ক্লাব পর্যায়ে দুই মহাদেশেরই সর্বোচ্চ শিরোপার ছোঁয়া পেয়েছেন যারা

ক্লাব ফুটবলে সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন ট্রফি কোনটি?

অনেকেই উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের কথা বলবেন। সেটি অবশ্য ভুল হবে না, কারণ এই আসরে ইউরোপের বিভিন্ন লিগের সেরা দলগুলো প্রতিযোগিতা করে। সব বড় বড় খেলোয়াড়ই এই আসরে নিজেদের সেরাটা দেবার জন্য উম্মুখ হয়ে থাকেন। এই আসরের চ্যাম্পিয়ন হবার অর্থ হচ্ছে পুরো ইউরোপের সেরা হওয়া। আর কে না জানে যে, বিশ্ব ফুটবলের সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ টুর্নামেন্ট এই ইউরোপেই হয়।

ইউরোপের সর্বোচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন শিরোপা; Source: goal.com

কিন্তু মর্যাদার বিচারে ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপকে কি পেছনে ফেলা উচিত? বরং উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ীকে ইউরোপের চ্যাম্পিয়ন আর ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়নকে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন বলার কারণে ক্লাব বিশ্বকাপ টুর্নামেন্টকে বেশি মর্যাদা দেওয়াটা যৌক্তিক। কিন্তু এরপরও প্রতিদ্বন্দ্বিতার অভাবের কারণে মানুষ ক্লাব বিশ্বকাপকে খুব বেশি মর্যাদা দিতে চায় না। এই টুর্নামেন্টে সব মহাদেশীয় ক্লাব চ্যাম্পিয়নরা অংশগ্রহণ করলেও সচরাচর ধরে নেওয়া হয় যে, ইউরোপের ক্লাবটিই চ্যাম্পিয়ন হবে।

এককথায় বলে দেওয়া যায় যে, উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতাটাই বেশি কঠিন। পক্ষান্তরে ক্লাব বিশ্বকাপে যে দলগুলো আসে তাদের মাঝে ইউরোপের দলটি বাদে বাকি দলগুলো ইউরোপের অন্যান্য যেকোনো দলের কাছে হেরে যাবার সম্ভাবনাই বেশি। ক্লাব বিশ্বকাপের বাকি দলগুলো খেলতে আসে মোটামুটি বাছাই প্রক্রিয়ার কারণে। কাজেই ইউরোপের ক্লাবের চ্যাম্পিয়ন না হওয়াটাই অঘটন ধরে নেওয়া হয়। আপনি যখন চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতবেন, তখন আপনি ইউরোপের চ্যাম্পিয়ন। কিন্তু ক্লাব বিশ্বকাপ যখন না জিতবেন, তখন কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে আপনার ক্লাব সেই বছরের বিশ্বের সেরা ক্লাব নয়। ২০০৬ সালে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছিল রোনালদিনহোর স্বপ্নের বার্সেলোনা। কিন্তু সেই বছরের ক্লাব বিশ্বকাপ জিতেছিল ব্রাজিলিয়ান ক্লাব ইন্টারন্যাসিওনাল। তাই আনুষ্ঠানিকভাবে সেই বছরের পুরো বিশ্বের সেরা ক্লাব কিন্তু বার্সা নয়, সেটা ইন্টারন্যাসিওনাল।

দক্ষিণ আমেরিকার সর্বোচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন শিরোপা; Source: Torcedores.com

তবে বিপরীতেও কথা থাকে। চারবার চ্যাম্পিয়নস লিগ আর একবার ক্লাব বিশ্বকাপ জয়ী ক্লাব এবং দুবার চ্যাম্পিয়নস লিগ আর দুবার ক্লাব বিশ্বকাপ জয়ী ক্লাবের মাঝে কোনটিকে এগিয়ে রাখবেন? বেশিরভাগ মানুষ কিন্তু প্রথমটিকেই রাখবে। এর থেকে আবার ধারণা করা যায় যে, চ্যাম্পিয়নস লিগের মর্যাদাটাই আসলে বেশি।

তবে বিষয় যা-ই হোক, ক্লাব বিশ্বকাপের বিষয়টিকে যদি মাথা থেকে একপাশে সরিয়ে রেখে হিসাব করা যায়, তাহলে বলা যায় ইউরোপের দলগুলোর জন্য সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ টুর্নামেন্ট হচ্ছে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ, আর দক্ষিণ আমেরিকার ক্লাবগুলোর মাঝে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ টুর্নামেন্ট হচ্ছে কোপা লিবার্তাদোরেস।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে ইতিহাসে এমন কোনো খেলোয়াড় আছেন কি, যিনি কিনা উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ আর কোপা লিবার্তাদোরেস দুটোই জয় করতে পেরেছেন?

