ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ নিয়ে ফুটবল ভক্তদের আগ্রহের মাত্রাটা একটু বেশিই। কারণ ক্লাব ফুটবলের অন্যতম সেরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা, গতিময় ও উত্তেজনাপূর্ণ ফুটবলটা এই লিগে নিয়মিত দেখা যায়। লিভারপুল, চেলসি, ইউনাইটেড, সিটি, আর্সেনালের মতো বড় দলগুলো তো রয়েছেই, এই লিগে শক্তিশালী ও বড় দলগুলোর বিপক্ষে তথাকথিত ছোট দলগুলোর নিয়মিত পারফরম্যান্সও চোখ ধাঁধানো।
যা-ই হোক, ছোট কিংবা বড় দল, প্রতিবারের মতো এই মৌসুমেও রয়েছে কিছু চমক দেখানো ফুটবলার। কারও উপর হয়তো আরও আগে থেকেই প্রত্যাশা ছিল, কেউ ক্যারিয়ারের পড়ন্ত সময়ে দুর্দান্ত খেলে দলের হাল ধরছেন, কিংবা অখ্যাত কোনো তরুণ ফুটবলার; অসাধারণ পারফরম্যান্স দিয়ে তারা সত্যিই অবাক করে দিয়েছেন প্রিমিয়ার লিগ ভক্তদের, এই খেলোয়াড়দের নিয়েই আজকের লেখা।
স্টারিজ, লিভারপুল
লিভারপুলের দুর্ধর্ষ ফ্রন্ট লাইনের তিনজনের দারুণ পারফরম্যান্স এবং ইনজুরির সাথে নিয়মিত লড়াই, সব মিলিয়ে লিভারপুলের পাতা থেকে ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যেতে শুরু করেছিলেন স্টারিজ। কোনো কিছুই যেন ঠিক মতো হচ্ছিল না। ইনজুরি, ওয়েস্টব্রমে ধারে থাকা অবস্থায় গোল-বিহীন মৌসুম- সব মিলিয়ে এমনও গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল যে, হয়তো এই স্ট্রাইকারকে বিক্রি করে দিতে যাচ্ছে লিভারপুল। কিন্তু দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন এই ইংলিশ স্ট্রাইকার।
প্রাক মৌসুমে প্রদর্শনী ম্যাচগুলোতে চমৎকার পারফরম্যান্স দেখিয়ে নিজের প্রতি কোচ ক্লপের আস্থা ফিরিয়ে আনতে পেরেছিলেন তিনি। এই সময়ে তিনি মোট ৫ গোল করেছিলেন। এই মৌসুমে লিভারপুল ভক্তদের অন্যতম প্রিয় খেলোয়াড়ে পরিণত হয়েছেন তিনি। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে চেলসির বিপক্ষে তার বদলি হিসেবে নেমে শেষ মুহূর্তে করা অসাধারণ গোলটি। এই গোলটির সুবাদেই চেলসির বিপক্ষে নিশ্চিত তিন পয়েন্ট হারানোর পরিবর্তে এক পয়েন্ট নিয়ে মাঠ ছাড়ে লিভারপুল। সালাহ-ফিরমিনোদের ছাপিয়ে মানের সাথে লিভারপুলের সর্বোচ্চ গোলদাতা (৪) এখন তিনিই। এর মধ্যে রয়েছে প্রিমিয়ার লিগে ২ গোল, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ও লিগ কাপে ১টি করে গোল।
অ্যালেক্সান্ডার মিত্রোভিচ, ফুলহ্যাম
নিউক্যাসলের হয়ে ৫৯ ম্যাচে মাত্র ১৩ গোল করলেও, ফুলহ্যামে যাওয়ার পর সার্বিয়ান খেলোয়াড় মিত্রোভিচ তার প্রতিভার চূড়ান্ত প্রতিফলন দেখাতে সক্ষম হয়েছেন গত মৌসুমে ইংলিশ চ্যাম্পিয়নশিপে। বলতে গেলে, তার নিয়মিত ও মূল্যবান পারফরম্যান্সের বড় অবদান ছিল ফুলহ্যামের প্রিমিয়ার লিগে জায়গা করে নেওয়ার ব্যাপারে। লোনে থাকা অবস্থায় চ্যাম্পিয়নশিপে ফুলহ্যামের হয়ে তিনি করেছেন ১২ গোল। এরপরই দলটিতে তার স্থায়ী হওয়া ছিল সময়ের ব্যাপার।
