Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মাশরাফি বিন মর্তুজা: ক্রিকেটের ফিনিক্স পাখি

২০০১ সাল। হঠাৎ করেই জীবনটা বদলে গেল নড়াইলেই চিত্রাপাড়ের সদ্য কৈশোর পার হওয়া দুরন্ত ছেলেটির। যে ছেলেটি নদীতে সাঁতার কেটে, পাড়ায় দস্যিপনা করে, বন্ধুদের সাথে যাবতীয় দুষ্টুমি আর আড্ডাবাজি করে, শখের ক্রিকেট খেলে সময় কাটাতো, সে হঠাৎ করে হয়ে গেল একজন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার, রীতিমতো তারকা ক্রিকেটার। মাত্র নয় মাসের ব্যবধানে জেলা শহর নড়াইল থেকে লাল-সবুজের প্রতিনিধিতে পরিণত হয়ে গেল। ক্রিকেটের সবার কাছে পরিচিতি পেল ‘পাগলা’ নামে। সেই ছেলেটি আর কেউ নয়, মাশরাফি বিন মর্তুজা। নড়াইলের সবাই যাকে চেনে ‘কৌশিক’ নামে।

একটু শুরু থেকেই বলি। ২০০০ সালের দিকে ‘খুলনা টাইগার্স’ নামের বিভাগীয় দল ঢাকায় গেল অনুর্ধ্ব-১৭ বিভাগীয় চ্যাম্পিয়নশিপে খেলতে। সে দলে নড়াইলের কৌশিক নামের একটা ছেলে সুযোগ পেয়ে গেল, যে ছেলেটি শুধু জোরে বলই করে না, অনেক জোরে বলকে মারেও। বিশাল বিশাল ছক্কা হাঁকানো যার প্রধান কাজ হলেও তীব্র গতিতে বলও করতে পারতো। সেই অনুর্ধ্ব-১৭ পর্যায়ে খুলনা টাইগার্সের পক্ষে দারুণ পারফর্ম করেন। কিছুদিন পরে ডাক পান অনূর্ধ্ব-১৭ জাতীয় দলের ট্রায়ালে। ঢাকায় গিয়ে ট্রায়াল দিয়ে টিকেও যান। শুরু হয় তার নতুন জীবন। ২০০১ সালে অনুর্ধ্ব-১৭তে ডাক পেয়ে সে বছরই অনুর্ধ্ব-১৯ এবং ‘এ’ দলে খেলে ফেলেন। এরপর দ্রুত অভিষেক হয়ে যায় জাতীয় দলেও। ২০০১ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ সফরে আসা জিম্বাবুয়ের সোনালি যুগের দলটির বিপক্ষে টেস্ট ক্যাপ পেয়ে যান। কোনো প্রথম শ্রেণির ম্যাচ না খেলেই বিশ্বের বিরল ক্রিকেটারদের একজন হিসেবে টেস্ট খেলে ফেলেন মাশরাফি বিন মর্তুজা নামক বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রথম জেনুইন ফাস্ট বোলার, প্রথম গতিদানব!

অ্যান্ডি রবার্টস নামক ক্যারিবিয়ান কিংবদন্তি ফাস্ট বোলারকে বিসিবি হঠাৎ উড়িয়ে আনে দেশের সম্ভাবনাময় পেসারদের নিয়ে ক্যাম্প করার জন্য। উনি এসে বেশ কয়েকজনকে নিয়ে ক্যাম্প করেন। তার মধ্যে দু’টি ছেলে তাকে দারুণভাবে মুগ্ধ করে। একজন তালহা জুবায়ের, অপরজন মাশরাফি বিন মর্তুজা। তবে মাশরাফির কথা তিনি আলাদাভাবে মিডিয়ায় বলে যান। সেই ছেলেটিকে আলাদাভাবে যত্ন নিতে, তাকে গড়ে তুলতে পরামর্শ দিয়ে যান। মাশরাফিকেও বলেন,

