চট্টগ্রামে শীত পড়েছে। সকালে কুয়াশা, সন্ধ্যায় কুয়াশা। তবে বেলা পড়ার সাথে সাথে আদুরে রোদের মাখামাখিতে সূর্যের আলোয় ঝলমল করে সাগরপাড়ের জহুর আহমেদ চৌধুরী ক্রিকেট স্টেডিয়াম। কখনও কখনও সাগরতীরের নাম না জানা বুনো পাখি গ্যালারির কোনো এক কোনে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ চোখে দেখে ২২ গজের ক্রিকেট। যেন ভেবে বসে মাঠে বোধহয় তেরটা সাদা পরী খেলতে নেমেছে। আবার এটাও হয়তো ভাবে, পরী তো মেয়ে হয়, ছেলে না। তাহলে কী নাম দেওয়া যায়? অতিথি পাখির সেই ভাবনায় বিচ্ছেদ ঘটে সমর্থকদের উল্লাসের চিৎকারে।
স্টেডিয়ামের প্রেস বক্সের ছাদ থেকে সাগরটা দেখা যায়। বিশাল বিশাল কার্গো জাহাজগুলো ঠাই দাঁড়িয়ে থাকে। দূর থেকে মনে হয় একেকটা অন্ধকার, কী ধৈর্য্য নিয়ে অপেক্ষা করছে সূর্য ডোবার!
সাদা পরী কথাটা রূপকার্থে ব্যবহার করা হয়েছে। জহুর আহমেদের টেস্ট ম্যাচগুলোতে কী যেন এক আলাদা আবেগ থাকে। তাজা তাজা একটা ভাব থাকে। সেই তাজা ভাবটা চলে আসে বাংলাদেশ দলের মধ্যেও। সে কারণেই কি না, এখানে পাঁচদিনের ম্যাচ খেলতে এলে ভালোই জমে স্বাগতিকদের।
এই মুহূর্তেও জমে উঠেছে। উইন্ডিজের বিপক্ষে চলমান টেস্টের প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশ ৩০০ রান পার করে থেমেছে। এই ৩০০ রান পার করার পেছনে নাঈম হাসান-তাইজুল ইসলামদের টেল এন্ডার জুটির যেমন কফিনে শেষ পেরেক মারার মতো অবদান আছে, তেমনই সবচেয়ে বড় কাজটা করে দিয়ে গেছে মুমিনুল হকের সেঞ্চুরি। এ নিয়ে ক্যারিয়ারের অষ্টম টেস্ট সেঞ্চুরি নিজের ঝুলিতে পুরলেন মুমিনুল, যার ছয়টিই এই চট্টগ্রামে! শুধু তা-ই নয়, চলতি বছরে এই ভেন্যুতে টানা তিন ইনিংসে সেঞ্চুরি পাওয়ার রেকর্ড গড়েছেন ২৭ বছর বয়সী এই ক্রিকেটার।
কক্সবাজারের ছেলে সৌরভ ঘরের মাঠে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট পান না। সেটা হলে হয়তো সৈকতে সুরভিত কিছু ইনিংস আসতো মুমিনুলের ব্যাটে। সেই কষ্টটা ভুলিয়ে দিয়েছে চট্টগ্রাম। সৈকত না দিলেও সমুদ্র মুমিনুলকে দিয়েছে দু’হাত ভরে।
বাংলাদেশ ক্রিকেটে সাগরপুত্র কম ছিল না। এমনকি বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল ও সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান তামিম ইকবাল এই সাগরের কোলেই জন্মেছেন, বেড়ে উঠেছেন। সেই তিনিও মায়ের কোলে ব্যর্থ। ব্যর্থতা চায় না সাগরের বিশালতা। তার বুকে একটুখানি সাফল্যের সবুজ পাতা হয়ে বেড়ে উঠেছেন মমিনুল। আর সেই মায়া জড়িয়ে গেছে সাগরের নোনা জলে, হারানো মনিহার ফিরিয়ে দিয়েছে মমিনুলের পায়ে।
১.
