একজন ফুটবলার হুইল চেয়ারে বসে আছেন, আর তার এক ফ্যান তার ইনজুরড পা ধরে কান্না করছে... এইরকম দৃশ্য আপনি কয়বার দেখেছেন?
গত দশকের শুরুতে বিশ্বের টপ ১০ স্ট্রাইকারের লিস্ট করতে গেলে আপনাকে অবশ্যই রাদামেল ফ্যালকাওকে রাখা লাগবেই। ২২ বছরের ফুটবল ক্যারিয়ার কখনই মসৃণ ছিল না তার। ক্লাব পরিবর্তন, ইনজুরি, কিছু অফ ফর্মের সময়, দুর্দান্ত স্কোরিং, টপ লেভেলের শিরোপা জয় — সবই ছিল তার এই ক্যারিয়ারে। স্পেন-পর্তুগালে বিধ্বংসী ক্যারিয়ার নিয়ে গিয়েছিলেন ফ্রান্সে নতুন করে টপ লেভেলে উঠা ক্লাব মোনাকোতে। কিন্তু এরপরের ইনজুরিটা তার ক্যারিয়ারটা মোটামুটি অর্ধেক করে দেয়। কিন্তু ঐ যে 'ফর্ম ইজ টেম্পোরারি, ক্লাস ইজ পার্মানেন্ট' কথাটা আছে না? এটা পুরোপুরি খাটে এই ফ্যালকাওয়ের ক্ষেত্রে। ইনজুরির পরের ৩ বছর খুঁজে ফিরেছিলেন নিজেকে, এরপর আবারও ফিরেছিলেন স্বরূপে।
কলম্বিয়ার সবচেয়ে পুরাতন শহর সান্টা মার্টা। কার্লোস ভালদেরামার মতো গ্রেট আগেও প্রোডিউস করেছিল তারা। এরপর তারা ফুটবল বিশ্বকে দিল ফ্যালকাও। তার বাবাও ছিলেন প্রফেশনাল ফুটবলার, তিনি ছিলেন একজন সলিড ডিফেন্ডার। ফ্যালকাওয়ের ফুটবলে আসার অন্যতম কারণ ছিলেন তিনিই। একবার নাক ফেটে গিয়ে ফুটবল ছেড়ে বেসবল ক্যারিয়ার শুরু করেন। কিন্তু সহজাত গোল-পোচার ইন্সটিংট আছে যার মধ্যে, তাকে কি আর আটকানো যাবে? সেখানে জয় হয় ফুটবলেরই।
মাত্র ১৩ বছর বয়সেই কলম্বিয়ার দ্বিতীয় বিভাগের ক্লাব ল্যান্সেরোস বোয়াকার মূল টিমে জায়গা করে নেন। কলম্বিয়ার ফুটবলে সবচেয়ে কনিষ্ঠ ফুটবলার হিসেবে অভিষেক হয় তার। বয়সের জন্য যদিও পার্টিসিপেশন সার্টিফিকেট পাননি সে বছর, তবুও তাতে কি যায় আসে?
প্রথম গোল পেতে তার সময় লাগে আরো ১ বছর। তার ২ বছরেই ফ্যালকাও নিজেকে অন্য লেভেলের প্রমাণ করে ফেলেন। এরপর ২০০৫ সালেই তার নতুন জার্নি শুরু সাউথ আমেরিকান জায়ান্ট রিভারপ্লেটে। সেখানে ডেব্যু ম্যাচেই স্টপেজ টাইমে গোল পান, গোল পান টানা ৭ ম্যাচেই। সদ্য টিনএজ পার হওয়া ফ্যালকাও তখন আগুন ফর্মে। এরপরই দুর্ভাগ্যের প্রথম হানা, ছিঁড়ে যায় ডান হাঁটুর লিগামেন্ট। সেই সাথে আরো কিছু কমপ্লিকেশন দেখা দেয় সেখানে। পুরো সিজনে আর খেলতে না পেরে পরে খেলায় ফিরে আসেন আবার ২০০৭-০৮ মৌসুমে। সেই বছর ১৯ গোল, পরের বছর আবার ১৬ গোল। এই ফর্মে ইউরোপের নজরে পড়ে যান সে সময়েই। পোর্তো সে সময় খুঁজছিল লিসেন্দ্রো লোপেজের একজন পারফেক্ট রিপ্লেসমেন্ট। তাই সেখানেই তারা নিয়ে গেল ফ্যালকাওকে।
