Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মিনহাজুল আবেদীন নান্নু: দ্য পিপলস চয়েজ ব্যাটসম্যান

বহু আকাঙ্ক্ষিত অস্ট্রেলিয়া সিরিজ। দুটি মাত্র টেস্ট, কিন্তু অপেক্ষাটা দুই বছরের। সেই সিরিজকে নিয়ে বাংলাদেশ দল কেমন হবে সেটাও আকাঙ্ক্ষিতই। দল ঘোষণার দিন পুরো মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে সকাল থেকেই চলছিল গণমাধ্যমকর্মীদের তোড়জোড়। ইলেকট্রনিক মাধ্যমে যারা কাজ করেন, তারা তো আগেভাগেই ‘নিজস্ব দল’ লিখে রেখেছেন চিরকুটে। দুয়েকটা নড়চড় হবে। ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে পাঠিয়ে দেবেন কর্মক্ষেত্রে। কিন্তু এদিন আলোচনাটা যতটা না ছিল দল নিয়ে, ততটা বেশি ছিল মুমিনুল হককে নিয়ে। এই সিরিজের আগের সিরিজেই শ্রীলঙ্কাতে শততম টেস্টে জায়গা হয়নি তার। অথচ সাদা পোশাকের টেস্টে তিনি এককথায় ‘অটোমেটিক চয়েস’। বিকেল গড়াতেই অপেক্ষার প্রহরগুলো যেন কাটতে চাইছিল না।

অবশেষে সংবাদ সম্মেলন কক্ষে হাজির হলেন তৎকালীন কোচ চান্দিকা হাতুরুসিংহে, নির্বাচক কমিটির সদস্য হাবিবুল বাশার সুমন ও প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন নান্নু। একে একে, থেমে থেমে দল ঘোষণা করলেন নান্নু। অবাক করে দিয়ে সবাই টের পেলো, মুমিনুল হক দলে নেই! অথচ দেশের মাটিতে তার গড় তখন ৫৮.১০!

সেদিনের সেই সংবাদ সম্মেলন; Source; The new nation

সেদিনের সংবাদ সম্মেলন অনেক দীর্ঘ হয়েছিল। প্রায় ২৭/২৮টি প্রশ্ন করা হয়েছিল নান্নুদের। যার মধ্যে তিনটি বাদে সবগুলো মুমিনুল হককে নিয়ে। কয়েক দফা ধৈর্য্য হারিয়েছিলেন নান্নু। একরকম বাধ্য হয়ে পরদিন মোসাদ্দেক হোসেন সৈকতকে ইনজুরি ‘দেখিয়ে’ দলে নেওয়া হয় মুমিনুল হককে। যদিও ওই সংবাদ সম্মেলনেই তিনি জানিয়েছিলেন, মুমিনুলকে সরানোর সিদ্ধান্ত তাদের নয়, বরং কোচের। তারপরও প্রধান নির্বাচক হিসেবে একটা গুরুদায়িত্ব তার থেকেই যায়। আর এমন ঘটনা নান্নু কীভাবেই বা ভোলেন!

ঠিক ১৮ বছর আগে তাকেও যে দলে রেখেছিলো না তখনকার নির্বাচকরা! পরে চাপে পড়ে মুমিনুলের মতোই দলে ভিড়িয়েছিল। কারণ তিনি নির্বাচকদের পছন্দের নয়, বরং ছিলেন ‘পিপল চয়েজ’ ক্রিকেটার। বলা চলে, বাংলাদেশের টেস্ট না খেলা সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান। ভাগ্য ২০১৭ সালে নান্নুকে সেই একই জায়গায় দাঁড় করিয়েছিল। কেমন ছিল নান্নুর ক্রিকেট ক্যারিয়ার? আজকের নান্নু হতে গিয়ে কতটা ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে তাকে?

১.

নান্নুর ক্রিকেটীয় গল্প কিংবা তার উঠে আসার কথা বলার আগে নির্বাচক-নান্নুর সেই ঘটনাটা আগে বয়ান করা যাক। তাতে বোধ করি তাল ধরে রাখতে সুবিধা হয়। ১৯৯৯ সালে যখন প্রথমবার ওয়ানডে বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ পেল বাংলাদেশ, তখনই দলের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান নান্নুর কপালে শনি দেখা দিল। প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলার জন্য যখন দল ঘোষণা করলো নির্বাচকরা, সেখানে নাম ছিল না নান্নুর। অথচ যেদিন দল ঘোষণা করা হয়, সেদিন ছিল প্রস্ততি ম্যাচ। সেই ম্যাচে সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন নান্নু!