‘তোমাকে তোমার দেশ ডাকছে। তুমি অনেক বড় ফাস্ট বোলার হবে। শুধু শরীরটার একটু যত্ন নিও।’ 

নড়াইলের চিত্রা নদীতে শিশু-কিশোরদের খেলা। একসময় মাশরাফিও এই নদীতে সাঁতার কেটে বেড়াতেন। Image Courtesy: Getty Images

অনূর্ধ্ব-১৭ থেকে ১৯ দ্রুততার সাথে খেলে ফেলে ‘এ’ দলে ভারত সফরেও চলে গেলেন। ভারতে গিয়ে প্রতিটি ম্যাচেই গতির ঝড় তুলেছিলেন, মরা উইকেটেও কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের। এর মধ্যে মুম্বাইয়ে একজন ব্যাটসম্যানের হেলমেটের গ্রিল ভেঙে ফেলেন। যা দেখে তারা ঠাট্রা করে বলে ফেলেছিল,

‘তোমরা কৌশিককে আমাদের দিয়ে দাও, প্রয়োজনে এখান থেকে ব্যাটসম্যান নিয়ে যাও।’

সেই সফরেই ভারতের তখনকার প্রভাবশালী ক্রিকেট প্রশাসক ও জাতীয় দলের নির্বাচক কমিটির চেয়ারম্যান চন্দ্রকান্ত গুলাবরাও বোর্দে, ওরফে চাঁদু বোর্দে মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে বাংলাদেশি একটা ছেলের গতির ঝড় তোলা দেখে ভীষণ উত্তেজিত হয়ে যান। হঠাৎ দেখলেন, ঐ ছেলেটির একটা বল ব্যাকফুটে খেলতে গিয়ে গতিতে পরাস্ত হয়ে একজন ব্যাটসম্যান উইকেটেই উল্টে পড়ে গেল। এরপর তিনি সেই দলের ম্যানেজার দীপু রায় চৌধুরীকে খুঁজে বের করে জানতে চাইলেন ছেলেটি সম্পর্কে। উনি মাশরাফির নাম বলার পর বোর্দে বললেন, 

‘তোমরা অনেক বড় সম্পদ পেয়ে গেছ। এই ছেলে একদিন বিশ্ব কাঁপাবে।’

যেকোনো সম্পদকেই যদি অতি-ব্যবহার করা হয়, তাহলে সেটা একসময় ক্ষয়ে যাবে, কমে যাবে এর কার্যকারিতা। এই সহজ সত্যটা তৎকালীন বাংলাদেশ জাতীয় দলের ম্যানেজমেন্ট বোঝেনি, অথবা বুঝেও না বোঝার ভান করেছিল। অ্যান্ডি রবার্টস ১৭-১৮ বছরে প্রথম শ্রেণির কোনো ম্যাচ না খেলিয়ে মাশরাফিকে টেস্ট বা জাতীয় দলে না খেলানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন। আবার এ-ও বলেছিলেন, যদি বিশেষ কোনো প্রতিভা হয়, তাহলে খেলানো যেতে পারে। তবে অবশ্যই যেন তার সঠিক যত্ন নেয়া হয়, এবং সতর্ক থাকা হয়।

ভারতের বিপক্ষে ‘এ’ দলে খেলে আসার পর পিঠে হালকা ব্যথা ছিল। সেটা ভালোভাবে রিকভার না করিয়েই তাকে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্ট ও ওয়ানডে খেলানো হলো। গতির ঝড় তুলে দারুণ বল করলেন সিরিজজুড়েই। ভালো বল করায় তাকে অতিরিক্ত বল করানো হচ্ছিল প্রতিটি ম্যাচেই। ব্যথাটা আরেকটু বাড়ে ঐ সিরিজশেষে। তবু তাকে নিয়ে যাওয়া হলো নিউ জিল্যান্ড সফরে। প্রথম টেস্টে অনেক বল করানো হয়। ভালো করছিলেন বলে লম্বা স্পেলে বল করানো হচ্ছিল। ব্যথা আরও বাড়ে তাতে। দ্বিতীয় টেস্টে তাকে না খেলানোর পরিকল্পনা হয়, বিশ্রাম দেয়ার কথা মিডিয়াতেও আসে। কিন্তু তখনকার কোচ ট্রেভর চ্যাপেল ও ফিজিও জন গ্লস্টারের ইচ্ছাতেই খেলানো হয়। ফলে সে টেস্টেই জীবনে প্রথমবারের মতো ইনজুরিতে পড়েন। পিঠের ইনজুরিতে পড়ে দেশে চলে আসেন।

