তামিম ইকবাল এখনও রাতে দুঃস্বপ্ন দেখেন কিনা, তা জানা সম্ভব না। কিংবা মুশফিকুর রহিম-সৌম্য সরকাররা সেদিন বেঁচে ফেরার পর এখনও ঠিকভাবে ট্রমা কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন কি না, সেটাও জানতে পারা অসাধ্য। তবে হ্যাঁ, এ কথা সত্যি যে, ২০১৯ সালের মার্চে নিউ জিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে মসজিদে বন্দুক হামলা থেকে বেঁচে ফেরা ছিল পুরো বাংলাদেশ দলের জন্যই এক নতুন জীবন।
সে কারণেই কি না, ফিউচার ট্যুর প্ল্যান (এফটিপি) অনুযায়ী, আসন্ন জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তান সফর নিয়ে দুশ্চিন্তার ভাঁজ বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি)। পূর্ব সূচি অনুযায়ী, পাকিস্তানে তিনটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ ও দু'টি সাদা পোশাকের টেস্ট ম্যাচের সিরিজ খেলতে যাওয়ার কথা তামিম-মুশফিকদের। কিন্তু ২০০৯ সালের শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট দলের উপর ভয়াবহ সেই জঙ্গী হামলার দুঃস্মৃতির প্রভাব তো রয়েছেই, সাথে এ বছর নিউ জিল্যান্ডে অল্পের জন্য বেঁচে ফেরার ঘটনা মিলিয়ে অনেকখানিই 'ব্যাকফুটে' বাংলাদেশ।
তবে হ্যাঁ, পাকিস্তানের সাথে ক্রিকেটীয় বন্ধুত্বটা বাংলাদেশের নতুন নয়। তাই যত কিছুই হোক, টি-টোয়েন্টি সিরিজটা খেলবে বাংলাদেশ। প্রশ্ন কেবল টেস্ট ক্রিকেট নিয়ে। কিন্তু পাকিস্তানের চাপ, খেলতে হবে পুরোটাই। এমনকি বাংলাদেশের টেস্ট খেলতে না চাওয়ার পিছনে ভারতের 'হাত'ও খুঁজে পেয়েছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী!
১.
২০০৯ সালে কুমার সাঙ্গাকারা, মাহেলা জয়াবর্ধনেদের উপর সিরিজ চলাকালীন সময়ে হামলার ঘটনায় ১০ বছর পাকিস্তানে টেস্ট ক্রিকেট হয়নি। ২০১৪ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটও হয়নি। এর মাঝে পুনরায় দেশটিতে ক্রিকেট ফেরাতে কম তদবির করেনি দেশটির সর্বোচ্চ ক্রিকেট সংস্থা পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (পিসিবি)। কিন্তু অবস্থার উন্নতি কিংবা আতঙ্ক; দুইয়ে মিলিয়ে আইসিসি থেকে অনুমতি মেলেনি। মাঝে অবশ্য ২০১৪ সাল ও তার পরবর্তী সময়ে নিজ আয়োজনে জিম্বাবুয়ের মতো দল দেশটিতে দ্বিপাক্ষিক সিরিজ খেলেছিল, কিন্তু সেটির পুরো দায়দায়িত্ব ছিল দুই দেশের। পরবর্তীতে চলতি বছরের অক্টোবরে সেই শ্রীলঙ্কাই সিরিজ খেলে গেল পাকিস্তানে।
কোনো অঘটন না ঘটলেও নিরাপত্তা ছিল বাড়াবাড়ি পর্যায়ের। লঙ্কান দলের সদস্যরা এই নিরাপত্তায় 'দমবন্ধ' হয়ে পড়ছিলেন বলেও খবর প্রকাশিত হয়েছিল।
সেই ধারাবাহিকতায়, শ্রীলঙ্কা যখন সফর করেছে, সেটাও আবার নিরাপদভাবে শেষ হয়েছে, তাতে করে খানিকটা হলেও আত্মবিশ্বাস ফিরে পাচ্ছে দেশটি। বাংলাদেশকে তাই পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দেওয়া হবে বলেও জানানো হয়েছে।
কিন্তু আসলেই কি নিরাপদ পাকিস্তান?
