Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ধরনীর বুকে এমন রাত একবারই আসে

এমন একটা রাত শেষ কবে এসেছিল পৃথিবীর বুকে? মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে মাঠে নামবে ব্রাজিল এবং আজেন্টিনা; দু’দলই যদি জিতে যায়, চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী এই দুই দুই দেশ বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল খেলবে নিজেদের বিপক্ষে। বিশ্বকাপ এলেই এ দেশের আর্জেন্টিনা এবং ব্রাজিল সমর্থকের ভেতর যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। আর এমন দুই দেশ যদি সেমিফাইনালে মুখোমুখি হয়, তাহলে না জানি পুরো দেশটাই ফেটে পরে! এমনিতেই বাংলাদেশে ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনার সমর্থকদের সংখ্যাটা বেশি। কোয়ার্টার ফাইনালের ম্যাচ শুরু হবার আগে দুই দল নিয়ে তো উত্তেজনা ছিলই। কিন্তু উত্তেজনার আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছিল সেমিফাইনালে ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনার মুখোমুখি হবার সম্ভাবনা।

তিতে ব্রাজিলের দল ঘোষণা করলেন। তেমন কোনো পরিবর্তন নেই। ৪-২-৩-১ ছকে রাইটব্যাকে নামলেন মিলিতাওকে। অ্যালেক্স স্যান্দ্রো পুরো ফিট নন, তাই লেফটব্যাক হিসেবে দানিলোকে নামানো হলো। ক্রোয়েট কোচ জ্লাৎকো দালিচও তার দলে তেমন পরিবর্তন আনলেন না। মদরিচ-ব্রজোভিচ-কোভাচিচকে নিয়ে ক্রোয়েশিয়া একাদশ তিনি সাজালেন।

ক্রোয়াট এই মিডফিল্ড ত্রয়ীর কারিশমা সম্পর্কে তিতে অবশ্যই জানতেন। আরও হয়তো জানতেন, এই মিডফিল্ডের পারফরম্যান্সে কখনও ভাটা পড়ে না। তবুও তিতে ব্রাজিল মিডফিল্ড নিয়ে আরেকবার ভেবে দেখলেন না। নেইমার আছেন, সাথে দুই উইঙ্গার হিসেবে রাফিনহা এবং ভিনিসিয়ুস। স্ট্রাইকার হিসেবে দারুণ ফর্মে থাকা রিচার্লিসন। বেঞ্চের শক্তিমত্তাও নেহায়েত মন্দ নয়। এই ভয়ঙ্কর আক্রমণ ঠেকাবে কে! ‘বুড়োদের দল’ ক্রোয়েশিয়া তো গতির সামনে তো দাঁড়াতেই পারবে না। 

দোষটা নিজের ঘাড়েই নিতে হবে; Image Credit: Getty Images

ব্রাজিলকে সেমিফাইনালে দেখে ফেলেছিল অনেকেই। কিন্তু এখানেই ফুটবলটা পার্থক্য গড়ে দেয়। চিন্তা করে নেওয়া আর মাঠের ফুটবলটা যে আকাশ-পাতাল তফাৎ। ব্রাজিল তাদের খেলা শুরু করেছিল ঐ ঈর্ষাজাগানিয়া আক্রমণের উপর ভিত্তি করেই। ছোট ছোট পাস দিয়ে ভিনিসিয়ুস-নেইমার-রাফিনহার গতিকে কাজে লাগিয়ে ব্রাজিল ক্রোয়াট ডি-বক্সে ঢুকে পড়ছিল বারবার। কিন্তু ক্রোয়াট দেয়ালকে সেলেকাওরা কখনই ভাঙতে পারেনি। আর যে কয়টি শট গাভারদিওল-লভরেনকে এড়িয়ে ভেতরে ঢুকে গেছে, দমিনিক লিভাকোভিচ সেগুলোকে লুফে নিয়েছেন খুব সহজে। পুরো ৯০ মিনিট ম্যাচের পার্থক্য গড়ে তুলেছিলেন এই ক্রোয়াট রক্ষণজুটি। আর ভিনিসিয়ুসকে তার ফুটবলটাই খেলতে দেননি ক্রোয়েশিয়ার রাইটব্যাক জুরানোভিচ।

