কলোম্বোতে দুই ম্যাচের টি-টুয়েন্টি সিরিজের প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশ কিছুক্ষণ পরেই মাঠে নামবে। এমতাবস্থায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুঞ্জন শুরু হলো অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা টি-টুয়েন্টি থেকে অবসর নিবেন। প্রথম টি-টুয়েন্টির টস অনুষ্ঠিত হওয়ার পূর্বমুহূর্তে মাশরাফির ভ্যারিফাইড ফেসবুক পেজে টি-টুয়েন্টি ক্রিকেট থেকে মাশরাফি অবসর নিচ্ছেন এমনটাই জানানো হয়।
ম্যাচ শুরু হওয়ার আগে দলের সিনিয়র ক্রিকেটার এবং কোচিং স্টাফদের নিজের অবসরের কথা জানান তিনি। শ্রীলঙ্কায় অবস্থানরত সাংবাদিকদের কল্যাণে তা মুহূর্তের মধ্যেই চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। কলোম্বোর প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে প্রথম টি-টুয়েন্টিতে দুই অধিনায়ক টস করতে আসেন। টস ভাগ্য মাশরাফির পক্ষে যাওয়ার পর ধারাভাষ্যকার ডিন জোন্স তাকে ঘিরে সবধরনের গুঞ্জন সম্পর্কে জানতে চাওয়ার পর মাশরাফি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেন টি-টুয়েন্টি থেকে অবসর নিচ্ছেন সিরিজ শেষেই। ডিন জোন্সের প্রশ্নের জবাবে বলেন। হ্যাঁ, এই সিরিজই বাংলাদেশের হয়ে আমার শেষ টি-টুয়েন্টি সিরিজ। আমি ধন্যবাদ জানাতে চাই বিসিবি, পরিবার, বন্ধুবান্ধব, সতীর্থ ও কোচিং স্টাফের সবাইকে। আমি ধন্যবাদ জানাতে চাই আমার ভক্তদের যারা গত ১৫-১৬ বছর ধরে আমাকে সাহস জুগিয়ে এসেছে।
Source: ESPNcricinfo
হঠাৎ করেই বিদায় জানালেন ক্রিকেটের ক্ষুদ্র সংস্করণকে। এইবারই প্রথম না, মাশরাফির টি-টুয়েন্টি থেকে অবসর নেওয়ার গুঞ্জন উঠেছিলো গতবছর টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের পর। সেইবার জানিয়ে দেন, অবসরের কথা ভাবছেন না। কিন্তু নিউজিল্যান্ড সফর শেষে এবং শ্রীলঙ্কা সফরের শুরু থেকেই প্রধান কোচের আবদার ছিল টি-টুয়েন্টিতে নতুন দল সাজানোর। কোচের টি-টুয়েন্টি নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা গতবছর জিম্বাবুয়ে সিরিজেও দেখা গিয়েছিল। এতে করে কয়েকজন সিনিয়র ক্রিকেটারকে টি-টুয়েন্টি ক্রিকেট থেকে বাদ দেওয়ার পরামর্শ দেন হাথুরুসিংহে। মাশরাফি শেষপর্যন্ত নিজ থেকেই টি-টুয়েন্টি ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দেন। তামিম ইকবাল এবং মুশফিকুর রহিমকেও টি-টুয়েন্টি থেকে বাদ দিতে চেয়েছেন কোচ।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান নাজমুল হাসান পাপন ম্যাচ শুরুর আগের দিন চার সিনিয়র ক্রিকেটারকে ডেকে নিয়ে বলেন, তিন ফরম্যাটে তিনজন অধিনায়ক চান এবং মাশরাফিকে তার টি-টুয়েন্টি ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবতে বলেছেন।
টি-টুয়েন্টি ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবা মানে আকার ইঙ্গিতে তাকে অবসর নেওয়ার কথা বুঝানো। অনেক ভেবেচিন্তে মাশরাফি নিজেই সিদ্ধান্ত নিলেন এখনি সময় টি-টুয়েন্টি ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর। প্রথম টি-টুয়েন্টিতে মাশরাফি টসে জিতে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর দুই দলের জাতীয় সঙ্গীত অনুষ্ঠিত হওয়ার সময় মুষলধারে বৃষ্টি নামে কলোম্বোর প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে। আধঘণ্টা খেলা বন্ধ থাকলেও কোনো ওভার কাটা যায়নি। এই মাঠে স্বাগতিক শ্রীলঙ্কা ১১ ম্যাচে মাত্র ১টি তে জয় পেয়েছে। নিজ দেশের মাঠে এমন পারফরমেন্স কিছুটা হতাশাজনক। কিন্তু টি-টুয়েন্টিতে সাম্প্রতিক সময়ে তাদের সাফল্য আশা জাগানিয়া। অস্ট্রেলিয়া এবং সাউথ আফ্রিকার মাটিতে টানা দুটি টি-টুয়েন্টি সিরিজ জিতেছে এই বছরেই। অন্যদিকে বাংলাদেশ নিজেদের শেষ ৭টি টি-টুয়েন্টিতে জয়ের মুখ দেখেনি।
