Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মুস্তাফিজ: ধ্রুবতারা নাকি ধূমকেতু?

২০১৫ সালে বাংলাদেশের ক্রিকেটে যখন মুস্তাফিজুর রহমান নামের জ্বলজ্বলে নক্ষত্রের আবির্ভাব, তার আলোয় ঝলসে গিয়েছিল পুরো ক্রিকেট বিশ্বেরই। জাতীয় দল তো বটেই, আইপিএলে গিয়েও ব্যাটসম্যানদের তুর্কি নাচন নাচিয়ে ছেড়েছিলেন। কিন্তু সময় যত গড়িয়েছে, সে আলোর দীপ্তি তত কমেছে। মুস্তাফিজের সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স বরং এখন প্রশ্ন তুলছে, মুস্তাফিজ ঠিক কী ছিলেন – ধ্রুবতারা, নাকি ধূমকেতু? 

গত বছরখানেকের মুস্তাফিজের দিকে তাকালে আপনার অবাক হতেই হবে, যে মুস্তাফিজ একসময় ব্যাটসম্যানদের বলেকয়ে বিভ্রান্ত করতেন, যে মুস্তাফিজ ডেথ ওভারে ছিলেন আনপ্লেয়েবল, সেই মুস্তাফিজ কি না এখন রীতিমতো রানমেশিন হয়ে উঠেছেন! মুস্তাফিজের গত দশ টি-টোয়েন্টি ম্যাচের দিকে তাকালে দেখা যায়, এই দশ ম্যাচে তিনি বল করেছেন ৩২.৫ ওভার, উইকেট পেয়েছেন ১২টি, ৯.২৬ ইকোনমি রেটে রান দিয়েছেন ৩০৪! অর্থাৎ, প্রতি চার ওভারে মুস্তাফিজ রান দিয়েছেন প্রায় ৩৭ করে, যা টি-টোয়েন্টিতে দলের সেরা বোলার হিসেবে গণ্য হওয়া বোলারের থেকে কোনোভাবেই কাম্য নয়। 

যেন অভিষেকেই স্বর্গারোহণ!; Image: Munir Uz Zaman/ Getty Images

পরিসংখ্যান সবসময় যে সত্যটাই বলে, এমন নয়। কিন্তু যারা এ সময় মুস্তাফিজের বোলিং দেখেছেন, তারা নিঃসন্দেহে স্বীকার করে নেবেন যে, অন্তত এক্ষেত্রে স্ট্যাটবুক মিথ্যা বলছে না। মুস্তাফিজ বাস্তবিকই গত ম্যাচে এতটাই করুণ।

এরকম অবস্থায় প্রশ্ন উঠতে বাধ্য, মুস্তাফিজের এরকম নিদারুণ অবস্থার রহস্য কী? সাথে এটিও জিজ্ঞাসা করতে অনেকে বাধ্য হবেন, মুস্তাফিজের সমসাময়িক কাগিসো রাবাদা কিংবা জাসপ্রিত বুমরাহ’র যখন এত উন্নতি, তখন মুস্তাফিজ কেন কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন খাদের কিনারে? 

মুস্তাফিজের হঠাৎ উত্থান, কিংবা তার সব কিছু জয় করে হুট করে বিশ্বসেরা হয়ে উঠবার গল্পটা নতুন করে বলতে গেলে পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটা হয়ে যায়। সে গল্প অনেক বলা হয়েছে। আপাতত তোলা থাকুক স্মৃতির শেলফে।

পরিসংখ্যানে ঠিকঠাক

২০১৫ সাল থেকে পার হয়েছে চার বছরের সামান্য বেশি কিছু সময়। এর মধ্যে মুস্তাফিজ যেমন পৃথিবীর সুউচ্চ পর্বতের চূড়ায় বসেছেন, তেমনি কখনও অনুভব করেছেন ইনজুরির করাল গ্রাস। মুস্তাফিজের ক্যারিয়ার পরিসংখ্যান দেখলে কিন্তু অতটাও খারাপ মনে হবে না, বরং বাংলাদেশের হিসেবে দারুণই মনে হবে।