এখনকার সময় যেভাবে একজন ক্রিকেটারের যত্ন নেয়া হয়, ইনজুরিতে আক্রান্ত হলে পুনর্বাসনে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করা হয়, সে সময় এরকম করা হতো না। নইলে তালহা জুবায়েরের মতো গতিতারকা, তারেক আজিজের মতো পেসার ইনজুরিতে হারিয়ে যেতেন না। শুধু মাশরাফি বলেই হয়তো তখন তাকে ব্যাঙ্গালুড়ুতে পাঠানো হয়। সেখান থেকে ফিরে নড়াইলের বাড়িতে বসে পুনর্বাসনের কাজ শুরু করেন। ডাক্তারের কথামতো বিভিন্ন ব্যায়াম-স্কিপিং করেন। কিন্তু কে জানতো, এই স্কিপিংই যে কাল হয়ে যাবে তার জন্য?

ইনজুরি বারবার কেড়ে নিয়েছে ম্যাশের সোনালি সময়; Image Courtesy: Getty Images

একদিন স্কিপিং করছিলেন, হঠাৎ দড়ি পেঁচিয়ে যায় পায়ে। পড়ে যান তিনি। কট করে একটা শব্দ হয়, আর ব্যথায় কুঁকড়ে যান। সবাই ছুটে আসেন। কিছুক্ষণ পর একটু ভালো লাগে, সবাই ভুলে যান ব্যথার কথাটা। ভাবেন, কিছুই হয়নি। কিন্তু মাশরাফি মাঝে মাঝে হাঁটুতে ব্যথা টের পান। পরেরবার পিঠের ব্যথার ফলোআপ করাতে ব্যাঙ্গালুড়ুতে গিয়ে ডাক্তারকে ব্যথাটার কথা বলেন। ডাক্তার এমআরআই করান। এমআরআই রিপোর্টেই আসে দুঃসংবাদটা, এক হাঁটুর লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেছে তার।

লিগামেন্ট কী, তা তখন না জানলেও জেনেছিলেন, অপারেশন করতে হবে। এটা ঠিক করার একমাত্র উপায় হলো সার্জারি। কিন্তু সার্জারিতে তখন তার অনেক ভয়। দেশ থেকে বাবা উড়ে যান। হয়ে যায় সার্জারি। দেশে ফিরে আবারও পুনর্বাসন প্রক্রিয়া, আবারও খেলায় ফিরে আসার প্রতীক্ষা। সেই যে শুরু হয়েছিল, এরপর এভাবেই চলতে থাকে। মোট সাতবার দুই হাঁটুতে মেজর অপারেশন হয়, প্রতিবারই সবাইকে অবাক করে দিতে দুর্দান্ত প্রতাপে ফিরে আসেন। ঠিক যেন ফিনিক্স পাখির মতো। যে ডাক্তার তার একটা বাদে বাকি সবগুলো অপারেশন করেছেন, সেই অস্ট্রেলিয়ান ডেভিড ইয়াং পর্যন্ত এই ফিনিক্স পাখির অদ্ভুত জীবনীশক্তি দেখে মুগ্ধ হয়ে যান। তাকে অনুপ্রেরণার অপার উৎস হিসেবে মনে করেন।