এখানে একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে যে, কাজটি করা সম্ভব কেবলমাত্র ল্যাটিন খেলোয়াড়দের জন্য। সচরাচর ল্যাটিন খেলোয়াড়রাই ইউরোপে খেলার জন্য আসে, ইউরোপের খেলোয়াড়দের ল্যাটিনে যাবার রেকর্ড খুব সম্ভবত নেই। ইউরোপের লিগের মান উন্নত- এই যুক্তির সাথে সাথে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, ইউরোপের জীবনযাত্রার মানও যথেষ্ট উন্নত। এই কারণেই ল্যাটিনের সেরা খেলোয়াড়েরা ইউরোপে আসতে আগ্রহী হন।

মূল প্রসঙ্গে চলে আসা যাক।

ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, এ পর্যন্ত মাত্র নয় জন খেলোয়াড়ের ভাগ্যে দুটো ট্রফিতেই চুমু খাবার সৌভাগ্য হয়েছে। অনুমিতভাবেই খেলোয়াড়দের সবাই ল্যাটিনের। তাদের কীর্তিগুলোর দিকে একটু চোখ বুলানো যাক।

দিদা

১৯৯৭ সালে ব্রাজিলিয়ান ক্লাব ক্রুজেরিওর হয়ে কোপা লিবার্তাদোরেস জেতেন দিদা। ইউরোপে মিলানের হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতেন দুবার; ২০০২-০৩ আর ২০০৬-০৭ মৌসুমে।

দিদা, একমাত্র গোলকিপার হিসেবে এই অর্জনের অধিকারী; Source: goal.com

এছাড়া তিনি করিন্থিয়াসের হয়ে ২০০০ সালে এবং মিলানের হয়ে ২০০৭ সালে ক্লাব বিশ্বকাপও জেতেন।

কাফু

সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্রাজিলিয়ান এই ডিফেন্ডার সাও পাওলোর হয়ে কোপা লিবার্তোরেস জেতেন ১৯৯২ আর ১৯৯৩ সালে। এসি মিলানের হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতেন ২০০৬-০৭ সালে।

কাফু, যিনি সর্বকালের অন্যতম সেরা রাইটব্যাক হিসেবেও পরিচিত; Source: Goal.com

এছাড়া সাও পাওলোর হয়ে ১৯৯২ আর ১৯৯৩ সালে ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ আর মিলানের হয়ে ২০০৭ সালের ক্লাব বিশ্বকাপও জিতেছেন কাফু।

রকি জুনিয়র

ব্রাজিলিয়ান এই ডিফেন্ডার পালমেইরাসের হয়ে কোপা লিবার্তাদোরেস জেতেন ১৯৯৯ সালে। তিনি চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতেন মিলানের হয়ে, ২০০২-০৩ সালে।

পাবলো সরিন

সরিন জুভেন্টাসের হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতেন ১৯৯৫-৯৬ মৌসুমে। আর কোপা লিবার্তাদোরেস জেতেন রিভার প্লেটের হয়ে, ১৯৯৬ সালে।

কার্লোস তেভেজ

তেভেজ বোকা জুনিয়র্সের হয়ে ২০০৩ সালে জেতেন কোপা লিবার্তাদোরেস, স্বীকৃতিস্বরূপ পান ২০০৩ সালের দক্ষিণ আমেরিকার বর্ষসেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার। চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতেন তিনি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে, ২০০৭-০৮ মৌসুমে।

তেভেজ ছিলেন ইউনাইটেডের সেরা সময়ের এক যোদ্ধা; Source: Buzz Nigeria

তিনিও সেই স্বল্প সংখ্যক খেলোয়াড়দের মাঝে একজন, যিনি কিনা ল্যাটিন আমেরিকা এবং ইউরোপ দুই জায়গার ক্লাবের হয়েই ক্লাব বিশ্বকাপ জয় করেছেন। ল্যাটিন আমেরিকার হয়ে তিনি জিতেছেন ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ।

ওয়াল্টার স্যামুয়েল

আর্জেন্টাইন, মূলত সেন্টার ব্যাক পজিশনে খেলতেন। ২০০০ সালে বোকা জুনিয়র্সের হয়ে স্যামুয়েল জেতেন কোপা লিবার্তাদোরেস, আর ২০০৯-১০ সালে ইন্টারমিলানের হয়ে জেতেন চ্যাম্পিয়নস লিগ।

স্যামুয়েলস ছিলেন খুবই শক্ত প্রতিপক্ষ; Source: Zimbio

রোনালদিনহো

রোনালদিনহো ২০০৫-০৬ সালে বার্সালোনার হয়ে জেতেন চ্যাম্পিয়নস লিগ। ১৯৯২ সালের পর ক্লাবের ইতিহাসে বার্সা সেবার দ্বিতীয়বারের মতো জিতে নেয় এই ট্রফি।

