Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

অস্কার পিস্টোরিয়াস: নক্ষত্রের পতন

ভ্যালেন্টাইনস ডে, ২০১৩।

রাত বাজে চারটে। দক্ষিণ আফ্রিকা পুলিশের অন্যতম ডিটেকটিভ হিল্টন বোথা আর তার স্ত্রী ঘুমে অচেতন। এমন সময় বেরসিকের মতো বেজে উঠল ফোন, বাজতেই থাকল।

ডিটেকটিভ বোথার পেশাগত জীবনের অনুষঙ্গই এমন রাত্রিকালীন কল। চোখ ডলতে ডলতে রিসিভার তুললেন তিনি। তার বস ফোন করেছেন। অপরপ্রান্তের কথা শুনে মুহূর্তের মধ্যেই ঘুম উধাও হয়ে গেলো বোথার। দ্রুত উঠে পোশাক পরে তৈরি হয়ে নিলেন তিনি।

স্ত্রী অড্রেও ততক্ষণে উঠে পড়েছেন। স্বামীর এহেন কাজকর্ম তার কাছে অপরিচিত নয় মোটেও। তিনি শুধু প্রশ্ন করলেন কী হয়েছে। বোথা জবাব দিলেন, অস্কার তার বান্ধবীকে গুলি করেছে।

কে এই অস্কার, তা অড্রেকে বলে দিতে হলো না। দক্ষিণ আফ্রিকার সবাই তাকে একনামে চেনে। তিনি দেশের সোনার ছেলে, বিখ্যাত প্যারালিম্পিয়ান অস্কার পিস্টোরিয়াস।  

পিস্টোরিয়াস আর রিভা সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন বেশ কিছুদিন © FRENNIE SHIVAMBU/EPA

কে এই অস্কার পিস্টোরিয়াস? 

দক্ষিণ আফ্রিকার নামকরা প্যারালিম্পিয়ান অস্কার পিস্টোরিয়াস। তার জন্ম ১৯৮৬ সালের ২২ নভেম্বর, জোহানেসবার্গে, দস্তা বা জিঙ্ক ব্যবসায়ী দম্পতি শিলা আর হেঙ্কে পিস্টোরিয়াসের ঘরে। ভূমিষ্ঠ শিশুকে পরীক্ষা করে চিকিৎসক তার বাবা-মা’কে দুঃসংবাদ দিলেন। তাদের ছেলের দুই পায়ে কোনো ফিবুলা  নেই।

টিবিয়া ও ফিবুলা পায়ের দু’টি হাড়, যা পাশাপাশি থাকে। হাঁটু থেকে গোড়ালি পর্যন্ত এই দুই হাড়ের অবস্থান। পায়ে ভর দিয়ে চলাচলের জন্য এদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কোনো একটি না থাকলে সমস্যা হয়ে যায়।

ছোট্ট অস্কার; Image Source: mirror.co.uk

 

ফিবুলা না থাকায় অস্কারের পক্ষে তার পা ব্যবহার করে হাঁটা শেখা সম্ভব হচ্ছিল না। বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করে তার এগার মাস বয়সে পরিবার তার দুই পা হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলার কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়। মা শিলা এসময় ছেলের জন্য একটি চিঠি লেখেন, ছেলেকে বলেন যে কোনো কিছুতে অংশগ্রহণ করে সে কখনো পরাজিত হয় না, পরাজিত সে-ই যে কি না অংশ না নিয়ে বসে থাকে। মায়ের আশা এই শিক্ষা বড় হয়ে পিস্টোরিয়াস কাজে লাগাবেন।   

কেটে ফেলার পর হাঁটুর সাথে লাগানো হয় ফাইবার গ্লাসের কৃত্রিম পা। এই পা দিয়েই অপারেশনের ছয় মাস পর্যন্ত প্রথম দুই পায়ে দাঁড়ালেন পিস্টোরিয়াস।  বাবা-মা তাকে স্বাভাবিক অন্য সব শিশুর মতোই বড় করতে থাকেন, উৎসাহ দেন খেলাধুলায়। প্রিটোরিয়াতে স্কুলে যেতেন পিস্টোরিয়াস, সেখানে অল্প বয়সের আরম্ভ করেন রাগবি আর ওয়াটার পোলো’র মতো খেলা।

