'রিভার্স সুইপ...আমি মনে করি, এটা আমার খুব প্রিয় শট। এখনো এরকম পরিস্থিতি আসেনি, আসলে অবশ্যই আমি এটা খেলব। এটা বলতে চাই, সুযোগ আসলে একটা নয়, চার-পাঁচটা ইনশাল্লাহ খেলব।’
মুশফিকুর রহিমের উদ্ধৃতিটা খুব সম্ভবত জানা আছে আপনার। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচটা সেদিন বাংলাদেশ জিতেছিল, আগের ম্যাচে ৮৪ রান করার পর আবার করেছিলেন সেঞ্চুরি, মুশফিকুর রহিমের কথাতে আত্মবিশ্বাস ঠিকরে না বেরোনোটাই বরং অস্বাভাবিক হতো। মুশফিক ব্যতিক্রম হননি।
কিন্তু আজ প্রায় এক বছর বাদে কি একই প্রশ্নে একই রকম প্রত্যয়ী শোনাবে মুশফিকের গলার স্বরটা? এখনো কি রিভার্স সুইপ খেলতে চাইবেন তিনি, কোনো জড়তা ছাড়াই?
বই-পুস্তক-অন্তর্জাল ঘেঁটে রিভার্স সুইপের লম্বা একটা ইতিহাসই পাওয়া যাবে। সেই ১৮৭০ সালেই নাকি সুইচ হিট খেলেছিলেন উইলিয়াম ইয়ার্ডলি, খেলেছিলেন তার সমসাময়িক ওয়াল্টার রিডও। পাকিস্তানের মোহাম্মদ ভাইরাও নাকি এমন কিছু শট খেলতেন, যেগুলোকে রিভার্স সুইপের কাতারে ফেলা চলে। তবে রিভার্স সুইপটা নতুন মাত্রা পেয়েছে সম্প্রতি, এবি ডি ভিলিয়ার্স-গ্লেন ম্যাক্সওয়েল-জস বাটলার-এউইন মরগানরা দেখিয়েছেন, এই শটটা ছাড়া এখন আর চলেই না।
চলে না বলেই মুশফিকও এই শটটা আয়ত্তে আনতে চেয়েছেন। মাঝে একটা সময় সাফল্যও পেয়েছেন, টুকটাক কিছু ব্যর্থতাও খুঁজে পাওয়া যাবে। কিন্তু সমস্যাটা মাত্রা ছাড়িয়েছে ইদানীংয়ে। মুশফিক যদিও মানতে চাইবেন না, তবে পরিসংখ্যানটা তার বিপক্ষেই কথা বলছে। ২০২১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ১৮ বার রিভার্স সুইপ করতে চেষ্টা করেছেন তিনি। চার মারতে পেরেছেন মাত্র দুবার, আউট হয়েছেন দ্বিগুণ সংখ্যকবার। পুরস্কারের চাইতে যখন শাস্তিই মিলছে বেশি, তখন তো বলতেই হচ্ছে, 'কুচ তো গড়বড় হ্যায়, দায়া!'
