Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মাশরাফি বিন মুর্তজা: ঢাকা লিগের শেষ আলোটুকুও কেড়ে নিয়েছিলেন যিনি

পুরস্কার বিতরণী শেষ। সমর্থকদের ভিড়ের মাঝে একটুখানি জায়গা রয়েছে, তার মধ্যে দিয়ে লাইন দিয়ে ড্রেসিংরুমের দিকে হাঁটছেন ক্রিকেটাররা। কেবল ব্যতিক্রম মাশরাফি বিন মুর্তজা। তিনি জায়গাটা পার হতেই যেন মানুষের ‘যানজট’ লেগে গেল! ওখানেই সেলফি শিকারি আর শুভেচ্ছাবাণী গ্রহণ করতে গিয়ে আটকে গেলেন। এ যেন খ্যাতির বিড়ম্বনার চেয়েও বেশি কিছু। গতিক সুবিধের না দেখে কর্তব্যরত পুলিশ, টিমের ম্যানেজার ও কর্মকর্তারা মিলে মাশরাফিকে একরকম টেনেহিচড়ে নিয়ে গেলেন ড্রেসিংরুম পর্যন্ত। দূর থেকে দেখলে মনে হবে কোনো দাগী আসামীকে ভিড় থেকে বাঁচিয়ে কারাগারে নেওয়া হচ্ছে। আসলেও তাই। তবে ভিড়টা তার সমর্থকদের, দাগী আসামী নন মাশরাফি; সবার প্রিয় তিনি।

বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) তিন নম্বর মাঠে লিগেন্ডস অব রূপগঞ্জের বিপক্ষে জয় তুলে নিয়ে ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশনের শিরোপা জিতেছে মাশরাফিদের আবাহনী লিমিটেড। দেশের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ এই ঘরোয়া টুর্নামেন্টের আবেদন এখনও খানিকটা বেঁচে আছে, তা মাশরাফি-নাসিরদের ম্যাচ দেখে অন্তত টের পাওয়া যায়। আর মাশরাফি? এই লিগে নতুন করে আলোচনার  বিষয় হয়ে উঠেছেন। যেখানে নিজেও ক্যারিয়ারকে আর বেশিদূর দেখছেন না, সেই লোকটিই ভেঙ্গেচুরে ফেলেছেন লিগের সব অতীত রেকর্ড! এক মৌসুমে হয়েছেন লিগের সর্বোচ্চ শিকারি। ১৬ ম্যাচে নিয়েছেন ৩৯ উইকেট যা আগে কেউ কখনও ঢাকা লিগে পায়নি। মাশরাফির এমন কৃতিত্বে সবাই খুশি, আনন্দিত, অবাক আর আপ্লুত।

কিন্তু মাশরাফি? আঙুলের কড়ে গুণে উইকেটের সংখ্যায় সন্তুষ্টি খুঁজতে আসেননি তিনি। নিজে যেটা চেয়েছিলেন, সেটাই করতে পেরেছেন। সেই চাওয়াটা কী? সেটা হলো কেবলই বোলার হিসেবে খেলতে চাওয়া। পেরেছেন দেশের অন্যতম জনপ্রিয় এই ক্রিকেটার, বাংলাদেশ জাতীয় দলের সফলতম ওয়ানডে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা। তার সফলতায় যেটা সঙ্গী ছিলো, তার নাম ভাগ্য।

মাশরাফি, আবাহনীর জার্সিতে; Source: Daily Star

মাশরাফি টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর নিয়েছেন। ইনজুরি শঙ্কার দায় দিয়ে টেস্টেও খেলানো হয় না তাকে। যদিও মাশরাফি সাদা পোশাকের আন্তর্জাতিক ম্যাচে ফিরতে গেল কয়েক বছর ধরেই মুখিয়ে আছেন। এমনকি নিদাহাস ট্রফিতে যখন মাশরাফিকে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে অবসর ভাঙবার অনুরোধ করা হলো, তিনি রাজি হননি। বলেছিলেন, টেস্ট খেলতে চান।

সে কারণেই কিনা গেল বছরে দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানের পর জাতীয় লিগে খেলতে নেমেছিলেন মাশরাফি। এ বছরের শুরুতে ঘরের মাটিতে জিম্বাবুয়ে-শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ত্রিদেশীয় সিরিজে বাংলাদেশকে ফাইনাল পর্যন্ত নিয়েছিলেন। সেখানে শিরোপা জিততে না পারার আক্ষেপ এখনও পোড়ায় তাকে। এরপর সেই ঘরের মাঠেই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট শুরু হলো, টি-টোয়েন্টিও হলো। একই সঙ্গে পর্দা উঠলো ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগের। ‘প্লেয়ার ড্রাফট’ পদ্ধতিতে মাশরাফিকে প্রথমে দলে টেনেছিল ঢাকা লিগে প্রথম নাম লেখানো শাইনপুকুর। কিন্তু পরবর্তীতে আবাহনী লিমিটেড তাকে দলে টানে ‘প্লেয়ার এক্সচেঞ্জ’ পদ্ধতিতে। আকাশি-হলুদ জার্সিতে তার হাতেই নেতৃত্ব দিতে চেয়েছিল টিম ম্যানেজমেন্ট। কিন্তু রাজি হননি তিনি। পরবর্তীতে দায়িত্ব দেওয়া হয় নাসির হোসেনের কাঁধে। কিন্তু অধিনায়ক না হয়েও সব আলোচনা, সব আলোটুকু নিজের দিকে পুরো টুর্নামেন্টে টানতে পেরেছিলেন মাশরাফি; নিজের বোলিং, নিজের ব্যাটিং দিয়ে।