Source: ESPNcricinfo
টসে জিতে ব্যাটিংয়ে নেমে শুরুতেই ধাক্কা খায় বাংলাদেশ। ইনজুরি কাটিয়ে ফেরা অভিজ্ঞ পেসার লাসিথ মালিঙ্গার প্রথম ওভারের দ্বিতীয় বলেই প্যাভিলিয়নে ফিরে যান টি-টুয়েন্টিতে বাংলাদেশের একমাত্র সেঞ্চুরিয়ান তামিম ইকবাল। দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে সাব্বির-সৌম্য ঝড়ো ব্যাটিং করে স্কোরবোর্ড সচল রেখেছিলেন। এই দুইজনে মাত্র ২৯ বলে ৫৭ রান যোগ করেন। ইনিংসের ৬ষ্ঠ ওভারের ১ম বলে সাব্বির রহমান অসতর্কতাবশত রান আউট হওয়ার পর সৌম সরকারও ঐ ওভারেই ফিরে যান ২০ বলে ২৯ রান করে। ৫ ওভারে ১ উইকেটে ৫৭ রান থেকে ৬ ওভারে ৩ উইকেটে ৫৭ রানে পরিণত হয় বাংলাদেশের স্কোর! মুশফিক, সাকিব দ্রুত ফিরে গিলে ম্যাচের লাগাম নিজেদের দখলে নিয়ে নেয় শ্রীলঙ্কা।
মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত এবং মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ ৬ষ্ঠ উইকেট জুটিতে ৫৭ রান যোগ করলে সম্মানজনক রান সংগ্রহ করে বাংলাদেশ। ৩১ রান করা রিয়াদ মালিঙ্গার দ্বিতীয় শিকারে পরিণত হলে ক্রিজে আসেন অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা। নুয়ান কুলাসেকারার অফ স্ট্যাম্পের বেশ বাহিরের বল চতুরতার সাথে লেগ সাইডে খেলে ৪ রান আদায় করে নেওয়ার পর মাশরাফি বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন ফর্ম থেকেই অবসর নিচ্ছেন তিনি। বাংলাদেশের দেওয়া ১৫৬ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নামা শ্রীলঙ্কা শুরু থেকেই ছিল আক্রমণাত্মক। পাওয়ার প্লের ৬ ওভারে কোনো উইকেট না হারিয়ে তোলেন ৫৭ রান। মাশরাফি বিন মর্তুজা দলের ৭ম এবং নিজের ২য় ওভারের ৫ম বলে শ্রীলঙ্কান অধিনায়ক থারাঙ্গাকে প্যাভিলিয়নে পাঠিয়ে বাংলাদেশকে ব্রেক থ্রু এনে দেন। ম্যাচের শুরুতে অবসরের ঘোষণা দেওয়া মাশরাফিই ছিলেন বাংলাদেশের সফল বোলার।
শ্রীলঙ্কান ওপেনার কুশাল পেরারা (৭৭) একের পর এক বাউন্ডারি হাঁকিয়ে যখন শ্রীলঙ্কাকে সহজ জয় এনে দিচ্ছিলেন তখনি মাশরাফি ২ উইকেট শিকার করে বাংলাদেশকে ম্যাচে ফেরান। নিজের শেষ টি-টুয়েন্টি সিরিজের প্রথম ম্যাচে ৩১ রান দিয়ে ২ উইকেট শিকার করলেও দলের ৬ উইকেটের হার এড়াতে পারেননি তিনি।
ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে আচমকা কেনো অবসর নিচ্ছেন মাশরাফি বিন মর্তুজা সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমি চেয়েছি টি-টুয়েন্টিতে তরুণরা সুযোগ পাক। তাদের জায়গা করে দিতেই আমার অবসরের ঘোষণা। তাছাড়া টি-টুয়েন্টি ক্রিকেট অনেক দ্রুত পরিবর্তন হয়, এবং আমি পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ পাই না।
আর টি-টুয়েন্টি ক্রিকেট কখনো এনজয় করেননি এমনটাও জানান তিনি। তিনি না থাকলে দলের অন্যান্য তরুণ ক্রিকেটাররা ফ্রিডম নিয়ে খেলতে পারবেন এবং দলের একটা জায়গা ফাঁকা হবে। রুবেলের ব্যাপারে বলেন, ও শেষ ২টি টি-টুয়েন্টিতে ৭ উইকেট পেয়েছে কিন্তু এখন স্কোয়াডেও নেই। তার সেরা ১১ তে থাকা উচিৎ ছিল। আমার কারণেই নেই, কারণ আমি অধিনায়ক হিসাবে খেলছি।
সংবাদ সম্মেলনে আরো বলেন, মাশরাফি থেকে দেশ বড়, দেশের ক্রিকেটের স্বার্থেই তিনি টি-টুয়েন্টি ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছেন। মাশরাফি বিন মর্তুজার টি-টুয়েন্টিতে অভিষেক হয়েছিলো ২৮-শে নভেম্বর ২০০৬ সালে। ঐ ম্যাচের মধ্য দিয়েই আন্তর্জাতিক টি-টুয়েন্টিতে বাংলাদেশের পথচলা শুরু হয়। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে নিজেদের প্রথম টি-টুয়েন্টি ম্যাচে বাংলাদেশ যখন ব্যাটিং বিপর্যয়ে তখন মাশরাফি বিন মর্তুজা ২৬ বলে ৩৬ রানের ইনিংস খেলে দলকে লড়াকু সংগ্রহ এনে দেন। ঐ ম্যাচে বল হাতে ১ উইকেট শিকার করে মাশরাফি বিন মর্তুজা ম্যাচ সেরার পুরস্কার নিজের করে নেন।