মাশরাফি যখনই ক্যারিয়ারে অসাধারণ সব বল করতে শুরু করেন, পূর্ণতার কাছাকাছি চলে যান, তখনই ফনা তুলে ছোবল মারে ইনজুরি নামক বিষাক্ত সাপ। বিশেষ করে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্টে ২০০৩ সালে দারুণ বল করার পর কিংবা টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে প্রথম টেস্টে খেলতে নেমে ২০০৯ সালে মাত্র দ্বিতীয় দিনেই যখন ইনজুরিতে পড়ে সিরিজ শেষ হয়ে যায়, এবং দেশের মাটিতে অনুষ্ঠিতব্য ২০১১ বিশ্বকাপের দল থেকে বাদ পড়ে যান, তখন প্রথমবারের মত প্রকাশ্যে কেঁদে ফেলেন মানসিকভাবে ভীষণ শক্ত মানুষটা। মিডিয়ায় তার কান্নারত ছবি আসার পর দেশের কোটি ক্রিকেটভক্ত অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন।

দেশের মাটিতে নিজেদের ম্যাচগুলো হওয়ায় সে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের কোয়ার্টার, এমনকি সেমিতে খেলারও সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু ৫৮ ও ৭৮ রানে দুটো ম্যাচে অলআউট হওয়ার লজ্জা বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে দেয় টাইগারদের। মাশরাফি থাকলেই এই অবস্থা হতো কি না, বলা যায় না। তবে মাশরাফির উপস্থিতি যেভাবে পুরো দলকে ঐক্যবদ্ধ করে, বদলে দেয় সবার শরীরি ভাষা তাতে আশা তো ছিলোই যে তিনি থাকলে হয়তো আরও ভালো রেজাল্ট হতো। তখনকার অধিনায়ক সাকিব আল হাসান নিজেই একটা সাক্ষাৎকারে ‘মাশরাফি কেমন মানুষ’ এই প্রশ্নের উত্তরে বলেন,

‘ওয়ান অফ দ্য গ্রেটেস্ট মোটিভেটর। যেকোনো পরিস্থিতিতে একটা দলকে, কোনো একটা গ্রুপকে কীভাবে চাঙা রাখা যায়, সেটা ওনার চেয়ে ভালো কেউ জানে না। ওনার আশেপাশে থাকা মানেই উনি আপনাকে ফুরফুরে করে রাখবেন’।

২০১৫ বিশ্বকাপ থেকে ফেরার সময় বিমানবন্দরে সংবর্ধনায়; Image Courtesy: AFP

বারবার ইনজুরির থাবা তার সেরা সময়গুলো কেড়ে নিয়েছে, কমিয়ে দিয়েছে তার বলের গতিও। তবু তিনি ফিরে এসেছেন বারবার। ইনজুরি তাকে টেস্ট খেলার জন্য ‘আনফিট’ করে দিলেও নিয়তি তাকে আবারও অধিনায়ক করে একটা দলকে বদলে দেয়ার দায়িত্ব দিয়ে দেয়। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ দলটি যখন হারের বৃত্তে চলে গিয়েছিল আবারও, ক্লোজ ম্যাচ, এমনকি নিশ্চিত অনেক জেতা ম্যাচও হারছিল দল, ভারতের দ্বিতীয় সারির দলকেও হারাতে পারছিল না, তখন আবারও তাকে সীমিত ওভারের ক্রিকেটের জন্য দায়িত্ব দেয়া হয় অধিনায়কত্বের। তার দারুণ নেতৃত্বে বদলে যায় দলটি। ঘরের মাঠে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। বিদেশেও কমবেশি সাফল্য পায়।

গতি কমে গেলেও কৌশলী বোলিংয়ে নিজেও সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন দলকে। অনেকে ‘অধিনায়ক কোটায়’ খেলার অভিযোগ তুললেও পরিসংখ্যান বলছে, তার অধিনায়কত্বের সময়ে মোস্তাফিজ ছাড়া আর তার চেয়ে আর বেশি উইকেট কেউ নিতে পারেননি। এমনকি অধিনায়ক হিসেবে ১০০ উইকেট নেয়ার বিরল কৃতিত্বও দেখান তিনি। এর আগে বিশ্বে মাত্র চারজন বোলার এই অর্জন করতে পেরেছিলেন। শুধু তাই নয়, এখনও ওয়ানডেতে দলের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারী (২৭০) তিনিই। স্পিননির্ভর একটা দলের জন্য যা বিস্ময়কর বটে!

