পূর্বসূরিদের পথ ধরে ক্রোয়েশিয়াকে তাদের সেরা সাফল্যের খুব কাছে নিয়ে এসেছেন ইভান রাকিটিচরা। এখন আর দুটো ধাপ পার হয়ে স্পর্শ করতে চান ট্রফিটা। বিশ্বকাপে নিজের স্বপ্ন, অভিজ্ঞতা আর ইচ্ছের কথা বলেছেন ইভান রাকিটিচ।
"সেই সময়ে একটা সেকেন্ডকে একটা ঘণ্টার মতো দীর্ঘ মনে হচ্ছিলো। ফলে কী হতে যাচ্ছে, এ নিয়ে অনেক কিছু ভাবার সময় পাচ্ছিলাম। সেই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছিল, সব বাতি বন্ধ করে দিই। কেউ যেন আমাকে বা এখানে কী হচ্ছে, দেখতে না পায়। মনে হচ্ছিলো, আমি একা একাই পেনাল্টি নিতে যাচ্ছি।"
গত শনিবার নিনঝি নভোগ্রদ স্টেডিয়ামে ক্রোয়েশিয়ার কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠার স্বপ্ন যখন তার পা আর ডেনমার্কের গোলরক্ষক ক্যাসপার স্মাইকেলের ক্ষিপ্রতার ওপর নির্ভর করছিলো, সেই পেনাল্টি নেওয়ার মুহূর্তটার বর্ণনা দিচ্ছিলেন ইভান রাকিটিচ।
ক্রোয়েশিয়ার জার্সি গায়ে; Image Source; Pulse
সোচিতে একটা হোটেলের কোণে বারে বসে কথা বলতে থাকা রাকিটিচের কণ্ঠে ফুটে উঠছিল সেই সময়ের সেই ভয়ানক চাপের গল্প। রাকিটিচ বলছিলেন একা একা মাঝ মাঠ থেকে হেঁটে সেই পেনাল্টি স্পটে যাওয়ার কথা এবং রেফারির বাঁশির জন্য দীর্ঘ অপেক্ষার কথা। তিনি বর্ণনা করছিলেন স্মাইকেলের হাত সামনে এনে নাড়াতে থাকার সেই ঘোর লাগা দৃশ্যটি।
AVERTISEMENT
রাকিটিচ বলছিলেন,
"খেলার আগে আমার একটা ভালোলাগা কাজ করছিলো। আমি আমার স্ত্রীর সাথে কথা বলছিলাম। ও আমাকে বলল, "আজকের খেলাটা পেনাল্টিতে গড়াবে এবং তুমি শেষ স্কোরটা করবে।" পুরো সকালটা আমি স্মাইকেলের ভিডিও ফুটেজ দেখেছি বসে বসে। সে ফ্রিকিকে কী করে, পেনাল্টিতে কী করে; তার মুভমেন্ট বোঝার চেষ্টা করেছি। আমি আন্দ্রে ক্রামারিচের সাথে কথা বলেছি। ও স্মাইকেলের সাথে লেস্টারে একসাথে খেলে। ওর কাছ থেকে আরেকটু জানার চেষ্টা করেছি। ফলে আমার অনেক আত্মবিশ্বাস ছিল।"
সেই আত্মবিশ্বাসটা অবশ্য নড়ে যাওয়ার কথা। কারণ, রাকিটিচ যখন পেনাল্টি নিতে যাচ্ছেন, তখন তিনি জানেন যে, স্মাইকেল ইতিমধ্যে শ্যুট আউটে দুটি পেনাল্টি ঠেকিয়ে ফেলেছেন; মিলান বাদেলিজ ও জোসিপ পিভারিচের শট। এরও আগে অত্যন্ত নাটকীয়ভাবে অতিরিক্ত সময় শুরু হওয়ার মিনিট পাঁচেক বাকি থাকতে স্মাইকেল ঠেকিয়ে দিয়েছেন মর্ডিচের পেনাল্টি। এতে আত্মবিশ্বাস কমে না?