ব্রাজিল টানা আক্রমণ শানিয়ে গেছে। কিন্তু মধ্যমাঠের দখল সবসময়ই ছিলো ক্রোয়েশিয়ার হাতে। ক্যাসেমিরো এবং পাকেতাকে ব্যবহার করে ডাবল-পিভটের এই কৌশল ব্রাজিলের মাঝমাঠকে সারাক্ষণ উন্মুক্ত করে রেখেছিল। যদিও কাতার বিশ্বকাপ শুরুর পর থেকেই তিতের এই কৌশল আর ব্রাজিলের ফাঁকা মাঠ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে অনেকেই। তবে সেলেকাও কোচ তার পরিকল্পনাতেই অটুট থেকেছেন। 

প্রথমার্ধে ব্রাজিলের  বল পায়ে রাখার দুর্বলতা চোখে লাগছিল। গতির সাথে আক্রমণ শানিয়ে গেলেও ব্রাজিলের খেলার ধরন সেভাবে মন কাড়তে পারেনি কারও। তিতে পারতেন বেঞ্চে থাকা ব্রুনো গিমারেজকে নামিয়ে মধ্যমাঠের প্রাণ ফেরাতে। কিন্তু সে পথে তিনি এগোননি। দ্বিতীয়ার্ধে তিনি একের পর এক আক্রমণভাগের খেলোয়াড় নামিয়েছেন। একবার অ্যান্থনি, এরপর পেদ্রো। তার পরিকল্পনাই হয়তো ছিল গোল করাকে ঘিরে। কিন্তু দিনটা যে আসলে ক্রোয়াট গোলরক্ষক লিভাকোভিচেরই। ব্রাজিলের প্রতিটা আক্রমণের সামনে তিনি ছিলেন রক্ষাকর্তা হিসেবে। পুরো ম্যাচে ১১টি সেভ করেছেন; যেন এক লিভাকোভিচের কাছে ম্লান হয়ে গেছে পুরো ব্রাজিলের আক্রমণ।

লিভাকোভিচের কাছে ব্রাজিল আটকে গেছে বারবার; Image Source: Getty Image

কৌশলগত লড়াইয়ে তিতে এক মুহূর্তের জন্যও মাঠে ফিরতে পারেননি। ৪-২-৪ ছকে খেলানো ফুটবল এই আধুনিক যুগে খাটে না। এজন্য দরকার ছিল কোনো একজনের এক সেকেন্ডের জন্য দানব হয়ে ওঠা। একক প্রচেষ্টায় দলকে টেনে নেওয়া, ম্যারাডোনা যেটা করেছিলেন। বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার জন্য যেটা মেসি করছেন, অথবা ফ্রান্সের জন্য এমবাপে। দলের প্রাণভোমরা নেইমার তখনও মাঠে। গ্যালারিভর্তি সেলেকাও সমর্থকের চোখ তখন তার উপরে। অতিরিক্ত সময়ে ব্রজোভিচের কাছ থেকে বলটা বের হতেই সেলেকাওদের কাছে সেই মুহূর্তটা নেমে এলো।

নেইমারের বয়সটা ৩০ বছর ছাড়িয়ে গেছে। ক্যারিয়ারের শুরু থেকে তাকে ‘প্রিন্স নেইমার’ নামে ডাকা হয়। কিন্তু প্রিন্স থেকে রাজা হওয়া তার কখনোই হয়নি। ১০৫ মিনিটে নেইমার সেই দানব হয়ে উঠলেন। ক্যারিয়ারে প্রথমবার ‘মরুর দেশে’ নেইমার হলেন সেলেকাওদের রাজা। এই নেইমারকেই তো দেখতে চেয়েছিল পুরো বিশ্ব।

আর ১৫ মিনিট ক্রোয়াটদের রুখতে পারলেই সেমিফাইনালের টিকিট। কিন্তু এই অন্তিম সময়ে ব্রাজিলের ভেতর চলে এলো গা ছাড়া ভাব। আর মাঝমাঠের নিয়ন্ত্রণ তো মদরিচদের আগে থেকেই ছিল। ১১৭ মিনিটে ব্রাজিলকে স্তব্ধ করে দেন পেতকোভিচ। নেইমারের একক প্রচেষ্টাকে ম্লান করে দিয়ে ম্যাচটা গড়ায় পেনাল্টি শ্যুটআউটে।

