ইয়ান স্মিথের একদিন

তিনি ডাকাবুকো কেউ নন। গিলক্রিস্ট-পূর্ববর্তী সময়ের উইকেটকিপার, যিনি উইকেটকিপিংটাই করতেন মূলত, তবে ব্যাটিংটা পারতেন মোটামুটি। ব্যাটিং করতেন লেট অর্ডারে, সোজা বাংলায় আমরা বলতে পারি, লেজের দিকে। সেদিনও তেমনি লেজের দিকে যখন নেমেছিলেন, অকল্যান্ডের ইডেন পার্ক তখন বিষণ্ণ। টসজয়ী অধিনায়ক আজহারউদ্দীনের ফিল্ডিং নেয়ার সিদ্ধান্তটাকে যে ‘দারুণ’ বলেই প্রায় প্রমাণ করে ফেলেছেন তার বোলাররা! মনোজ প্রভাকর, কপিল দেব আর  অতুল ওয়াসান পেসত্রয়ী মিলে কিউই ব্যাটিং অর্ডারে ছড়িয়ে দিয়েছেন কেমন মনমরা এক ভাব। ব্যাটসম্যানরা একে একে ফিরছেন আর ভাবছেন, কার মুখ দেখে যে ঘুমটা ভাঙলো! মোটে তৃতীয় ম্যাচ খেলতে নামা অতুল ওয়াসানই ছিলেন মূল হন্তারক, প্রথম সেশনে ২৩ রানে ৩ উইকেটসহ, ৪০ রানে ৪ উইকেট নিয়ে টপ-মিডল অর্ডার ধ্বসিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। ৫১ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে ধুঁকতে থাকা স্বাগতিক নিউজিল্যান্ড এক পর্যায়ে হারিয়ে বসে ১৩১ রানে ৭ উইকেট। এই সময় মধ্যমাঠে প্রবেশ করেন আমাদের আজকের নায়ক, ইয়ান স্মিথ

তারপর কী হলো? কী করলেন তিনি?

হাস্যজ্জ্বল ইয়ান স্মিথ; Image Source: Getty Images

১.

স্যার হ্যাডলি ততক্ষণে ফ্লো পেয়ে গেছেন। থমসনকে নিয়ে পাল্ট লড়াইয়ের চেষ্টা ১৩১-এ থমসনের বিদায়ে শেষ হলেও, হ্যাডলি লড়াইটা টেনে নিলেন ইয়ান স্মিথকে সঙ্গী করে। স্মিথ ব্যাটিং খুব একটা মন্দ করেন না। আট নাম্বারে নেমে তার অপরাজিত ১১৩ আছে, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। অকল্যান্ডেই। তা অবশ্য বছয় ছয়েক আগের কথা। সবেধন নীলমণি ঐ একটি শতক ছাড়া তখন পর্যন্ত আর কোনো সেঞ্চুরি নেই স্মিথের ক্যারিয়ারে। তাহলে যা করার করতে হবে হ্যাডলিকেই। হ্যাডলিও তা-ই জানতেন। ইয়ান স্মিথও সেটাই মেনে নিয়েছিলেন। অধিনায়ককে সঙ্গ দেয়াটাকেই নিজের প্রথম এবং প্রধান দায়িত্ব বলে মনে করলেন। অধিনায়কের সঙ্গে তার ২৩ ওভারে ১০৩ রানের জুটিতে, স্মিথ রান করেছেন মাত্র ৩৮। দৃশ্যপটে তখনো হ্যাডলিই আছেন। হিরওয়ানির বলে ১০৮ বলে ৮৭ করে হ্যাডলি ফিরে গেলে নিউজিল্যান্ডের ইনিংসের থেমে যাওয়া সময়ের ব্যাপার মনে হলে দোষ ধরার উপায় নেই কিন্তু! 

২.

দ্য অ্যাশেজ, তৃতীয় টেস্ট, অ্যাডিলেইড। মন্টি নোবেলের অস্ট্রেলিয়ার ২৮৫-এর জবাবে ইংল্যান্ড থামল ৩৬৩ তে, লিড ৭৮ রান। দ্বিতীয় পালার ব্যাটিংয়ে অধিনায়ক মন্টি নোবেল ৬৫ করলেও দলের ব্যাটিং বিপর্যয় এড়াতে পারলেন না। স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়া ১৮০ রানে হারিয়ে বসল ৭ উইকেট। লিড মাত্র ১০২! এই সময়ে ক্রিজে এলেন ক্লেম হিল। হ্যাঁ, সেই ক্লেম হিল, অস্ট্রেলিয়ান বাঁহাতি গ্রেট। পেলেন হার্টিগানকে, যিনি মিনিট কয়েক আগেই নেমেছেন। তারপর দু’জনে মিলে অষ্টম উইকেট জুটিতে স্কোর বোর্ডে জমা দিলেন ২৪৩ রান! হার্টিগান ১১৬ করে ফিরলেও হিল ফিরলেন ১৬০ করে। দলের স্কোর তখন পেরিয়ে গেছে পাঁচশো। অস্ট্রেলিয়া ৪২৯ রানের টার্গেট ছুঁড়ে দিয়েছিলো সেবার ইংল্যান্ডকে।