চ্যাম্পিয়নশিপের পারফরম্যান্স প্রিমিয়ার লিগেও তিনি ধরে রাখবেন এই ব্যাপারে সমর্থকদের ইতিবাচক প্রত্যাশা ছিল এবং তিনি সেই প্রত্যাশার পূর্ণ প্রতিদান দিয়েছেন এই মৌসুমেও। যদিও তার দল ফুলহ্যাম ৮ ম্যাচে মাত্র একটি জয় নিয়ে রয়েছে পয়েন্ট তালিকার ১৭তম অবস্থানে, কিন্তু তিনি দলের হয়ে করেছেন ৫ গোল। প্রিমিয়ার লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতাদের তালিকায় আগুয়েরো, কেন ও মুরের সাথে তিনি দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছেন।
গ্লেন মারে, ব্রাইটন
প্রিমিয়ার লিগে এই মৌসুমে এখন পর্যন্ত ব্রাইটন করেছেন সর্বমোট ১০ গোল এবং দলটির স্ট্রাইকার গ্লেন মারে একাই করেছেন দলের অর্ধেক গোল। মারের গুরুত্বপূর্ণ গোলের কারণেই লিগ তালিকার ১৩তম অবস্থানে রয়েছে দলটি। মারের বয়স এখন ৩৫ এবং ক্যারিয়ারের পড়ন্ত সময়ে তিনি যেন জ্বলে উঠেছেন। গত বছর প্রিমিয়ার লিগে তার ক্যারিয়ার সেরা ১২ গোল করেছিলেন। এই মৌসুমেও তিনি তার সেই ফর্ম ধরে রেখেছেন এবং দলকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন সামনে থেকে।
প্রিমিয়ার লিগে মুরের অভিষেক হয় ২০১৪ ফেব্রুয়ারিতে, যদিও ক্রিস্টাল প্যালেস ও বোর্নমাউথের হয়ে একেবারেই বলার মতো কিছু করতে পারেননি তিনি। ব্রাইটনের হয়েই সেরা সময় পার করছেন এই ইংলিশ খেলোয়াড়। ক্লাবটির হয়ে ২০১৬-১৭ মৌসুমের ইংল্যান্ডের চ্যাম্পিয়নশিপে করেছিলে ২৩ গোল ও ৫ অ্যাসিস্ট, যা তার দলের প্রিমিয়ার লিগে জায়গা করে নিতে বিশাল ভূমিকা রেখেছিল। মারে তার ফর্ম এখনও বেশ সাবলীলভাবে ধরে রেখেছেন। এই মৌসুমে এখন পর্যন্ত ৫ গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতাদের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছেন।
ম্যাট ডোহার্টি, ওলভস
সেপ্টেম্বর মাসের 'পিএফএ ফ্যানস প্লেয়ার অব দ্য মান্থ' খেতাব জিতে নিয়েছিলেন ওলভসের ২৬ বছর বয়সী আইরিশ ডিফেন্ডার। ডোহার্টি পেয়েছিলেন মোট ৩৯% ভোট, যেখানে তিনি পিছনে ফেলেছিলেন আগুয়েরো, লাকাজ্জাত্তে ও হ্যাজার্ডের মতো খেলোয়াড়দের। তার অর্জনের মাসে ওলভসরা ছিল অপরাজিত এবং দলটির এই অর্জনে ডোহার্টির অনবদ্য পারফরম্যান্স বড় ভূমিকা রেখেছিল। সেই হিসেবে প্রথম আইরিশ খেলোয়াড় হিসেবে তার এই অর্জন অবশ্যই বিশেষ কিছু।
ক্রিস্টাল প্যালেসের বিপক্ষে একমাত্র জয়সূচক গোলটি করেছিলেন এই রাইট ব্যাক। তাছাড়া প্রিমিয়ার লিগে এখন পর্যন্ত ৪ ক্লিন শিট রাখার পাশাপাশি ২টি গোলে অ্যাসিস্টও করেছেন তিনি। তার পারফরম্যান্সের ফলাফল সহজেই দৃশ্যমান। কারণ লিগ টেবিলের ৭ম দলটি হচ্ছে উলভারহ্যাম্পটন ওয়ান্ডারার্স।
জেমস ম্যাডিসন, লেইস্টার
গত গ্রীষ্মের দলবদলের সময়ে ২০ মিলিয়ন পাউন্ডে চ্যাম্পিয়নশিপে খেলা নরউইচ সিটি থেকে লেইস্টার সিটিতে যোগ দেন জেমস ম্যাডিসন। প্রিমিয়ার লিগে প্রথমবারের মতো খেলতে নেমেই বাজিমাত করেছেন ২১ বছর বয়সী এই তরুণ। প্রিমিয়ার লিগের মতো আসরে যেখানে প্রথম মৌসুমের একটি লম্বা সময় চলে যায় মানিয়ে নিতে, সেখানে জেমস ৮ ম্যাচে করেছেন ৩ গোল ও ২ অ্যাসিস্ট।
