সময়টা ১৯৬৪ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের ২৪ তারিখের রাত। তৎকালীন বিশ্ব হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন সনি লিস্টনের লড়াই দেখতে ফ্লোরিডার মায়ামি বীচে জড়ো হয়েছে একঝাঁক দর্শক। সনি লিস্টন তার যুগে কেবল চ্যাম্পিয়নই ছিলেন না, বরং প্রতিপক্ষের উপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তারও করতেন। প্রতিপক্ষ যে-ই হোক না কেন, সবাই লিস্টনের জয়ের ব্যাপারে মোটামুটি নিশ্চিতই থাকতো। সেদিনও তা-ই ছিল। প্রতিপক্ষ ক্যাসিয়াস ক্লে'র হুংকার এবং নিজের জয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাস দেখানোর পরও কেউ ভাবনাটা পাল্টানোর প্রয়োজন মনে করেননি। তখন পর্যন্ত ৩৫টি লড়াইয়ে লিস্টনের হার মাত্র ১টি, জয় পাওয়া ম্যাচের বেশিরভাগই নকআউটের মাধ্যমে। কাজেই উপস্থিত দর্শকদের সবাই জানে যে, অল্প কিছুক্ষণের মাঝেই ক্লে'কে পিটিয়ে তক্তা বানাতে যাচ্ছেন লিস্টন। ম্যাচে ফলাফল সম্পর্কে সবাই এতটাই নিশ্চিত ছিল যে, নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকাও তাদের সবচেয়ে জুনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার রবার্ট লিপ সাইডকে পাঠিয়ে ছিল ম্যাচটা কভার করতে। তাদের ধারণা ছিল, ক্লে সর্বোচ্চ ২/৩ রাউন্ড টিকতে পারবে।
কিন্তু ম্যাচ শুরু হবার পরেই পরিস্থিতি পাল্টে যেতে লাগলো। প্রথম রাউন্ড থেকেই ক্লে ম্যাচের নিয়ন্ত্রন নিজের হাতে নিয়ে নিল। তবে ৫ম রাউন্ডে গিয়ে পরিস্থিতি আবার লিস্টনের পক্ষে চলে গেলো। সেই সময় লিস্টনের দস্তানা থেকে সম্ভবত কিছু একটা তরল পদার্থ ক্লে'র চোখে ঢুকে যাওয়ায় তিনি কিছুই দেখতে পাচ্ছিলেন না। এক পর্যায়ে ক্লে খেলা থামিয়ে দিতে চাইলেও তার প্রশিক্ষক জোর করে আবার রিংয়ে পাঠান। শেষ পর্যন্ত সপ্তম রাউন্ডে গিয়ে লিস্টন হার মানেন। মাত্র ২২ বছর বয়সেই বিশ্ব হেভিওয়েটের শিরোপা জিতে সবাইকে অবাক করে দেন ক্লে। অবশ্য তখনো লড়াই শেষ হয়নি। দ্বিতীয় দফায় লড়াই হলো ৩ মাস পর, ২৫শে মে। সবাই আশা করছিলো, এই দফা লিস্টন প্রতিশোধ নিয়েই নেবেন। কিন্তু সবাইকে হতভম্ব করে দিয়ে ক্লে'র কাছে লিস্টন হেরে গেলেন প্রথম রাউন্ডেই।
‘ক্যাসিয়াস ক্লে’ নামটা শুনে আপনি হয়তো ভ্রু কুঁচকে ভাবতে পারেন, লোকটা আসলে কে?
আসলে এই নামে তিনি বিশ্বে খুব বেশি মানুষের কাছে পরিচিত নন। কাজেই, নাম না শুনলেও আপনাকে দোষ দেওয়া যাবে না। তবে তিনি যে নামে পরিচিত, সেটা না শুনলে লোকে যে আপনার দিকেই ভ্রু কুঁচকে তাকাবে, তা নিশ্চিত। ১৯৬৪ সালে সনি লিস্টনকে হারানোর পর ক্লে ঘোষণা দেন, তিনি তার নাম পাল্টে রেখেছেন মোহাম্মদ আলী। অবশ্য তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ডেভিস মিলার জানান, মাঝে নাকি নাম পরিবর্তন করে রেখেছিলেন 'ক্যাসিয়াস এক্স'। তবে এই বিষয়টা খুব কাছের কয়েকজন বাদে কেউ জানেন না বললেই চলে।
লিস্টনকে হারানোর পরই বক্সিংয়ে শুরু হয় একটা নতুন যুগ। সেটা মোহাম্মদ আলীর যুগ।
১.
