মুস্তাফিজুর রহমানের ঠিক যে সময়ে বাংলাদেশ জাতীয় দলে অভিষেক হলো, তার একমাস আগে শেষ হয়েছে ওয়ানডে বিশ্বকাপ। সেবার বাংলাদেশ বিশ্বকাপের আসরে দারুণ কিছু করে দেখিয়েছিল। জায়গা করে নিয়েছিল কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত। মূলত, এখন পর্যন্ত লাল-সবুজ জার্সিধারীদের বিশ্বকাপ ইতিহাসে এটাই সর্বোচ্চ অর্জন। কিন্তু মুস্তাফিজ জায়গা পেলেন পাকিস্তানের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজের শেষ ম্যাচটিতে। প্রথম ম্যাচেই দুটি উইকেট পাওয়াটা খুব সাধারণ মনে হলেও শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে সবার শহীদ আফ্রিদিসহ অন্যান্যদের যে নাকানিচুবানি মুস্তাফিজ খাইয়েছিলেন তা হয়তো এখনও তাদের মনে আছে।
মুস্তাফিজের যাত্রা সেই থেকে শুরু। ২০১৫ সালের এপ্রিলে টি-টোয়েন্টি অভিষেক, জুনে ওয়ানডে আর জুলাইতে সাদা পোশাকের টেস্ট। সবমিলিয়ে গেল চার বছরে উড়েছেন এই বাঁহাতি পেসার। খেলেছেন ৪৩ ওয়ানডে, ৩০ টি-টোয়েন্টি আর ১৩ টেস্ট। ইংলিশ কাউন্টি আর ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) মতো টুর্নামেন্টেও নিজেকে সেরা প্রমাণ করতে সময় নেননি। কিন্তু এই সময়ের মধ্যেই ছিল বড় ধরনের ছন্দপতন। টানা খেলতে গিয়ে কাঁধের ইনজুরি। অন্যান্য ইনজুরিও ছিল, সাথে ছিল ফর্মহীনতা আর ম্যাচের ক্লান্তি।
সব ভুলে আবারও নিজের সেরাটা দিয়ে দলকে এগিয়ে নিতে প্রস্তুত মুস্তাফিজ। যার ধারাবাহিকতায় আসন্ন ইংল্যান্ড ওয়ানডে বিশ্বকাপে তাকে দলে নেওয়া হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে। বলা যায়, বাংলাদেশের জন্য মুস্তাফিজ তুরুপের তাস। বল হাতে তার বিধ্বংসী স্লোয়ার আর কাটার তাকে যেমন বানিয়েছে 'কাটার মাস্টার' কিংবা 'দ্য ফিজ'; তেমনই তিনিই দলের হয়ে প্রতিপক্ষ দলের ব্যাটসম্যানদের হয়ে বারবার হয়ে উঠেছেন এক ত্রাসের নাম। ১৫ সদস্যের মূল দলে পাঁচ পেসারের অন্যতম সদস্য মুস্তাফিজ। নির্বাচক, অধিনায়ক কিংবা সিনিয়র গ্রুপ; সবার চোখেই মুস্তাফিজ দলের 'নাম্বার ওয়ান অটোমেটিক চয়েস'।
১.