তারপরও রাখা হয়নি নান্নুকে। ওই সময়ে দেশের সেরা ব্যাটসম্যানকে দলে না পেয়ে রুখে দাঁড়াল সমর্থকরা। দেশ জুড়ে তাকে দলে নেওয়ার জন্য মানববন্ধন পর্যন্ত করা হল, তার নিজের এলাকা চট্টগ্রামে মিছিল পর্যন্ত হলো। পুরো দেশের গণমাধ্যম একরকম ঝড় বইয়ে দিয়েছিল নান্নুর অনুপস্থিতির কারণে। এসব দেখে বিশ্বকাপের জন্য সফরের একেবারে আগ মুহূর্তে দলে ঠাই পেলেন নান্নু।

সমর্থকদের জয় হলো, কেবল নান্নুর নিজেকে প্রমাণ করাটা বাকি ছিল। কিন্তু তাকে তো প্রথম ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে একাদশেই রাখা হলো না। তৃতীয় ম্যাচে মান-সম্মান বাঁচিয়েছিলেন এই নান্নু। সুযোগ পেয়ে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে তিনি যখন ব্যাট করতে নামলেন তখন ২৬ রান তুলতে গিয়েই ৫ উইকেট হারিয়েছে বাংলাদেশ। সেদিন ৬৮ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেছিলেন নান্নু। পরের ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে হাফ সেঞ্চুরি পেয়েছিলেন এই ক্রিকেটার।

ভাই-সতীর্থদের সঙ্গে তরুণ নান্নু। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে; Source; Flickriver

সেবার বিশ্বকাপে ডাক পেলেও প্রথম টেস্টে আর তাকে নেওয়া হয়নি। যে নান্নুর ব্যাটে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার খানিকটা হলেও শক্তি পেয়েছিল বাংলাদেশ, সেই ক্রিকেটারকে বয়সের দোহাই দিয়ে বাদ দেওয়া হলো। দুর্ভাগ্য তার, হয়তো দুর্ভাগ্য বাংলাদেশেরও। সফলতার খুব কাছে এসেও হাত ছাড়া হলো রঙিন ঝাণ্ডা।

মজার ব্যাপার হলো, নান্নু যেমন সবার আবেদনে দলে ডাক পেয়েছিলেন, সফলও হয়েছিলেন; তার নির্বাচক প্যানেলের অধীনে বাদ পড়া মুমিনুলও হেঁটেছিলেন সেই পথে। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মুমিনুলও প্রথম ম্যাচে একাদশে জায়গা পাননি। দ্বিতীয় ম্যাচে চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী ক্রিকেট স্টেডিয়ামে পরপর দুই ইনিংসে সেঞ্চুরি তুলে নিয়ে গড়েছিলেন দেশের পক্ষে নতুন রেকর্ড।

২.

নান্নুর উঠে আসা চট্টগ্রামের বিখ্যাত আবেদীন কলোনি থেকে। তার দাদা মরহুম জয়নাল আবেদীন ব্রিটিশ কর্মকর্তার নামে কলোনির নাম। শুরু থেকেই ছিলেন ক্রিড়ামোদী। চট্টগ্রামের এম এ আজিজ আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম তৈরিতে তার বিশেষ অবদান ছিল। সেই শামসুল আবেদিনের পাঁচ সন্তানের একজন শামসুল আবেদীন। ব্যাংক কর্মকর্তা ছিলেন। পাশাপাশি ক্রিকেট-ফুটবল খেলতেন। তারই তিন সন্তান, মিনহাজুল আবেদীন নান্নু, নুরুল আবেদীন নোবেল ও তৈয়ব আবেদীন।

নোবেল-তৈয়বদের কথা আরেকদিন হবে। শুধু ছোট্ট করে বলে রাখা যেতে পারে, নোবেল এখন চট্টগ্রামের বিভাগীয় কোচ। খেলেছেন জাতীয় দলে। লাল-সবুজ জার্সিতে চারটি ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছেন তিনি। সবার ছোট তৈয়বও ক্রিকেটার ছিলেন। কিন্তু মায়ের ইচ্ছে, এই সন্তানটা বিদেশে পড়বে। তাই নিজের ক্রিকেটার হওয়ার ইচ্ছা দমিয়ে যেতে হয়েছে আমেরিকায়।

এখন প্রধান নির্বাচক, তখন ছিলেন নির্বাচক প্যানেলের সদস্য। কোচ জেমি সিডন্স, ক্রিকেটার মুশফিকুর রহিম ও আকরাম খানের সঙ্গে বৃষ্টি থেকে বাঁচতে দৌড়াচ্ছেন নান্নু; Source: AFP