পেনাল্টি শ্যুটআউটে তিতে করলেন তার চতুর্থ ভুল। প্রথমেই কিক নিতে পাঠালেন রিয়াল মাদ্রিদের উইঙ্গার রদ্রিগোকে। তার বয়সটা মাত্র ২১ বছর। এমন পরিস্থিতিতে স্নায়ুচাপ ধরে রাখা তার জন্য এমনিতেই কঠিন। তার উপর ক্রোয়েশিয়া প্রথম শটেই গোল করে ফেলেছে। রদ্রিগোর দুর্বল শট ঠেকিয়ে দিলেন লিভাকোভিচ। ব্রাজিল যেন ম্যাচটা হেরে গেল ঠিক তখনই।

আরও একবার স্বপ্নভঙ্গ; Image Source: Getty Images

দুর্দান্ত এক দল নিয়ে কাতারে এসেছিল ব্রাজিল। তারকার মেলা দেখে সবার স্বপ্নের পরিধিটা আরও বড় হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তারকাভর্তি দল থাকলেই যে বিশ্বকাপ জেতা যায় না! একেবারে স্বয়ংসম্পূর্ণ দল কখনোই হয় না; ঘাটতি থাকে, দুর্বলতা থাকে। তিতের ছোট ছোট কয়েকটা পরিবর্তন আর একটুখানি কৌশলের ছোঁয়া এই ব্রাজিলের ভাগ্যই পালটে দিতে পারতো। কিছু তিতে সেটা পারেননি। হয়তো সেটাই তার দুর্বলতা।

টাইব্রেকারে ব্রাজিল হারায় সেমিফাইনালে ব্রাজিল বনাম আর্জেন্টিনা ম্যাচ দেখার স্বপ্নটা ভেঙে যায় এক নিমিষেই। কিন্তু আর্জেন্টিনার স্বপ্নটা তখনও জ্বলজ্বলে।

ম্যাচ শুরু আগের সংবাদ সম্মেলনে শুরু হয়ে গেল ডাচ কোচ ফন গালের কথার তুবড়ি। নাইজেল ডি জং সেই কবে ব্রাজিল বিশ্বকাপে মেসিকে নিষ্প্রভ রেখেছিলেন; তিনি নাকি জানেন, কীভাবে মেসির মতো খেলোয়াড়কে থামিয়ে রাখতে হয়। ডাচ গোলরক্ষক নোপার্টও মেসিকে এক হাত নিয়ে নিলেন। মেসি তো পেনাল্টি মিস করেননি, মেসির সব শট নাকি ঠেকিয়ে দিবেন তিনি। ওদিকে স্কালোনির সোজাসাপ্টা জবাব – যা হবার, সবকিছু মাঠেই হবে। তাই দুই পক্ষের স্নায়ুযুদ্ধ শুরুর পর মনে হচ্ছিল, ফন হাল আর লিওনেল স্কালোনির ভেতর একটা কৌশলগত লড়াই দেখতে যাচ্ছে ফুটবলবিশ্ব।

ডাচদের যথারীতি ৩-৫-২ ছকের ফুটবল। দু’জন স্ট্রাইকারকে সবসময় উপরে রাখেন ফন হাল, তাই প্রতিপক্ষের আক্রমণের সময়ও গাকপো এবং মেমফিস নিচে নামেন না। এদেরকে নজরে রাখার ব্যবস্থা করা দরকার। স্কালোনি তাই নামালেন ৩-৫-২ ছক। তিনজন ডিফেন্ডার আর দু’জন উইংব্যাক।

বার্সেলোনার ম্যাচ যারা নিয়মিত দেখেছেন, তারা জানবেন মেসিকে তাঁতিয়ে দেবার ফলটা সুখকর হয় না। ম্যাচ শুরু হবার পর দেখা গেল: একজন নয়, মেসিকে মার্ক করে চোখে চোখে রাখছেন কয়েকজন। ব্রাজিল বিশ্বকাপে মেসিকে মার্ক করে রাখার পরিকল্পনা কাজে দিয়েছিল। কিন্তু এবার মেসি যা করলেন, এর জন্যই হয়তো তাকে ভিনগ্রহের ফুটবলার বলা হয়। নাথান আকের পায়ের মাঝ দিয়ে তিনি যে বলটা বের করে নাহুয়েল মোলিনাকে দিলেন, ঐ অ্যাঙ্গেল দিয়ে যে বলটা বের করা যায়, টিভি পর্দায় সেটাই ঠিকমতো বোঝা যাচ্ছিল না। 