২০১৯ বিশ্বকাপের আগেও তার অধিনায়কত্বের সময়কালে বাংলাদেশের সেরা পেসার তিনিই ছিলেন, পরিসংখ্যান অন্তত তাই বলে। শুধু বোলিং নয়, ব্যাটেও তিনি অনেক ম্যাচ জিতিয়েছেন দলকে। তার গুরুত্বপূর্ণ সময়ে খেলা ছোট ছোট ক্যামিও ইনিংস অনেকবারই উদ্ধার করেছে টাইগারদের। শুধু পরিচর্যার অভাবে আর ইনজুরির ভয়াল থাবায় বাংলাদেশ একজন সত্যিকারের অলরাউন্ডার থেকে বঞ্চিত হয়েছে এটা বলাই যায়। অনেক ক্রিকেটপ্রেমীর মত এটা নিয়ে এখনও আফসোস করেন হাবিবুল বাশার ও সাকিব আল হাসানের মতো ক্রিকেটারও। যাই হোক, বিশ্বকাপে আট ম্যাচে এক উইকেট পাওয়া তাকে নিয়ে সমালোচকদের হাতে নতুন করে অস্ত্র তুলে দেয়। শুরু হয় সমালোচনা। অনেকে অবসরের দাবিও তুলে ফেলে।

তিনি বরাবরই চুপ ছিলেন। এবার জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে তিন ওয়ানডে সিরিজের সময় সংবাদ সম্মেলনে এক সাংবাদিকের অবসর-সংক্রান্ত প্রশ্ন ও উইকেট না পাওয়া নিয়ে খোঁচায় বিব্রত হন তিনি। কড়া ভাষায় তার উত্তর দেন। এরপরের ম্যাচেই বলে দেন, সিরিজের তৃতীয় ওয়ানডেটি অধিনায়ক হিসেবে তার শেষ সিরিজ। একজন প্লেয়ার হিসেবে শুধু খেলা চালিয়ে যাবেন। এর আগে বিসিবির কেন্দ্রীয় চুক্তি থেকেও স্বেচ্ছায় নিজের নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন, নতুনদের জায়গা দিতে ও বোর্ডকে উন্মুক্ত চিন্তা করতে তখন দৃষ্টান্ত দেখিয়েছিলেন। ওয়ানডেতে এবার অধিনায়কত্ব ছাড়লেও টি-টোয়েন্টিতে ছেড়েছিলেন ২০১৭ সালের শ্রীলঙ্কা সফরে। যাই হোক, এখন থেকে মাশরাফি শুধুই একজন বোলার, সেই শুরুর দিনগুলোতে যেমন ছিলেন। তবে তখনকার মাশরাফি এমনই গতিদানব ছিলেন যে, তাকে দল থেকে বাদ দেয়ার চিন্তাও করেনি কেউ। এখনকার মাশরাফিকে শুধুই বোলার হিসেবে দলে রাখা হবে কি না, তা সময়ই বলে দেবে।

পাগল ভক্তরা মাঠে ঢুকে পড়ার পর নিরাপত্তাকর্মীদের কাছ থেকেও এভাবেই আগলে রাখেন; Image Courtesy: AFP

