Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

খালেদ মাসুদ পাইলট: বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রথম সিরিজ সেরা

ক্রিকেট খেলায় ম্যান অব দ্য ম্যাচ বলতে আমরা কী বুঝি? একটা ম্যাচে সব খেলোয়াড়ের মাঝে সবচেয়ে ভালো খেলেছেন এমন কিছু। ম্যান অব দ্য সিরিজ বলতে আমরা কী বুঝি? একজন খেলোয়াড় কোনো একটি সিরিজে সবচেয়ে ভালো খেলেছেন।

তবে ভালো-খারাপ যা-ই খেলুক না কেন, সচরাচর খুব এক্সট্রা অর্ডিনারি কিছু না করলে পরাজিত দল থেকে কাউকে ম্যান অব দ্য ম্যাচ অথবা ম্যান অব দ্য সিরিজের পুরষ্কার দেওয়া হয় না। ম্যান অব দ্য সিরিজের পুরষ্কার পাওয়া এমনিতেই খুব কঠিন কাজ। আর ছোট দলে খেলে সেটা পাওয়া তো আরো বেশি কঠিন। বিশেষ করে ২০০০ সালের বাংলাদেশ দলের কথা চিন্তা করলে সেটা অসম্ভবের পর্যায়েই পড়ে।  

বাংলাদেশের পক্ষে এখন পর্যন্ত ওয়ানডেতে সবচেয়ে বেশি ম্যান অব দ্য সিরিজের পুরষ্কার পেয়েছেন সাকিব আল হাসান, পাঁচবার। কেউ কি জানেন, বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম ম্যান অব দ্য সিরিজ হয়েছেন কোন খেলোয়াড়?

ইতিহাস সৃষ্টিকারী সেই খেলোয়াড়টি হচ্ছেন খালেদ মাসুদ পাইলট।

শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ২০০২ সালের সেই সিরিজ ছিল শ্রীলঙ্কার মাটিতেই। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বাংলাদেশের পারফর্মেন্স আগে বেশ খারাপই ছিলো। সেই সিরিজটাও ভালো কাটেনি। তবে এর মাঝেও মাসুদ ব্যতিক্রম ছিলেন।  

সিরিজের প্রথম ম্যাচেই ৮৬ রানে ৪ উইকেট পড়ার পর তুষার ইমরানকে নিয়ে ৯০ রানের জুটি করেন। ১৭৬ রানে তুষারও তাকে ছেড়ে চলে যান। লোয়ার অর্ডারের ব্যাটসম্যানদের সঙ্গী করে শেষ পর্যন্ত ২২৬ রান পর্যন্ত করতে পারে বাংলাদেশ, যাতে পাইলটের ৫৪ রান বড় অবদান রাখে। ম্যাচ অবশ্য শ্রীলঙ্কা জিতে নেয় ৫ উইকেটে।  

সিরিজ সেরা হবার পেছনে অধিনায়কত্ব একটি বড় ভূমিকা রেখেছিল; Image Source: YouTube

দ্বিতীয় ম্যাচে বাংলাদেশের আরো জঘন্য অবস্থা হয়। মাত্র ৭৬ রানে অল আউট হয়ে যায় বাংলাদেশ। পাইলট দলীয় সর্বোচ্চ ১৫ রান করে শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হন। মাত্র ১৫ ওভারেই ২ উইকেট হারিয়ে জিতে যায় শ্রীলঙ্কা।

সিরিজের ৩য় ম্যাচে শ্রীলঙ্কা প্রথমে ব্যাট করে দাঁড় করায় ২৫৮ রানের এক শক্ত স্কোর। বাংলাদেশ অল আউট হয় ২০০ রানে। এর মাঝে পাইলট করেন ৩৭ রান।

সিরিজের প্রাপ্তি ছিল অধিনায়ক পাইলটের ম্যান অব দ্য সিরিজের পুরষ্কার পাওয়া। এরপর আরো কতজনে কত কিছু হবে, কিন্তু প্রথমজনের তো আলাদা কিছু মর্যাদা প্রাপ্য থাকে।

সিরিজের একটি ম্যাচেও নিজের দল জয় পায়নি। ব্যক্তিগতভাবে একটি ম্যাচেও ম্যান অব দ্য ম্যাচ হননি। সিরিজের সর্বোচ্চ রান করেননি কিংবা সবচেয়ে বেশি উইকেটও পাননি। এরপরেও ম্যান অব দ্য সিরিজ পাওয়ায় ভূমিকা রেখেছিল অধিনায়কত্ব আর লড়াকু মানসিকতা। এভাবে বিশ্বের আর কেউ সম্ভবত ম্যান অব দ্য সিরিজের পুরষ্কার পাননি।

যেকোনো একটি দেশের জনগণের মনে খেলাধুলায় উম্মাদনা তৈরির জন্য একটি বড় ধরনের সফলতার প্রয়োজন। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল সেই সফলতা আনতে পেরেছিল ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফি জয়ের মাধ্যমে। ফাইনাল ম্যাচের শেষ বলে যখন জয়ের জন্য বাংলাদেশের ১ বলে ১ রান প্রয়োজন ছিল, তখন উত্তেজনায় ফুটছিল বাংলাদেশের মানুষ। হাসিবুল হোসাইন শান্তর দৌড়ে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ জিতে গেলেও সেই ম্যাচ জয়ের পেছনে পাইলট রেখেছিলেন বেশ বড় ভূমিকা। একটা পর্যায়ে বাংলাদেশের প্রয়োজন ছিল শেষ ৬ বলে ১১ রান। শেষ ওভারের প্রথম বলেই ছক্কা মেরে ম্যাচটা হাতের নাগালেই নিয়ে আসেন পাইলট। শেষ পর্যন্ত অপরাজিত ছিলেন ১৫ রানে, মাত্র ৭ বলে। টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের পক্ষে সবচেয়ে বেশি ব্যাটিং গড় ছিল (৯২) তারই।

সেমি ফাইনালের ম্যাচে তিন নম্বরে নেমে ৭০ রানের এক ইনিংস খেলে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন।

কিপিংয়ে বাংলাদেশ দলে তার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না; Image Source: WN.com

পাইলটের সবচেয়ে বড় যে গুণটা ছিল সেটা হচ্ছে দলের জন্য আত্মনিবেদন। দলের প্রয়োজনে অনেকসময় ব্যক্তিস্বার্থকেও জলাঞ্জলি দিয়েছেন। তার সময়ে দলের একমাত্র উইকেট কিপার ছিলেন তিনি। কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীই ছিল না সেই সময়। অথচ শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে একটি টেস্ট সিরিজে নিজে না খেলে মুশফিকুর রহিমকে খেলার সুযোগ দেন। মুশফিক সেই ম্যাচে ৮০ রানের এক ইনিংস খেলেন। পরবর্তীতে পাইলটকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেছিলেন,

“শ্রীলঙ্কাকে অলআউট করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে উইকেট যেহেতু ফ্ল্যাট, এখানে দেড়-দুই দিন ব্যাটিং করে ফেলতে পারলে টেস্ট ড্র করার একটা সুযোগ তৈরি হবে। আমার কাছে মনে হয়েছিল আমার বদলে মুশফিক ম্যাচটাতে ভালো খেলবে।”

মাশরাফির সাথে; Image Source: The Daily Star

শুধু এটাই নয়, দলের ভেতর এমন কোনো কাজে সায় দিতেন না যাতে অন্তর্কলহ তৈরি হয় অথবা দলের কারো মনে আঘাত লাগে। ২০০১ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজে অধিনায়ক ছিলেন দুর্জয়। কিন্তু টেস্ট সিরিজ শেষে সিদ্ধান্ত হয়, ওয়ানডে সিরিজের অধিনায়ক হবেন পাইলট। যেখানে অন্য সবাই অধিনায়কত্ব পাবার জন্য লালায়িত থাকে, সেখানে পাইলটের অভিব্যক্তি ছিল ভিন্ন রকম। বিনয়ের সাথে প্রস্তাবটা প্রত্যাখান করেন পাইলট এবং বলেন,