পিস্টোরিয়াসের বয়স যখন ১৫, তখন তার জীবনে নেমে আসে ট্র্যাজেডি। মমতাময়ী মা ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় তাকে ছেড়ে পাড়ি জমান অন্য জগতে। মায়ের স্মৃতিতে তার জন্ম আর মৃত্যুর দিন নিজের হাতে পরে ট্যাটু করে নিয়েছিলেন পিস্টোরিয়াস।

দৌড়বিদ পিস্টোরিয়াস

২০০৩ সালে রাগবি খেলতে গিয়ে ইনজুরিতে পড়েন পিস্টোরিয়াস। এই সময় চিকিৎসকেরা তাকে পরামর্শ দেন নিয়মিত দৌড়ানোর, তাহলে তার সেরে উঠতে সময় কম লাগবে। এই পর্যায়ে নিজের জন্য আইসল্যান্ডের “অসার” (Össur) কোম্পানির নির্মিত কার্বন ফাইবারের কৃত্রিম পা ব্যবহার করতে থাকেন পিস্টোরিয়াস। এটা অনেকটা ব্লেডের আকৃতির হওয়ায় পরে তার নাম হয়ে যায় “ব্লেড রানার”।

ব্লেডের মতো কৃত্রিম পা ব্যবহার করেন বলে পিস্টোরিয়াস পরিচিত হন ব্লেড রানার © AP

২০০৪ সালের জুন থেকে অসারে’র ব্লেড ব্যবহার করে দৌড়ানো শুরু করেন পিস্টোরিয়াস। তখনও তিনি স্কুলে। সেই বছরই এথেন্স প্যারালিম্পিকে ১০০ আর ২০০ মিটার দৌড়ে অংশ নেন তিনি। প্রথমটিতে স্বর্ণ আর দ্বিতীয়টিতে ব্রোঞ্জ গলায় ঝোলালেন।

২০০৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট থাবো এম্বেকি’র থেকে খেলোয়াড়ি কৃতিত্বের জন্য অর্ডার অফ ইখামাঙ্গা (Order of Ikhamanga in Bronze/OIB) সম্মান গ্রহণ করেন পিস্টোরিয়াস।

পরের বছর জুলাইতে রোমে এক আমন্ত্রণমূলক প্রতিযোগিতায় শারীরিকভাবে পূর্ণ সক্ষম দৌড়বিদদের সাথে প্রথম এক কাতারে দাঁড়ান পিস্টোরিয়াস। ৪০০ মিটার দৌড়ে নিজের সবচেয়ে ভালো টাইমিং করেন তিনি, ৪৬.৯০ সেকেন্ড। তার পারফরম্যান্স দৃষ্টি কাড়ল ইন্টারন্যাশনাল ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডের নিয়ন্ত্রণ সংস্থার (আইএএএফ)। পিস্টোরিয়াসকে তারা ডেকে নেয় বেশ কিছু পরীক্ষার জন্য। ফলাফল দেখে তারা ঘোষণা করে কৃত্রিম পা’য়ের কারণে পিস্টোরিয়াস কিছু সুবিধা পেয়ে থাকেন, তাই সক্ষম দেহের অ্যাথলেটদের সাথে তার প্রতিযোগিতায় নামা নিষিদ্ধ করে তারা।

তবে পিস্টোরিয়াস ততদিনে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চেনা মুখ হয়ে উঠেছেন। ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে বিবিসি তাকে “স্পোর্টস পারসোন্যালিটি অব দ্য ইয়ার” ঘোষণা করে ‘হেলেন রোলাসন’ পদক তুলে দেয়। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সাহসী অর্জনের জন্য এই পদক দেয়া হতো। টাইম ম্যাগাজিন ২০০৮ সালে তাকে বিশ্বের ১০০ জন প্রভাবশালীদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে, ২০১২ সালে এই কীর্তি আরেকবার করে দেখান পিস্টোরিয়াস।    

বেইজিং ২০০৮

পিস্টোরিয়াস পাখির চোখ করেছিলেন বেইজিংকে। তার ইচ্ছে: এখানেই তিনি গড়বেন ইতিহাস, মাঠে নামবেন সক্ষম দেহের অ্যাথলেটদের সাথে অলিম্পিকের প্রতিযোগিতায়। তবে আইএএএফ তার পথে বাধা সৃষ্টি করে রেখেছিল।