মুস্তাফিজর রহমান নিজেও বিশ্বাস করেন আসন্ন বিশ্বকাপে তার দুটি ডেলিভারি- স্লোয়ার বল এবং কাটার; তার অন্যতম সেরা বন্ধু হতে যাচ্ছে। ইংলিশ কন্ডিশনে তার 'ট্রেডমার্ক অফ-কাটার' বিশ্বের যেকোনো প্রতিপক্ষের জন্যই আতঙ্কের, তা তিনি নিজেও টের পান। তাছাড়া সাদা বলে তার দক্ষতা আর সামর্থ্যের সুনাম বেশ পুরনো। কিন্তু বিশ্বকাপের আগে পারফরম্যান্সের চেয়েও মুস্তাফিজের চোখে ইনজুরিমুক্ত থাকাটাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যদিও বিশ্বকাপ শুরু হতে বাকি মাত্র একমাসের কিছু সময় বেশি।
ইনজুরি ফেরত মুস্তাফিজ এখনও আছেন পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার মধ্যে। বিশ্বকাপ নিয়ে তার ভাবনা মূলত ওই স্লোয়ার আর কাটারকে ঘিরেই। বিসিবি একাডেমির মাঠে তাই বলছিলেন,
স্লোয়ার আর কাটার ছাড়া আমার বোলিংয়ে আর খুব বেশি কিছু নেই। আমার জন্য এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ ডেলিভারি। আমার বিশ্বাস, আমি বিশ্বকাপে এগুলো (স্লোয়ার ও কাটার) নিয়ে অনেক কাজ করতে পারবো। যদিও এই সময়ের মধ্যে আমি নিজের বোলিংয়ে নতুন বৈচিত্র্য নিয়ে কাজ করছি, শেখার চেষ্টা করছি। বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের উইকেট ব্যাটিং সহায়ক হবে। কিন্তু আমি আমার সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করবো।
চার বছর পর ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগে (ডিপিএল) ফিরে শুরুটা ভালোই করেছিলেন মুস্তাফিজ। ৬.৪ ওভার বোলিংয়ে তুলে নিয়েছিলেন ৩ উইকেট। কিন্ত শাইন পুকুর ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে সেই ম্যাচে খেলতে গিয়ে আবারও পড়েন ইনজুরিতে। গোড়ালির চোটে ছিটকে যান ম্যাচ থেকে। যদিও খুব গুরুতর চোট নয়, তারপরও, বিশ্বকাপকে সামনে রেখে মুস্তাফিজ ও বাংলাদেশ টিম ম্যানেজমেন্ট; উভয়ের চোখেই খানিকটা হলেও জ্বালাপোড়া বাঁধাবে এই চোট। সে কারণেই মুস্তাফিজ সতর্ক তার পুনর্বাসন প্রক্রিয়া নিয়ে।
ঠিক এই কারণেই ফেরা নিয়ে খুব একটা তাড়াহুড়ো নেই বাঁহাতি এই পেসারের মধ্যে। পরিকল্পনা অনুযায়ী সঠিকভাবে পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শেষ করেই ফিরতে চান। বললেন,
ব্যথাটা অনুভব করা স্বাভাবিক। কিন্তু এখানে তাড়াহুড়োর কিছু নেই কারণ এখনও অনেক সময় আছে। বিশ্বকাপের ম্যাচগুলোর মধ্যেও বড় ছুটি আছে। আমি আশাবাদী যে, এগুলো নিয়ে আমি কোনো বিপদে পড়বো না। আর ইনজুরি নিয়ে তো কিছু বলার নেই। আপনি যেকোনো মুহূর্তে, যেকোনো সময়ে ইনজুর্ড হতে পারেন।
চার বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে মুস্তাফিজ অনেকবার চোটগ্রস্থ হয়েছেন। শুরুটা হয়েছিল ২০১৬ সালে। অর্থাৎ, অভিষেকের পরের বছরেই। ইংল্যান্ডে টি-টোয়েন্টি ব্লাস্টে প্রথমবারের মতো সুযোগ পেয়ে খেলতে গিয়েই কাঁধের স্ট্রেনের চোট পান। এরপর অনুশীলনে ফুটবল খেলতে গিয়ে গোড়ালির চোট পান। ফলাফল, ২০১৭ সালের বিপিএল থেকে ছিটকে যান। বিশ্রামে থাকতে হয় পুরো টুর্নামেন্ট। শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশের বিপক্ষে ৩-০ তে আফগানিস্তানের জয় পাওয়া টি-টোয়েন্টি সিরিজেও অনুপস্থিত ছিলেন মুস্তাফিজ, সেই ইনজুরির কারণেই। দেরাদুনের সেই সিরিজের পর ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজেও অংশ নিতে পারেননি তিনি, কারণটা ইনজুরি। সেবার ২-০ তে হেরেছিল বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল।
২.