মাশরাফি যখনই ক্যারিয়ারের খারাপ সময় কাটিয়েছেন, তাকেও ছাড় দেওয়া হয়নি। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) থেকেও যেমন অদৃশ্য চাপ থাকতো, এমনকি সমর্থকদের মধ্যেও উঠতো বাঁকা গুঞ্জন। সমালোচনাও কম হয়নি। সেটার প্রমাণ পেতে খুব বেশিদূর যেতে হয় না। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) যে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সকে শিরোপা জিতিয়েছিলেন, সেই দলের হয়েই পরের বছর ব্যর্থ হয়েছিলেন। তখন চারিদিক থেকে কটু কথা শেলের মতো এসে বিঁধেছিল মাশরাফির গায়ে। তখন জাতীয় দলেরই এক জ্যেষ্ঠ ক্রিকেটার খুব আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘মাশরাফিরও নিন্দুক আছে! এ তো ভাবাও যায় না’।

জাতীয় দলেও বারবার সুর উঠেছে, ‘অধিনায়ক কোটায়’ খেলেন মাশরাফি। যোদ্ধাদের মতো সেই নিন্দার মুখে ছাই দিয়ে কখনও ব্যাটিং দিয়ে জবাব দিয়েছেন। আর প্রতিটা ম্যাচে বোলার হিসেবে নিজেকে আরও একটু ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন এই ‘নড়াইল এক্সপ্রেস’। গতি কমেছে বটে, কিন্তু ধারটা আগের চেয়েও শাণিয়েছেন, শাণিয়ে যাচ্ছেন।

হয়তো তারই ধারাবাহিকতায় আবাহনীর অধিনায়কত্ব নিতে চাননি। ব্যাপারটি খোলাসা হতে এ প্রসঙ্গে তার কাছে প্রশ্নও তোলা হয়েছিলো। সমর্থকদের ভিড় কাটিয়ে তখন মাশরাফি ড্রেসিংরুমের এক পাশে চেয়ারে বসে হাঁপাচ্ছিলেন। তার মধ্যেই সাংবাদিকদেরকে উত্তর দিলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে কোনো কারণ নেই। একটু রিল্যাক্স থাকার জন্য। সত্যি কথা বলতে খেলাতে মন বেশি দিতে অধিনায়কত্ব করিনি। আমি জানতামই না ১৬টা ম্যাচ খেলবো। অধিনায়কত্ব করলে মাঠে অনেক কিছু করতে হয়। এই কারণে আমি রিল্যাক্স থেকে বোলিংটা উপভোগ করতে চেয়েছি। ক্যাপ্টেন্সি করতে গেলে ব্যাটিং, ফিল্ডিং সেটাপ আবার বোলিং; সবদিকে দেখতে হয়। এবার চেষ্টা করেছি বোলিংটা দেখতে। শুধু বোলিংটাকেই ফোকাস করতে চেয়েছি।’

নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা প্রতি কদমে; Source: Walton

কিন্তু না চাইলেই কি তা পেরেছেন? নিয়মিত অধিনায়ক নাসিরকেও পদে পদে পরামর্শ দিতে হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে অধিনায়কের দায়িত্ব নিতে হয়েছে। অর্থাৎ, অধিনায়ক না হয়েও তাকেই রণপরিকল্পনা করতে হয়েছে। তাকেই অধিনায়কের ‘অধিনায়ক’ হতে হয়েছে। তারপরও চেষ্টা করেছেন নাসিরকে দিয়েই সবকিছু করাতে।

এ প্রসঙ্গে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর মাশরাফি বলেন, ‘আমি চেয়েছি নাসিরই অধিনায়কত্বের বেশিরভাগ জিনিসগুলো করুক। যখন খুব প্রয়োজন হয়েছে, তখন আমি করেছি। আমি একটু রিল্যাক্স থাকতে চেয়েছি।’