পিস্টোরিয়াস আপিল করলেন কোর্ট অব আরবিট্রেশন ফর স্পোর্টসে। বিতর্কিত এক রায়ে তার বিরুদ্ধে দেয়া আইএএএফের নিষেধাজ্ঞা বাতিল করে কোর্ট। বেইজিং অলিম্পিকে নাম লেখানোর পথ উন্মুক্ত হয়ে যায় তার সামনে। কিন্তু প্রয়োজনীয় কোয়ালিফাইং টাইম করতে ব্যর্থ হন তিনি, তাই এ যাত্রা স্বপ্ন পূরণ হলো না।

প্যারালিম্পিকে অবশ্য তেমন কোনো সমস্যা ছিল না, পিস্টোরিয়াস ১০০, ২০০ আর ৪০০ মিটার দৌড়ে জয়ের মালা ছিনিয়ে নেন, বিশ্ব রেকর্ডও সেট করেন। এরপর অনেকটা খেলোয়াড়ি আইকনে পরিণত হন তিনি, নাইকিসহ অনেক বড় বড় কোম্পানি এগিয়ে আসে তার সাথে কাজ করতে। 

বেইজিং প্যারালিম্পিকে বিশ্ব রেকর্ড করেন পিস্টোরিয়াস; Image Source: nta.ng

২০১২ লন্ডন

পিস্টোরিয়াস এবার ২০১২ সালের অলিম্পিক নিয়ে প্ল্যান করতে শুরু করলেন। তবে ২০০৯ সালেই বড় একটা ধাক্কা খান তিনি। দক্ষিণ আফ্রিকার ভাল নদীতে বোট চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়েন; চোয়াল আর পাঁজরের কয়েকটি হাড় ভেঙ্গে যায়, আঘাত লাগে চোখে।

তিনদিন কোমায় থাকার পর জেগে ওঠেন পিস্টোরিয়াস। তার দেহে তখন ১৮০টি সেলাই পড়েছে। চেহারা মেরামত করে সার্জারি করা লাগে তার, পাঁচদিন কাটাতে হয় ইন্টেন্সিভ কেয়ারে। তবে দ্রুতই সেরে ওঠেন তিনি, আরম্ভ করেন প্রশিক্ষণ।

২০১১ সালে নিউ জিল্যান্ডে প্যারালিম্পিক ওয়ার্ল্ড কাপে ১০০ আর ৪০০ মিটারে স্বর্ণ জেতেন পিস্টোরিয়াস। ৪০০ মিটার রিলেতে গলায় ঝোলান রৌপ্য। সে বছরই ইটালির লুগানোতে ৪০০ মিটারে নিজের সেরা টাইমিং করে দেখান তিনি, ৪৫.০৭ সেকেন্ড। তবে দক্ষিণ আফ্রিকার নিয়মানুযায়ী এটিও তার অলিম্পিকে যোগদানের জন্য যথেষ্ট ছিল না। তবে তারা তাকে দলে ডাকে, ৪০০ মিটার ব্যক্তিগত ও রিলে দৌড়ে নাম লেখানো হয় তার। 

লন্ডন অলিম্পিকে ৪০০ মিটার ব্যক্তিগত দৌড়ে শারীরিকভাবে পূর্ণ সক্ষম অ্যাথলেটদের সঙ্গে ট্র্যাকে নেমে ইতিহাস গড়েন পিস্টোরিয়াস, যদিও ফাইনালে পৌঁছতে পারেননি তিনি। রিলেতে তার দল ফাইনালে উঠলেও পদক জেতা হয়নি।

লন্ডন অলিম্পিকে অংশ নিয়ে ইতিহাস গড়েন পিস্টোরিয়াস; Image Source: washingtontimes.com

রিভা স্টিনক্যাম্পের হত্যা

লন্ডন অলিম্পিক পিস্টোরিয়াসকে নিয়ে যায় খ্যতির শীর্ষে। বিশ্বজুড়ে শারীরিক আর মানসিকভাবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষদের কাছে তিনি অনুপ্রেরণা। মিডিয়াজুড়ে চলছে তার নামে স্তুতিবাক্য। কিন্তু ছয় মাস পরই সেখান থেকে ঘটে অকস্মাৎ পতন, যখন বান্ধবী রিভা স্টিনক্যাম্পকে খুনের দায়ে অভিযুক্ত হন তিনি।