এ তো গেল ক্রিকেটার মাশরাফির কথা। মানুষ মাশরাফির কথাও একটু বলা দরকার। আসলে ব্যক্তি মাশরাফি ক্রিকেটার মাশরাফির চেয়ে কোনো অংশে কম নন। বিশেষ করে তার পাহাড়সমান ব্যক্তিত্ব, অসাধারণ চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গি, দেশ-সমাজ-মানুষ নিয়ে তার ভাবনাগুলো শুরু থেকেই অসাধারণ। বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে আমরা সেটার প্রতিফলন দেখতে পাই। তিনি দেশকে নিয়ে, তার এলাকা নড়াইলকে নিয়ে অনেক বেশি ভাবেন। সে অর্থে ক্রিকেটকে নিয়েই ভাবেন কম। ক্রিকেট তার কাছে স্রেফ একটা খেলা, বিনোদনের মাধ্যম। ক্রিকেটকেই জীবনের সব কিছু মনে করেন না কখনোই। তার রুটিরুজিটা ক্রিকেট বলেই খেলাটার প্রতি ভাবাবেগ আছে বটে, তবে ক্রিকেটারদের চেয়ে সমাজের অন্য পেশাজীবীদের বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন তিনি। ক্রিকেটারদের হিরোও মনে করেন না। তিনি বলেন

‘খেলা কখনো দেশের প্রধান আলোচনার বিষয় হতে পারে না। দেশে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আছে, যা সমাধান বাকি। সেখানে ক্রিকেট নিয়ে পুরো জাতি, রাষ্ট্র; সবাই এভাবে এনগেজ হয়ে পড়তে পারে না। আজকে আমাদের সবচেয়ে বড় তারকা বলা হচ্ছে, বীর বলা হচ্ছে, মিথ তৈরি করা হচ্ছে। এগুলো হলো বাস্তবতা থেকে পালানোর ব্যাপার।’

তাহলে তারকা কারা? তিনি বলেন,

‘তারকা হলেন একজন ডাক্তার। আমি ক্রিকেটার একটা জীবন কি বাঁচাতে পারি? পারি না। ডাক্তার পারেন। কই, দেশের সবচেয়ে ভালো ডাক্তারের নামে কেউ তো হাততালি দেয় না। তাদের নিয়ে মিথ তৈরি করুন, তারা আরও পাঁচজনের জীবন বাঁচাবেন। তারকা হলো লেবাররা, দেশ গড়ে ফেলছে। ক্রিকেট দিয়ে আমরা কী বানাতে পারছি? একটা ইটও কি ক্রিকেট দিয়ে তৈরি করা যায়? একটা ধান জন্মায় মাঠে? জন্মায় না। যারা ইট দিয়ে দালান বানায়, যারা কারখানায় আমাদের জন্য এটা-ওটা তৈরি করে, যারা ধান জন্মায়, তারা হলো তারকা।’

দেশপ্রেমের সংজ্ঞাটাও তার কাছে অন্যরকম। তিনি বলেন,

‘কেউ যদি রাস্তায় একদিন কলার খোসাটা না ফেলত, ট্রাফিক আইন মেনে চলত, রাস্তায় থুতু না ফেলত, তাহলে দেশটা বদলে যেত। দেশপ্রেম হলো যে যার জায়গা থেকে নিজের কাজটা সঠিকভাবে করে যাওয়া। আমরা অনেকেই বিদেশে গেলে আইন মানি, দেশে এলেই মানি না। তার মানে, আমরা নিজের দেশের চাইতে অন্য দেশকে বেশি ভালোবাসি।’

দেশ, রাষ্ট্র, সমাজ নিয়ে এমন অসাধারণ ভাবনাগুলো ব্যক্তি মাশরাফির অনন্যতার সাক্ষ্য দেয়।

অনেক ভক্ত আবেগে তাকে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথেও তুলনা করে। এটা নিয়েও তার ঘোর আপত্তি। তার মতে, মুক্তিযোদ্ধারা রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বীর।

‘তারা গুলি খাবে জেনেও, মরবে জেনেও যুদ্ধে গেছেন। আমরা তো খেলি, টাকা নিই। মুক্তিযোদ্ধারা কোনো লাভের আশায় যুদ্ধে যাননি। এক্ষেত্রে ক্রিকেটে বীর হলেন রকিবুল হাসান, শহীদ জুয়েলরা।’