ওই আবেদীন কলোনিতে নান্নুর ‘নান্নু’ হয়ে ওঠা। এমনও হয়েছে যে, সেখানকার রাস্তা আটকে দিয়ে খেলেছেন দুই ইনিংসের ক্রিকেট। সেখান থেকেই প্রথম বিভাগে খেলতে যাওয়া। তারপর তো ঢাকা লিগে খেলা শুরু করলেন। আবেদীন কলোনি থেকে ওই সময়ে কেবল ঢাকা লিগেই সাতজন ক্রিকেটার মাতাচ্ছিলেন! আর নান্নু হয়েছিলেন ঢাকাই ক্রিকেটের নতুন নায়ক, সবচেয়ে জনপ্রিয়দের একজন।

২০ বছর বয়সে ওয়ানডে ক্রিকেট দিয়ে বাংলাদেশ জাতীয় দলে অভিষেক হয়েছিল নান্নুর। ১৯৮৬ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে যে যাত্রা শুরু করেছিলেন, ১৯৯৯ সালে সেই পাকিস্তানের বিপক্ষেই নিজের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছিলেন। কেবল টেস্টটাই খেলা হয়নি তার। অথচ এই দীর্ঘতর সংস্করণই ছিল তার সবচেয়ে প্রিয়। নান্নুর হয়তো আফসোস আছে, আফসোস আছে দেশের ক্রিকেটেরও।

মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধে শহীদ হয়েছিল জুয়েল-মুশতাকরা। তাদের ইচ্ছে ছিল দেশের হয়ে জাতীয় দলে খেলার। নান্নুর বাবাও ক্রিকেট খেলেছেন। সঙ্গে রাজনীতিতেও জড়িয়েছিলেন। তাই তো মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তাকে বাড়ি থেকে উঠিয়ে নিয়ে যায় পাক সেনারা। আর ফেরেননি নান্নুর বাবা। তিনিও শহীদ হয়েছেন। যে দামে পাওয়া এই দেশ, নান্নুর কাছে এই দেশের মতোই হয়তো প্রিয় ক্রিকেট। ৩ বছর বয়সে বাবাকে হারানোর যন্ত্রনা এখনও ভোগায় তাকে। তবে বাবার প্রেরণা কাজে লাগিয়ে দেশ জয় করেছিলেন। দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলেছেন। নিজের সময়ে নিজেকে নায়ক বানিয়েছেন।

বাংলাদেশের জার্সিতে ২৭ ওয়ানডে ম্যাচ খেলা নান্নুর সর্বোচ্চ ইনিংসটি ছিল বিশ্বকাপের ওই স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে অপরাজিত ৬৮ রানের ইনিংসটি। আর পরের ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে হাফ সেঞ্চুরি; এই দুটিই তার ঝুলিতে পাওয়া দুটি আন্তর্জাতিক হাফ সেঞ্চুরি। ডানহাতি ব্যাটিংয়ের সঙ্গে অফস্পিনটাও ভালোই পারতেন নান্নু। সেখানেও আছে ১৮ উইকেট।

ঘরোয়া ক্রিকেটে নিজের সময়ে তাক লাগানো ব্যাটসম্যান ছিলেন। প্রথম শ্রেণীতে ২৪ ম্যাচে ৫১.৭৮ গড়ে ১,৭০৯ রানের এই ছোট পরিসংখ্যান তার অনেকটাই প্রমাণ করবে না। অন্তত দর্শক যারা দেখেছেন, তারা জানেন নান্নু কতটা স্টাইলিশ, নিখুঁত ব্যাটসম্যান ছিলেন। এই ফরম্যাটে ডাবল সেঞ্চুরিও আছে তার। খেলেছেন ২১০ রানের ইনিংস। সেঞ্চুরি মোট ৪টি, হাফ সেঞ্চুরি ৯টি।

লিস্ট ‘এ’ ম্যাচ খেলেছেন ৬৫টি। সেখানে ১,৫৬৭ রান আছে নান্নুর। সর্বোচ্চ  ১০৯ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেছেন। সেঞ্চুরি ১টি, হাফ সেঞ্চুরি ১২টি।

নান্নু আজ নির্বাচক। নিজেকে দিয়েই হয়তো তার জন্য টের পাওয়াটা তার জন্য সহজ যে কে আসলেই যোগ্য আর কে নন। নিজে ছিলেন পিপল চয়েজ ক্রিকেটার। তাই তো তার কাছ থেকেও এমন কোনো সিদ্ধান্ত সমর্থকরা কখনই আশা করেন না, যেখানে এ যুগের কোনো পিপল চয়েজ তার কোপে জায়গা হারাবে।

ফিচার ইমেজ- Dhaka Tribune

Related Articles