টিতে, এমনকি ওয়ানডেও ও অপ্রতিরোধ্য প্রতি ম্যাচেই ভালো খেলছে। আশা করি ও ইতিবাচক হিসেবেই নিবে। তবে এটা সম্পূর্ণ ওর ব্যক্তিগত ব্যাপার। শ্রীলঙ্কায় আমি তখন দলের সঙ্গেই ছিলাম। ও এক মুহূর্তও বলে নাই যে ও অবসর নিবে। আমি শুনেছি যখন টস হয়, তখন আসলে ওর সঙ্গে আলোচনা করার কোন সুযোগই ছিলো না। কারন ও ঘোষণাটা দিয়েছে আন্তর্জাতিক লেভেলে। এখন এটা ওর উপরই। ও যদি ফিরে আসে তাহলে বাংলাদেশের জন্য ভালোই হবে।’

খালেদ মাহমুদ সুজনের সাথে মাশরাফি বিন মুর্তজা; Source: Daily Star

মাশরাফির ক্যারিয়ারের শুরু হয়েছিলো এই সুজনের হাত ধরেই। তখনও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেই পা দেননি ‘নড়াইল এক্সপ্রেস’। তাই সুজনকে যেমন জানেন মাশরাফি, সুজনও চেনেন ভালো করে। সে কারণেই বলে দিয়েছিলেন, মাশরাফির ফেরার সম্ভাবনা অনেক করম। কে জানে, সুজনের কথা ফেলতে পারবেন না বলেই হয়তো অবসরের সিদ্ধান্ত জানাতে চাননি তাকে!

সুজন বলেন, ‘আমি ওকে (মাশরাফি) বলেছি চিন্তা করতে যে খেলবে কিনা। তবে আমি মনে করি না সে এখনও ঐভাবে চিন্তা করেছে। আমি ওকে বলেছিলাম ইতিবাচক চিন্তা করতে। তবে আমার মনে হয় না ও ফিরে আসতে চাইবে।’

নিজেকে নিয়ে এত আলোচনার কোনোকিছুই চোখ এড়ায়নি বাংলাদেশের সফলতম অধিনায়ক মাশরাফির। একজন পেসার হিসেবেই শুধু নয়, একজন পেস বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবে নিজের সেরাটা সবসময়েই দিয়ে আসার চেষ্টা করেছেন। সাদা পোশাকের টেস্টে ফেরার জন্য নিজের ইচ্ছায় নেমে পড়েছেন জাতীয় লিগের ম্যাচে। ২০ ওভারের ম্যাচ নয়, আপাতত তার লক্ষ্য টেস্টে ফেরা নিয়ে। সেদিকে আবার মন নেই বিসিবির।

সুজনের ভাষায়, ‘এটা খুব ইন্টারেস্টিং যে ও বেশ কিছু ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট খেলেছে। আমিও অনেক খুশি। অনেক সময় ও খেলতে পারে না। ইনজুরির জন্য খেলতে পারে না কিংবা বাংলাদেশ জাতীয় দলের খেলা থাকার কারণে পারে না। এবার খেলেছে এবং সেখানে ভালো পারফর্মও করেছে। আমি জানি না সামনে আসলে টেস্ট ম্যাচে মাশরাফিকে নেওয়া হবে কিনা। তবে আমি খুব খুশি যে সে এখনও ওয়ানডে ক্রিকেটের বড় প্রতিযোগী। মাশরাফি থাকা মানে একটা দলের অর্ধেক জয় পাওয়া হয়ে যায় বলতে গেলে।’

৩.

মিরপুরের ক্রিকেট পাড়ায় মাশরাফিকে নিয়ে যত আলোচনায় উড়ে বেড়াক, অধীর আগ্রহে সবাই অপেক্ষায় ছিলো নিদাহাস ট্রফির দল ঘোষণার জন্য। সেখানে মাশরাফি থাকবেন? গুঞ্জন একটাই। না, ১৬ সদস্যের স্কোয়াডে তার নাম ছিল না। অর্থাৎ অবসর ভাংবার কোনো আগ্রহ দেখাননি মাশরাফি। যে পাপন বলেছিলেন, তার কথায় ফিরতে পারেন মাশরাফি তিনি এবার হাঁটলেন উল্টোপথে

নাজমুল হাসান পাপনের সাথে; Source: BCB

বললেন, ‘মাশরাফির ব্যাপারে বলেছিলাম যে আগের সিরিজেই (শ্রীলঙ্কা) তাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে তাকে বলেছিলাম খেলার জন্য। সে কোনো আগ্রহ দেখায়নি। এবারও তার কাছে খবর পাঠানো হয়েছে, মিডিয়ার মাধ্যমেও দেখেছে। সে আমার জানামতে সে সম্পূর্ণভাবে না করে দিয়েছে। সেজন্য মাশরাফিকে এখানে আমরা চিন্তা করিনি।’

আগ্রহ সত্যিই দেখাননি মাশরাফি। হয়তো অভিমানে, হয়তো বাস্তবতায়। তাতে করে অন্তত দেশের ক্রিকেটের কর্তাব্যক্তিরা একটা বার্তা পেয়ে গেলেন, পায়ে ঠেলা লক্ষ্মীকে ফেরানো যায় না।

ফিচার ইমেজ: Dhaka Tribune

Related Articles