আর দশটা সাধারণ ছেলের মতোই ছিল তার শৈশব। বাবার কাছ থেকে একটা লাল সাইকেল উপহার পেয়ে সেটা নিয়েই ঘুরে বেড়াতেন ১২ বছর বয়সী আলী। কিন্তু একদিন বন্ধুদের সাথে আড্ডাশেষে ফেরার সময় দেখেন, সাইকেলটা কেউ চুরি করে নিয়ে গিয়েছে। সেই চোরকে শায়েস্তা করার জন্য তিনি প্রতিবেশী জো মার্টিনের কাছে গেলেন, যিনি পুলিশ অফিসার ছিলেন। সেই পুলিশের পরামর্শেই চোরকে শায়েস্তা করার জন্য শিখেন বক্সিং।
প্র্যাকটিসের মাত্র ৬ সপ্তাহ পর স্থানীয় এক টিভিতে অনুষ্ঠিত লড়াইয়ে জয়ী হন। ধীরে ধীরে তিনি অন্যান্য ছোটখাটো লড়াইয়েও জয়লাভ করতে থাকেন। ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত ১৯টি লড়াইয়ে অংশ নিয়ে তিনি প্রতিটিতেই বিজয়ী হন, যার মাঝে ১৫টিতেই তিনি প্রতিপক্ষকে নকআউট করেন। এই সময়ে তিনি অলিম্পিকেও স্বর্ণপদক জয় করেন।
সনি লিস্টনকে হারানোর পর থেকেই আলীর খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে আলী পরিণত হন তার সমকালীন সেরা বক্সারে। তার পেশাদারি জীবনে তিনি প্রথম সত্যিকারের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন ১৯৭১ সালে জো ফ্রেজিয়ারের বিপক্ষে। মুখোমুখি হবার আগ পর্যন্ত দুইজনই ছিলেন অপরাজিত। ১৫তম রাউন্ড পর্যন্ত একটা অসাধারণ দ্বৈরথের শেষে জয়ের মুখ দেখে জো ফ্রেজিয়ার। আলী তার ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো পরাজয়ের মুখ দেখেন।
১৯৭১ সালের ৮ই মার্চ ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে অনুষ্ঠিত সেই ম্যাচটি স্বীকৃতি পায় ‘গত শতাব্দীর সেরা লড়াই' হিসেবে।
অবশ্য ৫ বছর পর ১৯৭৫ সালে জো ফ্রেজিয়ারকে হারিয়েই আবার প্রতিশোধ নেন। সেই ম্যাচটাতে আলী শুরু থেকেই খুবই আক্রমণাত্মক ছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত জয়ী হন। ম্যাচটা ‘থ্রিলার ইন ম্যানিলা’ নামে বিখ্যাত।
জো ফ্রেজিয়ারকে হারানোর পর আলীর সামনে চ্যালেঞ্জ হিসেবে আসেন জর্জ ফোরম্যান। আলীর বিপক্ষে মুখোমুখি হবার আগ পর্যন্ত ৪০টি লড়াইয়ের প্রতিটিতেই ফোরম্যান জয়ী হয়েছিলেন যার মাঝে ৩৭টি ছিল নকআউটে জয়। এমনকি জো ফ্রেজিয়ারের মতো প্রতিদ্বন্দ্বীকেও তিনি নক আউটে পরাজিত করেছিলেন। এছাড়া ২৫ বছর বয়সী চনমনে ফোরম্যানের তুলনায় ৩২ বছর বয়সী আলীর গতি এবং রিফ্লেক্সও কিছুটা কম ছিল। স্বাভাবিকভাবেই ম্যাচের আগে আলী ছিলেন আন্ডারডগ। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে ৮ম রাউন্ডেই আলী জয়ী হন। ম্যাচটা ‘রাম্বল ইন দ্য জাঙ্গল’ নামে বিখ্যাত।
তিনি তিনবারের হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন, তিনবার খেতাব হারিয়ে সেটা আবার পুনরুদ্ধারও করেছেন যা কিনা বক্সিংয়ের ইতিহাসে বিরল। ১৯৮১ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি অবসরগ্রহণ করেন। পুরো পেশাদারি ক্যারিয়ারে আলী ৬১টি ম্যাচে অংশ নিয়ে ৫৬টিতেই জয়ী হন এবং মাত্র ৫টিতে পরাজয় লাভ করেন।
২.