‘ফ্যালকোম্যানিয়া’র শুরু হয় সেখানেই। মাঠের বাইরে শান্ত-চুপচাপ স্বভাবের ফ্যালকাও মাঠে তখন প্রচন্ড আগ্রাসী। ২০০৯-১০ মৌসুমেই পোর্তোর হয়ে করেন ৩৪টি গোল। পরের বছর আবার ৩৮টি। সে বছর ইউরোপা লিগ জিতে পোর্তো জয় করে ‘ট্রেবল’। ইউর্গেন ক্লিন্সম্যানের এক মৌসুমে করা ১৫ গোলের রেকর্ড ভেঙে ১৭ গোল নিয়ে এক মৌসুমে ইউরোপা লিগে নতুন গোলের রেকর্ড করেন তিনি। এটি ছিল তার প্রথম ইউরোপিয়ান ট্রফি।
পরবর্তী ইউরোপিয়ান ট্রফিটা জেতেন পরের বছরই, কিন্তু সেটি আর পোর্তো নয়, অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের হয়ে। সে সময় অ্যাটলেটিকোর রেকর্ড সাইনিং হিসেবে জয়েন করেন সেখানে।
অ্যাটলেটিকো সেই মৌসুমেই ডিয়েগো সিমিওনেকে নিয়োগ দেয়। তার ট্যাকটিক্সে অ্যাটলেটিকো ডিপ-লায়িং ডিফেন্স আর কুইক কাউন্টার-অ্যাটাকে খেলা শুরু করে। এই কাজে ফ্যালকাও ছিলেন সিমিওনের জন্য পারফেক্ট স্ট্রাইকার। কম চান্স আসবে; কিন্তু যা আসবে, তা মিস করা যাবে না - এই নীতিতে সেই মৌসুমে ফ্যালকাও করেন ৩৬টি গোল। প্রথম ৩ ম্যাচেই পান ৬ গোল। টানা দ্বিতীয়বার ইউরোপা লিগ জেতার সাথে পান 'কিং অফ দ্য ইউরোপা লিগ' খেতাব।
পরবর্তী মৌসুমে জেতেন কোপা ডেল রে। সে বছর তার মোট গোল ছিল ৩৪টি, এক দেপোর্তিভোর সাথে এক ম্যাচেই করেন ৫টি গোল। চেলসিকে ৪-১ গোলে উড়িয়ে দেওয়া সুপার কাপের প্রথমার্ধেই করেন হ্যাটট্রিক।
এই পর্যন্ত দেখে বলতেই পারেন, সেসময় টপ টেন কেন, সেরা পাঁচ স্ট্রাইকারের লিস্টে তাকে রাখতে কেন আপনি বাধ্য নন?
তবে পরবর্তী বছর অ্যাটলেটিকোর টাইটেল উইনিং সিজনে থাকেননি। তখন খুব কড়া গুঞ্জন ছিল তার রিয়াল মাদ্রিদ আর চেলসি ট্রান্সফারের। তবে তিনি বার্ষিক ১৮ মিলিয়ন ইউরোর পারিশ্রমিকে যোগ দেন সদ্য লিগ-ওয়ানে উঠে আসা ক্লাব মোনাকোতে। এই চুক্তিতে অ্যাটলেটিকো পায় ৬০ মিলিয়ন ইউরো। হোর্হে মেন্ডেজ এই ডিলের পেছনে থাকলেও ফ্যালকাও এই বেতন অস্বীকার করতে পারেননি ।
ফ্রেঞ্চ লিগে আসার পর ছোট ছোট ইনজুরি দেখা দেয় তার। তবে ৬ মাস পর তার জন্য যা অপেক্ষা করছিল, তার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিল না।
২০১৪ সালের জানুয়ারিতে ফ্রেঞ্চ লিগ কাপে মোনাকোর খেলা ছিল চতুর্থ বিভাগের দল মন্টস ডি'অর আজারগুয়েসের সাথে। ম্যাচের শুরুতেই গোল পেয়ে যান ফ্যালকাও, এরপর ম্যাচের ৪০ মিনিটে আরেকটি পরিষ্কার সুযোগ। অঘটন ঘটলো এখানেই। গোল বাঁচাতে সোনার আর্টেক খুব বাজেভাবে ডাইভ দেন ফ্যালকাওয়ের উপর। অপেশাদার ফুটবলারের এই জঘন্য ট্যাকলে সাথে সাথেই ছিঁড়ে যায় ফ্যালকাওয়ের এসিএল লিগামেন্ট। মোটামুটি সবাই নিশ্চিত, ফ্যালকাও আউট হচ্ছেন কমপক্ষে ৮ থেকে ১০ মাসের জন্য। কিন্তু কলম্বিয়ানদের কাছে এটি ছিল চূড়ান্ত হৃদয়ভঙ্গ। কারণ, আর ৬ মাস পরই ছিল ব্রাজিল ফুটবল বিশ্বকাপ। কলম্বিয়ানরা ভেঙে পড়ে পুরোপুরি। 