লেইস্টার সিটিতে প্রতি ম্যাচেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন এই ২১ বছর বয়সী তরুণ। মাহরেজ ও কান্তে বিহীন লেইস্টারের মাঝমাঠে একটা বড় শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তা কতটা পূরণ করতে পারেন এই তরুণ তা সময় বলে দিবে। তরুণ বয়সে তার খেলার কৌশল, দূরদৃষ্টি এবং পরিপক্বতা অবশ্য চোখে পড়ার মতো। লেইস্টারের হয়ে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের সুবাদে ইংল্যান্ডের জাতীয় দলেও ডাক পেয়েছিলেন এই মিডফিল্ডার।
আলেক্সান্দ্রে লাকাজাত্তে, আর্সেনাল
আর্সেনালের হয়ে গত মৌসুমের দ্বিতীয় ভাগে লাকাজাত্তে করেছিলেন ৯ গোল, যদিও শুরুতে ক্লাবটির হয়ে তেমন পারফরম্যান্স করতে পারছিলেন না তিনি। এরপর আর্সেনালে যখন অবামেয়াং যোগ দেয়, তখন অনেকেই মনে করেছিল যে হয়তো ক্লাবটিতে নিজের অবস্থান আর শক্ত করতে পারবেন না এই ফরাসি স্ট্রাইকার। আদতে এরকম কিছু হয়নি, বরং লাকাজাত্তে এই মৌসুমের শুরু থেকেই রয়েছেন দারুণ ফর্মে।
এই মৌসুমে লাকাজাত্তে এখন পর্যন্ত করেছেন ৫ গোল এবং এর মধ্যে প্রিমিয়ার লিগেই করেছেন ৪টি। প্রিমিয়ার লিগে অবামেয়াং ও তার গোল সংখ্যা সমান। আর্সেনালের আক্রমণভাগকে এই দুই খেলোয়াড়ের অনবদ্য ফর্ম নতুন মাত্রা দিয়েছে, সেই সাথে ক্লাবটি লিগ টেবিলে ফিরে পেয়েছে তাদের চিরচেনা ৪র্থ অবস্থান।
লুক শ, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড
গত বছর (১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত) একটি প্রিমিয়ার লিগ ম্যাচও খেলতে পারেননি লুক শ। শেষ পর্যন্ত শোনা যাচ্ছিল ইউনাইটেড ছেড়ে পাড়ি জমাবেন অন্য কোথাও। প্রিমিয়ার লিগের পয়েন্ট তালিকার অষ্টম অবস্থানে ইউনাইটেড, পগবা-মরিনহোর দ্বৈরথ, মাঠে খেলোয়াড়দের মধ্যে মরিনহোর উল্লেখযোগ্য সমন্বয়ের অভাব, লিগ কাপ থেকে বাদ পড়া, সামগ্রিকভাবে ইউনাইটেডের আকাশে কালো মেঘের ছায়া। এত কিছুর মধ্যেই লুক শ নতুন করে নিজেকে মেলে ধরেছেন, জায়গা করে নিয়েছেন নিয়মিত একাদশে।
পরিশ্রমী ও অদম্য লুক তার পারফরম্যান্সের বদৌলতে অ্যাশলি ইয়াংকে ছাপিয়ে নিয়মিত হয়েছেন একাদশের লেফট ব্যাক পজিশনে। রক্ষণ সামলানোর পাশাপাশি শ দলের আক্রমণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি। প্রিমিয়ার লিগে এই মৌসুমে এখন পর্যন্ত তিনি করেছেন ১টি অ্যাসিস্ট ও গোল। তার পারফরম্যান্স শেষ পর্যন্ত তাকে ইংল্যান্ড জাতীয় দলেও জায়গা করে দিয়েছে। সব মিলিয়ে দারুণ সময় কাটাচ্ছেন এই ইংলিশ ফুটবলার। হয়তো সামনে চুক্তি নবায়ন করতে দেখা যেতে পারে তাকে।
This article is in Bangla Language. It's about astonishing players in EPL this year. The references have been hyperlinked inside the article.
Feature Image Source: foxsports.com.au