অভিষেক টি-টুয়েন্টিতে ম্যাচ সেরার পুরস্কার হাতে মাশরাফি বিন মর্তুজা।
বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত ৬৬টি টি-টুয়েন্টি ম্যাচ খেলেছে, যার মধ্যে মাশরাফি বিন মর্তুজা খেলেছেন ৫৩টিতে। এবং দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন ২৭ ম্যাচে। তার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ৯টি টি-টুয়েন্টি ম্যাচে জয় পেয়েছে। টি-টুয়েন্টিতে বাংলাদেশের ২০টি জয়ের ৯টিতেই নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি।
২০১৫ সালে ওডিআই ক্রিকেটে তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ অসাধারণ নৈপুণ্য প্রদর্শন করে। কিন্তু ২০১৬ সাল ছিল টি-টুয়েন্টি ক্রিকেটের। টি-টুয়েন্টি বাংলাদেশ ইতিপূর্বে আহামরি কোনো সাফল্য পায়নি। ২০১৫ সালে মাশরাফির নেতৃত্বে পাকিস্তানের বিপক্ষে একমাত্র টি-টুয়েন্টিতে জয় পেয়েছিল বাংলাদেশ। ২০১৬ সালের প্রথম ১২ ম্যাচের ৭টিতেই জয় পায় বাংলাদেশ, কিন্তু টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত টানা ৮টি টি-টুয়েন্টিতে জয়ের মুখ দেখেনি বাংলাদেশ। ২০১৬ টি-টুয়েন্টি ক্রিকেটে তার অধীনেই পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে বাংলাদেশ এশিয়া কাপের ফাইনাল খেলে।
২০১৬ সালের টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপে প্রথম রাউন্ডের সবকটি ম্যাচ তার নেতৃত্বেই জয় পায় বাংলাদেশ। মাশরাফি বিন মর্তুজা এখন পর্যন্ত ৫৩টি টি-টুয়েন্টিতে ৪১টি উইকেট শিকার করেছেন। বাংলাদেশি বোলারদের মধ্যে তৃতীয় সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি এবং পেসারদের মধ্যে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি তিনি। ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ব্যাট হাতে ভূমিকা রেখেছিলেন মাশরাফি বিন মর্তুজা। ১৩৬.৫৯ স্ট্রাইক রেইটে করেছেন ৩৭৭ রান। ২৮টি চারের বিপরীতে হাঁকিয়েছেন ২৩টি ছয়। বেলফাস্টে ২০১২ সালে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে বল হাতে ১৯ রান দিয়ে ৪ উইকেট শিকারের পর ১৩ বলে ৩০ রানের ম্যাচজয়ী ইনিংসটি টি-টুয়েন্টিতে তার সেরা পারফরমেন্স। মাশরাফি বল হাতে ৪ উইকেট শিকার করে আয়ারল্যান্ডকে ১৪০ রানে বেধে রাখলেও ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতায় হারতে বসছিল বাংলাদেশ। ১৫.১ ওভারে ৮৭ রান তুলতেই ৬ উইকেট হারায় বাংলাদেশ। মাশরাফি ব্যাট হাতে নেমে ৪টি ছয়ের সাহায্যে মাত্র ১৩ বলে ৩০ রান করলে শেষ বলে ২ উইকেটের জয় পায় বাংলাদেশ।
মাশরাফি বিন মর্তুজা হঠাৎ করেই টি-টুয়েন্টি ক্রিকেটকে বিদায় জানালেও ওডিআইতে এখনো খেলে যাবেন। তার নেতৃত্বেই চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে অংশগ্রহণ করবে বাংলাদেশ। তার ক্যারিয়ারের গুরুত্বপূর্ণ সময় ইনজুরি কেড়ে নিয়েছে, ইনজুরির কারণে কখনোই ক্রিকেটের এই ক্ষুদ্র সংস্করণকে উপভোগ করতে পারেননি তিনি। তাই তরুণদের সুযোগ করে দেওয়ার জন্যই আচমকা অবসর নিয়েছেন মাশরাফি বিন মর্তুজা।
This article is in Bangla Language. Its about Bangladesh Cricket Teams Captain Mashrafe's announcement of t20i retirement.
References:
http://www.espncricinfo.com/ci/content/player/56007.html
http://www.espncricinfo.com/sri-lanka-v-bangladesh-2016-17/engine/match/1083449.html
Featured Image: theindependentbd.com