ক্লেম হিল, অস্ট্রেলিয়ান বাঁহাতি গ্রেট; Image Source: Popperfoto/Getty Images

ভাবছেন, কী থেকে কী? ইয়ান স্মিথের গল্পে এই হিল-হার্টিগান, অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড চলে এলো কীভাবে?

১৯৯০ এর সেদিনের অকল্যান্ড পর্যন্ত, নয় নাম্বারে ব্যাটিং করতে নেমে, ৮২ বছর ধরে যে ক্লেম হিলের ১৬০-টাই ছিল সর্বোচ্চ!

৩.

হ্যাডলির বিদায়ের পর ধীরে ধীরে দিনটাকে নিজের মতো করে রাঙাতে শুরু করেন ইয়ান স্মিথ। যেন জানিয়ে দিতে চাইছিলেন, অকল্যান্ডের ইডেন পার্কে সেদিন কেবলমাত্র তিনিই স্বমহিমায় ভাস্বর হবেন। আর সবাই ম্লান হয়ে যাবেন স্মিথ নামক দ্যুতির ঔজ্জ্বল্যে। যেমনটা হয়েছিলেন হ্যাডলি-ওয়াসান। বেচারা ওয়াসান তো এক ওভারে ১৭, আর অন্য এক ওভারে ২৪ রানও বিলিয়ে ছিলেন। তার ৪০ রানে ৪ উইকেটের দারুণ ফিগারটা দিনশেষে দেখাচ্ছিলো: ১৬.৪ ওভারে ১০৮ রানে ৪ উইকেট। চার ম্যাচের ছোট্ট ক্যারিয়ারের মোট ১০ উইকেটের পাঁচটিই ছিল সে ম্যাচে, চারটিই ঐ ইনিংসে। অথচ স্মিথের তান্ডব তাকে কেমন ‘গোবেচারা’ বানিয়ে ছেড়েছিলো!

নিউ জিল্যান্ডের ইনিংসের জবাবে আজহারউদ্দীন খেলেছিলেন দুর্দান্ত এক ইনিংস। দ্বিশতকের পথেও ছিলেন ভালোভাবে। কিন্তু ১৯২ রানে আউট হয়ে গেলে তার ডাবল সেঞ্চুরির স্বপ্নের মৃত্যু হয় সেখানেই। এরও বছর কয়েক আগে একবার ১৯৯ করেও আউট হয়ে গিয়েছিলেন আজহার। এরপর আর কখনো ডাবল সেঞ্চুরি তো দূরের কথা, কাছেই ভিড়তে পারেননি তিনি!

অ্যান্ড্রু জোনস আর মার্টিন ক্রো’র যুগল সেঞ্চুরি, ড্যানি মরিসনের পাঁচ উইকেট; সব আলাপ আজ অন্তরালে। কেবল আলোচনায় আছেন ইয়ান স্মিথ। সেদিনের অকল্যান্ড কেবল ও কেবলমাত্র ইয়ান স্মিথেরই যে ছিল!

গ্লাভস হাতে ইয়ান স্মিথ; Image Source: PA Photos

৪.

মার্টিন স্নিডেন একপাশ থেকে সঙ্গ দিয়ে গেলেন শুধু, অথবা উপভোগ করে গেলেন স্মিথের অবিশ্বাস্য ব্যাটসম্যানশীপ। ১৩৬ রানের জুটিতে স্নিডেন জুড়েছেন মোটে ২২! সেই ১৩৬ রানের জুটিটা আবার নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের নবম উইকেটে ছিল সর্বোচ্চ। স্মিথ সেদিন যা ইচ্ছে, তাই যেন করতে পারছিলেন। হুক, পুল, অন ড্রাইভের সাথে কাট আর কভার ড্রাইভও খেলছিলেন অনায়াসে। উইজডেন স্মিথের ব্যাটিং বন্দনায় লিখে,

‘Most of Smith’s early runs came from hooks, pulls and on-drives but true to character, he later played a full measure of cuts, and strokes into the covers.’