"আপনাকে আসলে এটা ভুলে যেতে হবে যে, স্মাইকেল এরই মধ্যে তিনটি পেনাল্টি ঠেকিয়ে দিয়েছে।"
রাকিটিচ বলছিলেন,
"আমাদের এক ডিফেন্ডার ভিদা আমাকে পেনাল্টি নিতে যাওয়ার আগে বলছিল, "প্লিজ গোল করো, প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ।" কিন্তু আমি খুব শক্ত ছিলাম। আর নিশ্চিত ছিলাম যে, আমাকে ঠেকাতে হলে ওর (স্মাইকেলের) জীবনের সেরা সেভটা আজ করতে হবে।’
মর্ডিচ অবশ্য ততক্ষণে নিজের হতাশা কাটিয়ে উঠে শ্যুটআউটে এসে বীরত্ব দেখিয়ে ফেলেছেন; নিজের শটে গোল করেছেন। এই শ্যুটআউটে রাকিটিচের পাশে সবচেয়ে বড় বীরত্বটা দেখিয়েছেন দানিজেল সুবাসিচ; তিনটি পেনাল্টি ঠেকিয়ে ফেলেছেন তিনি।
বার্সেলোনার রাকিটিচ; Image Source; Getti
রাকিটিচ বলছিলেন, খেলোয়াড়রা মর্ডিচের জন্য ম্যাচটা জিততে চাচ্ছিলেন। তবে তিনি স্বীকার করলেন যে বাদেলিচ ও পিভারিচ মিস করার পর একটা ভয় তাদের ঘিরে ধরেছিল। ২০০৮ সালের ইউরোতে তুরস্কের বিপক্ষে এমন পেনাল্টি শ্যুটআউটে হেরে বাড়ির পথ ধরার সেই স্মৃতি ফিরে এসেছিলো।
"শুটআউটের আগে আমি সবাইকে কয়েকটা মুহূর্তের জন্য এক জায়গায় পেয়েছিলাম। ওদের বললাম, "লুকা (মর্ডিচ) জীবনে অনেকবার আমাদের রক্ষা করেছে। এবার সুযোগ এসেছে, ওকে কিছু ফিরিয়ে দেওয়ার।" আর সুবাসিচকে বললাম, "সময়টা উপভোগ করো। কারণ, এটা তোমার সময় হতে যাচ্ছে।"
হ্যাঁ, খানিক সময়ের জন্য সেই ভিয়েনার ২০০৮ সালের স্মৃতি ফিরে এসেছিলো। কিন্তু আমাদের ওটা ভুলে যেতেই হতো। আর আমরা বলছিলাম, এবার ভিন্ন কিছু হবে।’
মর্ডিচের মানসিক শক্তি বোঝাতে গিয়ে মাথাটা ঝাঁকি দিয়ে রাকিটিচ বললেন,
"আমরা ওকে ওই পেনাল্টি মিসের পর প্রথম যে কথাটা বলেছিলাম, ‘বাহ! অবিশ্বাস্য, তোমার তো দারুণ সাহস।"
রাকিটিচ এই সাক্ষাৎকারে দারুণ কল্পনা মেশানো এবং প্রতিভার ছাপ রাখা শব্দ বাছাই করে কথা বলছিলেন। যেন তিনি মাঝ মাঠ থেকে দারুণভাবে বল বিতরণ করে চলেছেন। বলছিলেন তিনি রাশিয়ার বিপক্ষে ভরা স্টেডিয়ামে কোয়ার্টার ফাইনাল খেলার সম্ভাবনা নিয়ে,
"আমরা জানি, রাশিয়ান সমর্থকে বোঝাই একটা পুরো স্টেডিয়ামের সামনে খেলতে হবে আমাদের। ওদের জন্য এই ম্যাচটা একটা বিশেষ কিছু। ফলে আমাদের নিজেদের সেরাটা খেলতে হবে এই ম্যাচে। এই টুর্নামেন্টের আগে যদি কেউ আমাকে বলতো, তোমরা রাশিয়ার সাথে কোয়ার্টার ফাইনাল খেলবে, আমি সেটা বিশ্বাস করতে পারতাম না।"
রাশিয়া আগের রাউন্ডেই স্পেনকে বিদায় করে দিয়েছে। আর সেই পথে রাকিটিচের কদিন আগের সতীর্থ আন্দ্রেস ইনিয়েস্তার বিদায়টা নষ্ট করে দিয়েছে। এমন বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের এমন সমাপ্তি নিশ্চয়ই চাননি ইনিয়েস্তা।
আরেক সতীর্থ লিওনেল মেসিকে বিদায় করে দিয়ে এসেছেন রাকিটিচরা নিজেরাই। ক্রোয়েশিয়া ডেনমার্কের বিপক্ষে কষ্ট করে জিতলেও আর্জেন্টিনার বিপক্ষে দারুণ এক ম্যাচ খেলে এসেছে। লিওনেল মেসির সাপ্লাই লাইন কেটে দিয়ে তাকে একাকী করে রেখেছিলো ক্রোয়েশীয়। সেই ম্যাচ নিয়ে রাকিটিচ বলছিলেন,
AVERTISEMENT
"অন্যদের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, আমার মনে হয়, এবার বিশ্বকাপের সেরা পারফরম্যান্স আমরা দেখিয়ে ফেলেছি। প্রথম গোলের পর মনে হচ্ছিলো, "বাহ, আরো দাও"। আর এরকম যখন মনে হয়, তখন আসলে হারাটা অসম্ভব। আমরা খেলাটা শেষ করতেই চাচ্ছিলাম না।"
"মেসি বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়। কিন্তু ওরও খেলতে হলে বল দরকার হয়। অন্য কোনো খেলোয়াড়ের ক্ষেত্রে আপনি দুই বা তিন মিটার জায়গা ফাঁকা রাখতে পারবেন। মেসির ক্ষেত্রে ১০ সেন্টিমিটারও রাখতে পারবেন না। কারণ, ওখানেই সে বিশেষ কিছু করে ফেলবে। ফলে আমাদের জন্য এটা খুব জরুরি ছিল যে, শুধু ওকে আটকালে চলবে না, ও যেন বল না পায়, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে।"
মেসির সাথে। Image Source: Soccer Lamuda
মেসির সাথে কী এরপর কথা বলেছেন?