এই ‘রিল্যাক্স’ থাকাটা কাজে দিয়েছে মাশরাফির জন্য। বল হাতে আবাহনীর হয়ে সবগুলো ম্যাচে মাঠে নেমেছেন। মোট ১২৮.৫ ওভার বল করে খরচ করেছেন ৫৭০ রান। ওভার প্রতি রান খরচের গড় ৪.৪২। নিয়েছেন ৩৯ উইকেট। চার উইকেট নিয়েছেন দুই ম্যাচে, পাঁচ উইকেটও নিয়েছেন দুই ম্যাচে। এই আসরেই মাশরাফি প্রথম হ্যাটট্রিক পেয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, ওই হ্যাটট্রিকের পরের বলেও উইকেট নিয়েছেন। অর্থাৎ, চার বলে চার উইকেট! বাংলাদেশি কোনো বোলার হিসেবে লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে এটাই প্রথম। বোলার হিসেবে মাশরাফির পরের অবস্থানে থাকা বাঁহাতি স্পিনার লিজেন্ডস অব রূপগঞ্জের আসিফ হাসান। মাশরাফির সমান ম্যাচ খেলে তিনি নিয়েছেন ২৯ উইকেট। একই দলের পেসার মোহাম্মদ শহীদও নিয়েছেন ২৯ উইকেট। প্রাইম দোলেশ্বর স্পোর্টিং ক্লাবের পেসার ফরহাদ রেজারও একই অবস্থা। ১৬ ম্যাচে ২৯ উইকেট। অর্থাৎ, মাশরাফির পরের তিনজন বোলারই পেয়েছেন ২৯ উইকেট করে।

এত সাফল্যের কারণ মাশরাফি ঢাকা লিগকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলছেন না বলে সব মনোযোগ এখানে ঢেলে দিয়েছিলেন। তার ভাষায়, ‘আমি নিজেকে পুরো ফোকাস রেখেছিলাম। কারণ আমি জানি আমি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলছি না। এই কারণে পুরো লিগেই আমার ফোকাস ছিলো। এর বাইরে শৃঙ্খল ছিলাম। নিয়মিত জিম করেছি, প্রয়োজনীয় অনুশীলন করেছি। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারগুলোও মেনে চলেছি। উইকেটের জায়গায় নিজেকে ভাগ্যবান বলতে হবে। কারণ উইকেট নিয়ে আমি ভাবিনি’।

বোলার মাশরাফি; Source: BCB

বয়স এখন সাড়ে ৩৪। অনেক ক্রিকেটারই এই বয়সে ক্যারিয়ারের শেষ দেখেছেন। মাশরাফি এখনও আন্তরাজতিক ক্রিকেট খেলে যাচ্ছেন দাপটের সঙ্গে। দুই হাঁটুতে সাতবারের অস্ত্রোপচার মিলিয়ে সবকিছু সহজ নয়। জাতীয় দলের ওপেনার তামিম ইকবাল তার সতীর্থ মাশরাফির এমন পারফরম্যান্স দেখে অবাক হন। ছোটদের জন্য উদাহরণ মানতে বলেন।

ঢাকা লিগে মাশরাফির পারফরম্যান্স নিয়ে তামিম বলেছেন,  ‘উনি (মাশরাফি) প্রায় উনার ক্যারিয়ারের শেষ দিকে। এমন সময়ে এসে এরকম পারফরম্যান্স করা সহজ নয়। এটাই প্রমাণ করে উনি ঘরোয়া লিগকেও কতটা গুরুত্ব সহকারে নিয়েছেন। উনি যদি পাঁচ বা দশভাগেরও কম দিয়ে খেলতেন, তাহলে এই অর্জন তিনি পেতেন না। যারা তাকে আদর্শ মনে করেন, বা বাংলাদেশ দলের বোলার হতে চান তাদের জন্য মাশরাফির এই পারফরম্যান্স একটা অসাধারণ উদাহরণ’।

তামিমের খুনসুটির শিকার মাশরাফি; Source: AFP

জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ও বর্তমান নির্বাচক প্যানেলের সদস্য হাবিবুল বাশার সুমনের মতে, মাশরাফি বলেই এটা সম্ভব। তার চোখে মাশরাফি ‘সবসময়ই ভালো’। জাতীয় দলে মাশরাফিকে বড় একটা সময় নেতৃত্ব দিয়েছেন হাবিবুল বাশার। তাই ভালো করেই জানেন ‘পাগলা’ মাশরাফির ধার সম্পর্কে। ঢাকা লিগের এই মাশরাফিকে নিয়ে তিনি বলেছেন, ‘মাশরাফি সবসময় ভালো। এবারের লিগে ও মনে হয় সব ম্যাচ খেলেছে। এর আগে ওর বয়স কম ছিল, বেশি ইনজুরিতে পড়ত। বয়স বাড়ার সাথে সাথে ইনজুরিটা কমে আসছে। আশা করি এরকমই থাকবে ও। তবে ডেফিনেটলি অন্যদেরকে ওর কাছে শিখতে হবে। এমনিতেই মাশরাফি স্কিলের দিক থেকে অনেক এগিয়ে আছে। ওর কাছ থেকে যদি শিখতে পারে তাহলে তরুণরা অবশ্যই এগিয়ে আসবে’।

সবাই তো সব কথা বললেন। কিন্তু মাশরাফির কী ভাবনা? যাকে নিয়ে এত আলোচনা, এত ব্যবচ্ছেদ সেই রাজাধিরাজ মাশরাফি সব দায় দিচ্ছেন একটি জিনিসকেই।

‘আমি ভাগ্যে বিশ্বাস করি। কঠোর পরিশ্রম অবশ্যই দরকার। কিন্তু এখানে ভাগ্যের সহায়তাও আছে।’

ফিচার ইমেজ- Daily Star

Related Articles