আলী শুধু বক্সিংয়েই সেরা হয়ে থাকেননি, বরং তার প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল পুরো বিশ্বেই। ১৯৯৯ সালে বিবিসি থেকে তাকে গত শতাব্দীর সেরা ক্রীড়াবিদ পুরস্কারে পুরস্কৃত করেন। ফুটবলার জর্জ বেস্ট, পেলে, ক্রিকেটার ডন ব্র্যাডম্যান, গলফার জ্যাক নিকোলাস, এবং অ্যাথলেট জ্যাক ওয়েনস মিলে যে কয়টা ভোট পেয়েছিলেন, আলী একাই পেয়েছিলেন তার চাইতে বেশি।
তবে কেবল ক্রীড়াবিদ হিসেবেই নন, একজন মানুষ হিসেবেও অনবদ্য ছিলেন মোহাম্মদ আলী। ১৯৬৬ সালে তিনি সৈনিক পরীক্ষায় উত্তীর্ন হন, কিন্তু সেই বছরেই যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে ভিয়েতনামের বিপক্ষে যুদ্ধে অংশ নিতে তিনি অস্বীকৃতি জানান। কারণ হিসেবে জানান,
‘আমার বিবেক আমাকে ভিয়েতনামের বিপক্ষে লড়াই করতে সায় দেয় না। আর আমি কাদের বিপক্ষে যুদ্ধ করবো? তারা কখনো আমাকে কালো বলে গালি দেয় নি, তারা আমার বাবা-মা'কে হত্যা করেনি। শুধুমাত্র কালো বলে এই দরিদ্র মানুষদের উপর আমি অস্ত্র তুলে ধরতে পারি না’।
তবে যুক্তরাষ্ট্র সরকার বিষয়টাকে ভালোভাবে মেনে নেয়নি। সেই দেশের আদালত আলীকে ১০ হাজার ডলার জরিমানা করে, পাঁচ বছরের জেল দেয়, এবং বক্সিং থেকে তিন বছরের নিষেধাজ্ঞা দিয়ে তার শিরোপা কেড়ে নেয়। অবশ্য আলী আপিল করেন, যার প্রেক্ষিতে জরিমানা এবং জেলের শাস্তি মওকুফ হয়। মাঝের তিনটা বছর নষ্ট হয়, যে সময়টাতে সাধারণত একজন বক্সার তার ক্যারিয়ারের সেরা অবস্থায় থাকেন।
তবুও তিনি নিজের নীতির বিরুদ্ধে নতিস্বীকার করেননি।
৩.
১৯৭৮ সালের ১৯শে ফেব্রুয়ারি মোহাম্মদ আলী বাংলাদেশে ভ্রমণে আসেন। বিমানবন্দরে আলীকে বরণ করতে লাখ লাখ মানুষ ভিড় জমিয়েছিলো। ওই সফরে মোহাম্মদ আলীকে বাংলাদেশের নাগরিকত্বও প্রদান করা হয়েছিলো। এছাড়া পল্টনের মোহাম্মদ আলী বক্সিং স্টেডিয়াম উদ্বোধন করেছিলেন আলী নিজেই। তার সম্মানার্থেই স্টেডিয়ামটার নামকরণ করা হয়েছিলো। প্রায় সপ্তাহখানেক বাংলাদেশে ছিলেন আলী। ঢাকা, সুন্দরবন, রাঙ্গামাটি, কক্সবাজার, আর সিলেটের কয়েকটি জায়গায় ঘুরে মুগ্ধতাও প্রকাশ করেছেন।
কক্সবাজারে আখতার নেওয়াজ রুবেল নামে তৎকালীন একজন আওয়ামী লীগ নেতা আলীকে এক বিঘা জমিও উপহার দেন। বাংলাদেশের মানুষের আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে আলী বলেছিলেন,
'আমেরিকা থেকে বের করে দিলেও আমার আরেকটা বাড়ি থাকবে।'
আমেরিকা পৌছে তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন,
'যদি স্বর্গে যেতে চান তাহলে বাংলাদেশে যান।'
৪.