জানুয়ারিতেও শীত ছিল। এই বছরেই। নাটকীয়ভাবে বাংলাদেশের দায়িত্ব ছাড়ার পর চন্দিকা হাতুরুসিংহে শ্রীলঙ্কার দায়িত্ব নিলেন। প্রথম মিশন পড়লো এই বাংলাদেশে, মুমিনুলদের বিপক্ষেই। এই জহুর আহমেদ চৌধুরী ক্রিকেট স্টেডিয়ামেই সেই টেস্টের প্রথম ইনিংসে সেঞ্চুরি করলেন মুমিনুল। সে এক বুনো উদযাপন। তেড়েফুড়ে ইঙ্গিত করলেন লঙ্কান ড্রেসিংরুমের দিকে। ঠিক সেদিকে, যেখানে গালে হাত দিয়ে বসে ছিলেন হাতুরুসিংহে। সেদিন সবাই অবাক হয়েছিল, হাতুরুসিংহে নিজেও অবাক হয়েছিলেন। সবচেয়ে বড় কথা, নিজের এমন উদযাপন দেখে নিজেও অবাক হয়েছিলেন মুমিনুল হক।
সেই উদযাপনের কারণ আসলে দুটি। প্রথমত, তিন বছরে ২৩ ইনিংস পর সেঞ্চুরির দেখা পাওয়া। দ্বিতীয়ত, যে হাতুরুসিংহে তখন বাংলাদেশের সাবেক কোচ, সেই তিনি ততদিনে মুমিনুলের জন্য কাল হয়েছেন। প্রতিনিয়ত একের পর এক ভুল বের করা, মানসিকভাবে দমিয়ে দেওয়াসহ হেন কিছু নেই, যার পেছনে মুমিনুলের নিঃশেষ হওয়া বাকি ছিল। শ্রীলঙ্কান হেডকোচের দায়েই মুমিনুল খেতাব পেয়েছেন স্রেফ টেস্ট ব্যাটসম্যান হিসেবে। অথচ রঙিন পোশাকেও খুব খারাপ ছিলেন না তিনি।
মুমিনুল সেই যে ফিরলেন, মুমিনুল এখনও নিজের নামের প্রমাণ করে চলেছেন দারুণভাবে। ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ঘরের মাঠে উইন্ডিজ সিরিজের প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংস পর্যন্ত লিখেছেন চারটি সেঞ্চুরি কাব্যগাঁথা। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সেই টেস্টে 'ব্যাক টু ব্যাক' সেঞ্চুরি করে রেকর্ড গড়েছিলেন বাংলাদেশের হয়ে। এরপর চলতি মাসেই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে লিখলেন আরও একটি সেঞ্চুরি গ্রন্থ। চট্টগ্রামে আরও একবার।
সবকিছু ছাপিয়ে সাগরিকায় মুমিনুলের রানের সৌরভ ছড়ানোর গল্প এখন সবার মুখে মুখে। ক্যারিয়ারের ৮টি সেঞ্চুরির মধ্যে ৬টিই মুমিনুল পেয়েছেন এই সাগরিকায়।
চট্টগ্রাম তার নায়ক খুঁজে ফিরেছে বারবার। কিন্তু তামিম কিংবা তার পূর্বসূরীরা সেই নায়ক হতে পারেননি। মুমিনুল এক্ষেত্রে একেবারেই ব্যতিক্রম। বন্দর নগরীর বুকে নিজেকে করেছেন বলিয়ান, পিটিয়েছেন জয়ের ঢাক। সেটা হওয়ার পেছনে আরেকটি কারণ আছে। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারের সন্তান মুমিনুল জাতীয় লিগে চট্টগ্রাম বিভাগের নেতা। অর্থাৎ, এই ভেন্যুগুলোর সঙ্গে তার সম্পর্ক আত্মিক।
তারই ধারাবাহিকতায় মুমিনুল আরও একবার নিজেকে প্রমাণ করলেন। প্রমাণ করলেন প্রতিপক্ষ যে-ই হোক, ঘরের মাঠে তিনিই রাজা।
২.
সাম্প্রতিক সময়ে টেস্টে বাংলাদেশের অবস্থা একরকম নাজুক। জিম্বাবুয়ে সিরিজের আগে উইন্ডিজে প্রথম টেস্টে লজ্জার রেকর্ড আর হার। এরপর ঘরের মাঠে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে দ্বিতীয় টেস্টে জয় পেলেও, প্রথম টেস্টে সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামের অভিষেক টেস্টে হেরেছে বাংলাদেশ। এরপর আবারও উইন্ডিজ দলের সফরে খানিকটা চাপ ছিলই। বিশেষ করে মাস তিনেকের ব্যবধানে সেই একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে ঘুরে দাঁড়ানো ছাড়া অন্য কিছু ভাববার সুযোগ নেই সাকিব আল হাসানদের সামনে।
সবকিছু মিলিয়েই ব্যাটিং লাইনআপে মুমিনুলের দিকে প্রত্যাশার চাপ ছিল। কারণ সর্বশেষ চট্টগ্রামের এই ভেন্যুতে পরপর দুই ইনিংসে সেঞ্চুরি পাওয়া, পাশাপাশি মাত্র শেষ হওয়া জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ঢাকা টেস্টেও সেঞ্চুরি। চাপটা দারুণভাবে সামলেছেন এই ২৭ বছর বয়সী ক্রিকেটার। কেমার রোচ, শ্যান গ্যাব্রিয়েল, বিশুদের সামলিয়ে জয় করেছেন সাগরিকার উইকেট।
১৬৭ বলে ১২০ রানের ইনিংস খেলা এই ব্যাটসম্যান শেষবার জাতীয় দলের হয়ে এই ভেন্যুতে খেলতে এসে যে উইকেট পেয়েছিলেন, এবার তার উল্টো। প্রথম দিনের খেলা শেষে সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, "এবারের উইকেট বেশ ধীর গতির, টার্নও করছে অনেক। কিন্তু শেষবার যখন এই ভেন্যুতে খেলেছিলাম তখন উইকেট একেবারে ফ্লাট ছিল। বলও খুব একটা টার্ন করেনি।"
সেঞ্চুরি নিয়ে তার দর্শন বেশ দার্শনিকের মতোই। বিশেষ করে হাতুরুসিংহের দল থেকে 'গত' হওয়ার পর এমন পারফরম্যান্স নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। তবে মুমিনুল বলেছেন, "এই সেঞ্চুরিটা হয়তো আমার জন্য ভালো ছিল। মানুষ ছোট ছোট সমস্যার মধ্যে দিয়ে যায়। নতুন করে শিখে সমস্যা থেকে বের হয়ে আসে। আমি কখনোই হাতুরুসিংহেকে দেখানোর জন্য খেলিনি। আমি সেই মানুষটা হতে চাই, যে মাঠে পারফর্ম করবে।"
সাগরিকার এই সেঞ্চুরি দিয়ে টেস্টে সেঞ্চুরির সংখ্যায় মুমিনুল ছুঁয়ে দিয়েছেন ওপেনার তামিম ইকবালকে। একটু কৌতুক করে বলা যায়, ছুঁয়েছেন ঘরের ছেলেকে। যদিও মুমিনুল এগিয়ে রাখতে চান তার 'তামিম ভাইকে'। এ নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই যেন খানিকটা বিব্রত তিনি, "আমার সঙ্গে তামিম ভাইয়ের তুলনা করার প্রশ্নই আসে না। তিনি আমাদের দেশের, পুরো ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান। আমার কাছেও মনে হয় তার সঙ্গে আমার তুলনা চলে না।"
শুধু তামিম নয়, মুমিনুলের সামনে এখন সুযোগ ভারতীয় তারকা বিরাট কোহলিকে পেছনে ফেলার। দুজনেই চলতি বছরে চারটি টেস্ট সেঞ্চুরি পেয়েছেন। কোহলি এজন্য খেলেছেন ১৮ ইনিংস, মুমিনুল ১৩ ইনিংস। এতগুলো টেস্ট সেঞ্চুরি এই বছরে আর কারো নেই। মুমিনুলের সামনে তাই সুযোগ কোহলিকেও পেছনে ফেলার। তবে মুমিনুল এ নিয়ে প্রতিযোগিতায় যেতে চান না। বিনয় ঝরলো তার কন্ঠে, "বিরাট কোহলি আরও উঁচুতে। এসব নিয়ে চিন্তা করি না।"
মুমিনুল আসলেও চিন্তা করেন না। শুধু নিজের পারফরম্যান্সের মায়ার বাঁধনে জড়াতে চান সবাইকে। পরতে চান মনিহার।
This article is in Bangla language. It is a feature on Mominul Haque, a Bangladeshi batsman. He got century in CTG. He is now most centurian in 2018 along with Virat Kohli.
Feature Image: AFP