কেন? দেখে নেওয়া যাক। 

মুস্তাফিজ টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন ১৩টি, সেখানে ২১ ইনিংসে ৩৫.১৮ গড়ে ২৮ উইকেট তার, স্ট্রাইক রেট ৬৫.৮৯। টেস্ট অভিষেকেই চার উইকেট নিয়ে আরও একবার তাক লাগানোর পর মাত্র ১৩ টেস্ট খেলাটা হতাশাজনক, ইনজুরির কালো থাবার কাছে হারিয়েছে অনেক টেস্ট। তবে দায় যে স্রেফ ইনজুরির, ব্যাপারটি তেমনও না। সে যাই হোক, মুস্তাফিজের টেস্ট পরিসংখ্যানটা গড়পড়তা। 

টেস্টে মুস্তাফিজ প্রথম টেস্টের পর থেকেই ম্রিয়মাণ; Image: Munir Uz Zaman/Getty Images

ওয়ানডেতে মুস্তাফিজ মোট ম্যাচ খেলেছেন ৫৬টি, ৫৫ ইনিংসে উইকেট পেয়েছেন ১০৭টি। গড় ২২.৯৮, ইকোনমি ৫.২৪, স্ট্রাইক রেট ২৬.২, প্রায় প্রতি ম্যাচে দুই উইকেট। বছর হিসেবে এগোলে, ২০১৫ সালের ৯ ম্যাচে ১২.৩৪ গড়ে ফিজ উইকেট নিয়েছেন ২৬টি, প্রতি ১৭ বলে একটি করে উইকেট পেয়েছেন এবং রান দিয়েছেন ৪.২৬ গড়ে। পরের বছর ইনজুরির জন্য খেলতে পেরেছেন মাত্র দুই ম্যাচ, সেই দুই ম্যাচে শিকার চার উইকেট। ২০১৭ সালে কিছুটা বিবর্ণ, ১১ ম্যাচ খেলে ৩২.৫৭ গড়ে নিয়েছেন ১৪ উইকেট, ইকোনমি একটু বেড়ে ৫.৪৮, উইকেটপ্রতি বল খরচ করেছেন প্রায় ৩৬টি। ২০১৮ সালে দারুণ এক বছর কাটান মুস্তাফিজ, ১৮ ম্যাচে নেন ২৯ উইকেট, গড় ছিল ২১.৭২, ইকোনমি নেমে আসে ৪.২-তে। তবে এ বছরও উইকেটপ্রতি বল ছিল একটু বেশিই, প্রতি উইকেটের জন্য গড়ে মুস্তাফিজকে করতে হয়েছে ৩১ বল। উইকেটের হিসাবে ওয়ানডেতে ২০১৯ বেশ প্রসবা সাতক্ষীরার এই তরুণের জন্য, ১৬ ম্যাচে ২৮.১৪ গড়ে পেয়েছেন ৩৪ উইকেট। তবে স্ট্রাইকরেট কমে প্রায় ২৫-এ নেমে আসলেও ইকোনমি উঠে গেছে ৬.৭৭ অবধি। পরিসংখ্যান আপনাকে এটিও বলবে, ২০১৯ বিশ্বকাপে ২০ উইকেট নিয়ে বাংলাদেশের সেরা বোলার মুস্তাফিজ। কিন্তু আসলে কি তাই? 

টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারে মুস্তাফিজের অর্জন ৩৬ ম্যাচে ৫২ উইকেট, গড় ১৯.৬৭, ইকোনমি ৭.৭৯। ‘বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট’-এ তৃপ্তির ঢেকুর গিলবার মতো পারফরম্যান্স, কিন্তু প্রথম তিন বছরের সাথে শেষ দুই বছরের পার্থক্যটাই শঙ্কার কারণ। ২০১৫ সালের পাঁচ টি-টোয়েন্টিতে মুস্তাফিজের অর্জন ছয় উইকেট, ইকোনমি মাত্র ৫.৭৪। ২০১৬ সালে মাত্র ৮ ম্যাচে ১২.১৮ গড়ে ১৬ উইকেট, সাথে ডেথে তার বোলিং এ ব্যাটসম্যানদের চোখে গোলকধাঁধা দেখবার শুরু। ইকোনমিটাও দুর্দান্ত এ বছরে, মাত্র ৬.১২। পরের বছর ম্যাচ খেললেন চারটি, উইকেট শিকার ৫টি, ইকোনমি সামান্য বেড়ে ৬.৮৫। ২০১৮ সালে ১৩ ম্যাচে ২১.১৯ গড়ে ২১ উইকেট পেলেন বটে, তবে ইকোনমি রেটটা লাফ দিয়ে পৌছে গেল ৯.৮৫ এ। ২০১৯ সালের পরিসংখ্যান বলে, মুস্তাফিজ রীতিমতো বাদ পড়বার মত পারফর্ম করছেন, চার ম্যাচে ৪৩.৭৫ গড়ে ছয় উইকেট, ইকোনমি ৮.৪৬! সাথে স্ট্রাইকরেট ৩১, অর্থাৎ অংকের হিসেবে ম্যাচপ্রতি এক উইকেটও পাচ্ছেন না একসময় উইকেটকে ‘ছেলের হাতের মোয়া’ বানানো এই বাঁহাতি সিমার। 