"আমি ওই অবস্থায় থাকলে কারো সাথে কথা বলতে চাইতাম না। ফলে আমি ওকে একটা ম্যাসেজ দিয়ে রেখেছি শুধু।"
মাত্র ৪.৫ মিলিয়ন মানুষের একটা দেশ। কিন্তু তারকা ফুটবলার তৈরিতে কোনো কমতি নেই ক্রোয়েশিয়ার। রবার্ট প্রসিনেস্কি, বোবান, আসানোভিচ, সান্তিচ, সুকারের পথ ধরে রাকিটিচ, মর্ডিচ, কোভাচিচরা এখন বিশ্ব কাঁপাচ্ছে। একসময় তাদের উত্তরসূরিরা, সেই ১৯৯৮ সালে সেমিফাইনাল খেলে গিয়েছিলেন বিশ্বকাপে; সেটা ছিল স্বাধীনতা পাওয়ার মাত্র ৩ বছর পরের ঘটনা।
সেই সময়ে রাকিটিচের বয়স ছিল মাত্র ১০ বছর। তবে সেই স্মৃতি এখনও টাটকা রাকিটিচের,
"সেটা অসাধারণ একটা ব্যাপার ছিল। শুধু ফলাফলের জন্য নয়। ওনারা যেভাবে ফুটবল খেলেছিলেন, বিশ্বকে যেভাবে ক্রোয়েশিয়াকে চিনিয়েছিলেন, যেভাবে একটা ভালো পরিচিতি তুলে ধরেছিলেন, সেটা অসাধারণ ছিল।"
"তারা প্রথম বিশ্বকাপেই যেটা করেছিলেন, যে অনুভূতি পেয়েছিলেন, সেটা তো কখনোই পুনরাবৃত্তি করা সম্ভব না। আমরা যদি এখন বিশ্বকাপ জিতেও ফেলি, তাও ওটার সমান হবে না। মানুষের জন্য, ওই বিশ্বকাপটা এখনও বিশেষ কিছু। একটা যুদ্ধ থেকে বের হয়ে আসার জন্য ওটা দরকার ছিল।"
"তারা আমাদের জন্য হিরো। তারা পরের প্রজন্মের জন্যও তাই থাকবেন, পরের ১০ প্রজন্মের জন্য হিরো থাকবেন। তবে এখন যেহেতু আমরা বিশ্বকাপ খেলতে এসেছি, আমরা এমন কিছু করতে চাই যে, ক্রোয়েশিয়ায় এবং বিশ্বের মানুষ আমাদের কথাও যাতে বলে।’
এই বলই জীবন; Image Source; HNS
রাকিটিচ ক্যারিয়ারে তিনটি লা লিগা জিতেছেন, চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছেন। কিন্তু বিশ্বকাপটা জিততে পারলে সেটা তাকে অমর করে দেবে, এটা বোঝেন তিনি,
"আমরা আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় স্বপ্নের খুব কাছে চলে এসেছি। ফলে সুযোগটা আমাদের কাজে লাগাতে হবে। আশা করি, আমরা মাঠে সব উজাড় করে দিতে পারবো এবং ক্রোয়েশিয়াকে বন্দরে পৌঁছে দিতে পারবো।"
Featured photo: geeglenews
Download the Roar App
Share Your Reactions or Comments Below
fascinated0 Readers
informed0 Readers
happy0 Readers
sad0 Readers
angry0 Readers
amused0 Readers
Roar Media prides itself on producing original, refreshing, and thought provoking content which aims to capture the vibrancy of the South Asian region.