কর্ণাটক রাজ্য ক্রিকেট এসোসিয়েশনের (কেএসসিএ) আমন্ত্রণে সম্প্রতি ড. কে থিম্মাপিয়া মেমোরিয়াল চারদিনের টুর্নামেন্টে খেলে এসেছে বিসিবি একাদশ। ব্যাঙ্গালোরে গত ১০ জুলাই থেকে ৬ আগস্ট পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়েছে মিনি রঞ্জি ট্রফি নামে পরিচিত এই টুর্নামেন্ট। চারটি গ্রুপে মোট ১৬টি দল অংশ নিয়েছিল।
টুর্নামেন্টের সেমিফাইনাল থেকে ছিটকে পড়েছিল বিসিবি একাদশ। মুমিনুল হকের নেতৃত্বাধীন দলটা সেমিতে ছত্তিশগড় রাজ্য ক্রিকেট সংঘের কাছে হেরে বিদায় নেয়। গ্রুপপর্বে তিন ম্যাচের একটিতে জয়, দু'টিতে ড্র করে শেষ চারে গিয়েছিল বিসিবি একাদশ। ‘বি’ গ্রুপে ডক্টর ডি ওয়াই পাতিল ক্রিকেট একাডেমি, কর্ণাটক রাজ্য ক্রিকেট এসোসিয়েশন দল ও বিদর্ভ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের বিপক্ষে খেলেছিল মুমিনুল বাহিনী।
প্রতি বছরই টুর্নামেন্ট আয়োজন করে কেএসসিএ। বেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এই আসরে ভারতের বিভিন্ন রাজ্য দলও অংশ নেয়। বিসিবি একাদশের মতোই কলকাতা থেকেও ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল দল পাঠিয়েছিল টুর্নামেন্টে।
দুই ম্যাচ খেলা তাসকিন আহমেদ, তাইজুল ইসলাম ও শহীদুল ইসলাম দুর্দান্ত বোলিং করেছেন। ব্যাটিংয়ে প্রথম ম্যাচেই ১৬৮ রানের ইনিংস খেলেছিলেন মুমিনুল। জহুরুল ইসলাম, সাদমান ইসলাম, নাজমুল হোসেন শান্ত, নুরুল হাসান সোহান বেশ ধারাবাহিক ছিলেন ব্যাট হাতে। ইয়াসির আলী রাব্বি, আরিফুল হকরাও রান পেয়েছেন। টুর্নামেন্টে একমাত্র জয়টা এসেছে কেএসসিএ সেক্রেটারি একাদশের বিরুদ্ধে। গ্রুপপর্বের শেষ ম্যাচে স্বাগতিকদের ১০ উইকেট হারিয়েছিল বিসিবি একাদশ।
ফাইনাল খেলতে না পেরে আক্ষেপে পুড়ছেন অধিনায়ক মুমিনুল। তার মতে, শুধু ফাইনাল খেলাই নয়, এই টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হওয়া উচিত ছিল বিসিবি একাদশের। তবে সেমিতে ইনজুরির কারণে দুই মূল বোলার নাঈম হাসান ও শহীদুল ইসলামকে হারানোটা ছিল দলের জন্য বড় ধাক্কা।
তবে টেস্ট ক্রিকেটার হিসেবে নিজের পারফরম্যান্সেও সন্তুষ্ট হতে পারেননি মুমিনুল। অবশ্য টুর্নামেন্টের সার্বিক সুযোগ-সুবিধা দেখে বিমুগ্ধ তিনি। তার মতে, উইকেট-কন্ডিশন, সামগ্রিক মান বিবেচনায় পরবর্তী প্রজন্মের উন্নতির জন্য বিসিবির উচিত প্রতি বছর এই টুর্নামেন্টে দল পাঠানো। ভারত থেকে ফিরে একান্ত আলাপে মিনি রঞ্জি ট্রফিতে খেলার অভিজ্ঞতা সবিস্তারে জানিয়েছিলেন মুমিনুল।
প্রথমেই জানতে চাই, কর্ণাটকে কেমন হলো আমাদের পারফরম্যান্স? ফাইনাল খেলতে না পারার আক্ষেপ কতটা? আর সার্বিক পরিবেশ কেমন ছিল ওখানে?
আমি টেস্ট প্লেয়ার হিসেবে ছিলাম, আরও অনেক টেস্ট প্লেয়ার ছিল। সেদিক থেকে চিন্তা করলে আমার মনে হয় যে, ফাইনাল খেলা উচিত ছিল, এমনকি চ্যাম্পিয়ন হওয়াও উচিত ছিল। পরিবেশ যদি বলেন, আসলে এরকম টুর্নামেন্ট আমি কখনো খেলি নাই। আমার দেখা মতে, বাংলাদেশে তো হয় না এমন টুর্নামেন্ট। খুব প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ, পেশাদার খেলা হয়। সুযোগ-সুবিধা খুব ভালো, বিশেষ করে অনুশীলনের ম্যাচের দিনের সুযোগ-সুবিধা খুব ভালো ছিল। ওরা অনেক পেশাদার, এবং আম্পায়ারিংও খুব ভালো মানের। আম্পায়ারিং এক্সট্রাঅর্ডিনারি। আমি এরকম আম্পায়ারিং দেখি নাই। আমাদের দলের ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে কথা বললেও বুঝতে পারবেন। এতো পেশাদার আম্পায়ারিং করে ওরা। ওরা এই টুর্নামেন্ট নিয়ে অনেক সিরিয়াস, অনেক প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এই টুর্নামেন্ট।
বিসিবি একাদশে আপনার মতো অভিজ্ঞ ক্রিকেটারের পাশাপাশি কয়েকজন তরুণও ছিল। ওদের পারফরম্যান্সসহ সেমিতে খেলেই কি দল তৃপ্ত?