পরিসংখ্যান বলে বিশ্বকাপে সফল মুস্তাফিজ, আসলেও কি তাই?; Image: Gareth Copley/ICC/Getty Images

তবুও, পরিসংখ্যান বলে, মুস্তাফিজকে ব্রাত্য ঘোষণা করবার কাছাকাছি কোনো ঘটনাও ঘটেনি। কিন্তু বাস্তবতা বলে, পরিসংখ্যান এই আবার মিথ্যে বলল। মুস্তাফিজ এখন বাস্তবিকই খাদের কিনারায়।

কেন? সে প্রশ্নের জবাবও আসছে। 

খামতিটা তবে কোথায়? 

সহজ কথায় বলতে গেলে, নিজের উন্নতি না করতে পারাটাই মুস্তাফিজকে পিছনে ঠেলে দিয়েছে। মুস্তাফিজের সমসাময়িক রাবাদা কিংবা বুমরাহ যখন নিজেদের স্কিলসেট বাড়িয়েছেন, নিজেদের ক্রিকেটের সব ক’টি ফরম্যাটের জন্য প্রস্তুত করে তুলেছেন, মুস্তাফিজ তখন আটকে আছেন সেই কাটারেই। সাথে মরার উপর খাড়ার ঘা হিসেবে যুক্ত হয়েছে ইয়র্কার দেওয়া কমিয়ে ফেলা, সঙ্গে ইনজুরির কারণে গতির অভাব তো আছেই। 

মুস্তাফিজ যখন প্রথমবার দলে আসেন, তার শক্তির জায়গা ছিল কাটার। সাধারণত ঘন্টায় ১৩৫ কিলোমিটারে বল করা মুস্তাফিজের কাটারের গতি হতো ১২৫ এর আশেপাশে, যা সাধারণ স্লোয়ারের চেয়ে সামান্য বেশি, ব্যাটসম্যানরা বিভ্রান্ত হতেন এতেই। ইনজুরিতে পড়বার পর মুস্তাফিজের গতি নেমে আসে ১৩০-এর ঘরে, এর ফলে তার কাটারে চমকে দেওয়া কমতে থাকে, ফলে ২০১৭ সাল কিছুটা বাজে যায় ফিজের। তবে ২০১৮ সালে তার পুরনো গতি দেখা যায়, সাথে যেন আরেকটু বাড়েও। ফলে কাটারে ব্যাটসম্যানদের বোকা বানান আবারও, সেটির জন্যই টি-টোয়েন্টি আর ওয়ানডে মিলিয়ে সে বছর তার উইকেটসংখ্যা পঞ্চাশ ছোঁয়।

মুস্তাফিজ কি আদৌ তার অস্ত্রভান্ডারে নতুন কিছু যোগ করেছেন?; Image: Lakruwan Wanniarchchi/Getty Images

কিন্তু প্রযুক্তির এ যুগে জাদুর ভেলকি উন্মোচন হওয়াটা সময়ের ব্যাপার, মুস্তাফিজের ক্ষেত্রেও তাই। ব্যাটসম্যানরা মুস্তাফিজকে নিয়ে প্রস্তুতি নেন, মুস্তাফিজ ঠিক ফাঁদে পা দেন এবং মার খান। এসব বাদ দিলেও গত এক বছরে দারুণ প্রেডিক্টেবল হয়ে উঠেছে মুস্তাফিজের বোলিং, যেন ব্যাটসম্যান যেখানে চান, ঠিক সেখানেই বল করেন তিনি। ব্যাটসম্যানরাও সুযোগ পেয়ে হাতছাড়া করেন না, মুস্তাফিজের রান বিলিয়ে বেড়ানোর কারণ এটিই। 