২৬ বছরের পিস্টোরিয়াসের সাথে ২৯ বছরের আইনবিদ সহকারী ও মডেল স্টিনক্যাম্পের প্রণয় চলছিল বেশ কিছু সময় ধরেই। ২০১৩ সালের ভ্যালেন্টাইনস ডে ধুমধাম করে পালন করতে স্টিনক্যাম্প আর পিস্টোরিয়াস চলে যান জোহানেসবার্গের ত্রিশ মাইল দূরে প্রিটোরিয়া’তে তার পাঁচিল ঘেরা বাড়িতে।

রাত তিনটার সময় বাথরুমে থাকা মডেল স্টিনক্যাম্পকে বন্ধ দরজার মধ্য দিয়ে চারবার গুলি চালিয়ে হত্যা করেন পিস্টোরিয়াস। ময়নাতদন্তে পরে দেখা গিয়েছিল, একটি গুলি মাথায় আঘাত করেছিলো তার, বাকিগুলো লেগেছিল পেটে আর হাতে। পিস্টোরিয়াস এরপর ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে দরজা ভেঙ্গে ফেলেন, মৃত বান্ধবীকে দেখে সাথে সাথেই ফোন করেন পুলিশে।

পিস্টোরিয়াসের ফোনের পনের মিনিটের মাথায় তার বাড়িতে হাজির হলেন ডিটেকটিভ বোথা। পৃথিবী যে অদম্য, অনুপ্রেরণাদায়ী পিস্টোরিয়াসকে চেনে তার থেকে বোথার চেনা একটু ভিন্ন। ২০০৯ সালী এক পার্টিতে এক নারী অতিথিকে আঘাতের দায়ে আগেও তাকে গ্রেফতার করেছিলেন তিনি, যদিও পিস্টোরিয়াস সবটাই অস্বীকার করেন এবং তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ শেষ পর্যন্ত গঠন করা যায়নি।

পিস্টোরিয়াসের বাড়িতে গোলাগুলির ঘটনা শুনে হাজির হয় পুলিশ্; Image Source: bild.de

অকুস্থলে এসে বোথা দেখতে পান, স্টিনক্যাম্পের রক্তমাখা মৃতদেহ চাদরে জড়িয়ে সিঁড়ির তলে রাখা হয়েছে। কর্মচারীদের জেরা করে জানতে পারেন গুলির ঘটনার মিনিটখানেক পর পিস্টোরিয়াস নিজেই স্টিনক্যাম্পকে বাথরুম থেকে এখানে নিয়ে আসেন, এরপর তার নির্দেশে বাড়ির ম্যানেজার অ্যাম্বুলেন্স কল করেন। ইতোমধ্যেই পিস্টোরিয়াস নিজে বান্ধবীকে সিপিআর দেন।

বোথাকে জানানো হয় স্টিনক্যাম্প তখনও বেঁচে ছিলেন। প্রতিবেশী এক ডাক্তারও ছুটে এসেছিলেন, তবে মাথার আঘাতটি মারাত্মক থাকায় কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি।

বোথার কাছে এমন ঘটনা নতুন নয়। পুলিশি জীবনে ‘ইন্টিমেট পার্টনার ভায়োলেন্স’-এর এমন কাণ্ড বহু দেখেছেন তিনি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বন্ধু বা বান্ধবীটিই মূল হোতা হিসেবে চিহ্নিত হয়। তিনি পিস্টোরিয়াসের সাথে কথা বলতে গেলেন।

পিস্টোরিয়াস তখন গ্যারেজে বসে, তখনও রক্তমাখা কাপড় পাল্টাননি তিনি। অশ্রুসজল চোখে তিনি ডিটেকটিভকে বললেন যা ঘটেছে পুরোটাই দুর্ঘটনা, তিনি আসলে শব্দ পেয়ে মনে করেছিলেন কোনো ডাকাত বাথরুমে লুকিয়ে আছে, তাই গুলি চালিয়ে দিয়েছিলেন। এরপর ঘরে ফিরে আবিষ্কার করেন বান্ধবী উধাও। এরপরই ব্যাট দিয়ে দরজা ভেঙ্গে বাথরুমে ঢুকে তাকে দেখতে পান পিস্টোরিয়াস।  

বিচার

পিস্টোরিয়াসের গল্প বিশ্বাস করেননি ডিটেকটিভ। পরবর্তীতে স্টিনক্যাম্পের পরিবারও একে মনগড়া বলে উড়িয়ে দেয়। তাদের দাবি, কোনো চোর বা ডাকাত বাড়িতে ঢুকলে কোন আক্কেলে সে বাথরুমে দরজা আটকে বসে থাকতে যাবে? তাছাড়া পিস্টোরিয়াস যে বলছেন সন্দেহজনক শব্দ পেয়ে তিনি ঘুম থেকে উঠতে বন্দুক হাতে বেরিয়েছেন, তখনই তো তার খেয়াল করার কথা যে বান্ধবী পাশে নেই!