তবে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে তিনি অনুপ্রেরণা নেন। সাতবার মেজর সার্জারির পরও খেলা চালিয়ে যাওয়া ক্ষেত্রেও সেই অনুপ্রেরণা কাজ করে তার। মুক্তিযোদ্ধারা যদি গুলি খেয়ে, পঙ্গু হয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতেও যুদ্ধ করতে পারেন, তিনি কেন অপারেশনের কারণে দেশের প্রতিনিধিত্ব ছেড়ে দেবেন?

নির্বাচনী গণসংযোগ; Image Courtesy: Ariful Islam Roney

২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন৷ এতে তার ভক্তদের একাংশের ক্ষোভ আছে, কেন তিনি দলীয় রাজনীতিতে জড়ালেন। অথচ রাজনীতি নিয়ে তার অবস্থান পরিস্কার। তিনি মনে করেন, এই দেশটাকে বদলালে একমাত্র রাজনীতিবিদরাই বদলাতে পারবেন। কারণ, তারাই দেশ পরিচালনা করেন। এই দেশ, তার নিজের শহর নড়াইলকে বদলে দিতে চান তিনি। এজন্যই তার জনপ্রতিনিধি হওয়া।

আমরা সবসময় বলি, রাজনীতিতে সততা নেই। অথচ সৎ লোক রাজনীতিতে এলে আমরা স্বাগত জানাতে পারি না। দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে দেশের কথা ভাবতে পারি না। মাশরাফির রাজনীতিতে আসার কারণে যারা নেতিবাচক কথা বলছেন, তাদের মনে রাখা উচিত, এই মাশরাফিই বিপিএলে রংপুরকে শিরোপা জেতানোর পর বোনাসের পাঁচ কোটি টাকা ফ্র‍্যাঞ্চাইজির কাছ থেকে না নিয়ে নড়াইল হাসপাতালের জন্য একটা অ্যাম্বুলেন্স চেয়েছিলেন। মাশরাফি লোভ কিংবা ব্যক্তিগত লাভের কাঙাল নন। তার রাজনীতি হবে একান্তই মানুষের কল্যাণের জন্য, এটাই আমাদের বিশ্বাস।

দেশে অনেক অধিনায়ক আসবেন, অনেক সাফল্যেও ভাসবে দেশের ক্রিকেট। কিন্তু ‘ক্যাপ্টেন ফ্যান্টাস্টিক’ মাশরাফিকে পাওয়া যাবে না আর। ভয়ডরহীন ক্রিকেট ও বড় দলগুলোকে নিয়মিত হারানো যিনি শিখিয়েছিলেন, সবার মাঝে বিশ্বাসের বীজ বুনে দিয়েছিলেন যে, আমরাও পারি, সেই ‘অধিনায়ক’ মাশরাফি বিদায় নিয়েছেন। ‘ক্রিকেটার’ মাশরাফিও বিদায় নেবেন একসময়। কিন্তু ব্যক্তি মাশরাফি, প্রতিষ্ঠান মাশরাফি ফিনিক্স পাখির মতো বারবার ফিরে আসবেন। ভূমিকাটা বদলে গেলেও দেশকে সাফল্যে ভরিয়ে দেয়ার ক্ষুধাটা তার কখনোই যাবে না। যেভাবে বারবার ইনজুরির ছোবল থেকে মুক্ত হয়ে ক্রিকেটে ফিরে এসেছেন, সেভাবে আবারও অন্য কোনো ভূমিকায় আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন, এটা বলাই যায়।

Mashrafe Bin Mortaza is a great Bangladeshi cricketer and greatest ever captain. He is one of the most popular athletes in Bangladesh. Recently he is said goodbye from his captaincy against Zimbabwe in Sylhet. This story is about his cricket and life.

Featured Image: icetoday.net

Related Articles