এমন অবস্থায় বোলাররা সাধারণত নিজের ভাণ্ডারে যোগ করেন নতুন অস্ত্র, কিন্তু এখানেই মুস্তাফিজ সবচেয়ে পিছিয়ে। পিচ করে বাইরের দিকে যাওয়া ছাড়া তার অস্ত্রের ভাগাড় শূন্য, মাঝেমধ্যে ইনসুইঙ্গার দিয়ে বসেন বটে, তবে সেটি ইচ্ছা করে দেন নাকি হয়ে যায়, সে প্রশ্ন থেকে যায়। 

টেস্টে মুস্তাফিজের আউটপুটও প্রায় শূন্য। দল যেখানে টেস্টে একজন ফাস্ট বোলারের জন্য আঁকুপাঁকু করছে, দেশের সবচেয়ে প্রতিভাবান ফাস্ট বোলারের টেস্ট রেকর্ডটাই সবচেয়ে বাজে! গতানুগতিক সুইং কিংবা রিভার্স – কোনোটাতেই পারদর্শী নন মুস্তাফিজ। লাল বলে কাটারটা ঠিক কাজ করে না, এবং এখানে ব্যাটসম্যানরা সাদা বলের মতো রান বেরার করার জন্য অতটাও মরিয়া থাকেন না। ফলাফল, মুস্তাফিজের ব্যর্থতা! 

মুস্তাফিজের ডেথ বোলিংয়েও পড়েছে মরচে। ২০১৮ সালের নিদাহাসের ফাইনালের ১৮তম ওভারে মাত্র এক রান দেওয়া, কিংবা এশিয়া কাপে জীবন-মরণ ম্যাচে আফগানিস্তানের সাথে শেষ ওভারে আট রান ডিফেন্ড করা মুস্তাফিজ যেন হারিয়েই গেছেন! এখন আর ডেথ ওভারে মুস্তাফিজ রান আটকে রাখেন না, কিংবা উইকেট নিয়ে রানের চাকা থামিয়ে দেন না, ওয়ান-ডাইমেনশনাল এই মুস্তাফিজকে পড়তে ব্যাটসম্যানদের আর কোনো সমস্যাই হয় না। 

শেষ এভারে আট রান ডিফেন্ড করবার পর!; Image: Giuseppe Cacace/ Getty Images

মুস্তাফিজুর রহমান যে খাদের কিনারায় রয়েছেন, সেটি তিনি নিজে বুঝলেই নিজের ও দলের মঙ্গল। খাদের কিনার থেকে ফিরে আসতে হলে অস্ত্রভাণ্ডারে যোগ করতে হবে নতুন অস্ত্র, ফাস্ট বোলিং এর সূক্ষ্ম বিষয়গুলোকে দারুণভাবে ধারণ করতে হবে। যদি পারেন, তবে সেই পুরনো মুস্তাফিজকে ফিরে পাওয়াটা অসম্ভব কিছু নয়, বরং পাওয়া যেতে পারে তার চেয়েও দুর্দান্ত এক ‘কাটার মাস্টার’-কে। কিন্তু যদি না পারেন? 

তাহলে কালের অতল গহ্বরে হারাতে হবে। আফসোসে তিনি নিজে তো পুড়বেনই, পোড়াবেন এদেশের ক্রিকেটকেও।

প্রিয় পাঠক, রোর বাংলার ‘খেলাধুলা’ বিভাগে এখন থেকে লিখতে পারবেন আপনিও। সমৃদ্ধ করে তুলতে পারবেন রোর বাংলাকে আপনার সৃজনশীল ও বুদ্ধিদীপ্ত লেখনীর মাধ্যমে। আমাদের সাথে লিখতে চাইলে আপনার পূর্বে অপ্রকাশিত লেখাটি সাবমিট করুন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/

An article on Bangladesh's left-arm fast bowler Mustafizur Rahman, who has declined with time and now sits just steps away from oblivion. 

Feature Photo: Nur Photo/ Getty Images

Related Articles