অধিনায়ক হিসেবে আমি চ্যাম্পিয়ন হতে গেছিলাম। আমি এই টার্গেট নিয়েই গেছিলাম। যারা খেলছে, তারা হয়তো অনেকে সেমিফাইনালে খুশি। আমার কাছে মনে হয়, ফাইনাল খেলা উচিত ছিল। চ্যাম্পিয়ন না হন, অন্তত সেমিতে খেলা উচিত ছিল। আমি মনে করি, চ্যাম্পিয়ন হওয়া উচিত ছিল। আমার মতো টেস্ট প্লেয়ার ছিল। যতই বলি না কেন রঞ্জির প্লেয়ার, টেস্ট প্লেয়ার তো টেস্ট প্লেয়ারই। আমি যদি রঞ্জির দলের সঙ্গেও খেলি, আমার চিন্তা থাকতে হবে সেরা হওয়া। আমি যে টেস্ট ক্রিকেট খেলছি, রঞ্জির ক্রিকেটার তো এত টেস্ট খেলে না। ওই হিসেবে চিন্তা করলে আমাদের চ্যাম্পিয়ন হওয়া উচিত ছিল। ফাইনাল খেলা তো অবশ্যই। কারণ আমাদের দলে অনেকগুলো টেস্ট প্লেয়ার ছিল।
সেদিক থেকে এই টুর্নামেন্টে আপনার দলকে কি ৮০ ভাগ সফল বলবেন?
আমি ৮০ ভাগ বলবো না। আমার কাছে মনে হয়, আমরা ৫০ ভাগ সফল। চ্যাম্পিয়ন হওয়া অবশ্যই উচিত ছিল।
চারটি ম্যাচ খেলেছেন। অধিনায়ক হিসেবে নিজের দলে কোন কোন জায়গায় ঘাটতি দেখেছেন?
আমি যেটা ঘাটতি দেখছি, বোলিংয়ে। আমি সেমিফাইনালটাও জিততাম, কিন্তু আমার বোলার ইনজুরিতে পড়ে গেছে। দুইটা বোলার ইনজুরিতে পড়ে যায়। সেমিফাইনালের আগেই নাঈম হাসান ইনজুরিতে পড়ে। খেলা শুরু হওয়ার পর ৫ ওভার বল করে আমার মেইন বোলার শহীদুল ইনজুরিতে পড়ে যায়। মানে আমার দুইটা বোলার নাই। এমন দুইটা বোলার যখন থাকবে না, তখন অধিনায়ক হিসেবে কাজটা কঠিন হয়ে যায়। ওদের ব্যাটিং যেমন, ভাই যদি অনূর্ধ্ব-১৫ ব্যাটসম্যানও এনে দেন, দেখবেন ওদের আউট করা খুব কঠিন ভাই। ওরা টেকনিক্যালি খুব শক্ত। আমার কাছে মনে হয়, ওই দুইটা বোলার থাকলে আমি চ্যাম্পিয়ন হয়ে ফিরতাম।
টুর্নামেন্টের শুরুতেই সেঞ্চুরি পেয়েছেন। পরে আর বড় ইনিংস আসেনি। পারফরম্যান্সের বিচারে ব্যাটসম্যান মুমিনুলের অভিজ্ঞতা কেমন?
দেখেন, আমি টেস্ট, চারদিনের ম্যাচ যেখানেই খেলি, কিছু শেখার চেষ্টা সবসময় করি। আমি অনেক কিছু শিখছি। বিশেষ করে... আপনার... এসজি বলে যেটা হয়, নতুন বলের চেয়ে পুরাতন বলে চ্যালেঞ্জটা বেশি থাকে। ওই কন্ডিশনে উইকেটও ভালো থাকে, অনেক পেস-বাউন্সি উইকেট থাকে। বোলার-ব্যাটসম্যান সবার জন্যই ভালো সুযোগ থাকে। পুরো ট্রু উইকেট বলতে পারেন। ওই সময় কোন চ্যালেঞ্জ কীভাবে সামাল দিতে হবে, এসব জিনিস শিখতে পারছি।
আমার কাছে মনে হয় যে, টেস্ট প্লেয়ার হিসেবে আমার আরও দুটি সেঞ্চুরি করা উচিত ছিল। না হয় অন্তত একটা ডাবল সেঞ্চুরি দরকার ছিল। তিনটা সেঞ্চুরি বা দু'টি ডাবল সেঞ্চুরি হলে ভালো হতো। আমি একটা ডাবল মিসও করেছি। প্রত্যেকটা দলেই ওদের ৪-৫টা রঞ্জির ক্রিকেটার খেলে। আর শেষ যে ম্যাচটা খেলেছি, ওই দলে প্রায় সবাই রঞ্জির ক্রিকেটার। আমার মতো টেস্ট প্লেয়ার কিন্তু কেউ ছিল না। সেদিক থেকে আমার পারফরম্যান্স আরও ভালো হওয়া উচিত ছিল।
টুর্নামেন্টে ১৬টা দল খেলেছে। বিসিবি একাদশে কয়েকজন টেস্ট ক্রিকেটার ছিলেন আপনারা। নিশ্চিতভাবেই টুর্নামেন্টের অন্য দলগুলো সম্পর্কে ধারণা পেয়েছেন। বাকি দলগুলোর মান কেমন ছিল?