স্টিনক্যাম্পের ফোন তার পাশেই পড়ে ছিল, ফলে তার পরিবার উল্টো অভিযোগ করে আসলে পিস্টোরিয়াসের হাত থেকে বাঁচতেই বাথরুমে লুকিয়েছিলেন স্টিনক্যাম্প। সেখান থেকে ফোনে হয়তো সাহায্য চাইতে চেষ্টা করছিলেন, তখনই তাকে মেরে ফেলা হয়।   

পিস্টোরিয়াস ফেঁসে যান আরো একটি ইস্যুতে। যে বন্দুক দিয়ে গুলি চালিয়েছিলেন তিনি, সেটার কোনো লাইসেন্স ছিল না তার। সব মিলিয়ে বড় গাড্ডাতেই পড়েছিলেন তিনি, পুলিশ সেদিনই তাকে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেফতার করে।

তবে পিস্টোরিয়াস তার গল্প বদলাননি। সাতদিন পর জামিন শুনানিতে তার উকিল ব্যারি রু ব্যখ্যা করেন, বাথরুম থেকে সন্দেহজনক শব্দ পেয়েই গুলি করেন পিস্টোরিয়াস। দক্ষিণ আফ্রিকার তৎকালীন পরিস্থিতিকে এক্ষেত্রে সামনে আনেন তিনি। সেখানে তখন প্রতিদিন সহিংস অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। প্রায়শই বাড়িতে ডাকাতরা হামলা করত, মালামালের পাশাপাশি খুনজখমও করে রেখে যেতো তারা। উকিলের যুক্তি ছিল, তার মক্কেল এই ভয়টাই পেয়েছিলেন। 

তবে সরকারি উকিলের মন গললো না। আগস্টের ২৯ তারিখ ঠাণ্ডা মাথায় খুন আর অবৈধ অস্ত্র রাখার দায়ে পিস্টোরিয়াসের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করা হলো। দোষী সাব্যস্ত হলে কমসে কম ২৫ বছর জেল খাটতে হবে তাকে। পরের বছর বিচার শুরুর দিন নির্ধারিত হয়, একজন বিচারক অনুমতি দেন আদালত থেকে নির্দিষ্ট কিছু অংশ সম্প্রচারের।

২০১৪ সালের ৩রা মার্চ আরম্ভ হয় শুনানি, বিচারক থোকোজিলা মাসিপা। পিস্টোরিয়াসের বিপক্ষে স্টিনক্যাম্পকে নিয়মিত নির্যাতনের অভিযোগ তোলেন সরকারি উকিল। পুলিশের ক্যাপ্টেন ফ্রাসোয়া মুলার সাক্ষী দিতে এসে অভিযুক্তের সাথে স্টিনক্যাম্পের হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা দেখান।

বিচারক থোকোজিলা মাসিপার আদালতে আরম্ভ হয় পিস্টোরিয়াসের বিচার © Siphiwe Sibeko—Pool/Getty Images

মুলার জোর দেন মারা যাবার এক সপ্তাহ আগে স্টিনক্যাম্পের পাঠানো একটি বার্তার প্রতি, যেখানে মাথা গরম হলে পিস্টোরিয়াস তার ক্ষতি করে বসতে পারেন বলে আশঙ্কা করা হয়েছে। তবে অন্যান্য বার্তাগুলোতে আবার তাদের মধ্যে সুসম্পর্কের কথাই বলা ছিল। 

এপ্রিলের ৭ তারিখে পিস্টোরিয়াস নিজে সাক্ষী দিতে ওঠেন। সজল চোখে নিজের কৃতকর্মের জন্য স্টিনক্যাপের পরিবারের কাছে অনুশোচনা প্রকাশ করেন তিনি, তবে ঠাণ্ডা মাথার খুন ব্যাপারটা আবারও অস্বীকার করেন। 