৫৬ বলে পঞ্চাশ পেরোনো স্মিথ তিন অঙ্কে পৌঁছে যান মাত্র ৯৫ বলে। সেঞ্চুরির পর আরো উন্মত্ত হয়ে ওঠেন তিনি, ১১৮ বলে দেড়শো করে দিনশেষে অপরাজিত থাকেন ১২৮ বলে ১৬৯ করে।

‘অতিমানব’ স্মিথের অতিমানবীয়তায় ভর দিয়ে নিউজিল্যান্ড অবিশ্বাস্য এক দিনের পরিসমাপ্তি করে, ৯ উইকেটে ৩৮৭ রান করে। যা কি না টেস্টের কোনো এক দিনে নিউজিল্যান্ডের সর্বোচ্চ রান; আগের সর্বোচ্চ ছিল ৩৬৪, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে, ১৯৩২ সালে।

৫. 

১৬৯ করেছিলেন স্টুয়ার্ট ব্রডও। পাকিস্তানের বিপক্ষে, লন্ডনের লর্ডসে। মোঃ আমির তখন ১৮ বছরের টগবগে তরুণ। ইংলিশ গ্রীষ্ম উপভোগ করছেন দুর্দান্ত দাপটে। ২-১ এ সিরিজে পিছিয়ে থাকা পাকিস্তান সমতার লক্ষ্যে চতুর্থ টেস্ট খেলতে নামে লন্ডনে। আমিরের বোলিং তোপে ইংল্যান্ড ৪৭ রানে হারায় পাঁচ উইকেট, ১০২ রান তুলতে হারায় ৭ উইকেট। যার ছয়টিই পকেটে পুরেন আমির।

সেঞ্চুরির পর দর্শক অভিবাদনের জবাব দিচ্ছেন স্টুয়ার্ট ব্রড; Imege Source: Getty Images

আর তারপরই দৃশ্যপটে হাজির হন, স্টুয়ার্ট ব্রড। নাম্বার নাইন। পাকিস্তানি বোলিং নিয়ে ছেলেখেলা করে জোনাথন ট্রটের সঙ্গে গড়ে তোলেন ৩৩২ রানের পার্টনারশিপ! সাঈদ আজমলের বলে লেগ বিফোর হয়ে ইয়ান স্মিথ থেকে মাত্র চার দৌঁড় পেছনে থেকে শেষ করেন ব্রড। আর হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন ইয়ান স্মিথ, দীর্ঘ দুই দশক ধরে যে রেকর্ডটা নিজের করে রেখেছিলেন তিনি।

এখন তা হয়ে গেছে ঊনত্রিশ বছর। স্মিথ এখনও নয়ের সেরা হয়েই আছেন!

৬. 

১৬৯-এ দিন শেষ করা স্মিথ, পরদিন আর মিনিট কয়েকের বেশি টিকতে পারেননি। মনোজ প্রভাকরের বলে লেগ বিফোরের ফাঁদে পড়লে শেষ হয় অবিশ্বাস্য ইনিংসটির যাত্রা। স্মিথের স্বপ্নযাত্রার সমাপ্তিও বলা যায়। তবে সমাপ্তির আগে স্বপ্নযাত্রার এই সময়ে স্মিথ খেলে ফেলেন ১৩৬ বলে ১৭৩ রানের অনন্যসাধারণ এক ইনিংস, যা কি না কোনো নয় নাম্বার ব্যাটসম্যানের সর্বোচ্চ। প্রায় চার ঘন্টা (২৩৭ মিনিট) ব্যপী ইনিংসটাতে ছিল ২৩টি চার আর ৩টি ছয়, স্ট্রাইকরেট ১২৭।

মাইক্রোফোন হাতে, আথারটনের সাথে; Image Source: Getty Images

ক্রিকেট পরবর্তী জীবনে মাইক্রোফোনের কন্ঠস্বর হওয়ায়, হয়তো কোনো একদিন প্রেসবক্সে বসে দেখতে পারেন, তাকে তাড়া করছেন কোনো এক নয় নাম্বার ব্যাটসম্যান। ব্রডের মতো কেউ খুব কাছে গিয়েও শেষ মুহূর্তে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ করে দিতে পারেন তাকে। কখনো তার মনে উদিত হলেও হতে পারে, ইশ! সেদিনের সূর্যটা যদি আরো খানিক বাদে অস্তাচলে যেতো! স্বপ্নের দিনটার স্থায়িত্ব যদি আরো খানিকক্ষণ থাকতো! কে বলতে পারে, দ্বিশতকও সেদিন হয়ে যেত না?

দিনটা যে কেবল ও কেবলমাত্র ইয়ান স্মিথেরই ছিল!   

This article is in Bengali language. This is an article that is based on former kiwi cricketer Ian Smith's one-day special innings at number nine. Ian Smith to smack a sensational 173 off only 136 balls. At the close of the first day, New Zealand had careered to 387 for 9. Smith's 100 came up off 95 balls, at which point all hell broke loose: 23 balls later he passed 150.

Featured Image: Getty Images

Related Articles