আমি খুব খুশি হব, যদি এই সিরিজে দুর্জয়কে রেখে পরের সিরিজে আমাকে অধিনায়ক করা হয়। কারণ এভাবে সিরিজের মাঝপথে কাউকে ছুড়ে ফেলাটা ভীষণ অসম্মানজনক।

যদিও নির্বাচকরা পাইলটের সেই অনুরোধ রাখেননি। ওয়ানডে সিরিজটাতে তাই পাইলটকেই অধিনায়কত্ব করতে হয়েছিল। শুধু সেই সিরিজেই নয়, ২০০৩ সালে পাকিস্তান সফরের শেষ টেস্টের আগেও খালেদ মাহমুদ সুজনের পরিবর্তে পাইলটকে অধিনায়ক হবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন নির্বাচকরা। কিন্তু সেবার দৃঢ় কন্ঠে প্রস্তাবটা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন পাইলট। বলেছিলেন,

আমি আর নেব না। কারণ আমাকে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। দুর্জয়কে বাদ দেওয়ার সময় আমার খুব খারাপ লেগেছিল। আপনাদের কাছে অনুরোধ, পারলে সুজনকে এই অসম্মানটা করবেন না।

এই যুগে এই ধরনের মানুষ খুজে পাওয়াটাই তো প্রায় অসম্ভবের মতো।

ক্রিকেটার হওয়াটা হয়েছিল হুট করেই। খেলাধুলার সাথে সখ্যতা ছিল পারিবারিক ভাবেই। পাইলটের বাবা এবং চাচারা ছিলেন ৭ ভাই, সবাই ফুটবল খেলতেন। পাইলটের বাবা শামসুল ইসলাম ঢাকা লিগেই খেলেছেন ২০ বছর। পূর্ব পাকিস্তানের হয়ে সেই সময় জাতীয় দলেও সুযোগ পেয়েছিলেন। খেলার সুযোগ না পেলেও পাকিস্তানের যুব দলের হয়ে রাশিয়া সফর করেছিলেন।

ফুটবলই ছিল তাই পাইলটের ভালোবাসা। কিন্তু ১৯৮৭ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপের সময় রাজশাহীর জেলখানা মাঠে মিঠু স্মৃতি ক্রিকেট টুর্নামেন্টে রাজশাহী স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে খেলার সুযোগ পেয়ে গেলেন ক্লাস সেভেনে পড়া পাইলট। নেমে প্রথম ম্যাচেই করে ফেললেন ফিফটি। সেই টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ স্কোরারও হয়ে যান তিনি। সেই সময় শ্রীলংকার ডুমিন্ডা নামের এক বোলার ছিলেন যাকে ঢাকার কেউ খেলতে পারতেন না। তাকেও এক ম্যাচে মেরে ৯৪ রানের একটা ইনিংস খেলে ফেললেন পাইলট। ব্যাস, এরপরেই তার নাম-ডাক ছড়িয়ে পড়লো সবজায়গায়। এর পরপরই ঢাকা থেকে তার ডাক আসে। শুরুটা ওয়ারীর হয়ে হলেও পরবর্তীতে কলাবাগানের হয় তিন বছর খেলেন। এরপর আবাহনী-মোহামেডানের হয়েও মাঠ মাতিয়েছেন।