তা গড়বড়টা হচ্ছে কোথায়? ২০২১ সাল থেকে রিভার্স সুইপ খেলতে গিয়ে মুশফিকের হওয়া আউটগুলো বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যাচ্ছে, প্রায় সব রিভার্স সুইপেই বলগুলো পয়েন্ট আর থার্ড ম্যানের মাঝের ফাঁকা জায়গাটা দিয়ে পাঠানোর চিন্তা করছেন তিনি। কিন্তু, এক্ষেত্রে বল নির্বাচনটা ঠিকঠাক হচ্ছে না তার। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সাইমন হারমারের বলে তার সর্বশেষ ডিসমিসালটাই বিবেচনায় নিন। প্রায় ইয়র্কার লেংথের বলে পয়েন্ট আর থার্ড ম্যানের মাঝ দিয়ে ঘোরানোর সিদ্ধান্ত কেউই সমর্থন করবেন না, অন্তত ম্যাক্সওয়েল তো নন-ই।
ম্যাক্সওয়েল, মরগান, এবি, বাটলার - লেখাতে এই নামগুলো বারবারই আসবে। রিভার্স সুইপের সেরা ব্যবহারকারী তো তারাই। গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সময়কার খবর যেমন, আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে রিভার্স সুইপ করে সবচেয়ে বেশি রান তুলেছেন ম্যাক্সওয়েল আর মরগান। আর এই সাফল্য যে বহু বছরের সাধনার ফল, সেটা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না।
নিজের শট রেঞ্জ বাড়াতে তিন ধরনের রিভার্স সুইপ তূণে যোগ করেছেন ম্যাক্সওয়েল। ওভার দ্য উইকেট থেকে আসা অফ স্পিনারের বলে পয়েন্ট-থার্ডম্যানের মাঝ দিয়ে, বাঁহাতি অর্থোডক্স স্পিনারের বলে কাভারের ওপর দিয়ে, আর লেগ স্পিনারদের বলে পুরোদস্তর বাঁহাতি হয়েই রিভার্স হিটটা খেলতে চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু উইকেটে গেলে এই বেঁধে দেওয়া সূত্রটা কি ম্যাক্সওয়েলও সব সময় মানতে পারেন? তা যে পারেন না, তার প্রমাণ ইউটিউবের এক ক্লিকেই মিলবে। তবে নিজের জন্যেই বেঁধে দেওয়া ব্যাকরণটা না মেনেও ম্যাক্সওয়েল যে আউট হচ্ছেন না, তার কারণ, বলের ওপর 'সপাং' করে ব্যাট চালানোর গুণটা তিনি আয়ত্ত করেছেন। এবং, এই দ্রুতগতিতে হাত চালাতে পারেন বলেই এউইন মরগানকে সময়ের সেরা রিভার্স সুইপার বলেছিলেন এবি ডি ভিলিয়ার্স।
এবি আরও জানিয়েছিলেন, তার মতো ব্যাটার, যাদের রিভার্স সুইপটা মূলত শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে, তাদের জন্য শটটা পূর্ব-পরিকল্পিত। যে কারণে বল ছোড়ার আগে থেকেই শট খেলার জন্য অবস্থান নেওয়ার প্রস্তুতি শুরু করতে হয় তাদের। বোলাররাও ওই ট্রিগার মুভমেন্ট দেখে কিছু সংকেত পেয়ে যান, ভালো বোলাররা শেষ মুহূর্তে গিয়ে অ্যাডজাস্টমেন্টও করে নিতে পারেন লাইন-লেংথে।
এউইন মরগানের আশ্চর্যরকম ভালো হ্যান্ড স্পিডটা তাকে সাহায্য করছে ট্রিগার মুভ শুরু করতে দেরি করতেও। বল ছোড়া মুহূর্ত পর্যন্তও নিজের স্বাভাবিক স্ট্যান্সটা ধরে রাখাই যার প্রমাণ।