লিওনেল মেসি, দ্য ম্যাজিক ম্যান; Image Source: Getty Images

দু’পক্ষ ম্যাচের শুরু থেকেই তেঁতে ছিল। ম্যাচ চলাকালীন সময়ে রেফারি মাতেউ লাহোজ যেন আগুনে আরও বেশি করে ঘি ঢেলে দিলেন। ফাউল, হলুদ কার্ড এবং দু’পক্ষের বিবাদে জড়ানোর মাঝে আর্জেন্টিনার পক্ষে পেনাল্টি। তাতে ঠাণ্ডা মাথায় গোল করে, উদ্ভট এক সেলিব্রেশন করে ডাচদের সকল সমালোচনার উত্তর মেসি মাঠেই দিয়ে দিলেন।

৭৩ মিনিট পরে ২ গোলে এগিয়ে, ম্যাচটা অবধারিতভাবেই আর্জেন্টিনারই। কিন্তু ফুটবলটা তো ব্যবধান গড়ে দেয় এখানেই। সকল হিসাব-নিকাশ বদলে যায়, নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে চায় না। ৯০ মিনিট শেষে অতিরিক্ত সময় এলো ১০ মিনিট। মেসির পেনাল্টি গোলের পর নেদারল্যান্ডস পেল প্রায় ৩০ মিনিটের মতো। ২ গোলে এগিয়ে থাকার পর রোমেরো আর আকুনাকে তুলে নিয়েছিলেন স্কালোনি। তালিয়াফিকো আর পেতসেলাকে পেয়ে ডাচরা এবার সুযোগ পেলো আক্রমণ শানানোর। ৮৩ মিনিটে দারুণ একটা ক্রসে মাথা লাগিয়ে ফেলেন ওয়েগহর্স্ট। ম্যাচের রঙ বদলাতে শুরু করে তখনই। এই গোল পেয়েই নড়েচড়ে বসে নেদারল্যান্ডস। এরপর তাদের একের পর এক ক্রস, একের পর এক আক্রমণ। আর্জেন্টিনা প্রায় আটকেই দিয়েছিল, কিন্তু শেষ মিনিটে এসে ভুলটা করেন পেতসেলা। টেউন কপম্যানার্স ফ্রি-কিক না মেরে নিচু করে পাস দেন জটলার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা ওয়েগহর্স্টকে। ডাচরা ম্যাচে ফেরে তখনই।

এমি মার্তিনেজ, আরও একবার; Image Source: Getty Images

অতিরিক্ত সময়ে ম্যাচটা তখন পেন্ডুলামের মতো দুলছে। যেকোনো সময়, যে কেউ বনে যেতে পারতেন নায়ক অথবা খলনায়ক। এমি মার্তিনেজ শট ঠেকিয়েছেন, আর্জেন্টিনার আক্রমণ রুখে দিয়েছেন নোপার্টও।

এই টাইব্রেকারে কলম্বিয়াকে একাই রুখে দিয়েছিলেন এমি মার্তিনেজ। তার নৈপুন্যেই আর্জেন্টিনার কোপা জয়ের আশা বেঁচে ছিল। কাতার বিশ্বকাপের শুরু থেকেই আর্জেন্টিনার অন্যতম ভরসা ছিলেন তিনি। কিন্তু সৌদি আরবের বিপক্ষের ম্যাচের পর তাকে নিয়ে সমালোচনার কম হয়নি। সকল সমালোচনার উত্তর এমি মার্তিনেজ আবার দিলেন। প্রথমে ভ্যান ডাইক এবং বার্গহসের পেনাল্টি রুখে দিয়ে মার্তিনেজ আরও একবার বুঝিয়ে দিলেন, ভরসা তার উপর করাই যায়। সেটা একবার না, বারবার।

This article is in Bangla language. It is about the first two quarter-finals in the Qatar World Cup 2022.

Featured Image: Getty Images

Related Articles