রোনালদিনহো; Source: Twitter

এরপর ২০১৩ সালে অ্যাথলেটিকো মিনেইরোর হয়ে রোনালদিহো জেতেন ক্লাবটির ইতিহাসের প্রথম কোপা লিবার্তোদোরেস। টুর্নামেন্টে রোনালদিনহো চারটি গোল আর সাতটি অ্যাসিস্ট করেন। তবে পরিসংখ্যানও সবসময় ম্যাজিকের বিষয়গুলো ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয় না। সেমিফাইনাল আর ফাইনাল ম্যাচ দুটো হয়েছিল দুই লেগ করে। দুটি ম্যাচেই প্রথম লেগে অ্যাথলেটিকো মিনেইরো হারে ২-০ গোলে। কিন্তু দুই ক্ষেত্রেই রোনালদিনহোর ম্যাজিকে পরের লেগে দুর্দান্তভাবে ফিরে এসে টাইব্রেকারে ম্যাচ দুটো জিতে নেয় তারা। এই পারফর্মেন্সের জন্য রোনালদিনহো ২০১৩ সালের দক্ষিণ আমেরিকার বর্ষসেরা পুরস্কার জিতে নেন

নেইমার

পেলের ১৯৬৩ সালের পর সান্তোস আর দক্ষিণ আমেরিকার সেরা ক্লাবের স্বীকৃতি পাচ্ছিল না। কিন্তু তাদের এই আক্ষেপটা ঘোচানোর জন্য আসে নেইমার নামের এক রাজপুত্র, সান্তোসের হয়ে কোপা লিবার্তোরেস জেতে ২০১১ সালে। সাত গোল করে টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা হন নেইমার, যার মাঝে ২-১ গোলে জেতা ফাইনালের প্রথম গোলটিও তার ছিল। তার এই পারফর্মেন্স তাকে ২০১১ সালে দক্ষিণ আমেরিকার বর্ষসেরা খেলোয়াড়ে পরিণত করে

বর্তমান সময়ের অন্যতম সেরা; Source: xinhuanet.com

নেইমার বার্সেলোনার হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতেন ২০১৪-১৫ সালে। সেই টুর্নামেন্টে ১০ গোল করে মেসি আর ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর সাথে যৌথভাবে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা হন নেইমার। কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে ফাইনাল পর্যন্ত প্রতিটি ম্যাচেই গোল করেন। কোয়ার্টার থেকে ফাইনাল পর্যন্ত বার্সেলোনার ১৩টি গোলের মাঝে ৭টি গোলই করেন নেইমার।

দানিলো

এই কীর্তির সর্বশেষ উদাহরণ হচ্ছেন ব্রাজিলিয়ান রাইটব্যাক দানিলো। সান্তোসের হয়ে তিনি কোপা লিবার্তোরেস জেতেন ২০১১ সালে, রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতেন ২০১৫-১৬ আর ২০১৬-১৭ সালে।

এই কীর্তির সর্বশেষ সংযোজন; Source: Agencia EFE

শেষ কথা

কোনো কোনো খেলোয়াড় হয়তো ট্রফি জয়ী দলের অংশ ছিলেন, আবার কারো পারফর্মেন্সের কারণেই সেই দলের ট্রফি পাওয়াটা সহজ হয়েছে। তবে এখানে উল্লিখিত খেলোয়াড়দের অর্জনের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, তারা সবাই প্রথমে জিতেছেন কোপা লিবার্তোদোরেস, পরবর্তীতে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ। আসলে ল্যাটিন আমেরিকার প্রমাণিত খেলোয়াড়েরাই ইউরোপের বড় ক্লাবগুলোতে সুযোগ পায়। আর তাদের বেশিরভাগই তাদের ক্যারিয়ারের স্বর্ণালী সময়টা ইউরোপেই কাটান। ক্যারিয়ারের শেষভাগে অনেকেই আবার স্বদেশে ফিরে আসেন, তবে সেসময় তাদের পারফর্মেন্সেও স্বাভাবিকভাবে কিছুটা ভাটা পড়ে।

এই কারণে চ্যাম্পিয়নস লিগ পরবর্তীতে জেতার বিষয়টি যৌক্তিক। তবে সব নিয়মেই যে ব্যতিক্রম থাকে, সেটি প্রমাণ করতেই হয়তো এই তালিকায় ব্যতিক্রম হিসেবে উপস্থিত রয়েছেন রোনালদিনহো। ক্যারিয়ারের সোনালী সময়ে ইউরোপে কাটিয়ে একটা সময়ে নিজেকে হারিয়ে খুঁজে ফেরা দিনহো নিজের মাটিতে ফিরে এসেও জৌলুস দেখান। এই ধরনের খেলোয়াড়দের কারণেই হয়তোবা বিশ্লেষকরা বলেন, ‘Form is temporary, but class is permanent’।

ফিচার ইমেজ: Getty Images

Related Articles