যুক্তিতর্ক শেষ হয় আগস্টের আট তারিখে। ১১ সেপ্টেম্বর রায় ঘোষণা করলেন বিচারক। ঠাণ্ডা মাথায় খুনের যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি জানিয়ে আসামীকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন তিনি। 

অবিলম্বে পিস্টোরিয়াসকে নিয়ে যাওয়া হয় প্রিটোরিয়ার কোগোসি মাম্পুরু জেলখানাতে। এক বছর পরই তাকে জেল থেকে ছেড়ে চাচা আর্নল্ডের প্রিটোরিয়ার বাসায় গৃহবন্দী হিসেবে বাকি মেয়াদ পূর্ণ করার অনুমতি দেয়া হয়।

তবে বিচারক মাসিপার রায় মন ভরাতে পারেনি স্টিনক্যাম্পের পরিবার থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের। পিস্টোরিয়াস তার অবস্থানের জন্য অন্যায় সুবিধা পেয়েছেন বলে প্রচুর সমালোচনা ওঠে। সরকার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে। পিস্টোরিয়াস যখন গৃহবন্দীত্ব কাটাচ্ছেন, তখন আপিল কোর্ট রায় পরিবর্তন করে একে ‘ঠাণ্ডা মাথায় খুন’ বলে জানায়। ২০১৬ সালের জুলাইতে কারাবাসের মেয়াদ বাড়িয়ে করা হয় ছয় বছর। একই বছরের অক্টোবরে পিস্টোরিয়াসকে চাচার বাসা থেকে অ্যাটরিজভিল কারেকশনাল সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়।

কিন্তু শাস্তি অত্যন্ত লঘু হয়ে গেছে বলে আবারও সমালোচনা আরম্ভ হয়। সরকার এবার সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে। ২০১৭ সালে বিচারক উইলি সেরিটির নেতৃত্বে পাঁচজনের বেঞ্চ কারাবাসের মেয়াদ বাড়িয়ে করে দেয় পনের বছর। ইতোমধ্যে খেটে ফেলা সময় হিসেব করে পিস্টোরিয়াসকে আরো তের বছর পাঁচ মাস কারাগারে থাকতে হবে বলে রায়ে বলা হয়। স্টিনক্যাম্পের পরিবার এই রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে। 

সরকারি উকিলের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট পিস্টোরিয়াসের সাজা বাড়িয়ে দেন © AFP

বর্তমানে পিস্টোরিয়াস

পিস্টোরিয়াসের সাজা শেষ হবে ২০৩০ সালে, তবে ২০২১ সালের জুলাই থেকেই তিনি প্যারোলের যোগ্য বিবেচিত। কিন্তু এই সুযোগ পেতে হলে তাকে স্টিনক্যাম্পের মা-বাবার সাথে দেখা করতে হবে, যাকে দক্ষিণ আফ্রিকার বিচার ব্যবস্থায় “ভিক্টিম-অফেন্ডার ডায়ালগ” বলা হয়।

স্টিনক্যাম্পের বাবা-মা’র সাথে পিস্টোরিয়াসের দেখা করানোর কথা রয়েছে; Image Source: news.sky.com

স্টিনক্যাম্পের মা-বাবা দাবি করেছেন, প্যারোলে ছাড়ার আগে অবশ্যই পিস্টোরিয়াসকে তাদের মুখোমুখি হতে হবে। এজন্য তাকে অ্যাটরিজভিল থেকে সরিয়ে তাদের শহর কেবারহা’র (Gqerberha/পূর্ববর্তী পোর্ট এলিজাবেথ) একটি জেলে নিয়ে আসা হয়। কোভিডের মধ্যেই ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে প্যারোলের শুনানি হবার কথা থাকলেও স্টিনক্যাম্পের মা-বাবার সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করা না যাওয়ায় তা বাতিল হয়ে যায়।

দক্ষিণ আফ্রিকার বিচার বিভাগের কর্মকর্তা সিঙ্গাবাখু জুমালো জানিয়েছেন, এই দেখা করার বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর, এবং কাউকে এজন্য জোর করা যায় না। তাদের আশা এতটুকুই যে এর মাধ্যমে হয়তো দুই পক্ষই অতীতকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাবার শক্তিটুকু পাবে।

Related Articles