আমিও শুনলাম যে, আমরা সেমিফাইনালে খেলছি বলে, বাকি দলগুলোর মানটা নিয়ে অনেকের কাছে প্রশ্ন আছে। হয়তো ভাবছে, ওই দলগুলোর মান খুব ভালো নয়। ভারতের টেস্ট, চারদিনের ম্যাচ, বয়সভিত্তিক ক্রিকেট বলেন, ওদের খেলার মধ্যে একটা ধরন আছে, প্রতিযোগিতা আছে। যেটা অনেক সময় আমাদের টেস্ট ক্রিকেটেও দেখা যায় না। ওরা যখনই খেলে, যারাই খেলে, একটা রঞ্জির খেলোয়াড় হোক বা নতুন খেলোয়াড় হোক, এরা চারদিনের ম্যাচে সবসময় প্রতিপক্ষকে চাপের মধ্যে রাখার চেষ্টা করে। ওই জিনিসটা আমি দেখছি। আর এমন না যে, কেউ রঞ্জি খেলে নাই। আমরা প্রথম যে ম্যাচটা খেলছি, ওখানে ৫-৬টা খেলোয়াড় ছিল রঞ্জির। শেষ ম্যাচটাতে সবাই রঞ্জির। ওরা রঞ্জির প্লেয়ার। এর আগে গ্রুপে শেষ দুই ম্যাচে হয়তো একটু কম রঞ্জির প্লেয়ার ছিল। প্রত্যেক দলেই ৪-৫টা করে রঞ্জির প্লেয়ার থাকেই।
ওরা পেশাদার দল। ওদের সঙ্গে খেললে আমরা অনেক কিছু শিখতে পারবো। ওরা অনেক পেশাদার, খেলার মধ্যে সবসময় চ্যালেঞ্জ থাকে। ফিল্ডিং, ব্যাটিং, বোলিং খুব ভালো। ওদের ফিল্ডিং খুব ভালো। ভারত তো ফিল্ডিংয়ে এমনি অনেক উন্নতি করছে।
একেকটা রাজ্যের একেকটা টার্গেট থাকে। ওই হিসেবে ওরা অনেক এগিয়ে। সত্যি বলতে, ভারতীয় ক্রিকেট অনেক এগিয়ে আছে। ছোটখাটো টুর্নামেন্টের জন্য ওরা যে সুযোগ-সুবিধা দেয়, এটা অসাধারণ। আমি আমাদের সাথে তুলনা করছি না। আমি ওদেরটাই বলছি।
এখানে প্রতি বছর দল পাঠালে বাংলাদেশের ক্রিকেট কতটা উপকৃত হতে পারে?
আমার কাছে মনে হয়, এসব টুর্নামেন্ট খেললে, প্রতি বছর যদি যায়, প্লেয়াররা, বিশেষ করে ইমার্জিং প্লেয়ার যারা, তাদের জন্য অনেক ভালো এই টুর্নামেন্ট। ওখানে একেক জায়গায় একেক উইকেট। এসব জায়গায় চ্যালেঞ্জ থাকে। চিন্নাস্বামীতে একরকম উইকেট থাকে। চিন্নাস্বামীর বাইরে আরেকটা যে মাঠে খেলছি, ওখানে আরেক রকম উইকেট। আমার মতে, বাংলাদেশ যদি প্রতি বছর যায়, বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য অনেক ভালো হবে। বিশেষ করে পরের প্রজন্মের জন্য।
বিসিবি একাদশের হয়ে যারা খেলেছিলেন:
মুমিনুল হক (অধিনায়ক), নাজমুল হোসেন শান্ত, নাঈম হাসান, এবাদত হোসেন চৌধুরী, রবিউল হক, জহুরুল ইসলাম অমি, তাসকিন আহমেদ, সাদমান ইসলাম, আরিফুল হক, তাইজুল ইসলাম, ইয়াসির আলি চৌধুরী, সাইফ হাসান, নুরুল হাসান সোহান, শহিদুল ইসলাম ও সানজামুল ইসলাম।
This article is in Bangla language. This piece is Mominul Haque's interview on Mini Ranji Trophy experience. Mominul Haque is a valuable member of Bangladesh Cricket Team Test Squad.
Featured Image: Cricket Australia