শুরুতে রাজি থাকলেও শেষ দিকে এসে মত ঘুরিয়ে ফেলার কারণ, নিউ জিল্যান্ডের ঘটনা। কিন্তু সেখানে ভারতের প্রভাব রয়েছে উল্লেখ করেছেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশি। তার মতে,বাংলাদেশ তাদের দল পাকিস্তানে পাঠাতে চেয়েছিল। কিন্তু ভারতের কারণে এখন অন্য কথা বলছে।
অন্যদিকে বিসিবির বক্তব্য, তারা একবারও বলেনি বাংলাদেশ যাবে না। আপত্তি, টেস্ট ম্যাচগুলো নিয়ে। মুখে প্রকাশ করা হোক বা না হোক, পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা যেকোনো দেশের জন্যই দুশ্চিন্তার খোরাক যোগাবে। সে কারণেই কি না সিরিজে অংশ নেওয়া নিয়ে অনাহূত সমস্যার সৃষ্টি। সে কারণেই বাংলাদেশ টেস্টের জন্য সময় নিতে চায়। এই সময় নেওয়ার উদ্দেশ্য, প্রথমে টি-টোয়েন্টি সিরিজ খেলার পর নিরাপত্তা অবস্থা দেখে তারপর টেস্ট খেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। সেক্ষেত্রে এই মুহূর্তে টেস্ট খেলার কোনো পথ দেখছে না সফরকারি দল।
বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন বলেছেন,
'আমি দলের ক্রিকেটার, কোচিং স্টাফ সবার সাথে কথা বলেছি। তাদের সাথে কথা বলে আমি যা বুঝেছি, তা হলো, এই মুহূর্তে পাকিস্তানে গিয়ে টেস্ট খেলার কোনো সুযোগ নেই। আমরা এরই মধ্যে পাকিস্তানকে এ ব্যাপারে জানিয়েছি। বলেছি, আমরা আপাতত কেবল টি-টোয়েন্টি খেলতে চাই। যদি তারা রাজি থাকে, তাহলে আমরা সরকারিভাবে ক্লিয়ারেন্সের জন্য চেষ্টা করবো। এটা বোর্ডের কোনো ইস্যু না, এটা নিরাপত্তা ইস্যু। তাই সরকারের হাতেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নির্ভর করছে।'
টেস্ট ম্যাচ খেলার মূল উদ্দেশ্য, এটি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের অন্তর্ভুক্তও। তাই ম্যাচ দু'টির গুরুত্বও বেশি। তবে এই নয় যে, ম্যাচগুলো এখনই না খেললেই নয়। নিজেদের সুবিধামতো সময়ে খেললেও একই অবস্থা থাকবে। এ কারণেই বিসিবি অতীতে সিরিজের টেস্ট ম্যাচ দু'টি নিরপেক্ষ ভেন্যুতে খেলার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। কিন্তু সেই তখনই পাকিস্তান সাফ জানিয়ে দেয়, নিরপেক্ষ ভেন্যুতে তারা এই টেস্টের আয়োজন করবে না।
তবে বাংলাদেশ বোর্ড চাইলেও সব কিছু হচ্ছে না। শুধু নিরাপত্তা, সরকারি সিদ্ধান্তই সব নয়। ক্রিকেটার মতামত তো বটেই, দলের কোচিং স্টাফদের প্রায় সবাই বিদেশি। তাদের কেউ পাকিস্তানে লম্বা সফরে রাজি নন। এ নিয়েও কথা বলেছেন বিসিবি সভাপতি। পাকিস্তান যে নিরাপত্তা ব্যবস্থা বাংলাদেশকে দিতে চাইছে, তা নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশের সাথে সাথে তিনি বলেছেন,
'আমাদের কোচরা যেতে চায় না। কেউ কেউ হয়তো রাজি, কিন্তু সেটা সংক্ষিপ্ত সফরের জন্য। ক্রিকেটাররা জানিয়েছে, তাদের পরিবার, আত্মীয়-স্বজন সবাই এ নিয়ে দুশ্চিন্তায়। এমন পরিবেশে কীভাবে সবকিছু হতে পারে?'
২.