আলীকে নিয়ে অসংখ্য মজার ঘটনা প্রচলিত রয়েছে। যেমন, নিউইয়র্কের একটা পার্টিতে ভায়োলিনবাদক আইজ্যাক স্টার্নের সাথে পরিচয় হবার পর স্টার্ন বলেন,
‘বলতে পারেন আমরা দুজনেই একই কাজ করি। আমরা দু'জনেই হাত দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করি।'
রসিক আলী উত্তর দিয়েছিলেন,
'তবে আপনিই ভালো আছেন। আপনার গায়ে আঘাতের কোনো চিহ্ন নেই।'
একবার প্লেনে উঠার পর বিমান বালা তাকে সিট বেল্ট বাধতে বলায় তিনি বলেছিলেন যে,
‘সুপারম্যানদের সিট বেল্টের প্রয়োজন হয় না।'
নিজের সম্পর্ক অসম্ভব আত্মবিশ্বাসী ছিলেন তিনি, নিজেই নিজেকে গ্রেটেস্ট বলতেন। এই ব্যাপারে তাকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেছিলেন,
'আমার মতো এতটা নিখুঁত হলে বিনয়ী হওয়া কঠিন।'
তার জীবন ছিল বৈচিত্র্যময়। সৈনিক হিসেবে কাজ করেছেন, সেটা তো আগেই বলা হলো। যে সময়টাতে তিনি বক্সিংয়ে নিষিদ্ধ হয়েছিলেন, সেই সময়ে তিনি অভিনয়ের কাজও করেছেন কিছুদিন। নিউইয়র্কের ব্রডওয়ে থিয়েটারে ‘বাক হোয়াইট’ নামে একটা নাটকে অভিনয় করে প্রশংসিতও হয়েছিলেন।
জাদুবিদ্যার প্রতিও আলীর আগ্রহ ছিল। সেই আগ্রহ থেকে শিক্ষক রেখে জাদু শিখেছেন। রুমাল অদৃশ্য করা, কিংবা মাটি থেকে শূন্যে ভেসে থাকার মতো জাদুও দেখিয়েছেন।
বিশ্বের বিভিন্ন মানবতামূলক কাজেও আলীকে খুঁজে পাওয়া যায়। ১৯৯০ সালে ইরাক যখন কুয়েত দখল করেছিলো, তখন ১৫জন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিককেও বন্দী করা হয়। সেই মুহূর্তে মোহাম্মদ আলী স্বয়ং ইরাকে যান তাদেরকে মুক্ত করতে। ইরাকি শাসক সাদ্দাম হোসেনের সাথে আলোচনা করে সেসব বন্দীদেরকে মুক্ত করে নিয়েও এসেছিলেন।
আলীর জীবনের একটা দুঃখজনক অধ্যায় হচ্ছে পার্কিনসন্স রোগে আক্রান্ত হওয়া। ৩২ বছর এই রোগের সাথে যুদ্ধ করে শেষ পর্যন্ত মারা গেলেন ২০১৬ সালের ৩রা জুন। তবে সারা বিশ্বের অধিকার হারা স্বাধীনতাকামী আর বর্ণবাদবিরোধী মানুষদের কাছে তিনি অমর হয়েই রয়েছেন।
আলী তার কাজের প্রতি কতটা একাগ্র ছিলেন সেটার একটা ঘটনা বলে লেখাটা শেষ করা যাক।
একবার একজন সাংবাদিক আলীকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনি প্র্যাকটিসের সময় কতবার বুক ডন দেন?’
আলীর উত্তর ছিল,
‘আমি যখন বুকডন দেওয়া শুরু করি, তখন গুণতে শুরু করি না। বুকডন দিতে দিতে একটা সময় হাতে ব্যথা শুরু হয়ে যায়। ঠিক তখন থেকেই গুণতে শুরু করি।'
এই ছিলেন মোহাম্মদ আলী, প্রতিভার সাথে পরিশ্রমের মিশ্রণ ঘটিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে যিনি অমর হয়ে আছেন।
This article is in Bangla language. The article is about the Greatest Boxer Muhammad Ali who was regarded as the best sportsman of the last century. The references are hyperlinked in the article.
Featured Image: Getty Images