'ফ্যালকোম্যানিয়া'য় বিশ্বাসীরা রীতিমতো আর্তনাদ করেছে সে সময়। ওই যে লেখার শুরুতে বলা পা ধরে কান্না, সেটি ছিল এই ফ্যালকাওয়ের পা ধরেই । সেই পায়ের উপর তাদের ছিল অনেক ভরসা। এমনকি কলম্বিয়া থেকে সেই ট্যাকলার আর্টেককে নাকি পাঠানো হয়েছিল হুমকিও! ইনজুরির জন্য ফ্যালকাওকে ভুগতে হয় অনেকদিন। আগের ফর্ম ফিরে পাবেন কি না, তা নিয়েও ছিল অনেক সন্দেহ।
এর মাঝে তাকে লোনে সাইন করান লুই ভ্যান হাল, তার নতুন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের জন্য। কিন্তু ফর্ম এতই খারাপের দিকে ছিল যে তাকে আন্ডার-২১ টিমের সাথে খেলার জন্য ডিমোশন দেওয়া হয়। সেখান থেকে পারফর্ম করে আবার মূল দলে ফিরলেও ২৯ ম্যাচে করেন কেবল ৪ গোল। একটি ফ্লপ ডিল পিরিয়ড শেষ করে ফিরে আসেন মোনাকোতে, কিন্তু সেখানেও আর থিতু হতে না পেরে আবার ফেরেন ইংল্যান্ডে। মরিনহো আর হোর্হে মেনদেজ আলাদা চুক্তিতে আবার ফ্যালকাওকে লোনে নেয় চেলসি। ইউনাইটেডে থাকা সময়ের চেয়ে এটি ছিল আরো খারাপ সময়। সেই মৌসুমেই চেলসিকে রেলিগেশন জোনে নিয়ে যাওয়ায় বরখাস্ত হন মরিনহো। ফ্যালকাওকে বেঞ্চে বসেই কাটাতে হয় বছরের বাকি সময়টা। সেখানে ১২ ম্যাচ খেলে গোল করেন কেবল ১টি। তার ক্যারিয়ারের 'ডার্ক স্পট' বললে তার এই ইংল্যান্ডে কাটানো দু'টি বছরকে বলা যায়।
পরের বছর অবশেষে ফেরেন মোনাকোতে। এবার শুধু প্লেয়ার নন, দলের ক্যাপ্টেন তিনি। একগাদা ইয়ং প্লেয়ারের জন্য দলনেতা হিসেবে এক্সপেরিয়েন্সড একজনের দরকার ছিল। দলে তখন এমবাপ্পে-লেমার-মৌতিনহোর মত নতুন নতুন রাইজিং স্টার। সেখানে ফ্যালকাওকে আর বলা যাচ্ছে না ক্রাউন জুয়েল, কিন্তু এই 'টাইগার অফ কলম্বিয়া'কে আটকানো গেল না। সেই বছর লিগে করেন ২১ গোল, চ্যাম্পিয়নস লিগে ৭টি। পিএসজির রাজত্ব গুড়িয়ে দিয়ে মোনাকো জিতে নেয় লিগ-ওয়ান টাইটেল। সেই সাথে ফ্যালকাওয়ের প্রথম চ্যাম্পিয়নস লিগ খেলা এই মৌসুমে মোনাকো পৌছায় সেমিফাইনালে।
পরের মৌসুমে ১৮ গোল নিয়ে হন লিগে টপ স্কোরার। মোনাকো পৌঁছায় লিগ কাপের ফাইনাল পর্যন্ত। সে বছর চ্যাম্পিয়নস লিগের অ্যাওয়ে ম্যাচ খেলতে নিজের পুরনো বাড়ি অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদে ফিরে আসেন ফ্যালকাও। দর্শকরা স্ট্যান্ডিং ওভিয়েশন দিয়ে স্বাগতম জানায় মাত্র ২ বছর তাদের হয়ে খেলা তাদের এই গ্রেটকে। সেখানে তিনি পরবর্তীতে পান ফুলেল শুভেচ্ছা।