২০১৫ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে অভিষেকের ম্যাচেই আলো কেড়েছিলেন মুস্তাফিজ। সেই টি-টোয়েন্টি ম্যাচের পারফরম্যান্স দেখেই সাতক্ষীরার সেই সদ্য কৈশোর পেরোনো ছেলেটাকে নিয়ে সামনের পথগুলোর স্বপ্ন দেখেছিল বাংলাদেশ দল। সিদ্ধান্তটা যে সঠিক ছিল, সেটার প্রমাণও দিয়েছেন মুস্তাফিজ। ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডে অভিষেকে পাঁচ উইকেট তুলে নিয়েছিলেন। মূলত মুস্তাফিজের পারফরম্যান্সে চড়েই ভারতের বিপক্ষে প্রথমবারের মতো ওয়ানডে সিরিজ জিতেছিল বাংলাদেশ দল।
পুরনো সেই সাফল্যের কথা মনে করিয়েই আসন্ন বিশ্বকাপের মাঠে নামতে হচ্ছে মুস্তাফিজকে। সেক্ষেত্রে নিজের উপর দলের চাহিদার কতটুকু টের পাচ্ছেন এই পেসার? উত্তরটা তার কাছে পানির মতোই সহজ। এ প্রসঙ্গে মুস্তাফিজ বলেছেন,
আমি এর আগে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলেছি। এবার প্রথম ওয়ানডে বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছি। আমার উপর সবসবময়ই বাড়তি চাহিদা থাকে। সবাই আমার কাছ থেকে একটু বেশিকিছু আশা করে। আমিও সেভাবেই চেষ্টা করি। সবসময় আমি নিজের সেরাটা দিয়ে আশার প্রতিদান দেওয়ার চেষ্টা করি।
এই মুহূর্তে মুস্তাফিজের চোখ আয়াল্যান্ড ও উইন্ডিজের বিপক্ষে আসন্ন ত্রিদেশীয় সিরিজে। সেখানে ভালো করতে পারলেই বিশ্বকাপের প্রস্তুতিটা অনেকখানি এগিয়ে নেওয়া যাবে বলে তার ভাবনা। বললেন,
আমরা যদি এখানে (ত্রিদেশীয় সিরিজ) ভালো করতে পারি, তাহলে বিশ্বকাপের আসরে ভালো করাটা সহজ হবে।
বিশ্বকাপের আগে ত্রিদেশীয় সিরিজের পর পাকিস্তান ও ভারতের বিপক্ষে দুটি প্রস্তুতি ম্যাচ খেলবে বাংলাদেশ। বিশ্বকাপের আসরে মাশরাফি-মুস্তাফিজদের প্রথম লড়াই আসরের অন্যতম ফেবারিট দল দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হবে লন্ডনের কেনিংটন ওভালে, জুনের ২ তারিখে।
এবারের পরিবর্তিত নিয়ম অনুযায়ী, প্রত্যেকের সঙ্গে ম্যাচ খেলবে বাংলাদেশ। সেটা যেমন একদিক থেকে পরের রাউন্ডে যাওয়ার জন্য ভালো ব্যাপার, তেমনই ভালো খেলাটাও গুরুত্বপূর্ণ। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ কতটা ভালো করবে তা নির্ভর করছে তাদের প্রস্তুতি, অভিজ্ঞতা ও তরুণ ক্রিকেটারদের ব্যাট-বলে 'ক্লিক' করার উপর। ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে ব্যাটিং সহায়ক উইকেটের কথা বলা হলেও, সেখানকার পেস সহায়ক কন্ডিশনের কথা মাথায় রেখে ১৫ সদস্যের বাংলাদেশ দলে ভেড়ানো হয়েছে পাঁচ 'ফুল টাইম' পেসার। মুস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে এই পাঁচের তালিকায় আছেন মাশরাফি বিন মুর্তজা, রুবেল হোসেন, আবু জায়েদ রাহী এবং মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন।
This is an article based on Banladeshi left arm pacer Mustafizur Rahman. He is one of the important figure for Bangladesh World cup team. This is his debut ODI World cup. All necessary link has been hyperlinked.
Feature Photo: AFP