জাতীয় দলের হয়ে সুযোগ পেয়েছিলেন খুব অল্প বয়সেই Image Source: gettyimages.ca

জাতীয় দলের হয়ে প্রথম সুযোগ মেলে অনুর্ধ্ব ১৯ এর হয়ে ১৯৯৩ সালে। পরের বছরেই সফরে আসা ইংল্যান্ড ‘এ’ দলের বিপক্ষে সেঞ্চুরি তাকে মূল দলে জায়গা পাইয়ে দেয়। ১৯৯৫ সালের শারজাহ কাপেই ওয়ানডেতে অভিষেক হয়ে যায়। এরপর তো বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি স্মরণীয় কাজেরই অংশ হয়ে গিয়েছিলেন পাইলট।

বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টের সময় দলের প্রয়োজনে পাইলট ঠেকিয়ে খেলছিলেন। সেই সময় টিকে থাকাটাই ছিল মূল উদ্দেশ্য, রানটা ভাবার বিষয় ছিল না। তখন সৌরভ গাঙ্গুলী এসে বললেন, “এত বিরক্তিকর ব্যাটিং কোথা থেকে শিখেছ?” উত্তরে পাইলটও কম যান না। বললেন,

তোমাদের সুনীল গাভাস্কারের কাছ থেকে। তিনি তো ৬০ ওভার মাঠে টিকে ১৭৪ বল খেলে তুলেছিলেন মাত্র ৩৬ রান! মনে নেই?

লড়াকু মানসিকতার পাইলট মাঠে প্রতিপক্ষকেও ছাড় দেননি।   

দেশের হয়ে একটি টেস্ট সেঞ্চুরিও করেছেন Image Source: Dhaka Tribune 

দেশের হয়ে একটি টেস্ট সেঞ্চুরিও করেছেন, সেটাও দলের খুব প্রয়োজনের সময়ে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তাদের মাঠেই সিরিজের প্রথম টেস্টে বাংলাদেশ যখন ২য় ইনিংসে ব্যাট করতে নামলো তখন লিড পেয়েছিল ৫২ রানের। কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসে যেন পিচটা ব্যাটসম্যানদের জন্য বধ্যভূমিতে রুপান্তরিত হলো। মাত্র ৭৯ রানেই স্বীকৃত প্রথম ৬ জন ব্যাটসম্যান সাজঘরে ফিরে যাওয়ার পর পাইলট মাঠে নামলেন। তার সেঞ্চুরিতেই বাংলাদেশ দাঁড় করালো ২৭১ রানের একটি স্কোর। সেই টেস্ট ড্র করতে পেরেছিল বাংলাদেশ।  

৯৯ বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারানো সেই ঐতিহাসিক ম্যাচের একটা মূহুর্ত; Image Source: Bangla Cricket 

৪৪টি টেস্টে মাত্র ১৯.০৪ গড়ে ১৪০৯ রান করা পাইলটকে পরিসংখ্যান দিয়ে বুঝতে চাওয়াটা বোকামি। কিন্তু যারা প্রকৃত ক্রিকেট ফ্যান তারা বাংলাদেশ ক্রিকেটে পাইলটের অবদানের কথা কখনোই ভুলতে পারবে না।

ভুলে যাওয়া সম্ভবও না।

This article is in Bangla language. This article is about Khaled Masud Pilot, A former Bangladeshi cricketer who won the first man of the series award for Bangladesh cricket team.

Necessary sources are hyperlinked with this article.

1. সবচেয়ে বেশি ম্যান অব দ্য সিরিজ - ESPN

3. শ্রীলংকা বাংলাদেশের প্রথম ম্যাচের স্কোরকার্ড - ESPN

4. শ্রীলংকা বাংলাদেশের দ্বিতীয় ম্যাচের স্কোরকার্ড - ESPN

5. শ্রীলংকা বাংলাদেশের তৃতীয় ম্যাচের স্কোরকার্ড - ESPN

6. আইসিসি ১৯৯৭ ট্রফির ব্যাটিং গড় - ESPN

7. একটা চক্রের কারণে খেলতে পারিনি - Kaler Kantho

8. ক্রিকেটে কত কিছু হয়!- Prothom Alo

Image Source: Dhaka Tribune

Related Articles