সর্বশেষ ২০০৩ সালে পাকিস্তানের মাটিতে টেস্ট খেলেছিল বাংলাদেশ। তিন ম্যাচের সেই সিরিজের সবক'টিতেই হেরেছিল হাবিবুল বাশার সুমনরা। আবারও যখন ডাক আসছে, তখন বাংলাদেশ যেমন খেলতে মুখিয়ে আছে, তেমনই বাংলাদেশ সিরিজ নিয়ে দারুণ আশাবাদী পাকিস্তান দল নিজেদের সর্বোচ্চটা দিয়েই চেষ্টা করছে। মাঠে সেরা পারফরম্যান্স নিশ্চিতে যেমন জোর দেওয়া হচ্ছে, তেমনই মাঠের বাইরে দুই দলকে নিরাপত্তা দিতে নেওয়া হচ্ছে বিশ্বমানের উদ্যোগ। এরই মধ্যে দেশটিতে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ দল সফর করেছেন, এবং বিসিবিকে প্রতিবেদনও পেশ করেছেন, যেখানে পাকিস্তানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে মোটাদাগে সন্তুষ্টির কথাই বলা হয়েছে। কিন্তু এই নিরাপত্তায় বারবার কপালে ভাঁজ ফেলছে।
এমন অবস্থায়, বাংলাদেশের সফর নিয়ে 'না' করার কোনো কারণ দেখেন না পাকিস্তান দলের কোচ মিসবাহ-উল হক। তার মতে, কোনো ধরনের নিরপেক্ষ ভেন্যু নয়, বরং বাংলাদেশের উচিত পাকিস্তানে গিয়ে পুরো সিরিজ খেলার।
বাংলাদেশকে এই মুহূর্তে তাদের কতটা দরকার, তা উল্লেখ করেই তিনি বলেছেন,
'এই মুহূর্তে পাকিস্তানে টেস্ট ক্রিকেট আয়োজন করা খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। বাংলাদেশ যদি না আসে, তাহলে এটা হবে খুব হতাশাজনক। তারা (বাংলাদেশ) যখন এখানে এসে শুধুমাত্র টি-টোয়েন্টি খেলতে চাইছে, এবং টেস্ট খেলার জন্য নিরাপত্তাব্যবস্থাকে অজুহাত হিসেবে দেখানো হচ্ছে, তখন এটা খুব হাস্যকর। এগুলো আমার বোধগম্য হচ্ছে না।'
'আমি এখানে (না আসার) কোনো কারণই দেখছি না। আমার কাছে এটা স্রেফ অজুহাত মনে হচ্ছে। আমরা এমনিতেই অনেক কম টেস্ট খেলার সুযোগ পাই। সেখানে এই সিরিজটি না হলে পাকিস্তানের সাথে খুব অবিচার করা হবে।'
পাকিস্তান দলের টেস্ট অধিনায়ক আজহার আলীও বাংলাদেশের সফর নিয়ে চিন্তিত। বিশেষ করে, টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের কথা মাথায় রেখেই যেন হতাশা বাড়ছে তার।
তিনি বলেছেন,
'আমি আশাবাদী যে, পিসিবি ব্যাপারটি দেখবে। কিন্তু বাংলাদেশের সফর বাতিল করার কোনো কারণই আমি দেখছি না। এটা আইসিসির বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ। বিশ্ব একাদশ এখানে এসেছে, বর্তমান ক্রিকেটাররাও এখানে খেলছে। সবচেয়ে স্পেশাল ব্যাপার হলো, শ্রীলঙ্কা ক'দিন আগেই পাকিস্তানে এসে একটি নয়, দু'টি টেস্ট খেলেছে। যদি এশিয়ার দলগুলোই একে অপরকে সাহায্য না করে, এশিয়ার ক্রিকেট বোর্ড যদি একে অপরকে সাহায্য না করে, তাহলে এই দিন কীভাবে শেষ হবে?'
আজহার আলীর প্রশ্ন মিথ্যে নয়। কিন্তু অবস্থা ও পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশকেও ভাবতে হচ্ছে অন্যভাবে। বিসিবি যেমন চাইছে সিরিজটি সফলভাবে অনুষ্ঠিত হোক, তেমনই চাইছে না ক্রিকেটারদের উপর চাপ দিয়ে সিরিজে অংশ নিতে। যেমনটা বলেছেন বিসিবি সভাপতি,
'আমরা কখনোই পাকিস্তানে যাওয়ার জন্য আমাদের ক্রিকেটারকে জোর করতে পারব না। কেউ যদি যেতে না চায়, সে যাবে না। পাকিস্তানে যেতে কোনো ক্রিকেটারকে চাপ দেওয়া হবে না।'
বাংলাদেশ এরই মধ্যে নিজেদের টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ শুরু করেছে ভারতের বিপক্ষে। সেখানে বাজেভাবে হারলেও পাকিস্তানের বিপক্ষে মুশফিকুর রহিম-মাহমুদউল্লাহ রিয়াদরা হেরেছেও বাজেভাবে। তাই পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে তারাও ঘুরে দাঁড়াতে চাইবে। দিনশেষে জয়টা ক্রিকেটেরই হবে, এটাই হয়তো চাইবে সবাই। কিন্তু, ক্রিকেটের বাইরেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিছু আছে, সেটাও মনে রাখা প্রয়োজন।
This is an article based on Bangladesh's cricket tour to Pakistan. There is a security issue regarding the tour to Pakistan for test cricket. All necessary links have been hyperlinked.
Feature Photo: Indiantimes.com