কিন্তু এউইন মরগান কিংবা গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের মতো হ্যান্ড স্পিড মুশফিকের নেই, এবির মতো ভিত্তিটাও দাঁড় করাতে পারছেন না। যার প্রমাণ মিলেছিল গত বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে। লিয়াম লিভিংস্টোনের বলে আউট হয়েছিলেন সেদিন, বলকে ওই পয়েন্ট-থার্ড ম্যানের ফাঁকে পাঠানোর জন্য তার ভিত্তিটা ঠিকঠাক গড়ে ওঠেনি তখন। রিভার্স সুইপ স্পেশালিস্টরা যেখানে চান, ওয়াইড স্ট্যান্স নিয়ে ভালো একটা সাইড-অন পজিশনের ভিত্তি দাঁড় করাতে, সেখানে মুশফিকের ফ্রন্ট ফুটটা তাক করা ছিল মিড উইকেটের দিকে। ওই বেজমেন্টের ওপর ভর করে ১৮০ ডিগ্রি বিপরীতে শট খেলা, ভীষণ দুরূহ এক কাজ। বলটা যদি মিস না-ও করতেন, তবুও শটে জোর আনা প্রায় অসম্ভবই হতো তার জন্য। মুশফিক দাবি করতে পারেন, অতীতে তো একই টেকনিক নিয়েই সফল হয়েছেন তিনি। তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যে ধার কমেছে ওই টেকনিকের, হ্যান্ড-আই কো-অর্ডিনেশনও মরচে ধরেছে, সেটা তো পরিসংখ্যানেই প্রমাণ।
ওই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচেই তিনি আরেকটি রিভার্স সুইপ খেলেছিলেন আদিল রাশিদের বলে। পয়েন্টে দাঁড়ানো ফিল্ডারের হাতের ডগা ছুঁয়ে গেলেও বলটা হাতে জমেনি। জো রুট তার মাস্টারক্লাসে জানিয়েছিলেন, রিভার্স সুইপ খেলতে গেলেও শটটা যেন তার নিয়ন্ত্রণে থাকে, সে জন্যে মাথা বলের লাইনে রাখার নিয়মটা তিনি মেনে চলতে চেষ্টা করেন এই ঝুঁকিপূর্ণ শটেও। কিন্তু রাশিদের বলের লাইনটা অফ স্টাম্পের বেশ বাইরে ছিল, মুশফিক লম্বা একটা ফ্রন্টফুট স্ট্রাইড নিয়ে ম্যাক্সওয়েলের মতো কব্জির জোর আর কোমরে হালকা একটা মোচড় দিয়ে যে শটের বেগ বাড়াবেন, সেই চেষ্টাও করেননি। কাঙ্ক্ষিত ফলটাও তাই আসেনি।
সেদিন তো বেঁচে গিয়েছিলেন অল্পের জন্য, তবে এর আগে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে ক্যাচই দিয়ে ফিরেছিলেন শর্ট থার্ড ম্যানে। এ থেকে অন্তত একটা জিনিস স্পষ্ট, ফিল্ডারের মাথার ওপর দিয়ে বল নেওয়ার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ এলিভেশন পাচ্ছেন না তিনি। পাবেন কী করে? লাইন-লেংথের বিচার-বিবেচনা ঠিকঠাক হচ্ছে না বলে বেশির ভাগ বলই লাগছে না ব্যাটের সুইট স্পটে। ম্যাক্সওয়েল, এবি কিংবা বাটলারের মতো 'বডি অ্যাঙ্গেল' তৈরি করে, কিংবা ফ্রন্ট ফুটটা সোজা করে যে এলিভেশন আনবেন শটে, সেটাও পারছেন না। মুশফিকের রিভার্স সুইপগুলো তাই হয়ে যাচ্ছে প্যাডল সুইপের উল্টো, কিন্তু তাতে চাওয়ামতো উত্থিতি মিলছে না।
টেস্টে তার রিভার্স সুইপ খেলাটা বসিয়ে দিচ্ছে তার গেম অ্যাওয়ারনেস প্রসঙ্গে বড়সড় একটা প্রশ্ন চিহ্ন। বাউন্ডারি আদায়ের বাইরে রিভার্স সুইপ খেলবার উদ্দেশ্য তো একটাই থাকে, ফিল্ডিং ম্যানিপুলেশন। ব্যাপারটা কেমন, জস বাটলার সেটা বুঝিয়েছিলেন উদাহরণ দিয়েই।
'ধরুন, আপনি মিড উইকেটের দিকে বল পাঠিয়ে সিঙ্গেল খেলছেন। সেটা দেখে শর্ট মিড-উইকেটে একজন ফিল্ডার দাঁড় করানো হলো। আপনি তখন রিভার্স সুইপ খেলে ফিল্ডিং টিমকে ফের ভাবতে বাধ্য করতে পারেন। তখন ফিল্ড সেট-আপ বদলালে কনভেনশনাল শটে ফেরত যেতে পারেন।'
লিমিটেড ওভারের ক্রিকেটে না হয় রান করবার তাড়া থাকে, প্রতিপক্ষের ফিল্ডিং পরিকল্পনায় গুবলেট পাকিয়ে দেবার চেষ্টাও সে কারণেই। কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটে না বোলারদেরই আক্রমণ করবার কথা? ব্যাটারকে আউট করতে তাকেই না হাজারটা পরিকল্পনা করার কথা?
আর মুশফিক রিভার্স সুইপগুলো খেলছেনও কখন? ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে রাখিম কর্নওয়ালের বলে যখন শটটা খেলতে চাইলেন, বাংলাদেশ তখন ১৫১-৫, ক্যারিবিয়ানদের চেয়ে পিছিয়ে ২৫৪ রানে। তার ফিফটি হয়ে গেছে, অর্থাৎ ক্রিজে তিনি 'ওয়েল সেট'। এর কয়েক ওভার আগেই কর্নওয়াল ফিরিয়েছিলেন মোহাম্মদ মিথুনকে, মুশফিক নিজেই জোরালো এলবিডব্লিউর আবেদন বেঁচে গিয়েছিলেন আম্পায়ারস কলের সুযোগে। আর আউট হওয়ার ঠিক আগের বলেও সৌভাগ্যক্রমে চার পেয়েছিলেন ফাইন লেগ দিয়ে। বল থেমে আসছে পিচে পড়ে, বোলার ছন্দে আছেন, এমন স্পেলগুলো কাটিয়ে দেওয়াকেও না টেস্ট গৌরবময় অর্জন বলে স্বীকৃতি দেয়? একজন ব্যাটারের টেম্পারামেন্টের পরিচয়ও না এসব মুহূর্তেই মেলে?
আর দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্টে হারমারের বলটা দেখে কাটিয়ে দিলে মধ্যাহ্ন বিরতির বাকি থাকত আর ৯ বল। উইকেটে এর আগেই ১৩৫ বল কাটিয়ে দিয়েছিলেন বলে ২২ গজ সম্পর্কে ধারণাও পেয়ে যাওয়ার কথা পরিষ্কার। সেই মুহূর্তে অত ফুল বলে ওই রিভার্স প্যাডল সুইপ নামের আত্মাহুতি? ধারাভাষ্য কক্ষে খানিক আগেই মুশফিকের অভিজ্ঞতার ঝুলি নিয়ে কথা বলতে থাকা মার্ক নিকোলাসও যা দেখে বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, 'He is kidding, isn’t he?'
কোন ব্যাটার কী শট খেলবেন, এটা মার্ক নিকোলাস কেন, বাইরে থেকে কারোরই সেটা ঠিক করে দেওয়ার অধিকার নেই। পরিস্থিতির দাবি মেনে, নিজের শক্তি জেনে সেরা শটটাই নির্বাচন করেন ব্যাটার। পরিসংখ্যান কিংবা বাকি বিশ্বের ব্যাটারদের টেকনিক, কোনো মানদণ্ডেই যে রিভার্স সুইপটা মুশফিকের সেরা শট নেই এখন, সেটাও পরিষ্কার এক অর্থে।
তবুও মুশফিক রিভার্স সুইপ খেলতে পারেন, যদি তিনি জেমস অ্যান্ডারসন হতে চান। তবে এর আগে অ্যান্ডারসনের 'রিভার্স সুইপ স্পেশালিস্ট' হয়ে ওঠার গল্পটাও তিনি জেনে নেবেন নিশ্চিত।
কোনো এক মৌসুমে নাকি সাবেক অস্ট্রেলীয় উইকেটকিপার রডনি মার্শ একটা ক্যাম্প করছিলেন অ্যান্ডারসনদের সঙ্গে। তো সেখানে স্পিনাররা বল করতে এলেই ফরোয়ার্ড ডিফেন্স করতে গিয়ে আউট হচ্ছিলেন অ্যান্ডারসন, কিন্তু রিভার্স সুইপ খেললে প্রত্যেকটা বলই খেলছিলেন মাঝ ব্যাটে। সেই থেকে স্পিনার পেলেই টপাটপ রিভার্স সুইপ খেলার তরিকা বেছে নিয়েছেন তিনি। ২০১৮-২০২০ সময়কালে তার সবচেয়ে ফলপ্রসূ শট এই রিভার্স সুইপ।
১৬৯ টেস্ট খেলে ফেলার পর অ্যান্ডারসনের ব্যাটিং পজিশন দশের ওপরে উঠেছে মাত্র ২৫ বার (নাইটওয়াচম্যান শব্দটা না হয় এড়িয়েই যাওয়া হলো), দলেরও প্রত্যাশা নেই, রক্ষণে নিজেরই আস্থা নেই, তিনি তাই শটটা খেলতেই পারেন। কিন্তু, ৩৭ গড়ের একজন ব্যাটার, টেস্টে তিনটা ডাবল সেঞ্চুরি করেছেন, দল চেয়ে আছে চাতক চোখে, তিনি ফরোয়ার্ড ডিফেন্স করতে পারেন না…
এমন কথা শুনলে লোকে হাসবে না?
This article is in Bangla language. This is an analysis on Mushfiqur Rahim and his obsession with reverse sweep. Necessary hyperlinks and images are attached inside.
Featured image © Getty Images
Background image © ICC