ভালো সময় সবসময় থাকে না; এরপরের মৌসুমের মোনাকো যার প্রমাণ। ঘটে মোনাকোর ছন্দপতন। নতুন রাইজিং স্টাররা সবাই তখন অন্য ক্লাবে, কোনোমতে রেলিগেশন এড়ায় তারা। সব টুর্নামেন্ট মিলিয়ে ফ্যালকাও পান মোটে ১৬টি গোল। তাই চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আর বাড়াননি। ফ্রিতে চলে আসেন তুরস্কের গ্যালাতাসারাইতে। ২৫,০০০ ফ্যান কামাল আতার্তুক এয়ারপোর্টের বাইরে তাকে রাজকীয়ভাবে স্বাগতম জানান। এরপর তার আনভেইলিং প্রোগ্রামে ছিল চল্লিশ হাজার গ্যালাতাসারাই ফ্যান। তারা তাদের মতো করে লাল আতশবাজির আলোয় বরণ করে নেয় তাদের নতুন 'নাম্বার নাইন' ফ্যালকাওকে। এখন পর্যন্ত ভালো সময়ই চলছে তার সেখানে। গত মৌসুমেই করেছিলেন ২৪ ম্যাচে ১৫ গোল, আর এই মৌসুমে ৮ ম্যাচে ৫ গোল। ৩৫ বছর বয়সে এসেও দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন সারা মাঠ।
বোকায় থাকার সময় ইউনিভার্সিটি অফ পালের্মো থেকে ডিগ্রি নেন। সেই কথা তার দলের কেউই জানত না। সচরাচর একজন স্ট্রাইকারের ফ্রি-কিক অ্যাবিলিটি তেমন পোক্ত থাকে না। তবে ফ্যালকাও ছিলেন ভিন্ন। তার হাইটও কিন্তু একজন এভারেজ গোল-পোচিং স্ট্রাইকার থেকে কম। কিন্তু ক্ষিপ্রভাবে লাফিয়ে উঠার তার যে অ্যাবিলিটি, তাতে পরাস্তই হতেন ডিফেন্ডাররা। এই দু'টি জিনিস সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছিল ডিয়েগো সিমিওনেকে, নাহলে হয়তো অ্যাটলেটিকো খালি ডিফেন্ড করেই যেত, গোল পেত না তেমন সেই মৌসুমে। ৩৫টি গোল নিয়ে তিনি এখন কলম্বিয়ার ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলস্কোরার। ২০১২ ব্যালন ডি'অরে হয়েছিলেন পঞ্চম।
বর্তমান বিশ্বে এখন অনেক নামীদামী স্ট্রাইকারের জয়জয়কার। ফ্যালকাও এখন আর নজরের মধ্যেই নেই। তবে তার সেই আগের লিথাল অ্যাবিলিটি আছে এখনো। ঘাড় পর্যন্ত লম্বা চুলের একসময়ের বিশ্বের সেরা স্ট্রাইকারকে চেনানোর জন্যই রয়ে গেছে শুধু তার শার্প গোলস্কোরিং ইন্সটিংট। গোল পান আর না পান, কলম্বিয়ানরা এখনো চায়, আর্মব্যান্ড পরে যেন তাদের প্রতিনিধিত্ব ফ্যালকাও করেন। অবশ্য তিনি যেখানেই গেছেন, সেখানেই ছিলেন ফ্যান-ফেভারিট। আলাদা করে কাল্ট বানিয়ে ফেলেছিলেন বলা যায় ফ্যানদের নিয়ে। ফুটবল বিশ্বের স্বর্গ থেকে শুরু করে জাহান্নামের নিচের স্তরও তার দেখা হয়ে গেছে। সেখান থেকে এই বাঘ বেরিয়ে এসেছে কারোর সাহায্যে না, নিজের শক্তির জোড়ে। ক্যারিয়ারে নেই কোনো পরনির্ভরশীলতা, শুধুই ছিল এফোর্ট আর পরিশ্রম। আপনি তার এই ডেডিকেশনকে কোনোভাবেই অসম্মান করতে পারবেন না।
This article is in Bangla language. It is about Radamel Falcao, one of the most lethal strikers in the world.
Featured Image: VI Images via Getty Images
References: